#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১০
সেলিনা হতভম্ব গলায় বললো, “তুই এসব কী বলছিস ইরফান?”
মলিন হাসলো ইরফান, “মা তোমার কখনো মনে হয়নি তোমার ছেলেরা ভালো নেই। আজ তোমাকে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। তুমি মেয়ের কদর করতে পারবে না বলেই হয়তো আল্লাহ তোমাকে একটা মেয়ে দিয়েও কেঁড়ে নিয়েছে।”
কেঁপে উঠলো সেলিনা চৌধুরী, “ইরফান?”
“সত্যিটা সবসময় তেঁতো লাগে মা। তামান্না কখনো তোমার কথার অবাধ্য হয় না। তুমি ওকে এত কথা শোনাও কোনদিন সেসব আমাকে বলেনি। যখন দেখেছে আমার সামনে তুমি ওকে যা খুশী বলে যাচ্ছো আর আমি কিছুই বলছি না তখন ও নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছে। আমাদের দু’জনের মাঝে এসেছে দুরত্ব। মা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম তোমার অমতে। তাই তোমাকে কিছু বলতাম না, যেনো তোমার মনে না হয় তামান্না আমাকে কন্ট্রোল করছে। কিন্তু সেটাই তুমি কাজে লাগিয়েছো দিনের পর দিন। মেয়েটা আমার সাথে দুরত্ব তৈরি করলেও তোমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। আমরা দিনে দশবার তোমাকে মা ডাকলে ও ডাকে একশবার। তবু ওর জন্য তোমার মনে একটু জায়গা হয়নি। আচ্ছা মায়েরা বুঝি এমনই হয়? মা তো একটা ছায়ার মতো যেখানে সব সন্তান একটু ছায়া খোঁজে। তোমার অমতে বিয়ে করার শাস্তিটা তুমি আমাদের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছো।
কাঁপা গলায় সেলিনা বললো, “এসব তুই কী বলছিস ইরফান?”
ইরফান নিজের চোখ মুছে নিলো, “একদম ঠিক বলছি মা। ছোটবেলা থেকে ফারহানের কাছে আমি ছিলাম বন্ধুর মতো। যা তোমাদের বলতে পারতো না,সব আমাকে বলতো আর আমিও ওকে বলতাম। তামান্নার সাথে আমার সম্পর্কের কথা ফারহান প্রথম থেকেই জানতো। মাঝে মাঝে বলতো ভাইয়া কাপল তো হওয়া উচিত তোদের মতো। কিন্তু যখন দেখলো বিয়ের পর আমাদের সম্পর্কটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে, ফরহানের মনে তার বাজে প্রভাব পড়লো। নিজের অনুভূতি থেকে পালাতে শুরু করলো। কিন্তু আমি তো ফারহানকে ওর নিজের থেকে বেশি চিনি। ও অনুকে কতটা ভালোবাসে সেটা ও নিজে বুঝতে না পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি।
সবাই একসাথে বলে উঠলো, “অনু?”
ইরফান মুচকি হাসলো, “হ্যাঁ অনু। ভালোলাগা ভালোবাসা কী সেটা যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছে ফারহান। সেই অনুভূতিগুলো অনুর নামে করে দিয়েছে।”
সেলিনা বেগম বসে পড়লেন বেডে। শরীর কাঁপছে তার। সবসময় মানুষের কাছে শুনে এসেছে ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। ছেলের বউকে যেনো আগে থেকে কন্ট্রোল করে, নাহলে ছেলে হারাতে হবে। সেসব করতে গিয়ে যে সে দু’টো ছেলের জীবনই বিষিয়ে দিয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি। মাথায় হাত দিয়ে কান্না করে দিলো সেলিনা। নিজের ভুলগুলো আজ চোখের সামনে ভাসছে। কই এতদিন তো এসব ভুল মনে হয়নি। চোখের সামনের ভুল ধারণার দেয়াল আজ ভেঙে পরেছে বলেই হয়তো আজ নিজের ভুল বুঝতে পারছে।
ইরফানের বাবা আফতাব খান হতাশ গলায় বললো, “ছেলের সুখের কথা চিন্তা করে তোমার বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েটাকে এ বাড়ির বউ করে আনলাম। তার জন্য আজও তুমি আমাকে কথা শুনতে ছাড় দাও না। ভেবেছিলাম শুধু আমার সাথেই এমন করো। এদিকে তুমি যে ছেলের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে বসে আছো সেটা তো বুঝতে পারিনি শেলি। নিজের সন্তানের সাথে তুমি এমন করতে পারলে কী করে?
