বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা – 05

0
362

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা
#মম_সাহা
পত্রলেখার শোকেঃ পাঁচ
ঝিমিয়ে থাকা এক ফালি রোদ বটগাছের উপর নিবিড় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। যে আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে চির নিদ্রায় নিদ্রায়মাণ এক বৈধব্য রোগের অভিশাপে অভিশপ্ত অনেক গুলো বসন্ত বেঁচে থাকা নারীকে। বর্তমানে যে কেবল নিশ্চুপ, নিষ্প্রাণ লা°শ হিসেবে পরিচিত। পত্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সেই নিশ্চুপ দেহখানার পানে। পৃথিবী যেন ঘোষণা করেছে অযাচিত নিশ্চুপতা। কথা বলতে চেয়েও বাঁধ সাধছে অনুভূতিরা। কোথায় যেন খাঁ খাঁ শূণ্যতা। পত্র সেই নারীর কাছে গেলো অচঞ্চল, কম্পনরত পা নিয়ে। বুকে হৃৎপিণ্ডের উথাল-পাতাল। অবিশ্বাস্যকর ঘটনা টা এখনো পত্রের মস্তিষ্ক ছুঁতে পারে নি। পত্র কেমন আদুরে স্বরে বললো,
“ও পিসি, তুই কী আমায় চমকে দিবি? যেমন ছোট্টোবেলায় খুব করে চমকে দিতিস?”
পিসি কথা কয় না। মেলে রাখা গোল গোল চোখ গুলো তাকিয়ে থাকে কেবল পত্রের পানে। সেই দৃষ্টিতে প্রাণ নেই, হাসি নেই, ভাষা নেই। অথচ পিসির চোখ সবসময় কথা বলতো। কত জানা-অজানা কথা! পত্র হাসে, ঝুলে থাকা পিসির পা দু’টো ক্ষাণিক ঝাঁকিয়ে বলে,
“পিসি, এই পিসি, দেখ না, পত্র তোকে ছোট্টোবেলার মতন ডাকছে। তুই কী তবুও অভিমানে মুখে কুলুপ এঁটেই রাখবি? দেখ আমি ছোটো বেলার মতন আদুরে স্বরে ডাকছি। একটুও তুমি করে বলছি না। তবুও কী তুই উঠবি না?”
পত্রের মস্তিষ্ক হয়তো এখনো মানতে চাইছে না পিসির অনাকাঙ্ক্ষিত বিদায়। সবটা ঘটনায় বাকরুদ্ধ করে দেয় আতসকে। সে অবাক, বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে একবার পিসি এবং আরেকবার পত্রকে পরোখ করছে। পত্রের এমন উন্মাদনায় তরতর করে তার অবাক ভাব আকাশ ছুঁইছুঁই করছে। সে কোনো মতে তবুও উচ্চারণ করলো,
“পত্রলেখা, উনি তোমার পিসি?”
আতসের কথায় পত্র তার দৃষ্টি ক্ষাণিক বাঁকালো। আড় চোখে আতসের দিকে তাকিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ। ও আমার পিসি। দেখুন না সুন্দর পুরুষ, পিসি কেমন চুপ করে আছে, কোনো কথা’ই তো বলছে না।”
“পত্রলেখা! কথা বলবে কীভাবে উনি? উনি তো বেঁচেই নেই।”
পত্র বোধহয় রুষ্ট হলো আতসের কথায়। বেশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“কিসের বেঁচে নেই? পিসি আমায় কথা দিয়েছে, সে আমার পুতুলের মতন আমারেও লাল টুকটুকে বউ সাজিয়ে রাজকুমারের কাছে তুলে দিবে। আর আমার পিসি কখনো কথা ভাঙে না।”
আতস এই বোকা-সোকা মেয়েটাকে কিছু বলার ভাষা’ই খুঁজে পেলো না। ততক্ষণে পত্রের শীতল ভাব উত্তেজনায় পরিবর্তিত হচ্ছে। সে বার বার নিজের পিসির পা গুলো নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“উঠ পিসি, ও পিসি, উঠ না। তুই না খাইয়ে দিলে পত্র খায় বল? তুই তো এমন বুক ভার ভার কষ্ট কখনো দিতিস না পত্রকে, তবে আজ এমন দমবন্ধ কষ্ট কেন দিচ্ছিস? পিসিরে, উঠ না রে পিসি। পত্রের বড়ো বড়ো চুলে তুই ছাড়া কে তেল দিয়ে দিবে? কে বিণুনী গেঁথে দিবে বল? পত্রের হাত পুড়ে গেলে কে মা’কে বকা দিবে রে পিসি? তুই কী তোর পত্রের কথা শুনবি না? খুব কী রাগ করেছিস পিসি? অভিমান হয়েছে খুব? পিসিরে, পর করে দিচ্ছিস আমায়?”
