#রোদেলা-৭৫
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
রেজওয়ান আর প্রিসিলা খুলনা গিয়েছে রিজওয়ানের বন্ধুর বিয়ের দাওয়াতে। সুফিয়ানকে ওদের গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়েছে জমি সংক্রান্ত ঝামেলায়। রোদেলা একা বাড়িতে রয়েছে। সুফিয়ান যদিও বলেছিলো কৃষ্ণচূড়ায় গিয়ে থাকতে এ দুটো দিন। কিন্তু ও যায় নি সেখানে। বাড়ি দেখাশোনা যে করেন তিনি আছেন এ অযুহাতে একাই রয়েছেন এ বাড়িতে। এত বড় বাড়িতে একা থাকা কষ্টের কিন্তু ওখানটায় গিয়ে থাকাটাও অশান্তির। যখন চারদিক থেকে অশান্তি আর কষ্ট ঘিরে থাকে, মানুষ যত টুকুর ভর নিতে পারে সেটাকেই বেছে নেয়। রোদেলা একা থাকাটাকেই বেছে নিলো কৃষ্ণচূড়র বদলে। প্রায় দিন পনেরো হবে ঐ বাড়িতে যায় ও না ফোন ও দেয় না। যদিও খবরা খবর সবই পায় প্রিসিলা মারফত। তবুও এতটুকু দেয়াল ও ইচ্ছে করেই টেনে রাখলো ওর চারদিকে। একটু একা থাকা জরুরি। এসব ভাবছিলো সারাটা রাত।
বিশাল খাটের একপাশে গায়ে চাদর ঢেকে শুয়ে আছে রোদেলা। নির্ঘুম একটা রাত কাটলো ওর সুফিয়ানকে ছাড়া। সকালের সোনারোদে পুরো ঘর আলোকিত। পুব দিকের দেয়ালটা কাচের হওয়ায় খুব সকালেই পুরো ঘর আলোয় ভরে যায়। মুখে আলো পরায় চাদরটা টেনে নিলো ও। আলস্য ভড় করছে ওর উপর। উঠে গিয়ে পর্দা টেনে দিতে ইচ্ছে করছে না। সুফিয়ান প্রতি রাতে জানালার ভারী পর্দাগুলো টেনে দেয়। গতকাল বিকেলে ও রওনা দিয়েছে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাই পর্দা টানার কথা মনে ছিলো না রোদেলার। গত রাতটা প্রায় জেগেই কাটিয়েছে ও। বিন্দু মাত্র ঘুম ছিলো না চোখে। বই পড়ে ফেসবুক স্ক্রোল করে কেটেছে বিশাল রাতটা। শেষ রাতে চোখ বুজে এসেছিলো হয়তো, এখন সকালের রোদ ওর এই ক্ষুদ্র ঘুমের চেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটালো। বালিশের নিচে হাতড়ে ফোনটাকে কাছে টেনে আনে। সাড়ে ছয়টা বাজে, ফোন করে সুফিয়ানকে। বেজে ফোনটার লাইন কেটে যায়। রোদেলা পাশ ফিরে শুতেই কল করে সুফিয়ান।
: হ্যালো…. (ঘুম থেকে উঠায় রোদেলার গলাটা কেমন যেন আদুর শোনায়…)
: বাপরে…! ম*রে*ই গেলাম আমি… এভাবে হ্যালো বললে সব কাজ ফেলে কিন্তু চলে আসবো এক্ষুনি..
: ধ্যাত, বাজে কথা রাখুন তো, শুনুন কি বলি…
: হুম, তুমি কি শুয়ে কথা বলছো…?
: হুম,
: উঠো নি এখনো,
: না…
: এত সকালে ফোন দিলে যে…
: জানালার পর্দা টেনে দিই নি, পুরো ঘর রোদে ফর্সা হয়ে গেছে এত সকাল হওয়া সত্ত্বেও…
: নেমে পর্দাটা টেনে দাও…
: উঠতে ইচ্ছে করছে না..
: আমি এসে পর্দা টেনে দিয়ে যাবো..?
: ধ্যাত, তা বলেছি নাকি….!
: তাহলে…?
: রাতে আমার ঘুম হয় নি,
: কেন?
: আমাদের এক হওয়ার পর এবারই প্রথম আমরা দুজন দুইদিকে রাত্রি যাপন করলাম।
: ওহ্… মুচকি হাসে সুফিয়ান,
: হুম….
: আমি কি চলে আসবো তাহলে…?
: আরে তা বলেছি নাকি…?
: তাহলে কি মানে দাঁড়ায় এ কথার?
: আই মিস ইউ…!
