#মধ্যবিত্ত
#নুসরাত_রিতু
#শেষপর্ব_(দ্বিতীয় অংশ)
ছোট করেই ব্যাবস্থা করেছিলো রাফি। গোটাকয়েক অতিথি এসেছিলো শুধু। রাহির টাকাটা রাফি খরচ করেনি। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের বাবার জুয়েলার্সের ব্যাবসা আছে। ভাইয়ের সাথে কথা বলে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দিয়ে এক সেট গহনা এনেছে রাফি। যার দাম প্রায় লাখ টাকা পরলেও বিনা সুদে পুরো ব্যাবস্থা করে দিয়েছে সেই ভাই। এবার মাসে মাসে বাকি টাকা দিয়ে দিলেই হবে ইনশাআল্লাহ।
বিকেলের দিকে রাহি আর রাফিকে রাহিদের বাসায় নিয়ে যায় জাফর সাহেব। এদের পক্ষের অতিথি বলতে কয়েকজন ক্লইন্ট আর রবিনের পরিবার। বাসায় এসেও রাহির সাথে কথা হয়নি রাফির।
সন্ধ্যার দিকে সাদকে নিয়ে সে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছে। রাত দশটার দিকে সাদ আর রাফি একসাথে ফেরে। সাদ যায় রাফিদের বাড়ি আর রাফি যায় সাদের বাড়ি। এ নিয়েও সাদের হাসির শেষ নেই। রাফিকে শালা শালা বলে ক্ষেপাতে সে খুব মজা পায়।
————————–
সেলিনা বেগমের কাছে রাহির রুমে বাসর সাজানোর জন্য অনুরোধ করেছিলো রিমি। প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে তাকে সাহস করে এই কথা বলতে। তবুও যে বলতে পেরেছে এতেই সে নিজের প্রতি সন্তুষ্ট। রাহিকে দ্রুত ঈশার নামাজ পড়িয়ে ওজু অবস্থায় বৌ সাজিয়েছে রিমি। সাদ আর রাফি বাইরে থাকায় ভালোই সুবিধা হয়েছে তার।
কিন্তু অসুবিধা করার জন্য রাহি তো ছিলোই। সে কিছুতেই সাজবে না। শেষে ধমক দিয়ে রিমি রাহিকে বললো, “উফ, আজ তোমার বর আসলে তার থেকে জেনে নিও সে কাকে ভালোবাসে আর নিজেও তাকে বলে দিও তুমি কাকে ভালোবাসো। তাহলেই তো কনফিউশান ক্লিয়ার হয়ে যায়। আর ঢং করবা না। সাজিয়ে দিবো তাই চুপচাপ বসো। ”
রাহি প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে কৌতুকের সুরে বললো “ননদ হওয়ার সাথে সাথেই বকাবকি শুরু! হায় আল্লাহ আমার কপালে এ কেমন ননদ দিলা? বিয়ের দুদিন যেতে না যেতেই এমন করছে সামনে কি করবে?”
রিমিও কৌতুকের সুরে বললো, “জ্বালিয়ে খাবো তোমাকে। এখন বকর বকর বন্ধ করে চুপচাপ বসো। শাড়িটা পড়াতে দেও আমাকে।”
সাড়ে নয়টার মধ্যেই রাহিকে সাজানো শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্য বেড়িয়েছে রিমি।
রাফি বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে আসতে আসতে এগারোটা পেরিয়েছে। রাহি ততক্ষণ একা বসে থাকতে থাকতে রেগে আগুন হয়েছে।
রাফি যখন রুমে ঢুকলো তখন দেখে কাঠগোলাপ দিয়ে পুরো ঘর সাজানো। প্রদীপ এর জায়গা দখল করেছে চায়না লাইট। যদিও তাতে খারাপ লাগছে না একটুও। বড় লাইট জ্বালানো না থাকলে এই লাইটগুলো আরো আরো সুন্দর রুপ ধারন করতো তা মুহুর্তেই আন্দাজ করে ফেললো রাফি।
মিনিট খানেক পরেই তার খেয়াল হলো রাহির তো রুমেই থাকার কথা৷ বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে লাগানো অর্থাৎ রাহি বাথরুমে নেই বারান্দার দিকে আগানোর আগে দরজাটা লক করে দিলো সে। রাহির জন্য আনা উপহারগুলোও বালিশের নিচে আড়াল করে নিলো। শুধু চুড়িগুলো হাতে নিলো রাহিকে পড়ানোর জন্য। এই চুড়ি পড়িয়েই রাহিকে মনের কথা জানাবে সে।
