মধুবালা – পর্ব 03

0
300

#মধুবালা [০৩]
#ফারজানা_আক্তার
আপন মনে ড্রাইভ করছে শুভ্র। পাশেই বসে ছোঁয়া মুচকি মুচকি হাসছে। লিলি পেঁছন থেকে লক্ষ করেছে ব্যাপারটা কিন্তু শুভ্রর ভয়ে লিলি গাড়িতে কোনো কথা বলেনা সবসময়ই চুপচাপ থাকার চেষ্টা করে। শুভ্র আঁড়চোখে বারবার দেখে যাচ্ছে ছোঁয়ার ওষ্ঠ জোড়ে ছড়িয়ে থাকা হাসি আর মনে মনে ভাবছে যতখুশি হেঁসে নে, আগামীকাল সকালে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে তখন তো কাঁদতে কাঁদতে চোখ চোখ মুখ লাল করে ফেলবি। আর সেই লাল লাল চোখ দেখে তখন আমিও এভাবে হাসবো আর তুই জ্ব’ল’বি।
গাড়ির স্টার্ট বাড়াতেই বাতাসে ছোঁয়ার অবাধ্য চুল গুলো শুধু মুখের সামনে এসে বিরক্ত করছে ওকে। ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট ক্লিপ বের করে চুলগুলো আঁটকে দেয়। এবার একটু স্বস্তি লাগছে ছোঁয়ার। কিন্তু শুভ্রর পছন্দ হলোনা ছোঁয়ার এই কাজটা তাই শুভ্র একহাতে ড্রাইভ করতে করতে অন্য হাত দিয়ে ছোঁয়ার চুল থেকে ক্লিপটা খুলে নিয়ে গাড়ির জানালার দিকে ছুঁ’ড়ে মা’রে। অবাক করা দৃষ্টিতে হা হয়ে দেখছে সব লিলি। ছোঁয়া তো যেনো ১০০ ভোল্টের শকড খেলো এমন ভাবে বসে আছে। রাগ হচ্ছে শুভ্রর উপর খুব। ছোঁয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শুভ্রর কলার চেপে ধরে বলে “আমার কাছে এই মুহুর্তে আর কোনো ক্লিপ নেই, এখন এই মুহুর্তেই আমার ক্লিপ খোঁজে এনে দাও। নয়তো আজ আগুন লাগিয়ে দিবো এই গাড়িতে।”
কথাটা বলতে না বলতেই একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে গাড়ি থেমে যায়। এভাবে হুট করে এবং অনেক জোরে গাড়ি থামায় লিলি পেঁছন থেকে কিছুটা সামনের অংশে চলে আসে। তখনও লিলির চোখ অবাক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে শুভ্র ছোঁয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত কান্ডগুলো। এভাবে হুট করে গাড়ি থামায় শুভ্র ছোঁয়া দু’জনেই সামনের দিকে ঝুঁকে যায় যদিও শুভ্র সুস্থ আছে তবে ছোঁয়ার কপাল বেয়ে র’ক্ত ঝড়ছে, ভয়েই ছোঁয়া জ্ঞান হারায়। হালকা কেঁটে গেছে কপাল। শুভ্র ব্যস্ত হয়ে পরে ছোঁয়ার কপালে র’ক্ত দেখে। যদিও র’ক্ত খুবই সামান্য। লিলি ভয় পেয়ে যায় কিছুটা। শুভ্র ছোঁয়াকে গাড়িতে বসিয়ে লিলিকে বলে ছোঁয়াকে আগলে ধরতে। শুভ্র গাড়ি থেকে নেমে দেখে গাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে তাও প্রচুর পরিমানে। ভয় পেয়ে যায় শুভ্র। দ্রুত লিলিকে গাড়ি থেকে নেমে দূরে সরে যেতে বলে ছোঁয়াকে কোলে তুলে নেয় শুভ্র। লিলি আর ছোঁয়াকে নিয়ে গাড়ি থেকে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ায় একটা বড় মেহগনি গাছের নিচে গিয়ে। হঠাৎ আ’তং’কে শুভ্রর আর লিলির বুক কাঁপছে খুব। ছোঁয়া তো অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে শুভ্রর বুকে। লিলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে “ভাই ছোঁয়াকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে কিন্তু।”
শুভ্র বোনের কথায় মাথা নাড়িয়ে টেক্সি রিক্সা থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কেউই দাড়াচ্ছে না। তারউপর শুভ্র জানেওনা না কিভাবে গাড়ি থামাবে। কখনো তো করা হয়নি এসব। এর মধ্যেও মনে মনে ছোঁয়াকে বকা দিয়ে যাচ্ছে শুভ্র।
