অপরাজিতা – পর্ব 24

0
452

অপরাজিতা
#২৪তম_পর্ব
স্নিগ্ধতা প্রিয়তা
রাজিতার ক্লাস শেষ হলে আনানের সাথে ওর খালা শাশুড়ীর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। তারপর আনান বলল,
–“আজ নিয়ন ভাইয়া এসেছিলো৷ ”
রাজিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–“মানে? কেন? উনি আবার এখানে কি করতে এসেছিলো? ”
তারপর আনান রাজিতাকে সব খুলে বলার পর রাজিতা বলল,
–“তোমার কি মনে হয় নিয়ন ভাইয়া সত্যি কথা বলছে? না মানে কার কথা বিশ্বাস করবো বলো? রিমি দিচ্ছে নিয়ন ভাইয়ার দোষ আর নিয়ন ভাইয়া দিচ্ছে রিমির দোষ! আমারতো মনে হচ্ছে দুজনের মধ্যেই ঘাপলা আছে! এতদিন দেখে আসছি, তবুও আমি মানুষ চিনতে পারলাম না! আফসোস! ”
–“তুমিতো আসলেই একটা বুদ্ধু! যারা তোমার ক্ষতি চায় তাদেরকেই তুমি আপন ভেবে বসে থাকো, আর যারা তোমাকে ভালবাসে তাদের ভুলগুলোই শুধু চোখে পড়ে! ভালবাসাগুলোকে ভুলের আড়ালে চাঁপা দিয়ে তার নিচে আবার নিজেই চাঁপা পড়ে যাও।”
–“তাই নাকি! তুমি খুব মানুষ চিনতে পারো তাইনা! অবশ্য তোমার মতো বিজ্ঞ সরি বৃদ্ধ মানুষদের সব জানারই কথা!”
–“আমি বৃদ্ধ না! আমি বৃদ্ধ হলে তুমি আমার বৃদ্ধা! তাহলে আর কোনো প্রবলেম নেই। আমাদের দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সংসার ভালই চলবে।… আচ্ছা তোমার যখন বয়স হয়ে যাবে, চুলগুলো সব পেকে যাবে, তখন তোমাকে কেমন লাগবে! ভাবোতো…. হা হা হা হা….আমারতো ভেবেই হাসি পাচ্ছে! বয়স্কা রাজিতা আমার চোখের সামনে ভাসছে। সামনের দাঁতগুলো সব পড়ে গেছে! কথা বলতে পারছে না! ”
কথাগুলো বলেই হাসতে থাকে আনান। তারপর রাজিতার মুখের দিকে তাকিয়েই ওর সব হাসি বন্ধ হয়ে যায়। মুখটা গোমড়া করে রেখেছে৷ আনান ওর দিকে তাকাতেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
–“বয়স মনে হচ্ছে শুধু আমার একারি বাড়বে! আর তুমি মনে হয় চিরকাল এমনি থাকবে!”
বলেই উল্টোদিকে মুখ করে রাজিতা নিজেও হেসে ফেলে। আনান ওর হাসি দেখে বলে,
–“কি ব্যাপার এই মুখ গোমড়া দেখলাম, আবার এখনি হাসির ঝিলিক! ব্যাপার কি?”
–“আমিতো তোমার বয়সকালের ছবি দেখতে পাচ্ছি! লাঠিতে ভর করে সাদা চুল আর দাড়ি নিয়ে আমার সামনে এসে বলবে,’ রাজিতা, দেখোতো আমার চশমাটা কোথায়! কোথাওতো দেখছি না!’ আর আমি চশমা দিতে দিতে বলব…”
রাজিতার কথা শুনে আনান বলে,
–“থাক! আর বলতে হবেনা!… আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো। তখন ক্লাস না থাকলে নিয়ন ভাইয়ার থেকে পুরো গল্পটা শোনা যেতো। আর তুমি বলছিলে না যে, আমি নিয়ন ভাইয়াকে কেন বিশ্বাস করতে চাচ্ছি?”
