১.
ফারহান ভাইয়ার বিয়ে লিজার সাথে। কথাটা শোনার পর বুকের ভেতরটা বড্ড জ্বালাপোড়া করছে অনুর। সেই ছোটবেলা থেকে ফারহানকে অনুর ভালোলাগতো। সেই ভালোলাগা কখন ভালোবাসায় রুপ নিয়েছে তা বলতে পারবে না। সবার অলক্ষ্যে একটু একটু করে তাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছে মনের কোণে। সেই মানুষটার বিয়ে তাও আবার তারই ছোট চাচার মেয়ের সাথে। তার নিজের উপর কেবল তাচ্ছিল্যের হাসি আসছে।
কী রে অনু কথা বলছিস না কেনো?
ধ্যান ভাঙলো অনুর, “কী বলবো ছোট আম্মু?”
তোর ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। এবার তো তুই বিয়ে করে নে।
করুণ দৃষ্টিতে অনু তার ছোট আম্মুর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “এখন যদি চিৎকার করে বলতে পারতাম কেনো এতদিন বিয়ে করিনি। আমি তো ফারহান ভাইয়ের আশায় বিয়ে করিনি। ভেবেছিলাম তার পড়াশোনা শেষ হলে যখন জব হবে তখন মনের কথা তাকে জানাবো। কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেলো।”
কী রে অনু কথা বলিস না কেনো?
অনু ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো, “হ্যাঁ বিয়ে তো এবার করতেই হবে। এখন আমি আমার রুমে গেলাম। ফ্রেশ হবো মাথা ধরেছে।”
কোনো রকমে পালিয়ে গেলো অনু। নাহলে ছোট আম্মু কোথা থেকে কোথায় চলে যেত তার ঠিক নেই। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। ফারহান অনুর বড় ফুপুর ছোট ছেলে। বুয়েটে ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে চাকরি হয়েছে মাস কয়েক আগে। চাকরি হওয়ার পর আর এ বাড়িতে আসেনি তাই অনু নিজের মনের কথাও বলার সুযোগ পায়নি। লিজা তার ছোট চাচার একমাত্র মেয়ে, তার অবশ্য একটা বড় ভাইও আছে। অনুরও একটা বড় ভাই আছে, যে ফারহানের সাথেই বুয়েট থেকে ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে চাকরি করছে।
কী রে অনু এসেই দরজা দিলি কেনো? ফ্রেশ হয়ে আয় কিছু খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে। আজ কিন্তু তোর বড় ফুপুরা আসবে।
মায়ের কথা শুনে অনু নিজেকে কোনোরকমে সামলে বললো, “মা আমি আসার সময় খেয়ে এসেছি। এখন মাথা ধরেছে একটু ঘুমাবো।”
অনুর কথায় তার মা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, “তুই আবার বাইরের ছাইপাঁশ খেয়ে এসেছিস অনু। আজকে যদি তোর পেটে ব্যাথা হয় তোকে আমি লা*থি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবো।”
অনু মায়ের কথার কোনো উত্তর দিলো না। তার বাইরের খাবার সহ্য হয় না। যেদিনই বাইরে থেকে ফুচকা চটপটি কিছু খেয়ে আসবে সেদিন তার পেটে ব্যাথায় কাঁদতে হবেই। তাই বাইরের এসব খাবার তার জন্য নিষিদ্ধ। অনুর মা বাইরে থেকে কিছু সময় বকবক করে চলে গেলো। অনু আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। দু’হাতে মুখ চেপে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। চোখের সামনে ফারহানের মুচকি হাসি লেগে থাকা মুখটা ভেসে উঠলো। কী সুন্দর সেই হাসি?
তানিশা উঠ আর কত ঘুমাবি বেয়াদব মেয়ে?
তানিশার মা মোমেনার কথায় তানিশার বিশেষ কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে নিজের মতো ঘুমাতে ব্যস্ত।
তানিশা তুই উঠবি নাকি আমি আয়াতকে নিয়ে একাই চলে যাবো তোর নানু বাসায়।
নানু বাসার কথা শুনে চট করে চোখ মেলে তাকালো তানিশা, “হঠাৎ করে নানু বাসায় কেনো মা? ”
বড় আপা আর ফারহান আসবে ঐ বাড়িতে। আপা আমাকে কল করেছিলো, তাই আমাকেও যেতে বললো।
ফারহানের নাম শুনে তানিশার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো।
আমি এখনই ফ্রেশ হয়ে আসছি মা। এসেই রেডি হয়ে নিচ্ছি।
মোমেনা ভ্রু কুঁচকে বললো, “এখনই রেডি হবি কেনো?”
তানিশা অবাক কণ্ঠে বললো, “তুমি না বললে নানু বাসায় যাবে?”
সেটা তো যাবো তোর আব্বু আসার পর, সন্ধ্যার দিকে।
তানিশা হতাশ কণ্ঠে বললো, “তাহলে এখন এভাবে ডেকে তুললে কেনো? কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম জানো তুমি?”
মোমেনা রেগে বললো, “জমিদারের বাচ্চা ঘুমাতে ঘুমাতে দুপুরের খাবারের সময় চলে যাচ্ছে। খাবার খাবে কখন শুনি আমি?”
তানিশা হতাশ গলায় বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি খাবার দাও।”
মোমেনা চলে যেতেই ফারহানের কথা ভেবে তানিশা খুশী খুশী ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
২.
