#অপরাজিতা
#১৬তম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
আজ রাজিতার শুধু দুইটা ক্লাস ছিলো। আনানেরও শুধু একটাই ক্লাস ছিলো। তাই ওরা তাড়াতাড়ি-ই বেড়িয়ে পড়ল।
গাড়িতে উঠার পর থেকে রাজিতাকে চুপ থাকতে দেখে আনান বলল,
–“আজ আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। বলো কোথায় যাবে?”
রাজিতা আনানের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
–“আজ আমার ভালো লাগছে না। অন্যদিন যাবো।”
–“ভালো লাগছে না বলেইতো আজ সারাদিন ঘুরব।”
–“আমি যেখানে বলব সেখানেই নিয়ে যাবেন?”
–“হুম। বলেছি যখন নিয়ে যাবো। বলেই দেখো!”
–“যদি বলি সিলেটের জাফলং যাবো?”
–“হুম! নিয়ে যাবো। সময় বেশি লাগবে আর…”
–“আচ্ছা হয়েছে, বুঝতে পেরেছি। এতই যখন আমার পছন্দের জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছে তখন আমি আপনাকে আমার সবথেকে প্রিয় জায়গায় নিয়ে যাবো। ”
–“তোমার প্রিয় জায়গা? কোথায় সেটা?”
–“গেলেই বুঝতে পারবেন। সিক্রেট! ”
আনান দেখলো যে, ওর সাথে কথা বললে রাজিতার মন ভালো হয়ে যাবে৷ তাই ও কথা বাড়ানোর জন্য বলল,
–“তোমার পছন্দের জায়গা আর কি হবে! এইকোনো পার্ক-টার্ক হবে নাকি?”
–“আপনার কোনোকিছু গেস করার ক্ষমতাটা এতো বাজে কেন! আপনিতো আমার পছন্দের জায়গার ধারে-কাছেও যেতে পারলেন না!”
–“উম! তাহলে কোনো রেস্টুরেন্ট? কোনো শপিং মল? নাকি কোনো রিসোর্ট? ”
রাজিতা এবার হেসে ফেলল। অনেকক্ষণ পর রাজিতার প্রাণখোলা হাসি দেখেই আনানের কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। ওর নিজের ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠলো। তারপর আনান আবার বললো,
–“আরে তুমিই বলে দাও! আমিতো পারছি না! মেয়েদের পছন্দের জায়গা কি হতে পারে আমি কীভাবে জানব!”
–“হুম। এইতো আরেকটু পরেই।…. বামের দিকে মোড় নিবেন মিজান ভাই।”
পরের কথাটা রাজিতা কিছুটা জোরে ড্রাইভারকে বলল।
গাড়ি থেকে নামতেই আনান দেখতে পেলো যে, ওরা একটা পুরাতন বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে। আনান রাজিতার হাতটা ধরে এগুতে এগুতে বলল,
–“এইটাই তাহলে আমার বউয়ের পছন্দের সিক্রেট জায়গা?”
–“হুম। আমার যখনি বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে, নিজেকে একা-একা লাগে, বা মন খারাপ থাকে, এখানে চলে আসি। ওদের দেখলে আমার নিজের বাবা-মায়ের কথাটা ভুলে যাই। ওদের সাথে নিজেকেও খুশি রাখার চেষ্টা করি।”
–“এত জায়গা থাকতে এটাই তোমার প্রিয় জায়গা?”
–“হুম। আমি তখন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুল শেষে বাসায় ফেরার পথে বুঝতে পারলাম যে, আমার প্রচন্ড জ্বর হয়েছে। জ্বরটা হয়তো সকালেই এসেছিলো, আমি বুঝতে পারিনি! ঠিক এই জায়গাটায়…”
রাজিতা বাসাটার সামনেই একটা বসার জায়গা দেখিয়ে বলল,
–“ঠিক এই জায়গাটায় আমি এসে বসে পড়ি। তারপর আরকিছু মনে নেই। পরে জানতে পারি যে, এখানে বসার পর জ্বরের প্রকোপে আমি সেন্সলেস হয়ে পড়ি, আর এখানের একটা বাচ্চা আমাকে দেখে লোকজন ডেকে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।”
–“তোমার জ্বর নিয়ে বের হয়েছিলে কেন?”