–“হুম। তোমার কেন মনে হচ্ছে যে, নিয়ন ভাইয়াই সত্যি কথা বলছে, আর রিমি মিথ্যে বলছে? এমনওতো হতে পারে যে, নিয়ন ভাইয়া নিজে বাঁচার জন্য রিমিকে ফাঁসাচ্ছে।”
–“সেটাতো রিমি আর নিয়ন ভাইয়ার সাথে সামনা-সামনি কথা বললেই ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আচ্ছা নিয়ন ভাইয়ার যে গার্লফ্রেন্ড ছিলো তুমি জানতে না?”
–“নিয়ন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড? আমি কেন! আমাদের পরিবারের কেউ কখনো শুনিওনি! ভাইয়াকেতো মেয়েদের সাথে তেমন কথা বলতেই দেখতাম না। তার আবার গার্লফ্রেন্ড আসবে কোথা থেকে!”
–“মেয়েদের সাথে কথা বলে কি বলে না তা তুমি জানবে কি করে! তুমি কি সারাক্ষণ নিয়ন ভাইয়ার সাথেই ঘুরে বেড়াতে নাকি! ”
–“না, তা নয়, আমি আসলে ওইভাবে কথাটা বলিনি। মানে উনার কোনো কাজিনরা আসলে শুধু ছেলেদের সাথেই বেশি কথা বলতে দেখেছি, মেয়েদের সাথে তেমন কথা বলতো না। আমি, রিমি আর নিলা আপু ছাড়া কারো সাথেই দরকার ছাড়া তেমন একটা কথা বলতো না। অন্যান্য আপুরাতো বলতো যে, নিয়ন ভাইয়া নাকি তাদের দেখলে ১০০হাত দূরে থাকে! মেয়ে দেখলে নাকি নিয়ন ভাইয়া ভয় পায়!”
কথাগুলো বলেই ফিক করে হেসে দেয় রাজিতা। আনান ওর মুখে নিয়নের এতকথা শুনতে মোটেও পছন্দ করছে না।
আনানের ওভাবে তাকানো দেখে রাজিতা ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। তারপর বলল,
–“আচ্ছা, খালামনিদের বাসা আর কত দূরে? এখনো পাচ্ছি না কেন?”
–“সামনে দেখো! তাহলে বুঝতে পারবে যে, এখনো বাসা কেন পাচ্ছিনা। এতক্ষণ শুধু বক-বক করেই যাচ্ছো, আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে খেয়াল আছে! তুমিতো তোমার ভাইয়া নিয়ে ডুবে আছো!”
রাজিতা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বিশাল জ্যাম লেগে গেছে রাস্তায়। আনান মন খারাপ করেছে দেখে রাজিতা বলল,
–“সরি, আমি আর কখনো তোমার সামনে নিয়ন ভাইয়ার কথা বলব না। কখনো বলিনা, এখন তুমিই তুললে তাই….”
–“শুধু আমার সামনে নয়, আর কারো সামনেই তুমি অন্যকোনো ছেলের গল্প করবে না। তোমার মুখে শুধু একজনের গল্প-ই থাকবে! আর সে হচ্ছে আনান রেদোয়ান! ”
–“ওকে! এবার বলো তুমি নিয়ন ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড এর কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? ভাইয়া কি তোমাকে কিছু বলেছে?”
–“হুম। উনিতো বললেন যে, ভার্সিটি লাইফে নাকি উনার গার্লফ্রেন্ড ছিলো, কিন্তু শেষের দিকে এসে ব্রেকাপ হয়ে যায়৷ উনার সাথে উনার গার্লফ্রেন্ড এর ছবিও দেখলাম আমি। কি নিয়ে নাকি একটা ঝামেলা হয়েছিল৷ সেটাতো শুনতেই পারলাম না। তুমি কল করেছো দেখেই মনে পড়ে গেলো যে, আমার ক্লাস আছে, তাই উনাকে বিদায় জানিয়ে ক্লাসে চলে গেলাম।”
–“ওহ আচ্ছা, তাইতো বলি যে, আমাদের প্রিয় স্যার ক্লাসে কেন দেরি করে গেলেন! আমিতো ভাবলাম যে, আমাকে ফেলে রেখেই হয়তো তুমি তোমার খালামনির বাসায় চলে গেছো!”
