#অপরাজিতা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
সকাল সকাল ওর চাচ্চুকে দেখে রাজিতাতো ভীষণ খুশি। ক্যাম্পাসে না হলে হয়ত ও কান্না করে দিতো এমন একটা অবস্থা।ওর চাচ্চু ওকে আসতে দেখে বললো,
–“কেমন আছিস মা? কাল ওভাবে চলে আসলি। সকালে ফোনে কথা বলেও ভালো লাগছিলো না। ওই বাসায় যেতেও মন চাচ্ছিলো না এতকিছুর পর৷ তুই যখন বললি যে, ভার্সিটি আসবি, তাই চলে আসলাম তোর মুখটা এক নজর দেখার জন্য।”
রাজিতা দেখলো যে, ওখানে চারপাশে অনেক লোকজন, তাই ওর চাচাকে নিয়ে মাঠের পাশে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। তারপর বলল,
–“কাল ওখান থেকে আসার পর আমারো ভালো লাগছিলো না। ছোট আম্মু কি খুব রাগারাগি করেছে কাল?”
–“তুই চলে আসার পর আরো ভীষণ রেগে গিয়েছিলো। আনান তোকে ওভাবে নিয়ে আসলো।”
–“চাচ্চু, আমিতো আসতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু.. ”
–“আনান ঠিক কাজ-ই করেছিলো। তুই থাকলে তোর চাচি হয়ত আরো অনেক কথা শোনাতো তোদের, সরাসরি না বললেও আকার-ইঙ্গিতে বলতো। নতুন জামাই ওমন পরিবেশে কি করে থাকতো বল।”
–“সেটা ঠিক। ওইজন্য আমিও চলে আসলাম। আনান যে কি ভাবছিলো কে জানে৷ নতুন জামাই শশুরবাড়ি গিয়েছিলো শখ করে, অথচ কতকিছু শুনতে হলো। আমি নিজেওতো কত কথা বলে দিয়েছি।”
–“মা তুই ওদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করিস না। এখন ওইটাই তোর নিজের বাড়ি৷ আমার জানামতে তোর শশুর খুব ভালো একজন মানুষ। আর আনানতো তার-ই ছেলে।”
–“হ্যাঁ চাচ্চু, উনারা অনেক ভালো মানুষ। দুইদিনেই আমাকে আপন করে নিয়েছে।”
–“তোর চাচিকে নিয়ে বেশি চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে৷ নিলাও সব ভুলে যাবে হয়ত। কিছুদিন একটু মাথা গরম থাকবে।”
–“না চাচ্চু আমি কিছু মনে করিনি। আমিতো জানি কে কেমন। কিন্তু আনান! ওতো অন্যকিছু ভাবছে।”
–“তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই শুধু ওদের সাথে মানিয়ে চলবি। আমি যেন কোনো কমপ্লিন না শুনি। ”
–“তুমিও আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করোনা। ”
–“চিন্তা আবার করবনা! তোকে বিয়ে দেওয়ার সময় মনে হচ্ছিলো যে, কেউ আমার কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুই হয়ত ভাবছিস যে, নিজের মেয়েদের রেখে তোকেই কেন আনানের ঘাড়ে চাঁপিয়ে দিলাম! আসলে আমি নিলা আর রিমিকে অনেক বুঝিয়েছি, ওরা নিজের মেয়ে হয়েও আমার কথা একবারও ভাবেনি।আমি তোকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাইনি। ”
–“চাচ্চু, যা হয়ে গেছে তাতো হয়েই গেছে, তুমি এইসব নিয়ে আর ভেবোনা।”
–“নারে মা, আমি চাইনা তুই তোর চাচ্চুকে এভাবে ভুল বোঝ। তোর চাচি বলছিলো যে, তোকে যে আমি এত আদর করি, তুইও নাকি আমার কথা ভাববি না। আমিও বড় মুখ করে বলেছিলাম যে, তুই অবশ্যই আমার কথা রাখবি৷ আর এ কারণেই আমি তোকে জোর করেছিলাম রে মা!”
–“আচ্ছা, এখনতো তুমি খুশি নাকি?”
