#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা
#মম_সাহা
পর্বঃ দুই
রাতের তুমুল বৃষ্টির পর ভেজা ভেজা ভোরের আগমন ঘটেছে। জ্যৈষ্ঠমাসের শুরুতেই কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন। গতকাল রাতেও টিনের চালে ঝুপঝাপ শব্দ করে কতক্ষণ তান্ডব চালিয়ে গেলো সে ঝড়। ভোর পাঁচটা বাজার সাথে সাথেই পত্রের বিছানা ছাড়ার অভ্যেস। সকাল সকাল উঠে উঠোন ঝাড়ু দেওয়া, আগেরদিন রাতের থালাবাসন সব সে-ই ধোয়। তারপর পুকুর পাড়ের পাশে জবা গাছ থেকে থোকা থোকা হয়ে ফুটে থাকা র°ক্তজবা ফুল পুজোর জন্য তুলে আনা তার দৈনন্দিন কাজের একাংশ। আজও সেই অভ্যাসবশত সে উঠে পড়েছে। উঠেই আগে তাদের ঘরের সামনে অবস্থানরত ছোটো উঠোনটা ঝাঁট দিয়ে নিলো। বৃষ্টির কারণে তা কাঁদা কাঁদা হয়ে থাকায় বেশ কষ্টই হয়েছে ঝাঁট দিতে। অতঃপর বাসনপত্র নিয়ে ছুটলো পুকুর পাড়ে।
গতকাল বৃষ্টি হওয়ার কারণে আজ সূর্য উঠেনি আকাশে। আশেপাশে তখনও আঁধার আঁধার ভাব এবং কনকনে ঠান্ডা বাতাসের উপস্থিতি। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই পত্র তাদের বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে সামনের ছোটো মাঠটা পিছনে ফেলে পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। পুকুরের জল টলমল করছে। পত্র দুই হাতের রাজ্যের থালাবাসন নিয়ে পুকুরের শেষ সিঁড়িটাতে নেমে উপুড় হয়ে বসে মনোযোগ দিয়ে তার কাজ করা শুরু করলো। থালাবাসন ধোয়ার প্রায় শেষ দিকে পত্রের চোখে কেমন যেন একটা আবছা অবয়ব ভেসে উঠলো। পত্র হেয়ালি করে উড়িয়ে দিয়ে হাতের থালাটা ছাঁই দিয়ে আরও কয়েকবার ঘষে যে-ই না পুকুরের জলে ডুবাতে নিবে ঠিক সেই মুহুর্তে পুকুরের জলে একটা মানব মূর্তির ছায়া ভেসে উঠলো। ভয়ে আৎকে উঠলো পত্র। সাথে সাথে দাঁত মুখ খিঁচে চোখ বন্ধ করে নিলো। মনে মনে তেত্রিশ কোটি দেবতাকেও বোধহয় সে স্মরণ করে নিলো। বিড়বিড় করে পড়ে নিলো হাজার রকমের শ্লোক ও মন্ত্র। বেশ খানিকটা সময় যাওয়ার পর ভীতু ভীতু মন নিয়ে কোনো মতে ডান চোখটা খুলে আবার জলের দিকে তাকালো পত্র। নাহ্, এবার আর সেই ছায়ামূর্তি টা দেখা যাচ্ছে না। হৃৎপিণ্ডের দুরুদুরু কম্পনের সাথে অসার হয়ে আসা শরীরটা নিয়ে সে থালাবাসন সহ কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো। ঘাটের সিঁড়ি পেরিয়ে সিমেন্টের ঢালাই করা খালি জায়গাটাতে পা রাখতেই গলা খাঁকারি দেওয়ার শব্দে আৎকে উঠলো সে। হাত থেকে ঝনঝনিয়ে পরে গেলো স্টিলের থালাবাসন গুলো। সে আবার চোখ খিঁচে অনবরত বলতে লাগলো,
“ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি,
রাম লক্ষ্মণ সাথে আছে করবি আমায় কী।”
তার অনবরত ছন্দ করে বলা কবিতা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো সামনের সুদর্শন যুবকটি। পত্র এতে আরও ভয় পেয়ে গেলো। দু’হাত জোর করে চোখ বন্ধ করেই বলতে লাগলো,
“ভগবান তেনারা বোধহয় আজ আমাকে শেষ করে দিবে। আমি আর কখনো এত সকালে পুকুরে আসবো না এবারের মতন মাফ করে দেও। বড়দি গো, তোমার বিয়েটা আর বোধহয় খাওয়া হলো না গো। ও পুষ্প, তুই এখন থেকে একা একা স্কুল যাবি কীভাবে?”