পিটপিট করে চোখ খুলতেই ছোঁয়া নিজেকে আবিষ্কার করে শুভ্রর খুলে। বেশ লজ্জাও পাই বটে। শুভ্র ছোঁয়ার দিকে তাকাতে যাবে ঠিক তখনই ওদের গাড়িতে প্রচন্ড রকম অদ্ভুত শব্দ করে আগুন লেগে যায়। ছোঁয়া ভয় পেয়ে আবারো শুভ্রর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে আর লিলি তো চোখ-মুখ খিঁচে শুভ্রর হাত খামছে ধরে। শুভ্র হা হয়ে দেখছে ওর স্বাদের গাড়িটা ওরই চোখের সামনে জ্ব’লে ‘ পু’ড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে দুই ফোঁটা। কে বলে ছেলেরা কাঁদতে জানেনা? হৃদয়ের খুব গভীরে আঘাত পেলে ছেলেদের চোখও ভিজে বি’ষা’ক্ত অশ্রুতে।
শুভ্র লক্ষ করে ছোঁয়ার জ্ঞান ফিরেছে তাই সে ওকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ির কাছে যায়। এখনো জ্ব’ল’ছে গাড়িটা। আ’গু’ন যেনো থামাথামির কোনো নামই নিচ্ছেনা।
শুভ্র হঠাৎ ছুটে এসে ছোঁয়ার বাহু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে “হয়েছে শান্তি তোর? তোর মুখের কথা অর্ধেক মুখে থাকতেই গাড়ি এ’ক্সি’ডে’ন্ট করে, এতো চালু কেনো তোর মুখটা? তোর জন্যই আজ আমার এতো প্রিয় গাড়ি হারাতে হয়েছে আমাকে। তুই কি এখনো ছোট রয়ে গেছিস? ড্রাইভ করছি আমি এমন সময় কেনো এভাবে কলার চেপে ধরলি? তোর ছেলেমানুষীর জন্য আজ শেষ হয়ে গেলো আমার প্রিয় গাড়ি। এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে দেখে নিস।”
ছোঁয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়ার খুব খারাপ লাগছে এখন। ছোঁয়া বুঝতে পারেনি এতো বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। বুঝলে কখনোই এমন করতোনা। আর আ’গু’ন ধরানোর কথা তো ও এমনিই বলেছিলো, এটা যে সত্যি হয়ে যাবে মুহুর্তেই তা ওর জানা ছিলোনা। বড্ড আফসোস হচ্ছে ছোঁয়ার। এই মুহুর্তে সে চুপ আছে কারণ শুভ্রকে এখন কিছু বলা মানে এই মাঝরাস্তায় নিজের বিপদ ডেকে আনা সমান। রেগে আছে খুব শুভ্র। ছোঁয়া হালকা মৃদু কন্ঠে উচ্চারণ করলো “আহ্ শুভ্র ভাইয়া হাতে ব্যাথা পাচ্ছি খুব। ছাড়ো প্লিজ।”
“আর আমার যে এখানটাই ব্যাথা হচ্ছে সেটা কীভাবে দেখাবো তোকে? সত্যি সত্যিই আ’গু’ন লাগিয়ে দিলি তুই ছোঁয়া। ”
বুকের বা পাশে এক হাত রেখে খুব কষ্টকর কণ্ঠে উচ্চারণ করে শুভ্র।
কেঁদে দেয় এবার ছোঁয়া। লিলি কোনোমতে সামলে বাসায় নিয়ে আসে দুজনকে।
*******
ছোঁয়ার কপালে র’ক্ত দেখে সেলিনা পারভীন আর জায়েদা বেগম ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরেন। সেলিনা পারভীন খুব যত্ন করে ঔষুধ লাগিয়ে বে’ন্ডে’জ করে দেয় আর জায়েদা বেগম ঔষুধ খাইয়ে দেয়। ছোঁয়া রোবটের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে। কোনো হেলদোল নেই ওর। দুই জা ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ ঘুমানো দরকার ছোঁয়ার। কিন্তু ছোঁয়ার যে ঘুম আসছেনা, ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে খাট হয়ে আছে। শুভ্র যদি সবাইকে বলে দেয় এ’ক্সি’ডে’ন্ট ওর জন্য হয়েছে তবে তো সবাই ওকে খুব বকবে আর বেলাল মির্জা তো এক পায়ে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি দিবে। ছোঁয়ার চোখে জল চলে আসছে এসব ভাবতেই।
লিলি অনেক অনুরোধ করে শুভ্র কে বলে যাতে এই ঘটনা কিভাবে ঘটেছে এটা সে কাউকে না বলে। লিলি চাইনা ছোঁয়াকে সবাই আবারো নিয়ে সভা বসাক। লিলি ছোঁয়াকে ভীষণ পছন্দ করে কারণ লিলির সব বিপদে সব প্রয়োজনে ছোঁয়া ওর পাশে থাকে সবসময়ই। শুভ্র অনেক ভেবে বোনের অনুরোধ মেনে নিলো কিন্তু মনে মনে ভেবে রেখেছে অন্যকিছু।
প্রায়ই সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়ে এলো শুভ্রর রাগ কমার কোনো নাম নেই। ছাঁদে গিয়ে পা ঝুলিয়ে রেলিংয়ের উপর বসে আছে শুভ্র। পা টিপে টিপে ছোঁয়া শুভ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্র ছোঁয়ার দিকে না থাকিয়েই বলে “আচ্ছা এখন যদি আমি তোকে টুপ করে নিচে ফেলে দেয় ধা’ক্কা দিয়ে তখন কি তুই বেঁচে থাকবি আর?”
