যেদিন তুমি এসেছিলে – পর্ব 17

0
640

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অসংখ্য উজ্জ্বল জ্যোতির মাঝে থেকেও চারিদিকে ঘোরতর শর্বরী দেখছে অর্ষা। নিকষ কালো আঁধারে যেন পুরো কমিউনিটি সেন্টার ছেঁয়ে আছে। হৈচৈ, কথাবার্তা তার কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মস্তিষ্ক আহরণ করতে পারছে না। অকস্মাৎ জীবন নামের অধ্যায়টি যে এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যাবে, সেটা তো সে কল্পনাতেও ভাবেনি। তার অসাড় মস্তিষ্ক একটু বিশ্রাম চাইছে। একলা থাকার আরজি করছে। তবে অর্ষার এসব মুখ ফুটে বলার অবকাশ নেই।
লম্বা ঘোমটার আড়াল থেকেই সে কিছুটা মাথা উঁচু করে তাকায়। সামনে অনেক মানুষজন থাকলেও তার দৃষ্টি গিয়ে আটকায় গ্যাঞ্জাম পার্টির সদস্যদের দিকে। ওদের অসহায়, করুণ দৃষ্টি অর্ষার ওপরেই যে স্থির ও নিবদ্ধ; তা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয় না তাকে। টুপ করে কয়েক ফোটা অশ্রু তার গাল বেয়ে চিবুকে এসে ঢেকে। হাতের টিস্যু দ্বারা অশ্রু মোছার বৃথা চেষ্টা বেশ কয়েকবার করেছে। লাভ হয়নি। চোখের পানি আজ ফুরাচ্ছে না। বারবার অশ্রুপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার আঁখিদ্বয়। অনাকাঙ্ক্ষিত সবকিছু আনন্দের হয় না। সুখের হয় না। অন্তত অর্ষা তো বাস্তবতা এবং নিজের জীবন দিয়েই সেটাই উপলব্ধি করতে পারছে। তার অবচেতন মন আহিলকে খুঁজছে। ও কেন নেই বিয়েতে?
অর্ষার নানাবিধ ভাবনার মাঝে আফরিন এসে পাশে দাঁড়ায়। একটু ঝুঁকে অর্ষার কানের কাছে বলে,’খিদে পায়নি? খাবে চলো।’
অর্ষার ঠোঁট ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে টের পায় তার কণ্ঠও রোধ হয়ে রয়েছে। সে মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝে দিলো খাবে না।
আফরিন জোর করার সাহস পেল না। মেয়ে হওয়ার সুবাদে অর্ষার জায়গায় সে নিজেকে একবার কল্পনা করেছিল। এমন অপ্রত্যাশিতভাবে যদি তার বিয়ে হতো তাহলে সেও তো মানতে পারত না। তবে সে জানে, তার ভাই কোনো অংশে কম নয়। যেকোনো মেয়েই ভাগ্যবতী হবে তার ভাইকে স্বামী হিসেবে পেলে। কিন্তু তবুও! প্রতিটা মেয়েরই তো বিয়ে নিয়ে আলাদা শখ, স্বপ্ন, ইচ্ছে থাকে। অর্ষারও হয়তো ছিল। অর্ষার চেয়ে তার বেশি কষ্ট লাগছে ভাইয়ের জন্য। পছন্দ করা মানুষটা এভাবে ঠকিয়ে গেল? এই মুহূর্তে তার সব রাগ গিয়ে পড়ছে কেয়ার ওপর!
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে যতটা আনন্দ, নাচ-গান হৈ-হুল্লোড় হওয়ার কথা ছিল ততটা না হলেও কম হয়নি। তবে যেই দুটো মানুষকে ঘিরে এত আয়োজন তারাই শুধু নিরব, নিশ্চুপ থেকে গেছে। বিয়ের আনন্দ নিতে পারেনি। একজন কান্নাকাটি করে হলেও নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে পেরেছে। কিন্তু আহনাফ! সে তো মুখ ফুটে বলা দূরে থাক; কাউকে মনের কষ্টটাই বোঝাতে পারছে না।
আহিল ফুপিকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হয়। তখন ওর কাজিনরা নাচছিল। চারদিকে শুধু গানের শব্দ। একপাশে গ্যাঞ্জাম পার্টিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও সেদিকে যায়। জহির চৌধুরী বোনকে অন্যদিকে নিয়ে যায়।
‘তোদের মুখ এমন ফাটা বেলুনের মতো লাগছে কেন? খেতে দেয়নি নাকি তোদের?’ পাঞ্জাবির কলার পেছনের দিকে টেনে কথাগুলো বলল আহিল। যা গরম পড়েছে!
