#মধুবালা [২৩]
#ফারজানা_আক্তার
হাত ভর্তি চুড়ি নিয়ে খেলছে ছোঁয়া। আজ ছোঁয়ার এতো খুশি লাগছে যে সে কি করবে না করবে বুঝতেই পারছেনা। সাড়া রুমে পায়চারি করছে আর চুড়ির শব্দ করছে। অপেক্ষা করছে বালাজোড়া কবে হাতে পাবে। আর যে তর সইছেনা। বধু সেজে নিজের রুমে বসে আছে ছোঁয়া। ছোঁয়া আর লিলিকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে লোক আনা হয়েছে। ছোঁয়াকে সাজানো শেষ। লিলিকে সাজানো হচ্ছে এখন। ছোঁয়া যেনো রুমে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত তাই সে বারবার বাহিরে চলে যেতে চাই কিন্তু সানিয়া লামিয়া সোহা মিলে ওকে আঁটকায়। শুভ্রর চেয়ে বালা জোড়ার অপেক্ষা তীব্র ছোঁয়ার। একটা লাল কয়েরি লেহেঙ্গা পরে বধু সেজেছে ছোঁয়া। মেকআপ দিয়ে কপালের ব্রণের দাগ ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আয়নাতে নিজেকে নিজে দেখেই চমকে যায় ছোঁয়া। শ্যামলাবর্ণ চেহারা টা দুধের মতো সাদা লাগছে ছোঁয়ার কাছে। সাজটা সুন্দর হলেও ছোঁয়ার কেনো জানি ভালো লাগছেনা। ব্রণেই যেনো ছোঁয়াকে একটু বেশি মায়াবী লাগে। সোহা তো মুখের উপর বলেই দিলো আকাশে ভেসে থাকা শুভ্র মেঘের মতো অনিন্দ্য লাগছে ছোঁয়াকে আজ।
সানিয়ার একটু মন খারাপ তবে লামিয়া আবারো বুঝিয়ে দিয়েছে। তবুও মনটা জুড়ে কেমন জানি অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছে সানিয়ার। সানিয়া টিনএজার। এই বয়সে এসব স্বাভাবিক তাই লামিয়া তেমন একটা সিরিয়াস নেইনি ব্যাপারটা। আলিয়াকে পেয়ে লামিয়া খুব খুশি। কারণ এই বাড়িতে সবার জোড়া আছে শুধু লামিয়ার ছিলোনা কিন্তু এখন লামিয়ার জোড়া হয়ে এসেছে আলিয়া তাই তারা দুজনই বেশ খুশি। ছোঁয়ার বয়সি লিলি আর সানিয়ার বয়সি সোহা তাই লিলি এতোদিন একটু মন খারাপ করে থাকতো। লামিয়া তো আলিয়াকে নিজের রুমের শেয়ারও দিয়ে দিয়েছে।
আলিফ আপাতত গেস্ট রুমে আছে, বিয়ের পর লিলির রুমে থাকবে এমনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজ শুভ্র ছোঁয়া আলিফ লিলির বিয়ে। পুরো বাড়ি জমজমাট আনন্দে।
গতকাল গায়ে হলুদে ছোঁয়া একটুও আনন্দ করতে পারেনি তাই ওর মন খারাপ। শুভ্র ওকে সারাক্ষণ নিজের কাছে বসিয়ে রেখেছে, নাচ গান কিছুই সে করতে পারেনি। মনে মনে অনেক বকেছে শুভ্রকে ছোঁয়া কিন্তু সামনাসামনি কিছু বলার সাহস সে পাইনি কারণ শুভ্র রেগে ছিলো খুব। ছোঁয়ার সব বন্ধু বান্ধব এসেছিলো গায়ে হলুদে আর সেখানে একটা ছেলের নাম নয়ন, এই নয়ন নামের ছেলেটা একটু দুষ্টুমি করে ছোঁয়ার হাত ধরেছিলো যা শুভ্রর মোটেও পছন্দ হয়নি। ছোঁয়া তবুও অনেক বুঝিয়েছে শুভ্র কে, নয়ন ওর বন্ধু শুধুমাত্র, এমনকি নয়নের গার্লফ্রেন্ড আছে এটাও বলেছিলো তবুও শুভ্রর রাগ কমেনি। অনুষ্ঠান নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে কিছু করেওনি নয়নকে, না কিছু বলেছে। কিন্তু ছোঁয়াকে এই বিষয় নিয়ে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছে। আজ শুভ্র ছোঁয়ার বিয়ে হলেও দুজন দুজনের সাথে প্রচুর রেগে আছে। শুভ্রর রাগ নয়ন হাত ধরেছে বলে আর ছোঁয়ার রাগ শুভ্রকে সে এতো বুঝানোর পরেও শুভ্র না বুঝার কারণে। সকাল থেকে দুজন দুজনের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। ছোঁয়া ভাবছে বিয়ের পরও সে তার রুমেই থাকবে, যাবেনা শুভ্রর মতো জেদি পুরুষের কাছে।