বারান্দার দরজায় দাড়িয়েই রাহিকে দেখতে পেলো রাফি। রকিং চেয়ারে বসে দুলছে। চোখ বন্ধ তবে জেগে আছে হয়তো নাহয় চেয়াড় দুলতো না।
রুমের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে রাহির উপর এসে পরেছে। রাহি একটা সিদুর লাল রং এর শাড়ি পরে আছো। খোপা করা চুল সাজিয়েছে বেলি ফুলের মালা দিয়ে। একপাশে সিথি করে চুলের মাঝ দিয়ে ছোট একটা টিকলিও পরেছে সে। ঠোট দুটো রক্তের মতো হয়ে আছে লিপস্টিক এর রং এ। চোখে মোটা করে কাজল। রাফি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। কোন সংকোচ, ভয় অস্বস্তি ছাড়াই সে রাহির টিকলির উপরে একটা চুমু দিলো।
হঠাৎ এতো কাছে কেউকে অনুভব করে লাফিয়ে উঠলো রাহি। আর স্বাভাবিক ভাবেই ধিপ করে মাথাটা ঠুকলো রাফির মাথার সাথে। দুজনেই বেশ ব্যাথা পেয়েছে, রাহি হালকা আর্তনাদ ও করে বললো, “আপনি কখন এসেছেন? দিলেন তো মাথাটা ফাটিয়ে।”
রাফি মিনমিন করে বললো, “আমি কিভাবে বুঝবো তুমি লাফিয়ে উঠবে?”
রাহি: একে তো মাথা ফাটালেন এখন আবার আমাকেই দোষ দিচ্ছেন?
রাফি:……..
রাহি: কখন এসেছেন আপনি?
রাফি: একটু আগে
রাহি: ডাকলেননা কেনো?
রাফি: এমনি
রাহি: খাওয়াদাওয়া কমপ্লিট?
রাফি: হ্যা, তুমি খেয়েছো?
রাহি: হ্যা, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো স্যার।
রাফি: আমারও।
রাহি: কিন্তু আমিই আগে বলবো
রাফি মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা বলো”
রাহি: আমি পেচানো কথা বুঝি না স্যার। আমি সরাসরি জানতে চাচ্ছি আপনার জীবনে কি কেউ ছিলো? মানে বিয়ের আগে আপনি কি কেউকে পছন্দ করতেন?
রাফি: হ্যা। তবে পছন্দ করতাম না, তাকে ভালোবাসতাম। এখনো বাসি।
রাহির দুচোখ মুহুর্তেই ছলছল করে উঠলো। কান্না আটকে বললো, “তবে বিয়েতে রাজি হলেন কেনো?”
রাফি: অতি কাঙ্ক্ষিত কিছু যদি পরিশ্রম ছাড়াই পেয়ে যাই তবে না কেনো বলবো?
রাহি: কি বলবেন সোজাসাপটা বলুন। এরমানে কি আপনি বাবার টাকা দেখে আমাকে বিয়ে করেছেন?
কথাটা সরাসরি রাফির হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। এই প্রশ্নটার সম্মুখীন যেনো কখনো না হতে হয় তাইতো সে রাহির প্রতি তার ভালোবাসার কথা লুকিয়ে গিয়েছিলো। তবুও কথাটা শুনতেই হলো, তাও নিজের ভুলের জন্য। নিজে যদি রাহিকে না ক্ষেপিয়ে সরাসরি মনের কথাটা বলে দিতো তাহলে এই জঘন্য কথাটা তার শুনতে হতো না।
নিজের কন্ঠ শক্ত করে রাফি বললো, “না, তোমার বাবার কি আছে কি নেই তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।”
রাহি: আমিও তে তাই জানতাম। তবে কেনো করলেন আমাকে বিয়ে?
কথাটা বলতে বলতে চোখের পানি গড়িয়ে পরলো রাহির। হেচকি দিয়ে কাঁদা শুরু করে দিলো সে। রাফি রাহিকে ক্ষেপাতে চেয়েছিলো কিন্তু কাঁদাতে না। তাই তাড়াহুড়ো করে বললো, “কারন মেয়েটা তুমি”
রাহি অবাক হয়ে বললো, “মানে?”