–“এসব ছাড়া কি তোমার মাথায় আরকিছু আসে নাকি!… যা বলছিলাম আর কি, তুমি সত্যিই জানতে না নিয়ন ভাইয়ার রিলেশনশীপের কথা? আমিতো উনার রিলেশনশীপ ছিলো শুনেই উনাকে আরো বিশ্বাস করে ফেলেছি। আমি ভাবলাম যে, তুমি হয়ত জানবে৷ ধুর! ব্রেকাপ কেন হয়েছিল সেটাই শুনতে পারলাম না। তবে এখনো যেহেতু ছবি রেখে দিয়েছে, আমার মনে হয় উনি এখনো মেয়েটাকে ভালবাসে। নইলে এতটা বছর ব্রেকাপের পরও কেউ তার ছবি কেন রাখবে নিজের ফোনে!”
রাজিতা বাইরে রাস্তার পাশে একটা দোকান দেখতে পেলো যেখানে মাটি, বেত, কাঠ ইত্যাদি দ্বারা তৈরি জিনিস বিক্রি করছে। রাজিতা আনানের কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
–“ওইখানে যাবে? যতক্ষণ জ্যাম আছে ততক্ষণ বসে না থেকে চলো ওইখান থেকে ঘুরে আসি, এই জ্যাম সহজে ছাড়ার নয়।”
–“ওইসব জিনিস তোমার খুব পছন্দ? আমাকেতো কিছুই বলো না, তোমার কি পছন্দ! কি অপছন্দ! কি করতে ভালো লাগে! কি করতে খারাপ লাগে! ”
–“তুমি কখনো জিজ্ঞেস করেছো? জিজ্ঞেস না করলে কি আমি নিজে থেকেই বলব নাকি! তখনতো ঠিক-ই বলে বসবে যে, আমি লোভী!”
আনানের সাথে গাড়ি থেকে নামতে-নামতে কথাগুলো বলল রাজিতা। আনান ওর হাত ধরে ওই দোকানের কাছে যেতে-যেতে বলল,
–“সবকিছুতেই তুমি আমার দোষ দেখতে পাও! আর আমার ভালবাসাগুলো চোখেই পড়েনা! কই আমিতো কখনো তোমার নামে কমপ্লেইন করি না! বউয়েরা স্বামীর কত সেবা-যত্ন করে! আর আমাকে দেখো! সারাক্ষণ বউকে মানাতেই চলে যায়! একটু যে ভালো করে কথা বলবে তাও নয়।”
ওরা রাস্তার কাছে দোকানটার সামনে চলে এসেছে। ওখানে অনেক ভীড়। রাজিতা আনানকে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি কেউ একজন রাজিতার গলা থেকে চেইনটা একটানে খুলে নিয়ে দৌড়ে পালালো। রাজিতা আর আনান কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিনতাইকারীটা অনেকদূর চলে গেছে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই রাজিতা আনানের হাত ছেড়ে গলায় হাত দিয়ে ওখানে বসে পড়ল। আনান দেখতে পেলো যে, রাজিতার গলায় রক্ত! চেইনটা এতজোরে টান দিয়েছে যে, রাজিতার গলার কাছে কিছুটা কেটে গিয়েছে।
আনান বুঝতে পারছে না যে, ও ছিনতাইকারীর পেছনে যাবে! নাকি রাজিতার কাছে! ছিনতাইকারী অনেকদূর চলে গেছে, আর রাজিতাকে এই অবস্থায় ফেলে রাখা যাবেই না।
মূহুর্তের মধ্যে ওখানে লোক জমা হয়ে ছোট-খাটো একটা জটলা পাকিয়ে গেলো। দূর থেকে মিজানও ছুটে এলো। আনান রাজিতার গলায় রুমাল পেঁচিয়ে দিয়ে ওকে ধরে নিয়ে গাড়ির কাছে গেলো।
রাজিতা এত লোকজনের মাঝে কান্না করতে পারছে না। কিন্তু যন্ত্রণায় ছটফট করছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়েই যাচ্ছে৷
রাজিতা আনানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আনান চাপ দিয়ে রাজিতার গলার ওখানে ধরে রেখেছে। চেইনটা অনেকটা মোটা ছিলো তাই অনেকটা কেটে গিয়েছে। হাল্কা-পাতলা চেইন হলে হয়ত তেমন কিছুই হতো না।
রাজিতার রক্ত দেখে আর ওর এই অবস্থা দেখে কষ্টে আনানের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কেন যে ও রাজিতাকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলো! আর এত মানুষ থাকতে ছিনতাইকারীটার রাজিতাকেই চোখে পড়লো!