পত্রের বিরতিহীন এত কথায় সামনের যুবকটি প্রায় আহম্মক বনে গেলো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“এই এই মেয়ে, কী বলছো এসব! চোখ বন্ধ করে রেখেছো কেন? তাকাও বলছি।”
কিঞ্চিৎ পরিচিত কণ্ঠ শুনতেই চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ভ্রু কুঁচকে আসে পত্রের। ঝটপট চোখ মেলে সামনের মানুষটাকে দেখে সে দু’কদম পিছিয়ে যায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
“আপনি এখানে!”
পত্রের সামনে দাঁড়ানো সাদা শার্ট পড়া ছেলেটি অমায়িক হাসলো। কিছুটা ঠাট্টা করে বললো,
“ভাগ্যিস এসেছিলাম, নাহয় তোমার এত ছন্দ শুনতে পেতাম? বলো?”
পত্র তবুও সামনের লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারলো না। চা বাগানের অনেকেই বলেছে ভুতেরা অন্যের ছদ্মবেশ ধরে আসে, হতে পারে পত্রের সামনের লোকটাও আসলে ভূত। মনের ভিতর ভয়েরা ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। পদ্ম ভীতু ভীতু কণ্ঠে বললো,
“তুই ভূ°ত তাই না? যা এখান থেকে। আমি তোরে ভয় পাই না।”
সুদর্শন যুবক একদম বোকা বনে গেলো। বোকা বোকা কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, কী বলছো? আর তুই করে বলছো কেন?”
পত্র লোকটার কোনো কথাতেই কান দিলো না, কোনোরকমে থালাবাসন গুলো উঠিয়ে ভোঁ দৌড় দিলো। ছেলেটা কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই ঝোপ থেকে উচ্চস্বরে হাসি শোনা গেলো। হাসতে হাসতে সেই মানব সুদর্শন যুবকটার পিঠে সশব্দে চ°ড় বসিয়ে দিয়ে মশকরার স্বরে বললো,
“কিরে ব্যাটা, এই কয়লার মাঝে কী পেয়েছিস? এমন ভোরে এসে রোমিও সাজছিস যে?”
বন্ধুর ঠাট্টায় কপাল কুঁচকালো ছেলেটি, কনুই দিয়ে বন্ধুর পেটে ছোটো আঘাত করে বললো,
“কয়লার তো দাম জানিস না তাই মজা করছিস, দাম জানলে আর করতি না।”
“তুমি যেন সব জেনে বসে আছো, মিয়া!”