–“খুশি মানে! তোকে বিদায় দেওয়ার সময় আমি যখন জানতে পারলাম যে, আনান পুরোপুরি সুস্থ তখনি আমার কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো।তখন কিছু বলিনি যে, সবাই ওইটা নিয়ে কানাঘুষা শুরু করে দিবে, এমনিতেওতো কানাঘুষা কম হচ্ছিলো না।কালকেই তোর চাচি আর নিলা যেমন করলো, সেদিন হলেতো তোর বিদায়-ই হতো না হয়ত! সারাজীবন তোকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা ছিলো, তা এখন দূর হয়ে গেছে৷ জানিনা আনান কেমন ছেলে, তবে তুই চাইলেই তোর স্থান করে নিতে পারবি। এটা আমি খুব ভালো করেই জানি।”
–“চাচ্চু তুমি খামোখা চিন্তা করছো। বললামতো আনান খুব ভালো ছেলে৷ আর ছোটবেলা থেকে আমি অধিকার আদায়ের যে যুদ্ধ করে এসেছি, এবার মনে হয় তার অবসান হয়েছে। আমি না চাইতেই উনারা আমাকে এত ভালবাসে, এই ভালবাসাগুলো আমি কি করে হারাতে দেই বলো।”
–“হ্যাঁ মা, যাই হয়ে যাক না কেন তোকে ভালো থাকতে হবে৷ তোর লড়াই তোকেই লড়তে হবে। আমি আজ আছিতো কাল নেই। এখন ওরাই তোর আপনজন।”
–“আর কাউকে আপন ভাবতে খুব ভয় হয় চাচ্চু। কে কখন কীভাবে ধাক্কা দেবে কে জানে!”
–“তুই একাই এসেছিস?”
–“মানে?”
–“না মানে, আনান তোকে একা আসতে দিলো?”
–“আসতে আবার দেয় নাকি! আমার শাশুড়ীকে বলে-কয়ে একা এসেছি।”
–“কাজটা কি তুই ঠিক করেছিস?”
–“আমার বান্ধবীরা সবাই জানে যে, আমার বোনের বিয়ে হলো, সেখানে এত নাটকীয় ভাবে আমার বিয়ে হয়েছে জানলে ওরা আমাকে নিয়ে মজা করা শুরু করবে। তাই আমি চাচ্ছিনা যে, আমার বিয়ের কথাটা সবাই এভাবে জানুক। সময়-সুযোগ বুঝে ওদের বলে দিবো আমার বিয়ের কথা। ”
–“তাই বলে তুই কারো কথা না শুনে একা-একা চলে আসবি? কাজটা কিন্তু ঠিক হয়নি।”
–“আচ্ছা, নেক্সট টাইম আর এই ভুল করব না। এইবার খুশি!”
–“দেখ, আমি শুধু চাই যে, তুই এখন ওদের সাথে মানিয়ে থাক, ভালো থাক, খুশি থাক। ”
রাজিতা ওর চাচার সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাসের কথা ভুলেই গেছে। হুট করে ওদের সামনে কিছুটা দূর থেকে মালিহা বলতে লাগলো,
–“কিরে তুই এখানে কি করছিস? একটা ক্লাস অলরেডি শেষ। এতবার কল করলাম, কল ধরলি না কেন?”
এসব বলতে বলতে মালিহা ওর চাচাকে দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করল। ওর চাচা মাঝেমধ্যেই আসে বলে মালিহা আগে থেকেই চিনে।
ওর চাচা রাজিতাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
রাজিতা ফোন বের করতেই দেখলো যে আনানের মা কয়েকবার কল করেছিলো। ক্লাস করার জন্য ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিলো বলে দেখতে পায়নি। মালিহার সামনেতো আর কথা বলা যাবেনা। তাই মালিহাকে পাঠিয়ে দিয়ে বলল যে, ও একটু পরে যাবে।
একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে ওর শাশুড়ীকে কল করল। কল রিসিভ করে ওর শাশুড়ী বলতে লাগলো,
–“কিরে মা, কল ধরছিস না কেন? গিয়ে আমাকে একবার জানাবি না। আমি কত চিন্তা করছিলাম যে, আনানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পাঠিয়েতো দিলাম একা, আবার ঠিকমতো পৌঁছালো কিনা! আনানতো আমার উপরে রাগ করে বেড়িয়ে গেলো।”
–“খুব বেশিই রাগ করেছে?”