সবাই বলাবলি করছিলো যে, ওই এলাকায় নাকি ইদানীং ছিনতাই বেড়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের গলা থেকে চেইন ছিনিতাই!
আনানের একটাই কষ্ট যে, ও পাশে থাকতেই রাজিতার সাথে এটা ঘটে গেলো! এই জ্যামের মধ্যে ওরা হাসপাতালে কি করে যাবে! তাই আনান বলল,
–“বাইরে চলো, আমরা নেমে দেখি সামনে কোনো হাসপাতাল থাকতে পারে। এইভাবে গাড়িতে বসে থেকে লাভ নেই। রক্ততো বন্ধই হচ্ছেনা!”
রাজিতা কান্না করতে-করতে বলল,
–“আমার লকেট! ওটা আমার বাবা-মায়ের শেষ স্মৃতি! ওটা আমি হারাতে পারব না! ওটা ছাড়া আমি কি করে থাকবো!”
আনান এই অবস্থায়ও রাজিতাকে ধমক না দিয়ে পারলো না।
–“এই অবস্থাতেও তুমি লকেট-লকেট করেই যাচ্ছো! চুপ থাকবে একটু! তোমাকে যেতে হবে না, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। সামনেই একটা হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে।”
বলেই গাড়ি থেকে নেমে রাজিতাকে কোলে তুলে নিতে গেলো। তখন রাজিতা গাড়ি থেকে নেমে বলল,
–“আরে আমি ঠিক আছি। জাস্ট একটু ছিলে গেছে। তেমন কিছুই হয়নি। চলো, আমি যাচ্ছি।”
বলেই আনানের সাথে রাজিতা হাসপাতাল অব্দি গেলো। ডাক্তার জানালো যে, আনান যতটা ভাবছে ততটাও কিছু হয়নি।সামান্য কেটে গেছে,ভাগ্যিস সেলাই দেওয়া লাগবে না, ব্যাথার ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। তারপর উনি ব্যান্ডেজ করে দিলেন। আর জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে বললেন। যেহেতু ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন, দুয়েকদিন পানি লাগানো যাবেনা। আরো কি কি করতে হবে সব বিস্তারিত বলে দিলেন। আনান মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিল। রক্ত দেখে আনানের যেন মাথা ঠিক ছিল না!
ডাক্তারের কথা শুনে আনান কিছুটা শান্ত হলো। তারপর ওর খালাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো যে, ওরা আজ যেতে পারবে না। পুরোটা শুনে ওর খালা জানালো যে, উনারা এক্ষুনি আসছে।
রাস্তার জ্যাম কমে গেছে। আনানরা বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এই জ্যামটা না থাকলেই এই অঘটনটা ঘটতো না!
রাজিতার আঘাতের জন্য কোনো কষ্ট হচ্ছেনা, কিন্তু ওর বাবার দেওয়া লকেটটার জন্য ওর ভীষণ মন খারাপ। মন খারাপ হোক বা ভালো, ও সবসময় ওর বাবা-মায়ের ছবিটা দেখে শান্তি পেতো। মনে হতো যে, ওর বাবা-মা যেন ওর সাথেই আছে। কিন্তু এখন ও কি দেখবে!