“সব না জানলেও, নারীর দাম ঠিকিই জানি।”
যুবকটির কথায় বিরক্ত হলো তার বন্ধু। পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে বললো,
“আতস, তুইও না! চল এখান থেকে।”
পত্রের যাওয়ার পানে আরেক পলক তাকিয়ে বন্ধুর সাথে পা মেলালো আতস।
_
কাঠফাঁটা দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে গ্রামের সরু পথটা দিয়ে ছুট লাগিয়েছে পত্র, হাতে একটা টিফিনবক্স। দুপুরের বাবার খাবার চা বাগানের কটেজের বা’দিকে সাহেবের বাড়ির কাছটাতে নিয়ে দিয়ে আসে সে। বাবার কাজ মূলত সেখানেই। কোনো পর্যটক এলে তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখানো, চা পাতার গুনাগুন সম্পর্কে জানানো ইত্যাদি কাজের ভার পদ্মের বাবা সমিরবাবুর উপর। আজও সে টিফিনবক্স নিয়ে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো।
সমিরবাবু কটেজে আসা সাহেবের ছেলে এবং ছেলের বন্ধুদের তখন চা বাগান সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঘর্মাক্ত মেয়ের মুখ খানি চোখে পড়তেই থেমে গেলো সমিরবাবু। গলা ছেড়ে মেয়েকে ডাক দিয়ে বললো,
“পত্র মা? এখানে আয়, এখানে আয়।”
পত্র বাবার দেখা পেতেই এক দৌড়ে বাবার সামনে চলে আসলো। দৌড়ের কারণে হাঁটুর নিচ অব্দি থাকা মোটা বেণীটা দুলে উঠলো। আতস অপলক তাকিয়ে রইলো সেই চুল গুচ্ছের দিকে। মেয়েটাকে দেখলে তার ভেতর কেবল মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। মেটে কালো রঙেও যে এমন মুগ্ধতা থাকতে পারে তা যেন তার ভাবনার বাহিরে ছিলো।
পত্র বাবার দিকে টিফিনবক্স টা এগিয়ে দিলো। ওড়নার কোণা দিয়ে নিজের ঘামে ভিজে যাওয়া মুখটা মুছতে মুছতে বললো,
“বাবা, আজ বিকেল বিকেল ফিরতে বলেছে মা। আজ দিদিকে আইবুড়ো ভাত খাওয়াবে। সন্ধ্যা যেন নাহয় একবারেই দেখো কেমন?”
সমিরবাবু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“তুই যা, আমি চলে আসবো। আর একদম পাড়া বেড়াবি না, সোজা গিয়ে ভাত খাবি কেমন? আজ সাহেবরা আছেন, নাহয় আমার সাথেই খাইয়ে দিতাম দু এক লোকমা।”
“ও তুমি চিন্তা করো না, আমি খেয়ে নিবো।”
“কাকাবাবু, ও আপনার মেয়ে নাকি?”
পত্রের কথার পরপরই উপস্থিত যুবকদের মাঝে শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের ছেলেটা মিষ্টি হাসি দিয়ে সমিরবাবুর উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা করলো। উত্তরে সমিরবাবু ক্ষীণ হেসে মাথা দুলিয়ে বললো,
“সে কেবল আমার মেয়ে না, আমার ছেলেও বটে। আমার সংসারের এমন কোনো কাজ নেই যে সে পারে না। আমার মেয়েই আমার ছেলে।”
আতস ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলো,
“নাম কী তোমার?”
পত্র লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। থুতনির সাথে বুক প্রায় লেগে গিয়েছে। ভোরে যেই একটা বোকা কাজ করলো, তারপর আর মুখ দেখানো মানায় নাকি! আতস হয়তো বুঝতে পারলো পত্রের লজ্জার কারণ তাই ফিচলে কণ্ঠে বললো,
“আমি মানুষ, নাম আতস। তোমার নাম?”
পত্র লজ্জা লজ্জা চোখ দু’টি মাটির উপর নিবদ্ধ রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“পত্রলেখা।”
ছিপছিপে গড়নের ছেলেটা প্রশংসার স্বরে বললো,
“বাহ্, দারুণ নাম তো! আমার নাম কঙ্কর আর আমি এই কটেজের মালিকের ছেলে। আমার বন্ধু তিনজন হলো আতস, গৌরব, নভ। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো পত্রলেখা। তা পড়াশোনা করো তো?”
“হ্যাঁ, করি।”
“কোন ক্লাস?”