রাফি হাতের চুড়ি দুই মুঠ সামনে এনে রাহির হাতটা নিলো। তারপর চুড়ি পরাতে পরাতে বললো, “প্রথম প্রথম তোমার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম না। কিন্তু ধীরে ধীরে কখন যে তোমাতে সবটা হারালাম মনে নেই আমার। একটা সময় মনে হতো তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আমি। এই যে চুড়িগুলো দেখছো এগুলোও তোমার জন্য আনা। কিন্তু চকলেট তোমাকে দিতে পারলেও চুড়ি গুলো দেয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি। তোমাকে কতোটা ভালোবাসি জানা নেই আমার। তবে এমন কোন মোনাজাত ছিলো না যাতে আমি তোমায় চাইনি।”
ততক্ষণে দু হাতে চুড়ি পরানো শেষ। রাহির হাতটা শক্ত করে ধরে রাহির চোখে তাকিয়ে রাফি বললো, “একটু ভালোবাসবে আমাকে?”
পুনরায় ঝরঝরিয়ে কেঁদে দিলো রাহি। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আপনি আমাকে আগে বলেননি কেনো? এটা ঠিক না। আপনার আগে বলা উচিৎ ছিলো। কেনো এতো কষ্ট দিলেন আমাকে”
রাফি আলতে করে জরিয়ে ধরে বললো, ” আজকে বলবো তাই হয়তো আগে বলা হয়নি।”
রাহি বুকের মধ্যে গুটিয়ে গিয়ে বললো, “আমি আপনাকে একদম ভালোবাসবো না। কোনদিন বাসবো না।”
রাফি হো হো করে হেসে দিয়ে বললো, “বাসতে হবেও না। কারন আমি জানি তুমি আমাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসো।”
৬ বছর পর:
মুয়াজ আজ খুব বেশি খুশি। কারন অনেকদিন পর সে সামিরকে দেখতে পাবে। বাবা বলেছে আজ সামির আর রিম আসবে বেড়াতে। রিম একটা পিচ্চি। ভালো করে খেলতেও পারে না তাই তার প্রতি কোন আগ্রহ নেই মুয়াজের। কারন রিমের বেস্ট ফ্রেন্ড হলো নূর। রিম বেড়াতে আসলে সবসময়ই শুধু নূরের সাথেই থাকে তাই রিমের জন্য নূর অপেক্ষা করছে আর সামিরের জন্য মুয়াজ।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে সাদ আর রিমি তাদের দুই সন্তান সামির আর রিম কে নিয়ে রাফিদের বাসায় বেড়াতে এলো। দরজা খুলেই তাদের উপর হামলে পরলো রাফি আর রাহির দুই সন্তান মুয়াজ আর নূর।
কাকতালীয় ভাবে মুয়াজ আর সামিরের জন্ম একই মাসে। কয়েকদিনের পার্থক্য শুধু। দুজনেই এবার পাঁচ বছরে পরবে। নূর আর রিমের বয়সের পার্থক্য দের মাস। নূর রিমের থেকে দের মাসের বড়। এটা নিয়ে তার ভাবের শেষ নেই। এদের বয়স তিন বছর।
রাফি সামনে এগিয়ে বললো, “আসসালামুআলাইকুম, এতো দেরী করলে যে। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষায় আছি জানো?”
কথা শেষকরেই দুই ভাগ্নেকে কোলে তুলে নিলো সে। ততক্ষণে সালামপর জবাব দিয়ে সাদও মুয়াজ আর নূরকে তুলে নিয়ে বললো, “আমার তো মনে হয় তোমাদের থেকে বেশি আমার বাবা মায়েরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। ”
মুয়াজ বিরোধিতা করে বললো, “না না আমি আল নূল সামিল আর লিম এল জন্য অপেখা কচ্ছি। মা পুপ্পিল জন্য অপেখা কচ্ছে আল বাবা তোমাল জন্য।”
পেছন থেকে আয়শা রহমান অভিমানী কন্ঠে বললো, “তাহলে আমার জন্য কি কেউ অপেক্ষা করেনি?”
মুয়াজ: কচ্ছে তো। দাদু তোমাল জন্য অপেখা কচ্ছে।
এভাবেই হাসিখুশিতে দিনটা কেটে গেলো তাদের। আশা করি এমন ভাবেই জীবনটাও কাটবে তাদের।
সমাপ্ত