রেশমি মুখ গোমড়া করে বলল,’খেতে দেবে না কেন? বিয়ের আগেই খেয়েছি আমরা।’
‘তোরা যে পেটুক সেটা আমি জানি। কিন্তু তুই মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন? তোরও বিয়ে হবে। কাঁদিস না। বিয়ের আগেই যে খেয়ে বসে আছিস, এখন কি আমি একা খাব?’
ওরা একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল,’তোকে ছাড়াই বিয়ে হয়ে গেছে তুই জানিস?’
‘হু। আব্বু ফুপিকে ফোন করেছিল। কী সমস্যা নাকি হয়েছে তাই বিয়েটা তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার। পরে ফুপু বলল, সমস্যা নেই। বিয়ে যেন দিয়ে দেয়। পৌঁছে তারপর কী হয়েছে শুনবে। কিন্তু কী সমস্যা হয়েছিল বল তো?’
একটু থেমে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,’বাই দ্য ওয়ে, অর্ষা কোথায়?’
এবার সকলের মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করে। কী বলবে এখন তারা? ওর প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর ওর-ই অনুপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে গেছে?
‘কী হলো? অর্ষা কোথায়?’ সকলের মুখাবয়ব দেখে ফের প্রশ্নটি করল আহিল।
সেসময়ে আফরিন সেখানে এসে উপস্থিত হয়। আহিলের হাত ধরে বলে,’আমার সাথে আয়। কথা আছে।’
‘কোথায় যাব? এখানেই বল।’
‘এখানে অনেক শব্দ। আমার সাথে আয়।’
আহিল বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে আফরিনের সাথে একটু দূরে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে বলে,’বল কী বলবি।’
‘বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে।’
‘সমস্যা কিছু হয়েছে শুনেছি। কিন্তু কী সমস্যা হয়েছে?’
‘কেয়া পালিয়েছে।’
আহিলের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে,’হোয়াট!’
‘হ্যাঁ। কমিউনিটি সেন্টারে আসার কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকেই পালিয়েছে।’
‘তাহলে ভাইয়ের পাশে ঘোমটা দেওয়া মেয়েটা কে?’
আফরিন ভয়ে ভয়ে বলল,’অর্ষা।’
আহিল বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বোনের দিকে। বিশ্বাস হচ্ছে না। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে,’তোরা কি আমার সাথে প্রাঙ্ক করছিস?’
আফরিন হতাশ হয়ে আহিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিমর্ষ হয়ে বলে,’না, সোনা।’
‘ধুর! মজাই করছিস তোরা। অর্ষা কখনো আমাদের গ্যাঞ্জাম পার্টির কাউকে ছাড়া বিয়ে করবে না। আর আমার অনুপস্থিতিতে ও বিয়ে করবে? অসম্ভব! প্রাঙ্ক করবি বলেই কেয়া আপু অতো বড়ো ঘোমটা দিয়ে রেখেছে তাই না? দাঁড়া, তোদের মজা আমি বের করছি।’ বলে আহিল স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়।
আহনাফের গম্ভীর মুখ দেখেও সে কিছু আন্দাজ করতে পারছে না। ভাইও কি এই প্রাঙ্কের সাথে শামিল?
আহিল সরাসরি বলল,’এই কেয়া আপু, থুক্কু ভাবি! ঘোমটা সরাও।’
ঘোমটার আড়াল থেকেই আহিলকে দেখে অর্ষার কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়। আহিল বলে,’আর ঢং করতে হবে না। ঘোমটা সরাও বলছি। এখন কিন্তু আমি শুধু সম্পর্কে তোমার বেয়াই না হুহ! দেবরও লাগি। ঘোমটা উঠাবে নাকি আমিই সরাব?’
