#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-০৫
সকাল থেকেই বাড়ি সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। হবেই না কেনো, আজ বাড়ির মেয়ের এনগেজমেন্ট বলে কথা। আজ সবাই বাড়িতেই আছে শুক্রবার হওয়ায়। তবে সবাই এখনো ঘুমাচ্ছে। অনু ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় হাঁটাহাটি করছে। অনুদের বাড়িটা বেশ বড় আর সুন্দর দোতলা একটা বাড়ি। তাদের আগের বাড়িটা অনেক পুরনো ছিল, বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো তাই বছর দু’য়েক আগেই এই বাড়িটা করা হয়েছে। সামনে অনেকটা খোলা জায়গা পরে আছে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো এখানে একটা ফুলের বাগান করবে কিন্তু কাজের চাপে কেউ আর সময় দিতে পারেনি। অনুর সময় আছে অনেক কিন্তু ইচ্ছা নেই, সে অলস প্রকৃতির মেয়ে। সময় পেলেই ঘুমাতে পছন্দ করে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ অনুর চোখ গেলো লিজার রুমের বেলকনির দিতে। খোলা বেলকনির রেলিং ধরে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অনু জানে না লিজার কী হয়েছে। তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে লিজা এমন উদাস হয়ে গেছে। তাদের তিন বোনের কেউ ভালো নেই। তানিশার ভালো না থাকার কারণ অনু জানলেও তাদের দুজনের ভালো না থাকার কারণ কেউ জানে না। লিজার দিকে তাকিয়ে অনুর বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো।
৮.
সূর্য বিদায় নিতেই দোতলা বাড়িটা রঙিন আলোয় সেজে উঠলো। মানুষের আনাগোনা বাড়তে লাগলো বাড়ির সামনে খোলা জায়গায়। খোলা জায়গাটা আজ সেজে উঠেছে আর্টিফিশিয়াল ফুলের গাছ আর নানা রঙের আলোয়।
অনু কালো রঙের একটা থ্রীপিস পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হিজাব পিন করছে। তানিশা তখনো রেডি না হয়ে বেডে বসে আছে।
অনু হতাশ গলায় বললো, “রেডি হয়ে নে বোনু আমার।”
তানিশা বেডে রাখা গ্রাউনের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি যাবো না।”
অনু হতাশ গলায় বললো, “আজ তুই না গেলে সবাই সন্দেহ করবে তনু।”
তানিশা ভেজা চোখে তাকালো অনুর দিকে, “কীভাবে দেখবো আপু?”
অনু তানিশার দিকে এগিয়ে গিয়ে চোখ মুছে দিলো দু’হাতে, “যা আমার না তা হারানোর কেনো এত ভয়?”
মানতে কষ্ট হচ্ছে, সে আমার নয়।
অনু জড়িয়ে ধরলো তানিশাকে মনে মনে বললো, “একই যন্ত্রণায় আমিও যে পুড়ছি বোনু। তুই তো তাও আমার কাছে প্রকাশ করতে পেরেছিস। আমার তো ভেতরে ভেতরে গুমরে মরা ছাড়া উপায় নেই।”
অনু তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “চল আমি তোকে সাজিয়ে দিচ্ছি আজ। মনে রাখিস প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তোর জন্য হয়তো ফারহান ভাইয়ার থেকেও ভালো কেউ অপেক্ষা করছে। যে তোকে খুব ভালোবাসবে। নিজেকে সামলে সেই সুন্দর সময়টার জন্য অপেক্ষা কর বোনু।”
তানিশা চুপচাপ অনুর কথা শুনে গেলো। কিছুই বললো না। অনু তানিশাকে গ্রাউন পড়তে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো জোর করে।
তানিশা গ্রাউন পরে বের হলে অনু তাকে দেখে বলে উঠলো, “মাশাআল্লাহ আমার বোনুটাকে পরীর মতো লাগছে।”
পার্পেল কালার গ্রাউনে সত্যি অসম্ভব সুন্দর লাগছে তানিশাকে, অনু হালকা একটু সাজিয়েও দিলো। রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় সবাই হিজাব পরে তাই তানিশাও পরে নিলো। দু’জনে একসাথে বাড়ির বাইরে এলো। ফারহান একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আহির আর মাহিরের সাথে। তারা তিনজনই সমবয়সী। আহির আর ফারহান একসাথে পড়াশোনা করলেও মাহির আলাদা। মাহির পেশায় পাইলট, একমাত্র বোনের এনগেজমেন্ট হওয়ায় অনেক কষ্টে ছুটি ম্যানেজ করতে হয়েছে।
মাহির জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে আহিরের দিকে তাকালো, “রুহির কী খবর আহির? ফারহান তো সেটেল হয়ে যাচ্ছে এবার তুই কবে হচ্ছিস?”