: আই মিস ইউ টু মাই ডিয়ার……
ফিসফিস করে বলে সুফিয়ান।
এরপর দুইপাশে নিরবতা বেশ কিছুক্ষণ।
: আমি যে কাজে এসেছি দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
এখানে আসলে তুমি বোর হতে, তাই আনলাম না সাথে করে।
: আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা…
কথা ঘুরাতে সুফিয়ান বলে-
: তুমি ওঠো, ফ্রেশ হও, নাশতা খাও। আমিও উঠবো এখন। সারাদিন কাজের উপর থাকা লাগবে।
: আচ্ছা… থাকেন তাহলে…
কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে সুফিয়ান বললো-
: আর হ্যা রোদ…
: হুম, শুনছি বলুন…
: আই লাভ ইউ….
হঠাৎ ফিসফিস কন্ঠে সুফিয়ানের গলায় এ কথটা যেন সাতসকালে খু*ন করলো রোদেলাকে…
: আপনি অনেক খরাপ লোক…
: আমি ভালো হতে চাই না প্রিয়…
: রাখুন তাহলে…
: ওকে বাই………
ফোনটা রেখে বিছনা ছেড়ে উঠলো রোদেলা। হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ কফি খেলো ম্যজম্যাজ ভবটা দূর করতে। নাশতা খেতে খেতে কথা বললো প্রিসিলার সাথে। সারাদিন কি করা যায় ভাবতেই মনে পরলো শাহনাজ আন্টির বাসায় যাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের বাসায় সুফিয়ানকে ছাড়া যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া তারা দাওয়াত করেছে আগামী শুক্রবার। হুট করে আজ যাওয়াটা যদিও কিছু মনে করবে না তারা। তবুও যাবে না বলেই ঠিক করলো। ফোন লিস্ট চেক করতেই সিমির কথা মনে পরলো। ফোন করলো ওর নম্বরে। কি ভেবে যেন কলটা কেটে দিলো ও। না জানিয়ে গিয়ে সারপ্রাইজ দিবে ওকে। অভিমান করে আছে ও। কল দিলেও কথা বলে নি ঠিকঠাক। রাগ করাটা যৌক্তিকই। তবুও সবকিছু খুলে না বললে ও বুঝবে না রোদেলা কতটা অপারগ ছিলো। তাই রেডি হয়ে দশটা নাগাদ বের হলো বাড়ি থেকে, রিকশায় উঠে কল করলো সুফিয়ানকে। সিমিদের বাসায় ও যাচ্ছে তা জানাতে। কলটা ধরলো না সুফিয়ান। কাজে নিশ্চয়ই ব্যাস্ত। ঠিক করলো একটা টেক্সট করে রাখবে ওকে। সময় পেলে তা দেখবে নিশ্চয়ই। ওর লেখা শেষ না হতেই একটা টেক্সট এলো সুফিয়ানের ফোন থেকে৷
“আমি এজলাসে, পরে কথা বলি।”
হেসে দিলো রোদেলা, অসম্পূর্ণ ম্যাসেজটা পূর্ণ করলো। সে লিখলো-
” আমি মগবাজার যাচ্ছি সিমিদের বাসায়, সন্ধ্যার আগেই ফিরবো। ফ্রী হয়ে অবশ্যই কল করবেন…”
এরপর একটা সুপারশপ থেকে কিছু কেনাকাটা করলো সিমির বাচ্চার জন্য। এগারেটা নাগাদ পৌঁছে গেলো ওদের বাড়ি। মনের ভিতর ধুকপুক করছে, কি রিয়্যাক্ট করে সিমি….?
বড় একটা শ্বাস নিয়ে কলিং বেলে চাপ দিলো ও। দড়জা খুললো বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে। বললো-
: কাকে চাই…
: তুমি কি উদয়…?
: হুম, কাকে চাই…?
আগের চেয়ে আরো গম্ভীর গলায়, ভেতর থেকে কারো গলা পাওয়া গেলো,
” কিরে তোকে না কত বলেছি কে তা না জিজ্ঞেস করে গেইট খুলবি না। ”
বলতে বলতে গেইটের কাছে এগিয়ে এলো সেই কন্ঠ স্বরটা।
রোদেলা ঠায় দাঁড়িয়ে, কন্ঠের মালিকের দেখা মিললো কয়েক সেকেন্ড ব্যাবধানে… থমকে দাঁড়িয়ে সে…
রোদেলা জিজ্ঞেস করলো…
: কিরে কেমন আছিস…?
: তুই…?
: হুম, কেন আমাকে দেখে খুশি হসনি মনে হচ্ছে,
মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরলো সিমি রোদেলাকে।
রোদেলা হাতের ব্যাগপত্র মাটিতে ফেলে আলিঙ্গনটাকে আরো শক্ত করলো। রোদেলা ঠিক বুঝেছে কাঁদছে সিমি…
: আরেহ্ কাঁদার কি হলো…? মনে হচ্ছে আমি ম*রে গেছি, তাই তুই….