অর্ষা যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। কিছুটা দূরে আহিলের বাবা-মা, কুসুম আর রুহুল আমিন অপ্রস্তুতভাবে এদিকেই তাকিয়ে ছিল। সকলকে এমন দেখে আহিলের মনেও এবার একটু কু ডাকা শুরু করে। সে ডানপাশে আফরিনের দিকে একটু তাকায়। এরপর চট করে এক টানে অর্ষার ঘোমটা সরায়। নতজানু হয়ে বসে থাকা ক্রন্দনরত অর্ষাকে দেখে তার হাত-পায়ের সঙ্গে দৃষ্টিও যেন অসাড় হয়ে যায় সাথে সাথে। জ্ঞানশূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে পলকহীন। এখনো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। অর্ষা না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলল?
সে কোনোরকম সিনক্রিয়েট করল না। ঘোমটা যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখল। সকলকে অবাক করে দিয়ে হাসল সে। আফরিনকে বলল,’আপু ক্ষুধা লাগছে আমার।’
আহনাফ যেমন নির্বিকার ছিল তেমনই রইল। আহিলের দিকেও তাকাল না একবার। শুধু অর্ষাই অবাক হয়ে ঘোমটার আড়ালে তাকিয়ে রইল। আহিল এত স্বাভাবিক কেন? তাহলে কি আহিলও জানত কেয়ার বদলে অর্ষার সাথে বিয়ে হচ্ছে? জেনেও আহিল ও’কে সাপোর্ট করল না!
আহিলের কথা শুনে আফরিন বিস্মিত হলেও বিচলিত হলো না। ও’কে নিয়ে যাওয়ার সময় গ্যাঞ্জাম পার্টিকেও ডেকে নিল। একটা অদ্ভুত বিষয়ও আফরিন খেয়াল করল। সেটা হলো, মানুষজনের আড়ালে যাওয়ার পর বন্ধু কিংবা আফরিন কারও সাথেই কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ খাচ্ছে শুধু।
খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় শুধু সকলের উদ্দেশ্যে বলল,’এটলিস্ট কল করে তোরা আমায় খবরটা জানাতে পারতি!’
সকলে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। সবকিছু চোখের পলকেই এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, আহিল যে বিয়েতে উপস্থিত নেই এটাই কারও মস্তিষ্কে হানা দেয়নি তখন।
বিদায়বেলায় অর্ষার ভাই কিংবা ভাবির জন্য একটুও দুঃখ লাগেনি। শুধু তিয়াস আর কেয়ার জন্যই তার কষ্ট হয়েছে। কেয়ার ওপরও রয়েছে তার চাপা অভিমান। এভাবে না পালালেই কি হতো না? রুহুল আমিন এবং কুসুম অবশ্য অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে একটু কান্নার অভিনয় করল। অর্ষা তিয়াসকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ কান্না করেছে। যখন গাড়িতে উঠছিল তখন তিয়াসও প্রচুর কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
কেঁদে কেঁদে বারবার বলছিল,’ফুপি তোতায় দায়? আমি ফুপি দাব। আমি ফুপিল কাছে দাব।’
কুসুম অনেক চেষ্টা করেও ওর কান্না থামাতে পারে না। গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে গাড়ির কাছে এসে বলল,’কাঁদিস না পাখি। আমরা কাল সকালেই তোর কাছে যাব। আর যা হয়েছে মেনে নে। তুই সুখী হবি ইন-শা-আল্লাহ্।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারেনি। শুধু অঝোর ধারায় মাথা নত করে কেঁদেছিল। বাড়িতে পৌঁছে আহনাফ আর কোথাও দাঁড়াল না। অর্ষাকে রেখেই নিজের রুমে চলে গেল। নিয়ম রক্ষার জন্য হলেও অর্ষাকে থেকে যেতে হলো। কত মানুষজন এসেছে অর্ষাকে দেখতে। অর্ষার মানসিক অবস্থা জহির চৌধুরী, আমেনা বেগম, আফরিন ওরা সবাই-ই বুঝতে পারছে। তাই জহির চৌধুরী স্ত্রীকে আড়ালে দূরে ডেকে নিয়ে বললেন,
‘অর্ষাকে ঘরে পাঠিয়ে দাও। অনেক ধকল গেছে মেয়েটার ওপর। মানসিক অবস্থাও ভালো না। এত ভিড়ের মধ্যে থাকলে আরও খারাপ লাগবে। ভিড় কমাও। যারা এসেছে মিষ্টি খাইয়ে পাঠিয়ে দাও। কাল এসে যেন বউ দেখে যায়।’
আমেনা বেগমও তাই করলেন। আফরিন গেল আহিলের রুমে। খাওয়া শেষ করেই আহিল চলে এসেছিল। রুমের দরজাও লক করা।
আফরিন দরজায় নক করে বলে,’আহিল দরজা খোল।’
ওপাশ থেকে দরজা না খুলেই আহিল জানতে চায়,’কী দরকার?’