আহির ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো, “অনু যতদিন বিয়ে না করছে আমি কীভাবে বিয়ে করবো? আমাকে যে বলছিস তুই কবে বিয়ে করবি? এখন তো তোর আর প্রবলেম নেই।”
মাহির মুচকি হাসলো, “মনের মতো কাউকে পেলেই বিয়ে করে নিবো। তাছাড়া হিসাব অনুযায়ী এবার তো তোর পালা ব্রো। আমাদের মধ্যে ফারহান বড় তারপর তুই আর সবার শেষে আমি। তাই বিয়েটাও সেভাবে করা উচিত। তুই অনুর বিয়ে নিয়ে টেনশন করছিস কেনো? সময় হলে ও বিয়ে করে নিবে।
অনুর বিয়ের কথা শুনে ফারহান একবার তাকালো মাহিরের দিকে। কথাটা মস্তিষ্কে আঘাত করলো নাকি মনে সেটা বুঝতে পারলো না ফারহান। তার আগেই চোখে পড়লো অনুকে। তানিশা আর অনু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অনু থ্রীপিস পড়তে বেশি পছন্দ করে তাই বিভিন্ন ফাংশনে থ্রীপিসই পরে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুন্দরী তানিশার পাশে অনুকে একটু বেশি সাধারণ লাগছে। ফারহান চোখ সরিয়ে নিলো অনুর থেকে। লিজা এখনো আসেনি তাই অনুষ্ঠান শুরুও হয়নি। ফারহান চোখ সরিয়ে নিতেই অনুর চোখ পরলো ফারহানের দিকে। হোয়াইট শার্টের উপর হোয়াইট কোট পড়েছে, প্যান্টের কালারও হোয়াইট। ফারহানের পছন্দের রঙ সাদা সেটা অনুর অজানা নয়। প্রায় হোয়াইট পরে তবে আজ একটু বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে যেনো। অনু পাশ ফিরে তানিশার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে এক দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে কেবল দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। তখনই হোয়াইট প্রিন্সেস হয়ে হাজির হলো লিজা। হোয়াইট গ্রাউনের সাথে হোয়াইট হিজাব। লিজার রুপ যেনো আজ তানিশাকে ছাড়িয়ে গেছে। লিজা অনুর দিকে তাকালে অনু একটা মুচকি হাসি উপহার দিলো তাকে। এখন অবশ্য লিজাকে খুশী খুশী লাগছে। অনু তানিশার হাত ধরে বাকি সবাইকে খুঁজতে লাগলো। গেস্ট মোটামুটি ভালোই এসেছে, অনু অনেকের সাথে সৌজন্যমূলক কথাও বললো। একদম চুপচাপ আছে কেবল তানিশা। অনু একপাশে এসে তার মা,ছোট আম্মু, ফুপিদের পেয়ে গেলো।
তোমরা এখানে আর আমি তোমাদের খোঁজে মরছি।
নুর জাহান বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “আজকের দিনেও এমন ফকিন্নির মতো সেজেছিস কেনো তুই? লোকজন বলবে আমরা তোকে কিছুই দেই না। তোর জন্য যে গ্রাউন কেনা হয়েছে সেটা কোথায়?”
অনু মায়ের কথায় অবাক হলো না। তার মা এমনই, তার সাথে বেশির ভাগ সময় রুড বিহেভ করে। লাবণি সবসময় লিজার প্রশংসা করে বেড়ায়, সেখানে নুরজাহান বেগম কিছু বলতে পারে না তাই সেই রাগ মেয়ের উপর ঝাড়ে। অনুর না আছে রুপ আর না আছে গুণ। এ নিয়ে তার মায়ের আফসোসের শেষ নেই।
অনু উত্তর দিচ্ছে না দেখে নুরজাহান ধমক দিয়ে বললো, “কী হলো কথা বলিস না কোনো?”
নুরজাহানের ধমকে আশপাশের মানুষ তাকালো তাদের দিকে। সেটা খেয়াল করে নুরজাহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
অনু চাপা গলায় বললো, “মা আস্তে কথা বলো। আশেপাশে অনেক মেহমান আছে। তুমি ভালো করেই জানো আমি থ্রীপিস পড়তে বেশি কমফোর্টেবল ফিল করি। তুমি আমার জন্য গ্রাউন এনেছো কেনো?”