“এবার নবম শ্রেণিতে।”
“বাহ্, ভালো তো। তা তুমি কী আমাদের সাথে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে দেখবে নাকি আশপাশ টা? তোমার বাবাও তো আছে।”
কঙ্করের প্রস্তাবে বাবার দিকে তাকালো পত্র। মুখ-চোখে অস্বস্তি খেলে গেলো তার। মিনমিন করে বাবার দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বললো,
“আমি বাড়ি যাবো, বাবা।”
সামিরবাবু মেয়ের আবদারে প্রাণখোলা এক হাসি দিলো। তারপর যুবক গুলোর দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“বাবা রা, মেয়ে আমার বড্ড নাজুক। এমনেতে দশ গ্রাম তার মাথায় থাকলেও অপরিচিত মানুষের সামনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। ও চলে যাক।”
উপস্থিত ছেলেদের মাঝ থেকে নভ নামের ছেলেটা কেমন কুৎসিত ঠাট্টা করে বললো,
“তা কাকা, মেয়ে তো আপনার সাক্ষাৎ আঁধার। আপনি তো সুন্দর, কাকিমা কী কালো নাকি?”
নভ’র বিকৃত ঠাট্টা যে কারোরই পছন্দ হলো না তা সবার মুখ দেখেই বোঝা গেলো। তবে একজনের গায়ে লাগলো না সে ঠাট্টা, বরং সে বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,
“না না, আমার মা তো অনেক সুন্দর, সাক্ষাৎ মা দুর্গা।”
“আর তুমি?”
নভের প্রশ্নে পত্রের হাসি হাসি মুখের হাসি আরও বিস্তৃতি লাভ করলো, নিজের বাবার বাহু জড়িয়ে ধরে বললো,
“বাবা বলেন, আমি একদম কালী ঠাকুরের মতন। যার কথা মনে পড়লেও শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। আর অভ্রদা বলেছে, নারীর দেহের রঙ তো কেবল ঠুনকো আস্তরণ। নারী স্বত্তার উপরে আর কোনো আবরণের ঠাঁই নেই।”
মেয়ের গভীর কথার ছোঁয়ায় গর্বে সমিরবাবুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। নভ বাদে বাকি যুবক গুলোও বেশ খুশি হলো। কঙ্কর নামের ছেলেটা তো বুকপকেটের মাঝে আটকে রাখা কলমটা পত্রের হাতে দিয়ে প্রশংসার সাথে বললো,
“তুমি অনেক সুন্দর, আর বুদ্ধিমতীও। তাই এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য।”
পত্র সাথে সাথে উপহার খানা নিলো না বরং বাবার চোখে খুঁজে বেরালো অনুমতির ছায়া। সমিরবাবু ঘাড় কাঁত করে কলমটা নেওয়ার সম্মতি দিতেই পত্র খুশি মনে নিয়ে নিলো সেটা। এবং যেমন ভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক তেমন ভাবেই চোখের পলকে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলো। যুবক গুলো সে পথ পানে তাকিয়ে রইলো। কিশোরীর ছুটন্ত পায়ে যেন পথেদের মাঝেও খিলখিল হাসিরছটা।
–
দুপুরের রোদ তখন পশ্চিম আকাশে ঝিমিয়ে এসেছে। বাবার ফেরার অপেক্ষায় পদ্মলতার আইবুড়ো ভাত টা দুপুরে করা হয় নি। বাবাকে ছাড়া মেয়েটা কিচ্ছু বুঝে না। অন্যদিকে এ সুযোগে মায়ের হাতে হাতে অনেক কাজ শেষ করেছে পত্র। গোবর জল দিয়ে উঠোন লেপে, কলসি ভরে খাবার জল এনে, উঠোন জুড়ে আলপনা এঁকে তারপর আবার স্নান করেছে। গরম কাল এলেই দু’বেলা তার স্নান করতে হয়। ছোটোবেলা থেকেই এমন অভ্যেস। স্নান