সেলিনার কাছে এসবের কোনো উত্তর নেই। তামান্না ঘুমন্ত তানভীরকে বুকে জড়িয়ে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার অবাক দৃষ্টি ইরফানের দিকে। বিয়ের এতগুলো বছরে আজ প্রথমবারের মতো ইরফান তার মায়ের কথায় জবাব দিয়েছে।
ইরফান এগিয়ে এসে তামান্নার কোল থেকে তানভীরকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগুতে লাগলো। তামান্নাও ইরফানের পিছনে গেলো। সেলিনা তখনো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আফতাব সেলিনার দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেও রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। ইরফান তানভীরকে আস্তে করে বেডে শুইয়ে দিলো।
“মায়ের সাথে তোমার এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।”
ইরফান তামান্নার কথা শুনে তাকালো তার দিকে, “আমি তো মিথ্যা কিছু বলিনি। মায়ের জন্যই আজ আমাদের সম্পর্কে এত দুরত্ব।”
তামান্না দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, “মা অনেকটা দ্বায়ী হলেও পুরোপুরি নয়। ইরফান একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে দুজন মানুষকেই যত্নশীল হতে হয়। ভালোবাসা এবং যত্ন দিয়ে মরুভূমিতেও যেমন ফুল ফোটানো যায়। অবহেলা আর অযত্নে একটা ফুলের বাগানও মরুভূমি হতে সময় লাগে না। একটু ভেবে দেখো তো ইরফান বিয়ের পর তুমি আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কতটুকু যত্নশীল ছিলে। আমি জানি প্রেমিক আর স্বামী এক হয় না। প্রেমিকের কাঁধে দ্বায়িত্ব থাকে না কিন্তু স্বামীর কাঁধে থাকে সংসারের দ্বায়িত্ব। কিন্তু অফিস পৌঁছে একটা ফোন দিয়ে বলাই যায় আমি পৌঁছে গেছি তুমি চিন্তা করো না। কিংবা লাঞ্চের সময় দু’টো মিনিট ব্যয় করে বলা যায় তুমি খেয়েছো কিনা। তুমি নিজে তো এসব করতেই না আমি করলে বিরক্তি প্রকাশ করতে। সপ্তাহে একদিন কিংবা মাসে একদিন একটু সময় করে বেলকনি কিংবা ছাদে বসে আমার সাথে দু’টো কথা বলতেই পারতে। মা যখন আমাকে কথা শুনাতো তুমি মাকে কিছু না বললেও, একান্তে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে বলতেই পারতে মায়ের কথায় কিছু মনে করো না, আমি তো আছি। ইরফান সম্পর্ক সুন্দর রাখতে অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় না। এই ছোট ছোট কেয়ার গুলো অনেক। যেটা তুমি কখনো করো নি। ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকতেও দিনের পর দিন আমি একাকিত্বে ভুগেছি। মনে হতো কেউ নেই আমার পাশে।
তামান্নার গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে গেলো। ইরফান বুঝতে পারলো দোষ শুধু তার মায়ের ছিলো না। সেও অনেকটা দ্বায়ী তাদের সম্পর্কের এই পরিণতির জন্য ইরফান হুট করে জড়িয়ে ধরলো তামান্নাকে।
ভেজা গলায় বললো, “আ’ম সরি। আমি বুঝতেই পারিনি তোমাকে এতটা কষ্ট দিয়েছি। ক্যারিয়ারের প্রতি এতটা ফোকাস করেছি যে, তোমাকে অবহেলা করে ফেলেছি। মাফ করে দাও আমাকে।
তামান্না ইরফানকে জড়িয়ে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। এতদিনের জমা অভিমান একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে।
১৬.