বাহির থেকে শোনা যাচ্ছে কাজি চলে এসেছে আর এটা শুনেই হঠাৎ বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হয় ছোঁয়ার, কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। বুকটা কাঁপছে, ধুকপুক করছে স্পন্দন। সোহা বলে “আজ থেকে আমার আপা হয়ে যাবে এই ঘরের বউ, আর আমি ননদ।”
সোহার কথা শুনে ছোঁয়া বেশ লজ্জা পাই। লজ্জায় কারো চোখের দিকে যেনো তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা।
এতক্ষণে লিলির সাজগোছও শেষ। দুজনকে আজ একই রকম লেহেঙ্গা পরিয়ে বধু সাজিয়েছে। লিলি এসে সানিয়ার হাতে ফোন দিয়ে বলে “এই শোন আমাদের দু’জনের ছবি যেনো খুব খুব সুন্দর হয়।”
সানিয়া কোনো কথা না বাড়িয়ে ছোঁয়া লিলির অনেকগুলো ছবি তুলে দেয়। সানিয়া খুব ভালো ফটোগ্রাফি করতে পারে। একপ্রকার শুভ্রর হাত ধরেই সানিয়া ফটোগ্রাফি শিখেছে তাই হয়তো শুভ্রর প্রতি ওর ভালোলাগা জন্মেছে।
তানহা আর রকিও এসেছে বিয়েতে। রকিকে শুভ্রর কাছে রেখে ছোঁয়ার কাছে যায় তানহা। তানহা দৌড়ে গিয়ে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে। ছোঁয়া খুব খুশি হয় তানহাকে দেখে।
“কেমন আছিস তানহা রানী? সংসার জীবন কেমন কাটছে?”
“আমি তো আলহামদুলিল্লাহ। আর তুইও তো বেশ ভালো আছিস দেখতেই পাচ্ছি কিন্তু তোর বরটার কী হলো? গোমড়ামুখে বসে আছে।”
তারপর ছোঁয়া তানহাকে সব খুলে বললো। তানহা সব শুনে হাসতে হাসতে শেষ। সোহা সানিয়া লামিয়া আলিয়া লিলি সবাই-ই হাসতেছে। শুভ্র যে ঘাড়ত্যাড়া এটা কারো অজানা নয়। ছোঁয়া আবার বলে উঠলো “ধুর বাদ দে তো। আমার বালা পেলেই চলবে, শুভ্র ভাই থাকুক উনার জেদ নিয়ে। তুই বল তোর রকির কী অবস্থা? ”
“রকি তো আগে থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর কাছে পাঁচ ওয়াক্ত দুই হাত তুলে এই একজন মানুষের ভালোবাসায় চেয়ে যাচ্ছি শুধু। ইনশাআল্লাহ খুব দ্রুত রকি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। থ্যাংকিউ ছোঁয়া তুই না থাকলে আমার ভালোবাসা কখনোই আমার হতোনা।”
*************
কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করেছে।
আগে লিলি আর আলিফের বিয়ে দিয়ে দিলো শুভ্র। শুভ্রর একটাই কথা আগে সে তার বোনকে বিয়ে দিবে তারপর নিজেরটা। শুভ্রর জেদের সাথে কেউ পারেনি তাই আগে আলিফ লিলিরটা হয়ে গেলো বিয়ে।
ছোঁয়ার মন খারাপ কারণ এখনো ওকে বালাজোড়া পরানো হয়নি। অপেক্ষা করতে করতেই যেনো ক্লান্ত ছোঁয়া।
ছোঁয়া নিজের রুমে বসে আছে সাথে সানিয়া আলিয়া লামিয়া সোহা আছে।
একটু পর শুভ্র ছোঁয়ার বিয়েটাও হয়ে গেলো। ছোঁয়া তবুও খুশি হতে পারছেনা কারণ বালা জোড়া এখোনো দিচ্ছে না বলে ওকে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে আসলো, এখনো ছোঁয়াকে বালাজোড়া দেওয়া হয়নি। ছোঁয়ার মনটা বেশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে যত সময় গড়াচ্ছে। রাতের খাবার শেষে ছোঁয়াকে শুভ্রর রুমে নিয়ে যেতে আসে লামিয়া আলিয়া সানিয়া সোহা, কিন্তু ছোঁয়া কিছুতেই শুভ্রর রুমে যেতে রাজি হচ্ছে না।
“কিরে আপা এতোদিন সবাইকে পাগল করলে বিয়ে বিয়ে করে আর এখন শুভ্র ভাইয়ের রুমে যেতে চাইছোনা কেনো?”
