#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ) ❌১৮+ এলার্ট
#মম_সাহা
পর্বঃ ১
কাক ডাকা ভোর। অবশ্য শহরের এই ঘৃণায় কার্তুজে মোড়ানো পুরুষদের এক প্রকার সুখ মহলে কাকের ডাক শোনা যায় না বললেই চলে। প্রকৃতিও এই পরিবেশকে প্রায় যেন হেয় করে। কিছুটা শোরগোল থাকে, আর থাকে দামাদামি করার শব্দ। শোনা যায় পুরুষদের মুখের সবচেয়ে নোংরা কথা, আর নিদারুণ নিষিদ্ধ সুখের আস্তরণ।
সরু ব্লাউজের পিঠ গলিয়ে পড়ছে একটা লাল টকটকে শাড়ির আঁচল। সেই শাড়ি পরিহিতা নারীটা পায়ের মাঝে লাগিয়ে নিচ্ছে আলতার রহস্য মাখা সৌন্দর্যতা। চোখে টানা করে মোটা কাজল লেপে রেখেছে, ঠোঁটে মেখেছে গাঢ় খয়েরী রঙের রঞ্জক। তার সুনিপুণ কাজটায় বিঘ্ন ঘটিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো আঠারো- বিশ বর্ষীয়া এক ছুটন্ত মেয়ে। লতার মতন অঙ্গ থেমে গেলো ঘরের দরজা অব্দি এসেই। কথা বলবে কি বলবে না ভেবেই সে দ্বিধায় পড়ে গেলো। তার নিশ্চুপতা কাটলো আলতা লেপা রমণীর গম্ভীর কণ্ঠে,
“কে? জরি? এখানে কী তোর?”
জরি অবাক হলো চওড়া দেহের নারীর বিচক্ষণতায়। অবশ্য এই পুরো পল্লীর দায়ভার যার উপর, তার বিচক্ষণতা থাকাটাই বোধহয় স্বাভাবিক। জরিকে চুপ থাকতে দেখে আলতার কৌটা নিচে নামিয়ে রাখলো রমণী। কৌটার মুখ লাগাতে লাগাতে বললো,
“কথা যদি না-ই বলবি তবে এখানে করছিস কী মা*।”
মেয়েটা ভয় পেলো বোধহয়। সে নতুন এসেছে, পুরোনো কেউ হলে হয়তো ভয় পেতো না, নতুন বলেই পাচ্ছে। রূপমাধুরী প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
“আমার ঘরের সামনে হুটহাট আসা নিষেধ, তোদের বলা হয়েছে না?”
মেয়েটা আমতা আমতা করে বললো, “জি, জি। আসলে আমাকে পাঠিয়ে ছিলো আপনাকে ডাকার জন্য। দোহার ভাই নামে একজন এসেছে তাই বিজলি আপু বলেছে আপনাকে ডাকতে।”
রূপমাধুরীর কর্কশ চাহনি কিছুটা কোমল হলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এদিকে আয় তো, আমার ঘরের পর্দা গুলো সরিয়ে দে। বিছানার চাদর টাও বদলে দিয়ে যা। আর কিরে, তোর সাজগোজ এমন কেন? এমন সাজগোজের কাস্টমার মিলবে!”