‘অর্ষাকে নিয়ে এসেছি। তুই আসবি না?’
‘বিয়ে যখন আমাকে ছাড়াই হয়েছে। তখন আমায় ছাড়াই বাকি কাজ হয়ে যাবে। তুই যা এখান থেকে। বিরক্ত করিস না।’
‘আমাদের ভুল বুঝিস না ভাই। পরিস্থিতিটাই অন্যরকম ছিল। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! কারোর-ই মাথা কাজ করেনি তখন।’
‘আপু তুই যাবি? আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাব আমি।’
আহিলকে বোঝাতে এলেও আর কথা বাড়াতে পারল না আফরিন। মেজাজ খারাপের সময় কিছু বললে তখন হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। এরচেয়ে ভালো মাথা ঠাণ্ডা হোক আগে।
.
অর্ষার পরনে আহনাফের দেওয়া সেই সবুজ শাড়িটা। কিছুক্ষণ আগেই ভারী লেহেঙ্গা পালটে এই শাড়িটা পরেছে। সে অবশ্য ইচ্ছে করে শাড়িটা পরেনি। আফরিন পরিয়ে দিয়েছিল বলেই মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সত্যি বলতে তার কথা বলার মতো মন-মানসিকতা এতটুকুও অবশিষ্ট নেই আপাতত। তবে সে এতটুকু তো বুঝতেই পেরেছে, কেন এত শাড়ি থাকতে আফরিন ও’কে এই শাড়িটাই পরাল! কারণ শাড়িটা আহনাফের পছন্দ ছিল।
দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। আফরিন আর কয়েকজন মেয়ে ও’কে জোর-জবরদস্তি করে এই ঘরে পাঠিয়ে দিলো। আহনাফ ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অর্ষার ইচ্ছে করছে এক দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? আর থাকবেই বা কীভাবে এখানে? একটা ছেলের সাথে এক রুমে থাকবে, হোক ছেলেটি তার স্বামী! একসাথে থাকতে হলে যেই মানসিক প্রিপারেশন একটা মেয়ের প্রয়োজন হয় সেটা তো তার নেই। তবে?
একবার ভেবেছিল আমেনা বেগমকে অনুরোধ করে বলবে যেন, ও’কে আফরিনের রুমে থাকতে দেয়। এর পূর্বেই আমেনা বেগম অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটান। অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,
‘মা, আমি জানি তোমার সাথে হয়তো কাজটা অন্যায় হয়ে গেছে। তুমি হয়তো বিয়েতে রাজি ছিলে না। কিন্তু আল্লাহকে তো তুমি বিশ্বাস করো বলো? আল্লাহর ওপর নিশ্চয়ই তোমার বিশ্বাস, ভরসা রয়েছে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটাই যে শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে আছে এটা তো আমাদের অজানা কিছু নয়। নয়তো তুমিই বলো, সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর কেয়া কেন পালাবে? আল্লাহ তোমার সাথে আহনাফের জুটি লিখে রেখেছিলেন বলেই যেভাবে হোক বিয়েটা তোমার সাথে হয়ে গেছে। আমার ছেলেটা খারাপ নয় মা। ও’কে তুমি গুছিয়ে নিও। একটু সামলে নিও। সম্পর্কটাকে সময় দিও মা। বড্ড চাপা স্বভাবের আমার ছেলেটা!’
এতকিছু শোনার পর অর্ষার আসলে তখন বলার মতো কিছু ছিল না। আর না ছিল প্রতিবাদ করার মতো কিছু। কী নিয়েই বা প্রতিবাদ করবে? তিনি তো কোনো কথাই মিথ্যা বলেননি।
অর্ষার বুকচিরে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে আশেপাশে তাকিয়ে পুরো রুমটা দেখে। রুমের মাঝখানে খাট। বামপাশে ওয়ারড্রব। ওয়ারড্রবের পাশেই ব্যালকোনিতে যাওয়ার দরজা। দরজার সাইডে জুতা রাখার র‍্যাক। সেখানে বিভিন্ন মডেলের জুতা রাখা। খাটের ডানপাশে টি-টেবিল আর এক সিটের একটা সোফা। তার পাশে ড্রেসিংটেবিল। ঘরের দরজার পাশ দিয়ে রাখা আলমারি। এর আগেও সে অনেকবার এই ঘরে এসেছে। কিন্তু কে জানত একদিন বউ হিসেবেই সে এই ঘরে আসবে?