অনুর ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার অনেক পরে। কানে তুলো গুঁজে মরার মতো ঘুমিয়েছে। কান্না আর ঘুমের জন্য চোখ ফোলা ফোলা হয়ে আছে। শ্যামবর্ণ মুখটা বিশ্রি লাগছে দেখতে। অনু কোনো দিকে না তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিলো। ঠান্ডা পানি শরীর ভিজিয়ে দিলো মুহুর্তে। প্রায় ঘন্টা খানেক শাওয়ার নিয়ে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজেকে দেখে চমকে গেলো। কী বিশ্রি লাগছে দেখতে?
অনু বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললো, “আজ ফারহান ভাই আসবে আর আজই এমন বিশ্রি দেখাতে হলো আমাকে?” “লেখনীতে তাহমিনা তমা”
পরক্ষণে ফারহান আর লিজার বিয়ের কথা মনে পড়ে গেলো অনুর। বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যাথাটা আবার অনুভব হতে লাগলো। নিজেকে কোনো রকম সামলে নিলো। যতটা সম্ভব ঠিকঠাক হয়ে রুমের বাইরে পা রাখলো। ড্রয়িংরুমের শোরগোল বলে দিচ্ছে তার ফুপুরা চলে এসেছে। গুটিশুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ড্রয়িংরুমের দিকে। তার ধারণাই ঠিক, সবাই চলে এসেছে। অনুকে সবার আগে তানিশার নজরে পড়লো। আপু বলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।
ডানগালে ছোট একটা কিস করে বললো, “কেমন আছো আপু তুমি?”
অনু জোরপূর্বক হেসে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ, তোরা কখন আসলি?”
মোমেনা অভিমানী গলায় বললো, “আমরা তো সেই কখন এসেছি আম্মিজান। কিন্তু আপনারই কোনো খোঁজ খবর নেই।”
ভার্সিটি থেকে এসে মাথা ধরেছিলো ফুপি। তাই ঘুমিয়ে ছিলাম, কেবল ঘুম ভাঙলো।
মোমেনা ব্যস্ত হয়ে উঠে এলো, “কী বলো আম্মিজান? এখনো খারাপ লাগছে, দেখি ইশ চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কত কষ্ট হচ্ছিল।”
অনু মুচকি হেসে বললো, “এখন ঠিক আছি ফুপি।”
অনুর বড় ফুপি সেলিনা মুখ ভেংচে বললো, “সত্যি মাথা ধরেছে নাকি ফুপুদের দেখে লুকিয়েছিলি?”
এটা কেমন কথা আপা লুকিয়ে থাকবে কেনো? দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওর মাথা যন্ত্রণা হচ্ছিলো।
হঠাৎ ফারহান গম্ভীর গলায় বললো, “আহ্ মা তুমি এসেই অনামিকাকে নিয়ে পড়লে কেনো?”
ছেলের কথায় সেলিনা ছেলের দিকে কটমটে চোখে তাকালো আর কিছু না বলে চুপ করে গেলো। অনু এতক্ষণ ফারহানের দিকে তাকায়নি তবে এবার তাকালো। আকাশী-নীল রঙের শার্টটায় অসম্ভব মানিয়েছে হলুদ ফর্সা মানুষটাকে। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। আশপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখে নিলো। আনুর বাবা, ছোট চাচা, ফারহান আর তানিশার বাবা চারজন একপাশে বসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। ফারহান তার মায়ের পাশে বসে ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ফ্লোরে আয়াত গাড়ি নিয়ে খেলছে। তানিশা আর মোমেনা তখনো অনুর কাছে দাঁড়ানো।
অনু মোমেনার দিকে তাকিয়ে বললো, “মা আর ছোট আম্মু কোথায় ফুপি?”
তারা তো কিচেনে সবার নাশতার ব্যবস্থা করছে।
আচ্ছা ফুপি, আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি।
অনু চলে গেলে মোমেনা আর তানিশা আবার আগের জায়গায় বসলো। তানিশা ফোন চালানোর নাম করে আড়চোখে ফারহানকে দেখে যাচ্ছে। আর ফারহান, সে তো মনে হচ্ছে ফোনের দুনিয়ায় হারিয়েছে।
মায়ের কাছে যেতে যেতে অনু চিন্তা করলো তার বড় ফুপির কথা। মানুষটা অজানা কারণে তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। বিপরীতভাবে লিজাকে অসম্ভব ভালোবাসে।
কী রে তোর চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো?
মায়ের কথায় ঘোর কাটলো অনুর।
তখন না বললাম মাথা ধরেছে, তার জন্যই।
অনুর মা সরু চোখে তাকালো তার দিকে, “সত্যি করে বল মাথা ধরেছে নাকি বাইরের কিছু খেয়ে পেট ব্যাথায় কেঁদেছিস?”
অনু তার মায়ের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “কেঁদেছি তো মা তবে পেট ব্যাথায় না বুক ব্যাথায়। বুকের পা পাশটায় যে খুব ব্যাথা হচ্ছে।”
অনু কিছু না বলে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরলো। হকচকিয়ে উঠলো অনুর মা নূরজাহান।
মেয়ের মাথায় হাত রেখে ব্যস্ত গলায় বললো, “বেশি খারাপ লাগছে আম্মু?”
মায়ের পরিবর্তন দেখে অনু মলিন হাসলো। একেই বুঝি মা বলে। একটু আগে বকলো এখন মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। অনু কিছু না বলে মাকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো।
#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
সূচনা পর্ব