জরি আমতা আমতা করে বললো, “আমি তো বুঝি না, আমাকে একটু বুঝিয়ে দিলে আমি নিজেই পারবো।”
“বাহ্, কাস্টমার পাওয়ার কী শখ তোদের! যাই হোক, আমি বিজলিকে বলবো সাজগোজের ব্যাপার টা। তুই আমার ঘর গুছিয়ে এখানে থাকবি। আমি দেখা করে আসি।”
“জি, জি।”
রূপমাধুরী আঁচলটা শক্ত হাতে কাঁধে চাপিয়ে অঙ্গ দুলাতে দুলাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। জরি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। রূপমাধুরীকে সে বেশ ভয় পায়। মহিলাটার চোখ-মুখ কেমন যেন শক্ত, কর্কশ। কথা বললে মনে হয় হুঙ্কার দিয়ে উঠছে। তবে সব ক্ষেত্রে তা না, কিছু কিছু সময় আবার এই মহিলার মুখ দিয়েই যেন মধু ঝড়ে। সুন্দর মুখশ্রী কিন্তু কঠিন তার আচরণ।
–
১৪২৯ বঙ্গাব্দের ১৫ই শ্রাবণ, শনিবার। রাজধানীর প্রাচুর্যের কোল ঘেষে গড়ে উঠা নিষিদ্ধ পল্লীর গল্প রচিত হয়েছে সভ্য সমাজের হাত ধরেই। সে গল্পেরই হাজার চরিত্রের মাঝে এক চরিত্র রূপমাধুরী। স্রোতের বেগে জন্ম নিয়েছে হয়তো তার ঘৃণার গল্প। যে গল্প স্বয়ং বিধাতাই রচনা করেছে নিষ্ঠুরতার সাথে। কত কন্যার ভাগ্যের নির্মমতায় আজ তারা এই পল্লীর সদস্য। আজ তারা রূপমাধুরী হয়ে উঠেছে।
বিশাল কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর এক ঘরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে রূপমাধুরী। তার সামনে গদোগদো করছে দোহার নামের লোকটা। মেয়েদের ইশারা করতেই একজন মেয়ে শরবত নিয়ে হাজির হলো। রূপমাধুরী মধু মাখা কণ্ঠে বললো,
“তা দোহার সাব, কী খবর? নতুন কোনো মেয়ে দিবেন নাকি?”
কালো কুচকুচে লোকটা সাদা দাঁত গুলো দেখিয়ে হাসি দিয়ে বললো,
“মাধুরী জি, আপনার কিছু মেয়ে হামি(আমি) নিতে চাচ্ছি। ওদের এদেশ থেকে পাঠাতে পারলে বহুত লাভো আছে। আপনি যদি রাজি হোন, হামার(আমার) দিলটা খুশি হয়ে যাবে।”
দোহার লোকটা এক সময় উড়িষ্যার উপকূলীয় একটা গ্রামে থাকতো। তাই তার ভাষার এমন জগাখিচুড়ি। তাছাড়া সে মাঝে মাঝে প্রতিবেশী দেশেও যায় এই মেয়েলি ব্যাপারের জন্য। পেটের টানে, অর্থের অভাবে সে আরও বহু বছর আগে উড়িষ্যা থেকে এই ঢাকা শহরে পা দিয়েছিল। তারপর টাকার টানেই সে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ করে গেলো অবলীলায়।
রূপমাধুরী ভাবুক স্বরে বললো,
“আমার এখানের মেয়েদের বিদেশ পাঠিয়ে আমি টাকা দিয়ে কী করবো? যদি কাস্টমার এসে মেয়েই না পায় তাহলে এই পল্লীর আর নামডাক থাকবে?”
“কত মেয়ে আপনার কাছে, দু চারটে এদিক ছে ওদিক করনে পে, কুছ নেহি হোগি। আপনি একটু হামার কথা বুঝিয়ে, এটা করলে হাম লোগোকি লাভই হবে।”
“আমাকে ভাবতে দেন দোহার সাব। মেয়েদের সব দেখেই তো সিদ্ধান্ত জানাতে হবে তাই না?”
“ও আপ ভাবিয়ে, হামার সমস্যা নাই। তবে মাধুরী জি, হামার আরও একটা আর্জি আছে।”
লোকটার শেষের কথায় কেমন যেন গদোগদো ভাবটা বেশি ফুটে উঠলো! রূপমাধুরী চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,
“কী ইচ্ছে?”
