মধ্যবিত্ব
নুসরাত রিতু
পর্ব ২
রাফির ফোনে এলার্ম বাজলো ঠিক ফজরের সময়। উঠে ফ্রেশ হয়ে বাসার সবাইকে ডাকলো। মা ততক্ষণে উঠে গেছে। বাবার সাথে মসজিদের দিকে রওয়ানা করলো রাফি।
নামাজ শেষে বাড়ি ফিরেই বসলো জেনারেল নলেজের একটা বই নিয়ে। ইন্টারভিউ ১০ টায়। ৯. ৫০ এর মধ্যে পৌছাতে হলে ৮.৩০ এর দিকে রওয়ানা করলেই হবে। কোন মতেই দেরি করতে চাইছে না রাফি। ৭ টার দিকে মা ডাক দিলো নাস্তা করার জন্য।
রিমির সকালে কোচিং আছে। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিবে রিমি। মহিলা কলেজে পড়াশোনা করলেও কোচিং এ ছেলে মেয়ে মেশানো। তাই বোরখা পরে খুব সুন্দর করে হিজাব পরে নিলো রিমি। তারপর দু ভাইবোন একসাথে নাস্তা করে নিলো। বাবা ফজর পরে একটু ঘুমিয়েছে তাই মা আর ডাকেনি বাবাকে।স্বামীর সাথে খাবে তাই ছেলেমেয়েদের সাথে বসেননি রেনু বেগম।
খাওয়ার পর ভালোকরে নিক্বাবটা লাগিয়ে মাকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিলো রিমি। রাফি গিয়ে আবার পড়তে বসলো।
সারে আটটার দিকে বন্ধু হিমেলকে ফোন দিয়ে জানলো সে কখন যাবে। হিমেলের বাইক আছে। একসাথে গেলে বাস ভাড়াটাও বেঁচে যাবে। জামান সাহেবের অবসরের পর থেকে প্রতিটা পয়শাই হিসেব করে খরচ করে রাফিরা। আগে এতোটা হিসেব করা লাগতো না।
৯.৫৫তে তারাহুরো করতে করতে অফিসে পৌছাতে পারলো রাফি আর হিমেল। রাফির ইচ্ছে ছিলো একটু তাড়াতাড়ি এসে বিশ্রাম নেয়ার। খুব বেশি তাড়াহুড়ো করে কাজ করা তার পছন্দ না। তারউপর এখন ঘেমে নেয়ে অবস্থা খারাপ। রিসেপশনের সামনে দাড়িয়ে ফ্যানের বাতাসে একটু জিরিয়ে নিলো রাফি।
তার ডাক পরলো এর ১০-১৫ মিনিট পরেই। সালাম দিয়ে প্রবেশ করে দেখে তিনজন বসে আছ ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। দুইজন পুরুষ একজন মহিলা। বসতে বলায় তাদের সামনে রাখা চেয়ারে বসলো রাফি। তারপরে আসতে থাকলো একের পর এক প্রশ্ন। পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো হওয়া প্রায় সব প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারলো রাফি। এবার তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো, “সিভিতে তো বয়স দেখাচ্ছে ২৭ তাহলে এর মধ্যে দাড়ি রেখেছেন কেন?”
রাফি: দাড়ি রাখা নবীর সুন্নত তাই স্যার।
সেই লোক: কিন্তু এই অফিসে তো দাড়ি এলাউ না। আপনি কি দাড়ি কাটতে পারবেন?
রাফি: দুঃখিত স্যার। এটা সম্ভব না।
সেই লোক: এমনিও আপনার সিজিপিএ আহামরি কিছু না। তারউপর অফিস থেকে বলা প্রথম কাজটাই আপনি করতে ব্যার্থ হয়েছেন। আপনার কি মনে হয় এর পরও আপনি চাকরিটা পাবার যোগ্য?
রাফি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অন্য ব্যাক্তি: আপনি এখন আসতে পারেন, কোন আপডেট থাকলে পরে জানিয়ে দেয়া হবে।
রাফি সালাম দিয়ে বেড়িয়ে আসলো। ও বুঝে গিয়েছে এই চাকরিটাও ওর হবে না। মন খারাপ করেই বাইরে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর হিমেলকে ডাকলো। হিমেলের যদিও দাড়ি নেই। রাফি ভাবলো হিমেলের হয়তো চাকরিটা হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেলো হিমেলও মন খারাপ করে চলে এসেছে। তারমানে তারও চাকরিটা হয়নি।
দুই বন্ধু অফিস থেকে বের হয়ে একটা টং এর সামনে দাড়ালো। দুইজনে দুইটা লাল চা খেয়ে বাসার দিকে রওয়ানা করলো। রাফিকে ওর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে হিমেল চলে গেলো ওর নিজের বাসায়।
বাড়িতে ঢুকেই দেখে জামান সাহেব আর রেনু বেগম কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে আর মটর ছুলছে।
জামান সাহেব: ইন্টারভিউ কেমন হলো?