–“আমিতো বুঝতেই পারিনি যে, জ্বর হয়েছে। এখনি বুঝতে পারিনা! তখনতো আরো ছোট ছিলাম!”
কথাগুলো বলতে বলতে দুপুরের রোদের মধ্যেই দুজনে ওখানে বসে পড়ল। আনান বলল,
–“তারপর কি হলো?”
–“সেটাই ছিলো আমার এখানে আসার শুরু। তারপর থেকে আমি যখনি এখানে আসতাম, আমার মনটা ভালো হয়ে যেতো।আস্তে আস্তে এখানকার তুলি আন্টির সাথে আমার পরিচয় হলো। আরো অনেক এতিম বাচ্চার সাথে পরিচয় হলো। তারা অনেকেই এখন এখান থেকে চলে গেছে। মাঝেমধ্যে আসে, আমার সাথে দেখা হয় মাঝেমধ্যে। ”
–“এখনো কীভাবে দেখা হয়?”
–“মনে করেন যে, হয়ত কোনো প্রোগ্রাম হলো,আর সেখানে আমিও আসলাম, ওরাও আসলো৷ ”
–“ওহ আচ্ছা।”
রাজিতার এমন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কথা বলতে দেখে আনানের খুব ভালো লাগছে। রাজিতার এইরূপটা আনানের কাছে লুকানো ছিলো, আজ যেন তা নিজের জানান দিচ্ছে। রাজিতা আবার বলল,
–“এখন ওরা ১৬ জন বাচ্চা আছে। আমি আসলেই ওদের জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসি৷ ওরা অনেক খুশি হয়৷ আর ওদের হাসিমুখ দেখে আমার নিজেরও ভালো লাগে।”
–“আমাদের বিয়ের পরেও কি এখানে এসেছো?”
–“না! দেখেছেন, বিয়ের পর আসলেই মানুষ স্বার্থপর হয়ে যায়৷ শুধু তাই নয়, সুখে থাকলে মানুষ কখনোই দুখী মানুষদের আর মনে রাখেনা। আজ আমার মন খারাপ হয়েছে আর ওমনি ওদের কথা মনে পড়ে গেলো!”
–“কয়-দিনই বা হয়েছে আমাদের বিয়ের! আর তোমাকে আমি একা ছাড়লেতো আসবে!”
–“তা অবশ্য ঠিক! তারপরেও। আচ্ছা আপনি বলেছিলেন না যে, আমাকে গিফট দিতে চান?”
–“হুম। শুধু বলিনি। দিতে চাইও।”
–“তাহলে সামনের ওই দোকানটা থেকে ২০টা আইসক্রিম নিয়ে আসুন।”
–“এতগুলো আইসক্রিম তুমি খেতে পারবে?”
–“আপনার আইকিউতো দেখছি আমার চেয়েও কম!”
কথাটা বলতেই আনান বুঝে গেলো যে, রাজিতা নিজের জন্য নয়, বাচ্চাগুলোর জন্য আইসক্রিম আনতে বলছে।
আইসক্রিম পেয়ে বাচ্চাগুলো খুব খুশি হয়েছিলো। তুলি আন্টি ওদের জোর করে খেতে বসিয়েছিলো। অচেনা জায়গায়, এমন পরিবেশে আনানের অস্বস্তি লাগলেও রাজিতাকে খুশি করার জন্য খেতে বসেছিলো। টেংরা মাছের ঝোল আর মিষ্টি কুমড়ার ভাজি দিয়ে বাচ্চাগুলো কি তৃপ্তি সহকারে খেলো! তা দেখে কেন জানি আনানের চোখে পানি চলে এসেছিলো।
গাড়িতে বসে রাজিতা বলল,
–“আপনি চাইলে আজ আপনাকে একটা বাস্তব গল্প শোনাতে পারি। একজনের জীবনে ঘটে যাওয়া, একদম সত্য ঘটনা। শুনবেন?”