পত্রের পা°গলের মতন প্রলাপ কেবল ধীরে ধীরে বাড়ছে। আতস মুহূর্তেই দিশেহারা হয়ে গেলো। আশেপাশের মানুষ ডাকা শুরু করলো। পত্রের উন্মাদনা, উত্তেজনা ততক্ষণে আকাশ ছুঁয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপতে থাকা উত্তেজিত শরীর মুহূর্তেই শীতল হয়ে গেলো। কাঁপতে কাঁপতে কেমন গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। আতস কেবল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হতভম্ব চোখে দেখলো সবটা।
_
প্রকৃতি জুড়ে সন্ধ্যা ঘন ঘন হয়ে আসছে। বাড়ির মাঝারি আকারের উঠোন জুড়ে মধ্যমনি হয়ে আজ শুয়ে আছে সরলা। তার ভাষারা আজ পথ হারিয়ে অচিনপুর চলে গিয়েছে। অভিযোগেরা আজ গোপনে নি°হ°ত। মিহি গুঞ্জনে ভারী হয়ে গেছে পরিবেশ। সরলার অনাকাঙ্খিত বিদায় কেবল পত্রদের বাড়ি না, স্তব্ধ করেছে পুরো চা বাগানকে। দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী মানুষটা আজ নিরব অভিযোগে বিদায় নিয়েছে যা মানতে পারে নি কেউ।
পত্র জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে তার ঘুণেধরা নড়বড়ে বিছানায়। ঠাকুর বাড়ির জেঠিমা আর বিন্নী বার বার পত্রের চোখে জল ছিটকে চালাচ্ছে জ্ঞান ফেরানোর প্রয়াস। ঝিম ধরা কিছু অনুভূতিহীন সময় অতিক্রম করার পর জ্ঞান ফিরলো পত্রের। চোখ মেলে আধো আলো আধো আঁধার রুমটায় বিন্নী আর জেঠিমাকে দেখে সে ধপ করেই উঠে বসলো। কেমন যেন আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,
“বিন্নী, তাড়াতাড়ি পুকুর পাড়ে চল। পিসি কেমন ঝু°লে আছে দেখবি আয়৷ তাড়াতাড়ি চল।”
কথাটা বলে মিনিট দুই ও অপেক্ষা করেনি সে। ক্লান্ত, দুর্বল শরীরটা নিয়েই বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। পা গুলো তখনো টলছে। সেই চঞ্চল পা দু’টো নিয়েই ছুটে গেলো উঠোনে, উদ্দেশ্য তার পুকুরপাড়। কিন্তু গন্তব্যে যাওয়ার আগেই কাঙ্খিত জিনিস দেখেই থেমে গেলো তার পা। উঠোন জুড়ে সাদা কাপড়ের হৃদয় হাহাকার করা সৌন্দর্যটা চোখ এড়ালো না তার। ব্যস্ত পা নিমিষেই থেমে গেলো। থেমে গেলো তার উৎকণ্ঠা। চেয়ে রইলো নির্বিকার সেই সাদা আস্তরণে ঢেকে থাকা দেহের পানে। যার চারপাশে ভীড় জমিয়েছে আত্মীয় স্বজন। বড়দি যার হাতটা ধরে হাউমাউ কাঁদছে। বাবা দূরে মোড়ায় বসে হয়তো চোখ মেলে যার সাথে কাটানো শৈশব স্মৃতিচারণ করছে। পুষ্পও তো কাঁদছে বোধহয় লুকিয়ে লুকিয়ে, মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে মা! পত্রের এই দৃশ্যটা দেখে কেমন হাসি এলো! আকাশ-পাতাল উজাড় করে খিল খিল করে হেসে উঠলো সে। মৃত বাড়িতে এমন হাসি নেহাৎ বেমানান ও আশ্চর্যের বলেই উপস্থিত সবাই তাকিয়ে রইলো পত্রের দিকে। এতে পত্রের কিঞ্চিৎও হেলদোল দেখা গেলো না, বরং সে দিব্যি হেসে গেলো। হাসতে হাসতে অশ্রু ভীড় করলো তার চোখে, তুমুল তাচ্ছিল্য করে মাকে বললো,
“কাঁদছো কেন, মা? মে° রেছো তো তুমিই।”
লজ্জায় ছায়ার মাথা নিচু হওয়ার উপক্রম। গ্রামের মানুষ যদি আজকের ঘটনা জানে তবে মুখ লুকানোর যে জায়গা থাকবে না তার। তাই তো মেয়েকে শাসনের স্বরে বললো,