রাজিতার ছোট খালা শাশুড়ী এসেছে, আর ওর চাচ্চু এসেছে। ওর খালা শাশুড়ী এসেই রাজিতার পাশে বসে বলতে লাগলেন,
–“তুমি ঠিক আছোতো? আনানটা তোমাকেই প্রোটেক্ট করতে পারলো না৷ এই ছেলেটা কি হয়েছে কে জানে! এইসব ছিনতাইকারীদের উপদ্রব এত বেড়েছে! মনে হয় দেশে আইন-কানুন কিছুই নেই, মগের মুল্লুক হয়ে গেছে! দিনে-দুপুরে ভীড়ের মাঝে থেকে ছিনতাই! আচ্ছা এত ভীড়ের মধ্যে আমরা পা ফেলার জায়গা পাইনা! আর ছিনতাইকারী, চোর এরা পালায় কীভাবে!”
রাজিতা মৃদু হেসে বলল,
–“খালামনি! আমি ঠিক আছি। কিছুই হয়নি, আনান শুধু আপনাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে! এই যে দেখুন, আমি ঠিক আছি।”
–“ঠিক থাকলে কি হবে! ভয়তো পেয়েছিস নাকি! এখনতো আমার নিজেরি খারাপ লাগছে, কেন যে তোদের আমার ওখানে যেতে বলেছিলাম! আমার ওখানে না গেলে হয়ত এমনটা হতো না।”
এমন সময় ওর শাশুড়ী এসে বলল,
–“তুইও না! এসেই শুরু হয়ে গেছিস। মেয়েটাকে একটু রেস্ট নিতে দে, কেবল ওর চাচা গেলো, আবার এখন তুই! আর ভাগ্যে যেটুকু হওয়ার সেটুকুতো হবেই, কিন্তু সচেতন থাকতে হবে আমাদের সবাইকে, যেন পরে এমনটা না হয়!”
আনানের মা আনানের খালাকে ওই ঘর থেকে নিয়ে গেলেন। তারপর রাজিতার জন্য নিয়তিকে দিয়ে খাবার পাঠালেন৷ কারণ আনান ওকে বিছানা থেকে নামতে মানা করেছে৷ রাজিতা আনানের এই বাড়াবাড়িটা নিতে পারছে না৷ আরে বাবা ওর গলায় একটু ছিলে গিয়েছে! এতে বেডরেস্টের কি আছে! আবার নাকি কথাও বলা যাবে না বেশি! গলাতে টান পড়বে!
আনান ফ্রেস হয়ে এসে রাজিতাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য খাবার প্লেট হাতে নিতেই রাজিতা ওর হাত ধরে বলল,
–“আরে তুমি কি করছো এটা, আমি নিজেই খাচ্ছি৷ আরে বাবা আমার গলায় ব্যাথা! হাতে নয়! তুমি বুঝতে পারছো না কেন! এইটুকুতেই এমন যত্ন করলে আমিতো দুইদিনে অলসের ডিব্বা হয়ে যাবো! তখন তোমার সেবা করব কি করে! তুমি চাও না যে৷ তোমার বউও তোমাকে সেবা করুক! ”
–“সে আগে সুস্থ হও, তারপর দেখা যাবে।”
কথাগুলো বলেই আনান রাজিতাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো৷ আনানের সেবা-যত্ন পেয়ে রাজিতা মুগ্ধ। ওকেও যে কেউ এতো ভালবাসতে পারে তা ও কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।
রাজিতার গলার ক্ষতটা প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছে। আজ ৩দিন রাজিতা ভার্সিটি যায় না। আনানের কড়া নির্দেশ বাসায় বসে পড়াশোনা করতে হবে! রাজিতা ভাবে যে, এর চেয়ে ক্লাস করাও ভালো। সারাদিন কখনো পড়াশোনা করা যায়! সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা না করেও উপায় নেই।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে রাজিতা একটু পড়তে বসলো৷বিছানায় বসে পড়তে -পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি! কপালে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে উঠে যায় রাজিতা। সামনে দেখে আনান। মাথাটা নিচু করে রাজিতাকে দেখছে। রাজিতা আনানকে দেখে উঠতে চাইলে আনান বলল,
–“আচ্ছা উঠতে হবেনা। বুদ্ধু! বিছানায় পড়তে বসলে ঘুমতো পাবেই! নেক্সট টাইম যেন দেখি চেয়ার-টেবিলে বসে পড়ছো। আর ঘুম যখন পেয়েছে আগে ঘুমিয়ে নাও। ঘুম-চোখে কখনো পড়া হয় নাকি!”