লিজার ফোনে ম্যাসেজের শব্দ হতেই সে ফোনটা হাতে নিলো। কেবলই একটু ঘুমঘুম লাগছিল। চোখ কচলে ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো ফারহানের ম্যাসেজ। ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে উঠলো লিজার। কিন্তু ম্যাসেজ ওপেন করে সেই হাসি স্থায়ী হলো না।
“লিজা তুই বলেছিলি না আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি অস্বীকার করেছিলাম, সেটা মিথ্যা ছিলো। হ্যাঁ আমি একজনকে ভালোবাসি, অনেকটা ভালোবাসি। অনেকগুলো বছর ধরে তাকে ভালোবাসি। তাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা হয়তো ডায়েরি পড়েই বুঝেছিলি।”
এতটুকু পড়েই চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো লিজার। তার ধারণাই তবে ঠিক ছিল। লিজা চোখ মুছে আবার পড়তে লাগলো।
“চারটা বছর ধরে সেই ভালোবাসা ছাই চাপা আগুনের মতো পুড়িয়ে যাচ্ছে আমাকে। সেই অনুভূতি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠলাম না। পারলে আমাকে মাফ করে দিস। আমি জানি এখন তোর কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বিয়েটা হলে সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে। আমি কোনোদিন তোকে ভালোবাসতে পারবো না। এই বিয়েটা হলে অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এভাবে চলে যাচ্ছি, আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। সবাইকে বলিস আমাকে যেনো মাফ করে দেয়। আমি কাকে ভালোবাসি সেটা বলতে পারলাম না। আমি এটাও জানি তাকেও কোনোদিন পাবো কিনা। তবে তাকে পাওয়ার আগে আমি নিজেকে খোঁজে পেতে চাই। মাফ করে দিস আমাকে।”
লিজা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো সেভাবে। কাকে দোষ দিবে সে? ফারহানকে নাকি নিজের ভাগ্যকে। এজন্যই তো সে বিয়েটা করতে চায়নি।
“এভাবে কেনো অপমান করলে ফারহান ভাইয়া? আমি তো চাইনি তোমাদের মাঝে যেতে। তোমরা নিজেরাই আমাকে এসবে টেনে এসেছো। কী প্রয়োজন ছিলো এভাবে অপমান করার?”
সকালে বিয়ে বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধতায় ঘিরে আছে। ঘুমের মেডিসিন খেয়ে সারারাত মরার মতো ঘুমিয়েছে অনু। দিন দুনিয়ার খবর ছিলো না তার। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাড়িটা কেমন চুপচাপ লাগছে তার কাছে। আশেপাশে কাউকে দেখতেও পাচ্ছে না। নিজের রুমে গিয়ে ফোন খুঁজতে লাগলো অনু। গতরাতে ফোনটা কোথায় রেখেছিল মনেই নেই তার। অনেক খোঁজার পর ফোন পেল বেলকনিতে। অন করতেই চমকে উঠলো অনু। ফারহানের নাম্বার থেকে বিশটা মিসকল। ফারহান তো দরকার ছাড়া সামনাসামনি কথাই বলে না আবার ফোন দিবে তাও আবার এতরাতে। হাজারটা চিন্তা ভাবনা নিয়ে অনু কল ব্যাক করলো। কিন্তু এক ভদ্র মহিলা সুন্দর করে গুছিয়ে বললো সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনু একটু চিন্তা ভাবনা করে ওর মায়ের নাম্বারে কল দিলো।
ফোন রিসিভ হতেই বললো, “মা তুমি কোথায়? বাড়িতে কাউকে দেখছি না কেনো?”
“এতক্ষণে তোর হুঁশ ফিরেছে? এতকিছু হয়ে গেছে তোর খবর নেই।”
“কী হয়েছে আর তোমরা সবাই কোথায়? তোমার গলা এমন লাগছে কেনো?”
“আমরা সবাই * হসপিটালে এসেছি?”
অনু অস্থির হয়ে বললো, “হসপিটালে কী করছো? কার কী হয়েছে মা?”
অনুর কথার উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিলো নুরজাহান। অনু বুঝতে পারছে না আবার কার কী হলো? কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বের হলো। লিজার রুম ক্রস করে যাওয়ার সময় দেখলো লিজার রুম ভেতর থেকে লক করা।
নক করে বললো, “লিজা তুই কী ভেতরে?”
কোনো উত্তর না পেয়ে অনু দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে কার কী হলো ভেবে?
চলবে,,,