“কী বলছিস? পা°গল হলি? একটা চ° ড় দিবো।”
পত্র আবার হাসলো। মুখে হাসি বজায় রেখে কেমন হেলেদুলে হেঁটে বাবার সামনে গেলো। অতঃপর হাঁটু গেড়ে বসে বাবার কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। গগণ ফাটানো চিৎকার দিয়ে বাবাকে চরম নালিশ করতে করতে বললো,
“বাবা গো, তুমি কেন আমার পিসির আরেকটু খেয়াল রাখলে না? সেই অভাগীনির তো তুমি ছাড়া কেউ ছিলো না তবে তুমি কেন তার খোঁজ রাখলে না? স্বামী মা° রা গিয়েছে বলে তাকে কেন এতটা অবহেলা দিলে বাবা? বেঁচে থাকতেও কেন ম° রার মতন বাঁচিয়ে রেখেছিলে বলো? এই বুঝি তুমি ভাই? সংসার বড়ো হলো বোনের চেয়ে? তুমি ভালো বাবা, ভালো স্বামী হতে পারলেও, ভালো ভাই যে হতে পারলে না বাবা! এই আফসোস তুমি কোথায় লুকাবে গো?”
সমিরবাবু আকাশ পানে মুখ করে কেঁদে উঠলো শরীর দুলিয়ে। কান্নার দাপট বাড়লো পদ্মলতারও। পিসির হাত দু’খানা মুঠ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। অনুশোচনায় মাথা নত করলো ছায়াও। হাসিখুশি বাড়িটা আজ নেহাৎই দুঃখের উৎসবে হামাগুড়ি খাচ্ছে।
আরও লোকজন এলো। বাড়লো হা-হুতাশ। পত্র, পদ্মের চিৎকারে ভারী হলো আবহাওয়া। কাঁদলো গ্রামবাসী। কেবল দূর আকাশ হতে হয়তো হাসলো সরলা। বেঁচে থাকতে যার দাম দেয় নি সমাজ, আর আজ তার মৃত্যুতেই শোকসভা! মানুষ পারেও বটে!
পিসির লা° শ নিয়ে যাওয়া হলো, সাথে ছুটলো পত্রলেখা। মুখে তার হরেক রকমের বুলি, আহাজারি করে বললো,
“পিসি, আমার আর বিনুনি করা হবে না। এলোমেলো চুল গুলো আমার আর গুছানো হবে না। আমাকে আর গ্রামের হাঁটে গিয়ে পুজার তিলক, চন্দন এনে দেওয়ার জন্য কেউ হৈচৈ করবে না। পুকুরের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে থোকা থোকা ফুল এনে দেওয়ার জন্য কেউ আর আমায় লুকিয়ে টাকা দিবে না। এতগুলো না নিয়ে আমি কেমন করে থাকবো রে, পিসি? জলভাতে অবহেলার মাছি বসবে তুই আমায় আর খাইয়ে দিবি না বলে। তুই কেমন করে নিজের সুখ খুঁজে নিলি আমাদের শোকে ভাসিয়ে? শেষমেশ এই পত্রের থেকে তুই মুখ ফিরিয়ে নিলি? সুখ খুঁজতে গিয়ে স্বা° র্থপর হলি!”
হতভাগা পত্রের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দেয় না পিসি। জ্বলন্ত অগ্নি কাঠে শুয়ে থাকে সে। সময়ের বেগে ধীরে ধীরে পু° ড়ে যায় তার নরম তুলতুলে শরীরটা। পত্র দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে। অসহায় কণ্ঠে বলে,
“তুমি বেঁচে থাকতে তোমার বিছানা হয়েছে মাটিতে আর আজ ম° রে গিয়ে ঠাঁই পেয়েছো চন্দন কাঠে। মৃ° ত্যু বুঝি এত দামী!”
ধোঁয়ার সাথে উড়ে যায় পিসির সকল দুঃখ। পত্রের মনে দগদগে হয়ে থেকে যায় আপন মানুষের বিদায় কালের অভিযোগ। মস্তিষ্ক নিউরনে নিউরনে চলে নিরবতা। হঠাৎ করেই কী যেন একটা নতুন কিছু করার উন্মাদনা চলে আসে তার মাঝে। এরপর আর সে কাঁদে না, চিৎকার করে না। তার চোখও হাসে কেবল, যেমন করে হাসতো পিসির চোখ দু’টো।
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here