নুরজাহান রাগী কিন্তু চাপা আওয়াজে বললো, “তোকে আমি কিচ্ছু বলবো না। তোকে জন্ম দিয়েই ভুল করেছি আমি। আল্লাহ না দিয়েছে রুপ আর না দিয়েছে কোনো গুণ। ভালো ভালো পোশাক পরে গায়ের রঙটা কোথায় একটু আড়াল করবে তা না ফকিন্নি সেজে ঘুরে বেড়ায়।”
লাবণি মিটমিট করে হেঁসে বললো, “থাক ভাবি আর বকে কী হবে? আর অনু যাই পড়ুক গায়ের রঙ তো আর ফর্সা দেখাবে না।”
নুরজাহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “তুই তানিশার সাথে ঘুরবি না আজকে। ওর পাশে তোকে আরও ফকিন্নির মতো লাগছে।”
নুরজাহান চলেই গেলো সেখান থেকে। অনু মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। মোমেনা এসে অনুর মাথায় হাত রাখলো।
মায়ের কথায় কষ্ট পেও না ফুপ্পি।
অনু মোমেনার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো, “এখন বুঝতে শিখেছি ফুপ্পি। এখন আর কষ্ট হয় না। আমার মায়ের আফসোস হয় আমি তার মেয়ে বলে। আমি বুঝতে পারি তার দিকটা।”
অনু দাঁড়ালো না সেখানে। দ্রুত পায়ে অন্যদিকে চলে গেলো। বিপরীত দিক হওয়ায় সেদিকে তেমন মানুষ নেই। চোখের পানিটা আর আঁটকে রাখা সম্ভব হলো না। অনেকটা সময় অভিনয় করে ফেলেছে আর পারছে না। ঠোঁটের কোণে কৃত্রিম হাসিটা আর ধরে রাখতে পারছিলো না তাই পালিয়ে আসতে হলো। বাইরের মানুষ তাকে কী বলে, তাতে তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু যখন দেখে তার মা তাকে নিয়ে লজ্জিত বোধ করে তখন ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এদিকটায় একটা সুইমিংপুল আছে। অনু কোনোদিকে না তাকিয়ে জুতা খোলে পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়লো। অনুর আর কোনো গুণ না থাকলেও নিজের অনুভূতি আড়াল করার গুণটা খুব ভালোই আছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বুঝতে পারবে না অনুর মনের মধ্যে কী চলছে? অনুর লাইফে এমন কেউ নেই যার সাথে সে সব অভিযোগ উজাড় করে বলতে পারে। বাবার সাথে অদ্ভুত এক দুরত্ব তার আর মা কখনো তাকে বুঝতেই চায়নি। ভাইয়া সে তো তার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। গোটা একটা পরিবারের সাথে থেকেও অনু বড্ড একা। এনগেজমেন্টের এনাউন্সমেন্ট হতেই অনু উঠে দাঁড়ালো। ইচ্ছে হলো ভালোবাসার মানুষকে নিজের চোখে অন্যকারো হতে দেখতে, অনুভূতিটা কেমন হয় উপলব্ধি করতে। পাজামার নিচের অংশ কিছুটা ভিজে গেছে অনুর। ওভাবেই এগুলো স্টেজের দিকে।
৯.
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে লিজা আর ফারহান। লিজার ঠোঁটে হাসি থাকলেও ফারহানের অনুভূতি ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। অনু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। শুধু সে নয় সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে।
সেলিনা চৌধুরী একটা রিং বক্স এগিয়ে দিলো ফারহানের দিকে। ফারহান রিংটা তুলে নিলো তার থেকে।
সেলিনা চৌধুরী মুচকি হেসে বললো, “এবার এটা লিজার অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দে।”
অনামিকা শব্দটা শুনে কেঁপে উঠলো ফারহান। একবার রিংটার দিকে তাকিয়ে লিজার দিকে তাকালো। ফারহানের ইচ্ছে করছে না রিংটা লিজাকে পড়াতে। ফারহান আশেপাশে তাকিয়ে অনুকে খোঁজার চেষ্টা করলো। অনু একটু দূরে আর আড়ালে দাঁড়ানোর জন্য ফারহানের নজরে এলো না।
সেলিনা তাড়া দিয়ে বললো, “কী হলো পড়াচ্ছিস না কেনো? লিজা অপেক্ষা করছে তো।”
লিজা তাকিয়ে আছে ফারহানের