“আপনার এখানে একটা লাড়কি আছে, সুন্দর করে মেয়েটা। পুনাম নামের। আমার তাকে বড়ো ভালো লাগে। তাকে কী আজ হামি পেতে পারি? বড্ড স্বাধ জেগেছে তাকে পাওয়ার।”
“না, সে এখন এক কাস্টমারের কাছে গিয়েছে কয়েক দিনের জন্য। আপনি অন্য কাউকে নিতে পারেন।”
দোহারের মুখটা ছোটো হয়ে এলো। মন খারাপ করে বললো, “তবে থাক। আবার আসবো, মাধুরী জি। চলতা হু।”
“আচ্ছা যান।”
লোকটা আর অপেক্ষা করলো না, ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। লোকটা বেরিয়ে যেতেই বিজলি ঘরে এলো। রূপমাধুরীর সবচেয়ে কাছের বলা যায় মেয়েটাকে। বিজলি এসেই বললো,
“পুনাম তো এখানেই ছিল, আপনি যে নিষেধ করলেন সে এখানে নেই! কেন?”
রূপমাধুরী চোখ রাঙালেন। ধমকের স্বরে বললেন,
“তোদের এখন কৈফিয়ত দিতে হবে আমার?”
বিজলি আমতা-আমতা করে বললো, “না না, আমি সেজন্য জিজ্ঞেস করি নি। আপনি রাগ করবেন না, আপ্পা।”
এই পল্লীর সবাই রূপমাধুরীকে আপ্পা বলেই সম্বোধন করে। রূপমাধুরী এবার আরাম করে সোফায় বসলেন, পা দুলাতে দুলাতে বললেন,
“এখানে আয় তো, এক খিলি পান বানিয়ে দে আমায়।”
বিজলি এলো, খুব যত্নে পান বানিয়ে দিলো। রূপমাধুরী আরামে পা দুলাতে দুলাতে বললেন,
“নতুন যে মেয়েটা এসেছে, তাকে জামাকাপড় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিস? যা তো, মেয়েটাকে নিয়ে আসতে বল কাউকে।”
বিজলি মেয়েটা তার কণ্ঠ চওড়া করে বাহিরে থাকা মেয়েটার উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বললো,
“বাহিরে কে আছিস? রানী আছিস? জরিকে নিয়ে আয় তো।”
বাহিরের মেয়েটা মৃদু স্বরে ‘আচ্ছা’ বলেই চলে গেলো। বিজলি সুন্দর করে পান সাজিয়ে রূপমাধুরীকে দিলো। রূপমাধুরী পান চিবোতে থাকলেন। গুন গুন করে গান গাইলেন। বিজলি বেশ ধীরে বললো,
“আপ্পা, আপনার গানের গলা কিন্তু বেশ। কী সুন্দর গান করেন!”
“সুন্দর গান দেখেই তো প্রেমিক পুরুষকে মুগ্ধ করেছিলাম, অথচ,,”
রূপমাধুরীর কথা থেমে গেলো। ভয়ে ভয়ে ততক্ষণে সেখানে জরি নামের মেয়েটাও উপস্থিত হলো। রূপমাধুরী সেখানে একবার তাকিয়ে পলক ঝাপটালেন। অল্প একটু চুন মুখে পুরে নিয়ে বললেন,
“তোর বয়স যেন কত?”
মেয়েটা ভীত কণ্ঠে জবাব দিলো, “সতেরো”।
“শরীর দেখে বুঝা যায় না। তা,এখানে এলি কেন? বয়স তো ভালো ই ছিলো, বিয়েশাদি করে নিতিস।”
“আমার ছোটো আরও চারটা বোন, আম্মা, আব্বা, দাদী সহ বড়ো পরিবার ছিলো। কিছুদিন আগে হুট করেই আব্বা মারা গেলেন। আম্মার চেয়ে আব্বার বয়স অনেক বেশি অবশ্য। পরিবারের হাল আমাকেই ধরতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্রামে কোনো কিছু করতে পারে না মেয়েরা। তাই আম্মা শহরে পাঠিয়ে ছিলেন একদিন রাতে লুকিয়ে। বলে ছিলেন টাকা যেন গ্রামে যায়, আমি যাই বা না যাই। এতগুলো মানুষের খাবার জোগাতেই আমি শহরে পা দেই কিন্তু তারপর,,,, ”
জরির কণ্ঠ ধরে আসে। মেয়েটা কেমন মূর্ছা যায় অপরাধবোধ, ঘৃণায়। রূপমাধুরীর কঠিন মুখ কোমল হয়। ধীর কণ্ঠে শুধায়,
“তারপর?”