কথাটা শেষ করতে দিলো না সিমি, আলিঙ্গন ছেড়ে টেনে নিয়ে গেলো ওর ঘরে। চোখ মুছতে মুছতে বললো-
: তুই এসেছিস আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না…
: কেন?
: তুই কি আগের রোদেলা আছিস এখন?
কত বড় হয়েছিস তুই….?
: মারবো এক কিল… আগের রোদেলা আছিস..? মানে কি? আমরা যত যাই হই না কেন আমরা বন্ধু ছিলাম, বন্ধুই থাকবো, নাকি তুই ভেবে রেখেছিস আমাকে বন্ধু পরিচয় দিবি না…?
: কি যে বলিস…? সেই ভাগ্য কি আমাদের আছে…?
এই যে বিয়ে করে এসেছি রান্না ঘরটাই একমাত্র আপন জায়গা। কোথাও যাওয়ার নেই, যেতে পারি না। সংসার, স্বামী, সন্তান, কাজ, দায়িত্ব, এসবেই আবর্তিত হচ্ছে আমার জীবন। কত কি স্বপ্ন ছিলো জীবন নিয়ে। কিন্তু জীবণ….!
জীবণ দেখ আমাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো।
এক পলকে সব যেন মনে পরলো রোদেলার। সিমি ভালো ছাত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলো শিক্ষক মহলে। স্কুলের কোন অনুষ্ঠান হোক কি দেয়ালিকা সব কিছুতে ডাক পরা এ মেয়েটির জীবণ এখন রান্নাঘরের উনুনে তাতছে। অথচ লিডারশীপ জিনিসটা ও খুব ভালো জানে। একবার কলেজে শিক্ষা সফরের জন্য একজন ছেলে ও একজন মেয়েকে দায়িত্ব নিতে বলা হলো। নির্দ্বিধায় ও দাঁড়িয়ে পরেছিলো এত মেয়েদের মধ্যে। অথচ আজ….!
এত পড়াশোনা, নাচ, গান এত এত কোর্স, সার্টিফিকেট কি দাম এখন এ জীবণে…?
ও বলেছিলো শ্বশুরবাড়ির এত বড় পরিবারের বড় বউ হওয়ায় কত দায়িত্ব ওকে পালন করতে হয়। খিদের চোটে পাগল হওয়া যে সিমি সহ্য না করতে পেরে চুলার উপর থেকেই তরকারি নিয়ে খেতো, সে এখন সবাইকে খাইয়ে, সবার শেষে খায়। ঠিকমতো ওড়ানা গায়ে রাখতে পারতো না বলে ওর মা ওকে অনেক বড় হওয়া পর্যন্ত বুকে কুচি দেয়া ফ্রক পরাতো। সেই সিমি এখন বারো হাত শাড়ি কি সুন্দর গুছিয়ে পরে।
এসব ভাবনাকে একপাশে রেখে রোদেলা বললো-
: চাকরী করছিস না, তাতে কি..? এত বড় বাড়ি দেখাশোনা করছিস, অনলাইনে গহনার ব্যাবসা দাঁড় করিয়েছিস, এত দায়িত্ব এত চাপে থেকে এতটুকুই বা কম কি?
: জানিস, দিন বাড়ার সাথে সাথে আমার মেজাজ ও তিরিক্ষি হতে থাকে। শান্ত স্বভাবের আমি এখন বদমেজাজী হয়ে গেছি।
বলে মৌণ থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো-
: থাক বাদ দে এসব, তুই বল কেমন আছিস…?
: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি সব মিলিয়ে…
প্রসঙ্গ বদলাবার সুযোগ পেয়ে রোদেলা বললো –
: আমি যা ভয় পাচ্ছিলাম তোর বাড়ি আসতে…
তুই সেদিন যে কান্ড করলি। কেঁদেকেটে ফোনটা রেখে দিলি। আমার কোন কথাই শুনলি না।
: আমার কান্নাটা কি অনাধিকার চর্চা ছিলো?
: কি বলছিস এসব? অনাধিকার চর্চা হলে তোর বাড়ি অবধি আসতাম?
: তা ঠিক, তোর কি মনে হয় আমার রাগ অযৌক্তিক।
: না, তা না…
: আচ্ছা বাদ দে এসব। ছেলে ওর দাদীর সাথে দাওয়াতে যাবে তুই একটু বস, ওকে আমি তিনতলা দিয়ে আসি। তারপর দুই বান্ধবী মিলে জম্পেশ আড্ডা হবে….
: আচ্ছা যা…
চলবে….