করে আসার সময় দিদির জন্য বকুল ফুলও কুড়িয়ে এনেছে, তা দিয়ে আবার মালা গেঁথে দিদির চুলের খোঁপাতেও লাগিয়ে দিয়েছে। এত এত কাজ শেষ করে অবশেষে নিজের ঘরে এসে বসলো মেয়েটা। আপাতত ঘরে বড়দি কিংবা পুষ্প কেউ নেই। পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করার কারণে বড় বড় চুল গুলো ভিজে একদম নাজেহাল অবস্থা। ব্যস্ত পায়ে উঠে ঘরের পূর্ব দিকে লাগানো টিনের মাঝের গোল আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো পত্র। অনেক খোঁজাখুঁজির পর চিরুনি বের করে তা চালান করলো চুলে। আনমনেই চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তার চোখ গেলো গোল ছোটো আয়নাটার উপর। কী মনে করে সে আয়নাটার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো, হাতে তুলে নিলো আয়নাটা। খুব যত্নে, মনোযোগ সহকারে নিজের টানা টানা, ভাসা-ভাসা মুখটার দিকে তাকালো। কেমন বড়ো বড়ো চোখ, নকশা করা ঠোঁট, উঁচু সরু নাক! যেন সৃষ্টিকর্তা বড়ো যত্ন করে বানিয়েছে এই চেহারা। কোথাও কোনো খুঁত নেই! পনেরো বছরের জীবনে পত্র বোধহয় কখনো এত মনোযোগ দিয়ে নিজেকে দেখে নি। লোকমুখে নিজের কুৎসিত বর্ণনা শুনে সত্যি বলতে কখনো নিজেকে দেখার ইচ্ছে হয় নি তার! অথচ সে অতটাও তো অসুন্দর না! ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, আয়না উলোটপালোট করে কতক্ষণ দেখলো নিজেকে! আবার নিজেই নিজের প্রশংসা করলো মেয়েটা । বড় সাধ জাগলো তার ভোমর কালো চোখ গুলোতে পুষ্পের মতন করে টানা টানা কাজল লাগাতে। অভ্রদা বলেন, জীবনে আর সব অপূর্ণ রাখলেও ইচ্ছে অপূর্ণ রাখা উচিৎ না। ইচ্ছে অপূর্ণ রাখলে জীবনের স্বাদটা পানসে হয়ে যায়। আর পত্র বরাবরই অভ্রদা’র কথা অনুযায়ী চলে। তাই তো আনন্দিত মনে খুঁজে চললো কাজল। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে আবিষ্কার করলো, তার কাছে আসলে কোনো সাজগোজের জিনিসই নেই! কাজলই বা আসবে কোথা থেকে? ভাবতে ভাবতেই পত্রের মন ছোটো হয়ে এলো। ইশ, কেন যে একটা কাজল নেই তার কাছে। হুট করেই তার পুষ্পের সাজগোজের বাক্সের কথা মনে পড়লো, যেখানে পুষ্পের সব ধরণের প্রসাধনী রয়েছে। পত্র চট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এক মিনিটও ব্যয় না করে পুষ্পের বাক্স থেকে কাজল বের করে খুব যত্নে এঁকে নিলো ডান চোখটা। সাজগোজের ব্যাপারে সে বড্ড অপরিপক্ক। সেই অপরিপক্ক হাত দিয়েই দু’চোখ ভরে আঁকাবাঁকা করে কাজল লেপ্টে নিলো। আবার উৎফুল্ল মনে আয়নার দিকে তাকালো সে। গায়ের রঙের সাথে কাজলের রঙটা প্রায় মিলে যাবে যাবে ভাব হলেও অত অসুন্দর লাগছে না তাকে। বা’চোখের কোণায় কাজলটা দিয়ে শেষ টান টা দেওয়ার সময় তার ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো তার মা ছায়া। ব্যস্ত কণ্ঠে ডাক দিতে দিতে থমকে দাঁড়ালেন তিনি, বিস্মিত কণ্ঠ আকাশ ছোঁয়া করে হাঁক তুলে বললেন,
“কী করছিস তুই, কালিন্দী!”