–“মনেতো হলো তাই। আর তুই নাকি ক্লাসে যাসনি, তাইতো আমার আরো বেশি চিন্তা হচ্ছে।”
–“আসলে চাচ্চু এসেছিলোতো তাই। ”
একটু থেমে রাজিতা আবার বললো,
–“আমি ক্লাসে যাইনি মানে? একথা আপনাকে কে বললো?”
–“আনান ফোন করেছিলো। তোকেও নাকি কয়েকবার ফোন করেছে, ফোন তুলিসনি।”
–“আমাকে ফোন করেছে? উনি কি আমার ক্যাম্পাসে এসেছে?”
–“হ্যাঁ। তোকে ওর সাথে যাওয়াই উচিৎ ছিলো। আমিও বোকার মতো তোকে একা পাঠিয়ে দিলাম।”
রাজিতা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আনান কেন ওর ভার্সিটিতে এসেছে? ওর এতো কেয়ার করে! নাকি সন্দেহ! যাইহোক ওর বান্ধবীরা যদি জানতে পারে যে, ওর স্বামী ওর খোঁজে ভার্সিটিতে চলে এসেছে তাহলেতো কেলেংকারী কান্ড হয়ে যাবে! আর সবথেকে বড় কথা ওরাতো জানেইনা যে, রাজিতার বিয়ে হয়ে গেছে।
ওপাশ থেকে ওর শাশুড়ী কি যেন বলছিলো। রাজিতা বলল,
–“মা এখন ফোনটা রাখি? দেখি আপনার ছেলে কোথায়!”
–“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
রাজিতা কয়েক পা হাটতেই দূর থেকে আনানকে দেখতে পেলো। কফি কালারের একটা কোর্ট পড়েছে। একহাত পকেটে, আরেকহাতে থাকা ঘড়িটা বারবার দেখছে আর এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে।রাজিতা বুঝতে পারলো যে,আনান ওকেই খুঁজছে।
রাজিতা আনানের সামনে গিয়ে আনানের হাত ধরে টানতে টানতে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে গেলো।
এমন আচমকা কেউ হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে যে কারো অবাক হওয়ার কথা। আনানও অবাক হয়ে গেছে রাজিতার ব্যবহারে৷ আনান যেন ছোট বাচ্চার মতো ওকে ফলো করছে।
ব্যাপারটা বুঝতে আনানের একটু সময় লাগলো৷ বুঝার সাথে-সাথেই আনান রাজিতার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ও কিছু বলার আগেই রাজিতা বলল,
–“সরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি যে, আপনারা আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করবেন। আমার একা আসাটা আসলেই ঠিক হয়নি। ”
–“তোমার কি সে বোধটুকু আছে৷ তুমিতো এটাও বুঝতে পারছো না যে, আমি যা করছি সব তোমার কথা ভেবেই করছি। তোমার ভালোর জন্যই করছি।”
–“আসলে আমাকে গাড়িতে আসতে দেখলে আমার বান্ধবীরে বিভিন্ন প্রশ্ন করতো, তাই..”
–“তো? ”
–“আমি কি বলতাম ওদের? যে, হুট করে আমার বো….”
এটুকু বলেই থেমে গেলো রাজিতা। আনান বলল,
–“হ্যাঁ বলো! কি বলতে চাচ্ছো! থেমে গেলে কেন? একটা সিম্পল বিষয় বুঝতে তোমার এত সময় লাগে।”
–“না মানে, আমি চাচ্ছিলাম না যে, আমার বিয়ের কথাটা ওরা জানুক।”
–“কেন? মানুষের কি বিয়ে হয়না? নাকি তোমার বিয়ে হয়েছে এটা তোমার বান্ধবীরা শুনলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে!”
–“আমারতো মনে হয় আপনিও চান না যে, আপনার বিয়ের কথা আপনার রিলেটিভরা কেউ জানুক!”
রাজিতার কথায় আনান অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
–“মানে?”
চলবে…….