রাজিতা এইবার উঠে বসে বলল,
–“সামনের সপ্তাহ থেকে কিন্তু আমি ক্যাম্পাসে যাবো। দেখো, আমার গলা একদম ঠিক হয়ে গেছে। একেতো কোথাও একটু ঘুরতে নিয়ে যায়না! তার উপরে এই কয়দিন আবার রুমবন্দী! ”
আনান হাসতে-হাসতে বলল,
–“আমার বউয়ের ঘুরাঘুরির শখ হয়েছে নাকি! আচ্ছা কথা দিচ্ছি, তোমার এই সেমিস্টারের পরীক্ষা শেষ হলেই আমরা ঘুরতে যাবো।”
তারপর রাজিতার গলার কাটা জায়গাটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো আনান। সূক্ষ্ম একটা দাগ হয়ে গেছে। আনান সেখানে হাত দিয়ে রাজিতাকে বলল,
–“ব্যাথা কি আছে আর?”
–“না, সেরে গেছে। তোমার এত সেবা-যত্ন বৃথা যেতে পারে বলো! তোমার এই সেবা-যত্ন পাওয়ার জন্য হলেও আমি প্রতি সপ্তাহে একবার করে অসুস্থ হতে চাই!”
আনান রাজিতার মুখে হাত দিয়ে বলল,
–“আর একবারো এইকথা বলবে না। এই কয়দিন আমার কত চিন্তা হয়েছে তোমাকে নিয়ে তা তুমি কি বুঝবে!”
বলতে-বলতে ওখান থেকে চলে গেলো আনান।
রাজিতার চাচি বারবার ফোন করছে উনাদের ওখানে যাওয়ার জন্য৷ আজ ছুটির দিন, আনান ভেবেছিলো যে, রাজিতাকে নিয়ে কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসবে, কিন্তু ওর চাচার বাসায় না গেলেই নয়! সেদিন থেকে এতবার বলেছে ওর চাচি! রাজিতা অসুস্থ ছিলো জন্য যেতে পারেনি, আজতো যেতেই হবে।
রাজিতাকে দেখে রিমি এগিয়ে গেলো। তারপর ওর হাত ধরে টানতে-টানতে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।
–“সরিরে রাজি, ছবির ব্যাপারটা বা তোকে পছন্দ করার ব্যাপারে ভাইয়া কিছুই বলেনি। আমিই এসব করেছিলাম। তুই আমাকে মাফ করে দে প্লিজ। কথা দিচ্ছি, আর এমনটা করবো না। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি! জানিনা সেগুলোর ক্ষমা পাবো কিনা!”
কথাগুলো বলেই রিমি কান্না শুরু করে দিলো। এমন সময় নিলা এসে বলল,
–“রিমি, রাজি, নিয়ন ভাইয়া তোদের ডাকছে।…. দেখি রাজি, তোর গলার কি অবস্থা এখন!”