রাফি: আলহামদুলিল্লাহ। দাড়ি কাটতে বলেছিলো, রাজি হইনি। রাজি হলেও যে চাকরিটা হতো এমন নয়, হিমেলেরও হয়নি।
জামান সাহেব: মন খারাপ করো না। একটা হয়নি আরেকটা হবে। যাও ফ্রেশ হয়ে নেও।
———————————————
২ টার দিকে খেতে ডাকলেন রেনু বোগম। বেগুন ভাজি, ডাল, ছোট মাছ আর ভাত এনে টেবিলে সাজিয়েছে রিমি। খেতে বসে রাফি খেয়াল করলো রিমির মনটা ভালোনা। সবার সামনে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পরে জানা যাবে ভেবে চুপচাপ খেয়ে চলে গেলো। সকালেই রবিনদের জানিয়ে দিয়েছে রাফি ঐ মেয়েটাকে পড়াতে রাজি। আজ থেকেই পড়া শুরু। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই রাফি ঘুমিয়ে গেলো।
ঘুম ভাঙলো রিমির ডাকে। চোখ খুলে দেখে মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছে রিমি। উঠে বসে রিমিকে বসতে বলে হাত মুখে পানি দিয়ে একেবারে ওজু করে বের হলো রাফি। এসে দেখে রিমি বসেনি। একই জায়গায় দাড়িয়ে আছে।
রাফি: কিরে এতো চুপচাপ যে! মন খারাপ?
রিমি: না, একটা জরুরি কথা ছিলো।
রাফি: আগে বস, তারপর বলে ফেল কি হয়েছে।
রিমি: মাসের ৭ তারিখ চলে, এখনো কোচিং এর টাকা দেয়া হয়নি তাই স্যার কাল অবশ্যই টাকা নিয়ে যেতে বলেছে। ওদিকে আম্মুর ঔষধ শেষ। যা টাকা আছে তা দিয়ে তার ঔষধ আনবে আজ বাবা। তাই বাবাকে কোচিং এর টাকার কথা বলতে সাহস হচ্ছে না।
কথাটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো রাফির। বাবার পেনশনের টাকা তুলতে তুলতে ১০ তারিখ হয়ে যায়। প্রতি মাসে তাই বাড়ি ভাড়ার টাকা আর কোচিং এর টাকা ওরা ১১ তারিখ দেয়।
নতুন কোচিং এ কথাটা বলা হয়নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুচকি হেসে রাফি রিমিকে বললো, “রাতে টাকাটা নিয়ে যাস। এইটুকু বিষয় নিয়ে তোর এতো মন খারাপ করা লাগবে না। এবার যা পড়তে বস। রেজাল্ট খারাপ হলে তোর খবর আছে”
চিন্তা মুক্ত হয়ে রুম ত্যাগ করলো রিমি।
আর রাফি বেড়িয়ে গেলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। আসর পড়ে একে বারে পড়াতে যাবে সে।
——————————————–
দুইটা টিউশনি শেষ করে ঈশা পড়ে রবিনদের বাসায় ঢুকলো রাফি। রবিনের মা যেন রাফির জন্যই অপেক্ষা করছিলো। আজ রবিন পড়বে না, রাফিকে নিয়ে রবিন আর রবিনের মা যাবে তার বোনের বাসায়। রাফিকে বসিয়ে চা খেতে দিয়ে চটপট তৈরি হয়ে নিলেন তিনি। তারপর তিনজন মিলে বেড়িয়ে পরলো নিজেদের গাড়ি করে।
গাড়ি থামলো একটা তিনতলা বাড়ির সামনে। এর দোতলায় থাকে রবিনের খালারা। বাকি ২ টা তলা ভাড়া দেয়া। রবিনদের পিছু পিছু দোতলার দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো রাফি। ততক্ষণে কলিং বেল চাপা শুরু করে দিয়েছে রবিন।
ঐপাশ থেকে বাজখাঁই গলায় চেচিয়ে উঠলো একটি মেয়ে কন্ঠ, “ঐ কেরে? বাড়ি কি তালগাছ নাই? এতোবার কেউ বেল বাজায়? এখন খুলবো না আমি দরজা, দাড়িয়ে থাক ঐপাশে”
রবিনের মা বললো আরে আমরা এসেছি দরজা খোল। কথাটা শুনেই মেয়েটা যেন একটু অপ্রস্তুত হলো সাথে বুঝতেও পারলো এটা তার খালাতো ভাই রবিনের কারসাজি।
দরজা খুলতেই রাফি দেখলো কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। পড়নে তার কলাপাতা রং এর একটা লং টপস সাথে জিন্স জাতীয় কিছু একটা পরা। গলায় একটা স্কার্ফ ঝুলছে। চুলগুলো খোলা, বোঝাই যাচ্ছে মাত্র শাওয়ার নিয়েছে মেয়েটা। অতি সাধারন দেখতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই যেন খেই হারিয়ে ফেলল রাফি। হুঁশ ফিরতেই চোখ নামিয়ে নিলো সে