কথাটা বলতে বলতেই শুভ্র বসা থেকে উঠে ছোঁয়ার ঠিক পেঁছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোঁয়া হঠাৎ ভয় পেয়ে কিছু না ভেবেই শুভ্রর বুকে ঝাপিয়ে পরে। শুভ্র হকচকিয়ে যায় ছোঁয়ার এমন কান্ডে।
“প্লিজ শুভ্র ভাইয়া আমায় মে’রো না। কত কত কিছু বাকি আছে এখনো। বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে, তারপর বাচ্চা কাচ্চার বিয়ে দিয়ে দাদি নানি হবো। তারপর বৃদ্ধ বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবো বালা দুটো নাতি বউয়ের হাতে পরিয়ে দিয়ে।”
শুভ্র কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলোনা, ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে গেলো। কি বলবে এই অদ্ভুত মানবীকে শুভ্র ভেবে পাচ্ছেনা। তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করে শুভ্র বলে “ছাড় বলছি আমায় নয়তো সত্যি সত্যি কোলে তুলে টুপ করে নিচে ছেড়ে দিবো।”
শুভ্র কিছুটা ধমকের সুরে বলে কথাটি তাই ছোঁয়া দ্রুত ওকে ছেড়ে দিয়ে রেলিং থেকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্র বাঁকা হাসে ছোঁয়ার মুখশ্রী জুড়ে ভয়ের হাবভাব দেখে।
*******
রাত তিনটা বিশ হতে চললো। শুভ্রর ফোনে এলার্ম বাজতেই ধরপড়িয়ে উঠে বসলো সে। তারপর পাশে রাখা ছোট্ট প্যাকেট থেকে সেন্টার ফ্রুটস বের করে প্রায়ই ২০/২১ টার মতো আর দাঁত বের করে পৈ’শা’চি’ক হাসি হাসে। আরেকটা ভয়াম হাতে নিয়ে একটু জোরে হাসতে চেয়েও হাসলোনা শুভ্র। এতোরাতে জোরে শব্দ করে হাসলে বি’প’দ। ভয়ামের ভেতরে রয়েছে অসংখ্য তেলাপোকা আর টিকটিকি। এগুলো সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে শুভ্রর। পরে ওর এক বন্ধুকে দিয়ে আনিয়েছে।
শুভ্র ধীরপায়ে খুব সাবধানে বাড়ির বাহিরে চলে আসে তারপর ছোঁয়ার বেলকনি দিয়ে ওর রুমে প্রবেশ করে।
একটা সাদা টি-শার্ট আর মেরুন কালার প্লাজু পরিধান করে খুব নিস্পাপ ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে ছোঁয়া। কপালে কয়েকটা টা ব্রণের ভীড় পাশ কাটিয়ে পাশেই ব্যান্ডেজ করা, তবুও হালকা কমলা রংয়ের ঢিম লাইটের আবছা আলোয় রূপবতী লাগছে এই শ্যামপরিকে। শুভ্র যেনো ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো অন্য কোথাও কিছুক্ষণের জন্য। ছোঁয়া হঠাৎ এপাশ থেকে ওপাশ হতেই শুভ্রর হুঁশ ফিরে আর লুকিয়ে যায় বুকসেল্ফের পাশে। পরে পরিবেশ শান্ত দেখে শুভ্র ওর কাজ সেরে নিজের রুমে এসে ঘুমিয়ে যায়।
হঠাৎ ছোঁয়ার চিৎকারে পুরো বাড়ির সবার ঘুম ভে’ঙ্গে যায় আর সবাই ঘুম ঘুম অবস্থায় ছুটে ওর রুমের দিকে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুন। শুভ্র দুষ্টু একটা হাঁসি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here