বলেই রাজিতার গলা চেক করে দেখলো নিলা। তারপর বাকি সবার সাথে কথা-বার্তা বলে নিয়ন রিমি, রাজিতা আর আনানকে নিয়ে ছাদে চলে গেলো কথা বলার জন্য।
সবাই চুপচাপ আছে। একে অন্যের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। নিয়ন নিরবতা ভঙ্গ করে রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“এইবার বল, তুই এসব কেন করেছিস? আর আমার নাম-ই বা কেন নিয়েছিস! তুই রাজিতার সাথে! আমার সাথে! এমনটা কেন করলি রিমি? আমি এতদিন তোকে কিছু বলিনি, কারণ রাজিতার এই ব্যাপারটায় সব জানা উচিৎ! আর আনানেরও।”
রিমি কান্না করতে-করতে বলল,
–“হিংসা! হিংসার বশবর্তী হয়ে আমি এসব করেছি।ওর এত ভালো বিয়ে হয়েছে জন্য আমার হিংসা হতো! আনান ভাইয়া ওকে এতো ভালবাসে জন্য আমার হিংসা হতো! ওকে এতো ভালবাসার কি আছে! তাই আমি ওদের মাঝে শুরুতেই ঝামেলা পাঁকাতে চেয়েছিলাম! কিন্তু আমি নিজেইতো পাঁকিয়ে যাচ্ছি! প্লিজ রাজিতা, আমাকে ক্ষমা করে দে, আনান ভাইয়া, আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দিন। আর ভাইয়া! তুমি আমাকে ক্ষমা করো, প্লিজ!”
রিমির মুখে কথাগুলো শুনে রাজিতা নির্বাক হয়ে গেছে। রিমি ওকে হিংসার চোখে দেখে! আর ও রিমিকে নিজের বোনের মতো দেখতো!
রিমির কথাগুলো শেষ হতে না হতেই নিয়ন ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। আনান আর রাজিতা যেন নিরব দর্শক হয়ে দুই ভাইবোনের নাটক দেখছে৷
রিমি কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে নিয়নকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,
–“আমিই মাকে বলেছিলাম যে, তুমি রাজিকে পছন্দ করো। আর সেটা শুনেই সেদিন মা আনান ভাইয়ের মামিকে কথাগুলো বলে। মা নিজে থেকে এসব বলেনি! আমার মুখে শুনে বলেছিলো! আর আমি এটাও দেখেছিলাম যে, আনান ভাইয়া আর রাজি কথাগুলো শুনে ফেলে! ওরা কেউ সেদিন মাকে কিছু বলে না! আমিতো ভেবেছিলাম যে, সেদিন-ই এসব শোনার পর কোনো একটা ঝামেলা হয়ে যাবে! কিন্তু আনান ভাইয়া সব শুনেও রাজিকেই বিশ্বাস করলো! এটা দেখে আমার আরো বেশি রাগ হলো! তাই কিছুদিন পরেই আমি তোমাদের ছবিগুলো আনান ভাইয়াকে পাঠাই! কিন্তু আফসোস! ওরা সেটাও ধরে ফেলে! আমি এতকিছু করেও ওদের আলাদা করতে পারলাম না। অথচ নিজের ভাইয়ের থেকেই আলাদা হতে চলেছি! আসলেই হিংসা মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। যেমনটা আমার হচ্ছে! প্লিজ ভাইয়া আমাকে ক্ষমা করে দাও! আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো এমন হবেনা!….রাজি! আনান ভাইয়া! আপনারাও আমাকে ক্ষমা করুন!…. রাজি, তুই ক্ষমা করলেই সবাই ক্ষমা করে দেবে। প্লিজ! আমার নিজের মাও আমাকে ভুল বুঝছে! আমার সাথে ভালো করে কথা বলছে না।”
সবাই নির্বাক! রাজিতা ভাবতেও পারেনি যে, রিমি ওকে এতটা হিংসা করে। হিংসার কারণে এতকিছু করে ফেললো অথচ কেউ কিছু বুঝতেই পারলো না।
রিমি আরোকিছু বলতে যাচ্ছিলো। তখন নিলা এসে ওদের বলল যে, ওর মা সবাইকে খেতে ডাকছে। তারপর চুপচাপ সবাই খেতে চলে গেলো।
রিমি চোখ মুছতে লাগলো। তারপর রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে সবার সাথে খেতে বসলো।
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here