“বেশি পক পক করিসনা তো। আমি কেনো ওই জেদি ঘাড়ত্যাড়াকে বিয়ে করতে পাগল হবো শুধু শুধু? আমি তো পাগলী হয়েছি শুধু আমার বালার জন্য, মধুর যেমন মিষ্টির অভাব নেই তেমন ওই বালাজোড়ার জন্যেও আমার ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। আমার মধুবালা এখনো আমাকে দেওয়া হয়নি কি করে আর মনটা ভালো থাকে বলে।”
“আপা বালাজোড়া নাকি চু’রি হয়ে গেছে।”
“এ্যাঁ কী বলিস তুই এসব? তোর কী মাথা নষ্ট হয়েছে? শুভ্র ভাইয়ের মতো কী তোকেও এখন পাবনা পাঠাতে হবে?”
এবার লামিয়া বলে উঠে “হ্যাঁ রে আপা। সোহা ঠিক বলেছে। চোরকে নাকি শুভ্র ভাই দেখেছে।”
“কী বলিস শুভ্র ভাই কোথায় এখন?”
“শুভ্র ভাই তো চো’র’কে ধরতে চো’রে’র পিঁছু নিয়েছে।”
“আমার বালাজোড়া এ্যাঁএএএএএ।”
ছোঁয়া সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেললো। সবাই অবাক। সামান্য বালার জন্য কেউ এতো পাগলামি করতে পারে কারো জানা ছিলোনা। আলিয়া তো সবার থেকে বেশি অবাক কারণ সবাই আগে থেকে ছোঁয়ার এমন পাগলামির সাথে অভ্যস্ত হলেও আলিয়া এসবের জন্য একদম নতুন। ছোঁয়ার বালার প্রতি এমন অদ্ভুত টান, পাগলামি, শুভ্র ভালোবাসা আলিয়ার মনে দাগ কে’টে’ছে, আলিয়া বেশ উপভোগ করছে বিষয়টা।
লিলি ছাড়া সবাই আছে এখানে। লিলি নিজের রুমে হয়তো বাসর করছে আর ছোঁয়া এখনো ন্যাকামী করতেছে। সব বোনেরা মিলে কোনোমতে বুঝিয়ে ছোঁয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা। সোহা গিয়ে জায়েদা বেগমকে ডেকে নিয়ে আসে। উনি এসে ছোঁয়াকে আদর স্নেহ করে বুঝাই তারপর বলে শুভ্র কে রুমের দিকে যেতে দেখেছেন তিনি। ছোঁয়া এই কথা শোনেই “শুভ্র ভাই এসেছে, আমার বালা এনেছে তো?”
“তুই নিজে গিয়ে দেখে আয়।”
জায়েদা বেগম কথাটা বলার সাথে সাথেই ছোঁয়া দুই হাত দিয়ে লেহেঙ্গা উপরের দিকে একটু তুলে ধরে ছুটে যায় শুভ্রর রুমের দিকে।
শুভ্রর রুমের দরজা খোলা, ছোঁয়া হাত লাগাতেই দরজা খুলে যায়। ছোঁয়া একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখে পুরো রুম অন্ধকার। ছোঁয়া একটু ভয় পেয়ে ঢুক গিলে সরু কন্ঠে বলে উঠে “শুভ্র ভাই।”
#চলবে_ইনশাআল্লাহ