জরি মেয়েটা কেঁদে দেয় মুখ চেপে। অস্ফুটস্বরে বললো,
“অচেনা শহরে পা রাখি, কিছুই জানতাম না। বইয়ে পড়তাম কেবল, ঢাকা দেশের রাজধানী। পড়াশোনা নিয়ে খুব শখ ছিলো। কিন্তু অভাবের টানাপোড়েনে আমার সব শখ শেষ। ট্রেন দিয়ে ঢাকা এসে ছিলাম। সারাটা দিন ট্রেন স্টেশনে কাটাই, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সারাদিনে আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় নি কেউ। কিন্তু যেই রাত হলো, দেখলাম কত মানুষ সাহায্য করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কেউ বাড়িঘর কোথায় জিজ্ঞেস করেছে, কেউ জিজ্ঞেস করেছে একা কিনা। এই এতশত সাহায্যের হাতের মাঝে একটা হাত বেছে নিলাম আমি। তাকে খুলে বললাম সব ঘটনা। লোকটা বাবার বয়সী দেখেই বিশ্বাস করে ছিলাম। সে বলেছিলো আমাকে একটা কাজ দিবে, আমি অনেক টাকা পাবো কিন্তু এমন কাজ যে আমার কপালে ছিলো কে জানতো! কিন্তু আমার বাড়ি ফেরারও উপায় নেই, মা বলেছে টাকা না পেলে সব বোনেরা মিলে গলায় দ/ড়ি দিবে। আমি তাই আপনার পায়ে নিজেকে সঁপে দিলাম আম্মা। আপনিই আমার আম্মা। আপনার কাছে একটা অনুরোধ, আমার বাড়ির মানুষদের বাঁচিয়ে দেন। নাহয় আমার আম্মা হয়তো আমার পরবর্তী অন্য বোনদের পাঠাবে টাকার জন্য, আর হয়তো ওদের মাঝে কেউ আমার মতন এই পথে চলে আসবে। অভাবের কাছে আমার জন্মদাত্রীও নিরুপায়। হয়তো সে বুজেছেই, মেয়ে হয়েছি, ঠিক অন্ধকার রাস্তায় ছেড়ে দিলে চওড়া দামের কাজ আমি পাবোই। কিন্তু আমি চাই না আমার বোনেরা কেউ এই দোযখে আসুক। বাঁচতে পারবে না ওরা। আম্মা, আপনি আমারে সাহায্য করুন। ওরা ছোটো, ওরা এই দোযখ সহ্য করতে পারবে না।”
“তুই, তুই শরীর দিবি, আমরা টাকা দিবো। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করে না, কেউ কারো আত্মীয় না। এখানে সবাই নিজের টা গুছাবে নিজের মতন।”
কথা বলেতেই রূপমাধুরীর চোখে ভেসে উঠলো কতশত স্মৃতি। হাসোজ্জল এক পরিবারের দৃশ্য তাকে মুহূর্তেই কেমন অসহায় করে দিলো। সে দ্রুত উঠে চলে গেলো নিজের ঘরে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। বাহিরে তখন শ্রাবণের আকাশ চিরে বৃষ্টির গতি বাড়ছে। ভিজে যাচ্ছে অতীত, ভিজে যাচ্ছে বাস্তবতা।
#চলবে
Home “ধারাবাহিক গল্প” বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা (৩য় পরিচ্ছেদ) - বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা-Part 1 (৩য় পরিচ্ছেদ)
বাকি পর্ব কই