–“হুম, বলো। তুমি বললে সব শুনতে রাজি আছি।”
–“গল্পটা তুলি আন্টির। আঙ্কেলের সাথে বিয়ের পাঁচটা বছর উনাদের খুব সুখেই কেটে যায়। তারপর আন্টির কোল আলো করে একটা ফুটফুটে মেয়ে আসে। আন্টি আদর করে মেয়েটার নাম রাখেন মায়া। মায়ার বয়স একবছর না হতেই আঙ্কেল উনাদের বাসার কাজের মহিলাকে বিয়ে করে বাসা ছেড়ে চলে যান। আন্টি বাচ্চা মায়াকে নিয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়েন। তখন উনার পাশে কেউ ছিল না। ভাগ্যিস উনি কিছুটা শিক্ষিত ছিলেন! তাই একটা কেজি স্কুলে চাকরি নিয়ে অনেক কষ্টে মায়াকে মানুষ করতে থাকেন। একবছর-দুবছর করে কেটে যায় ১৯ টি বছর। মায়া তখন এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। আর হ্যাঁ, এরমধ্যে মায়া অনেকবার চেষ্টা করেছে ওর বাবাকে দেখার জন্য।”
এতক্ষণ পর আনান বলে উঠে,
–“এরমধ্যে মায়ার বাবা একবারো ওদের খবর নেয়নি?”
–“না! নিজের মেয়েটাকে দেখতেও ফিরে আসেনি। ওই মহিলাকে নিয়ে অন্যশহরে গিয়ে সংসার পেতেছিলেন। মায়া ছিলো তুলি আন্টির একমাত্র সম্বল।”
–“তুমি বারবার ‘ছিলো’ বলছো কেন?”
–“কারণ এখন আর নেই। আরে আপনি চুপ করে গল্প শুনুন। গল্পের মধ্যে এতো কথা বললে গল্প করে মজা পাওয়া যায় নাকি!”
–“আমারতো মনে হয় যে, গল্প করার সময় গল্পের শ্রোতা মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করলেই বরং গল্পটা জমে ভালো! ”
–“আপনার লজিক আপনিই রাখেন৷ এখন আমার গল্প শুনেন। কোথায় যেন ছিলাম! ওহ আচ্ছা মনে পড়েছে৷ মায়ার এইচ এস সি পরীক্ষার সামনে ওর মা জানতে পারে যে মায়া একটা ছেলেকে ভালবাসে।ওরা পালিয়ে বিয়েও করে নেয়। নিজের মেয়ের সুখের জন্য তিনি রাজি হলেও ছেলের পরিবার কিছুতেই মায়াকে মেনে নিতে চায়না। যে মেয়ের বাবা নিজের ছোট মেয়ে আর বউকে ফেলে রেখে কাজের মহিলার সাথে চলে গেছে, সে মেয়ে কত ভালো হতে পারে! ব্যাপারটা মায়া কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। ও শেষবারের মতো ওর বাবার সাথে দেখা করতে ব্যর্থ হলে সুইসাইড করে নেয়! ওর মা স্কুল থেকে ফিরে মেয়ের ঝুলন্ত লাশ দেখে নির্বাক পাগলের মতো হয়ে যায়!”
–“তবুও ওর বাবা আসেনি?”
–“হুম। ১৯ বছর পর এসেছিলো মেয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে। শুধু তাই নয়, নিজের মেয়ের খুনের দায় নিজের বউয়ের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলে আশেপাশের লোকজন জব্দ করে উনাকে তাড়িয়ে দেন। শুধু তাই নয়, এই বাড়িটা তুলি আন্টির নামে করে দিতে বলেন। তারপর আস্তে আস্তে একজন -দুইজন করে এতিম বাচ্চা জোগাড় করে তাদের দেখাশুনা শুরু করেন তুলি আন্টি।”
–“উনার হাজব্যান্ড আর আসেনি?”
–“না মনে হয়।”
–“কি পাষাণরে বাবা!”
–“হুম। এখন তুলি আন্টি ওদের নিয়েই থাকেন সব সময়। কেউ সাহায্য না করলে ডাল-নূন যা হয় তাই খায়!”
গল্পটা শুনে আনানের খুব খারাপ লাগছে।সারারাস্তা দুজনে চুপচাপ আসলো।
রাজিতা যেন এই দু’ঘন্টায় কাল থেকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ভুলে গেছে। রাজিতাকে খুশি দেখে আনান নিজেও অনেক খুশি।
রাতে রাজিতাকে পড়তে বসতে দেখে আনান পেছন থেকে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো,
–“আমার বউটা যে আজ দেখছি পড়তে বসেছে! সূর্য কি আজ পশ্চিম দিক থেকে উঠেছিলো! নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি!”