আকষ্মিক ডাকে চোখের কোণের কাজলটা অযত্নের সহিত ক্ষানিকটা এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেলো। ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠলো হৃৎপিণ্ডটা। আমতা-আমতা করে পত্র বললো,
“কই মা, কিছু না তো।”
মেয়ের কথায় ভরসা পেলেন না ছায়া। বেশ গভীর দৃষ্টি ফেললো মেয়ের দিকে, কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
“এখন কী কাজল দেওয়ার সময়! যা কাজ পড়ে আছে তা করবে কে? একা হাতে আমি কয়দিক সামলাবো শুনি?”
পত্র হাতের কাজলটা রেখে মায়ের কাছে দ্রুত এগিয়ে এলো, বেশ অকৃত্রিম এক হাসি দিয়ে বললো,
“এইতো আমি করে দিচ্ছি, মা। বলো তো কী কী করতে হবে?”
ছায়া আঁড়চোখে একবার তাকালো মেয়ের দিকে, কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“ছানার ডালনা করেছিলাম, অভ্রটা তো আবার বেশ পছন্দ করে। দিয়ে আসবি, নাকি সাজগোজই করবি? না পুষ্পকে বলবো?”
“না না মা, তুমি আমাকেই দেও। আমিই দিয়ে আসি। পুষ্পকে কষ্ট দেওয়ার কোনো দরকার নেই আমি আছি না।”
“সারাদিন যে তুই কত কাজ করছিস, তোর বুঝি কষ্ট লাগে না?”
ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মলতার প্রশ্নে মা ও পত্রের নজর সেখানেই গেলো। পত্র মিষ্টি হেসে বললো,
“না, লাগে না বড়দি।”
পদ্মলতা এগিয়ে এলো, বোনের থুঁতনি ধরে বললো,
“কেন লাগে না কষ্ট?”
“কারণ আমি বাবা’র রাজকন্যা। আর রাজকন্যাদের কোনো কষ্ট থাকে না।”
মেয়ের কথায় ধমকে উঠলো ছায়া, বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
“কথা শেষ হলে একটু তরকারি টা দিয়ে এসে আমায় উদ্ধার করো। আর এই সাজগোজের কোনো দরকার নেই, যা মানায় না তা করার কী দরকার? এসব তোর জন্য না।”
“আমি জানি মা, সাজগোজ আমাদের জন্য না। অভ্রদা বলেছে, দরিদ্রের স্বপ্ন আর কালোদের শখ থাকতে নেই। সমাজে দু’টোই হাসির আর তাচ্ছিল্যের কারণ হয়ে থাকে।”
মেয়ের কথা বেশ অপমানে লাগলো ছায়ার, তৎক্ষনাৎ তাই মেয়ের গালে চ°ড় লাগাতে ভুললেন না সে। কণ্ঠের শব্দ প্রয়োজনের তুলনায় আরও উঁচুতে তুলে বললো,
“বড়ো কথা হয়েছে না? ম° রতে পারিস না?”
“আমি ম° রলে, তুমি কাকে মা° রবে মা? দিদি আর পুষ্প তো সুন্দর আর সুন্দররা তো মার খায় না।”
থেমে গেলো ছায়ার তরতাজা রাগ। ঝিমিয়ে এলো ক্রোধ। পত্রের হাসি হাসি মুখের সরল সোজা বাক্যের আড়ালের অভিমান হয়তো বুঝলো মায়ের মন তাই তো আর কোনো রূপ বাক্যব্যয় না করেই সে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। পদ্মের বড্ড মায়া হলো বোনটার জন্য। মেয়েটাকে পারে না সে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে।
#চলবে