রাজিতা হাত দিয়ে আনানের মাথাটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
–“ঢং বাদ দিয়ে যান এখান থেকে। পড়তে দিন। নইলে নিজেই আবার কাল অপমান করবেন।নিজেই ক্লাস-টেস্ট নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে! আবার নিজেই ঢং করছে!”
–“পরশুতো পার্টি আছে। আর তারপর দিন একটু রেস্ট নিবে না! তাই কালকেই টেস্টটা নিয়ে নেবো ভাবলাম। যার জন্য করি চুরি! সেই বলে চোর! আমি আর চুরিই করব না!”
–“নিজেই বলছেন চুরি করছেন! আবার চোর বললেই দোষ! ”
কথাগুলো বলেই দুজনে হাসতে লাগলো। এরপর আনান বলল,
–” তা তোমার ফ্রেন্ডরা যাবেতো? আমি কিন্তু ওদের জন্য এরেঞ্জমেন্ট করে ফেলেছি৷ ওরাতো অনেকজন! তাই আগে থেকে জানালেই ভালো হবে।”
–“চিন্তা করবেন না। দুয়েকজন বাদে সবাই থাকবে৷ হাজারহোক স্যার ইনভাইট করেছে! না গিয়ে উপায় আছে!”
–“ভুল বললে! আমি ওদের ইনভাইট করেছি স্যার হিসেবে নয়৷ দুলাভাই হিসেবে! আর ওরা স্যারের জন্য নয়, ফ্রেন্ডের জন্য আসবে!”
–“ওই একই হলো!”
–“তোমার জন্য একটা অফার আছে। ”
–“কি অফার?”
–” ওই ১৬ টি বাচ্চার এস এস সি পর্যন্ত পড়ার খরচ আমি দিবো।”
কথাটা শুনেই খুশিতে রাজিতার চোখ চকচক করে উঠলো। ও চেয়ার ছেড়ে আনানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
–“আমি কি সত্যিই শুনছি? আপনি সত্যি ওদের পড়ার খরচ দিবেন?”
–“হুম। আপাতত শুধু ওই ১৬ জনের। তাও আবার এস এস সি পর্যন্ত। পরের ব্যাপার পরে দেখা যাবে।এখন শুধু তোমার মতামতের অপেক্ষা।”
রাজিতা আনানকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। তবে এটা কোনো দুঃখের কান্না নয়। এটা সুখের কান্না। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে রাজিতা বলল,
–“আমি যে কি খুশি হয়েছি! তা বলে বুঝাতে পারব না। আমি আগে ভাবতাম যে, যারা না চাইতেই সব পায় তারা না পাওয়ার কষ্ট কখনো বুঝেনা! কিন্তু আপনাকে দেখে আমার নিজেকে ভুল প্রমাণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
আনানও রাজিতার পিঠে হাত দিয়ে বলল,
–“আগেই এত খুশি কেন হচ্ছো। আগে আমার শর্তটা শোনো।”
–“আপনার সব শর্ত আমি মাথা পেতে নেবো। শুধু একবার বলুন!”
–“আপাতত একটা শর্ত মানলেই হবে।”
–“কি?”
–“আমি আর এই আপনি শুনতে চাচ্ছি না। আপনি শুনলে নিজেকে কেমন পরপর লাগে।”
রাজিতা আনানকে ছেড়ে দিয়ে বোকাদের মতো আনানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“মানে?”
–“মানে এটাই। তোমার মুখে ‘তুমি’ ডাকটা শুনার জন্য শুধু কান নয়, হৃদয়টাও আকুপাকু করছে। বলো আমার শর্তে রাজি?”
রাজিতা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল,
–“এটা আবার কি ধরনের শর্ত!”
–“বলো রাজি?”
–“হুম।”
–“তাহলে বলো।”
–“আজ না! কাল থেকে, আমি পড়ব এখন!”
–“অফারটা কিন্তু আজকের জন্যই শুধু। ভেবে দেখো! নইলে পরে অনুতাপ করেও লাভ হবেনা!”
কথাগুলো বলেই আনান বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রইলো।
আনান বাচ্চাগুলোকে দেখেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছে যে, ওদের সাহায্য করবে! এক্সট্রা হিসেবে রাজিতার মুখে ‘তুমি’ বলা শুনতে পেলেতো মন্দ হয়না! শুয়ে-শুয়ে নিজেই নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে থাকে!
চলবে…..