সে কী করবে বুঝতে না পেরে রুমের ভেতর পায়চারি করা শুরু করে। তার পায়ে যে নূপুর ছিল সেই খেয়াল নেই। এত ধকলের মাঝে কি আর এসব খেয়াল থাকে? নূপুরের ঝুমঝুম আওয়াজে আহনাফের তন্দ্রা ভাব কেটে যায়। সে ঘাড় বাঁকিয়ে এদিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অর্ষার সাথে এর আগে সে অনেক কথাই তো বলেছে। কিন্তু আজ প্রথম তাকে অর্ষার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভাবতে হচ্ছে যে কী বলবে! নিয়তি মানুষকে কোথায় এনে ঠেকায় ভাবতেই ওষ্ঠে তাচ্ছিল্য হাসিটা ফুটে ওঠে। শ্লেষ, তাচ্ছিল্য ভাগ্যের প্রতি নাকি নিজের প্রতি সেটা বোঝাও বড্ড দায়।
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,’এভাবে হাঁটছ কেন?’
আকস্মিক আহনাফের কণ্ঠে শুনে অর্ষা একটু চমকে যায়। পায়চারি বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমতা আমতা করে বলল,’না, মানে এমনি।’
‘শুয়ে পড়ো।’
অর্ষা ইতস্ততভাবে বলল,’কোথায় শোব?’
‘আমার রুমে একটাই খাট। আমি যতটুকু জানি সবাই খাটেই ঘুমায়। তোমার এখানে থাকতে আপত্তি হলে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাও।’
অর্ষা নির্বোধের মতো বলল,’অন্য রুমে কেউ থাকতে দিলো না। এখানেই দিয়ে গেল।’
আহনাফ এবার আর দীর্ঘশ্বাস গোপন রাখতে পারল না। তার মন-মেজাজ ভালো নেই। তবুও সে চাইছে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে। কেননা এখানে তো অর্ষার কোনো দোষ নেই। তবে এ কথাও সত্য, অর্ষাকে দেখলেই কেয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’অর্ষা শোনো, আমি অনেক মুভি-সিনেমা দেখেছি। অনেক গল্প এবং উপন্যাসের বইও পড়েছি। তাই আমি জানি, তুমি কী ভাবছ। আমার যতটুকু ধারণা তুমিও অল্প হলেও মুভি দেখেছ, গল্প-উপন্যাসের বই পড়েছ। সেই মোতাবেক আমার ধারণা যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে তুমি চাইছ ফ্লোরে কেউ ঘুমাবে নয়তো সোফায়। তবে দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমি এর কোনোটাই পারব না। এতটুকু সোফায় যেমন আমি শুতে পারব না, তেমনই ফ্লোরে ঘুমানোর অভ্যেস আমার নেই। দুঃখিত এজন্যই যে, আমি কোনো সেক্রিফাইজ করতে পারলাম না। খাটটা যথেষ্ট বড়ো আছে। চারজন মানুষ অনায়াসে শোয়া যায়। তোমার আপত্তি হবে না। এতটুকু বিশ্বাস রাখো, ঘুমের মধ্যে কারও গায়ে হাত-পা দেওয়ার স্বভাব আমার নেই।’
মনের কথাগুলো আহনাফ বুঝে ফেলেছে জেনে অর্ষা লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। কিন্তু সে কীভাবেই বা আহনাফের সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে? যে ছেলের কেয়ার স্বামী হওয়ার কথা ছিল; সে-ই ছেলে এখন তার স্বামী!
অর্ষা বিমর্ষ হয়ে বলল,’আপনি অনেক রেগে আছেন তাই না? জানি, আপনি কেয়া আপুকে অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু আমি কী করতে পারতাম বলুন? আমার সত্যিই কিছু করার ছিল না। বিশ্বাস করুন, আমিও চাইনি বিয়েটা করতে।’
আহনাফ এতক্ষণ যেই রাগ, জেদটুকু নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টা করছিল, এবার আর কেয়ার নাম শুনে সেটা পারল না। সে অর্ষাকে ধমক দিয়ে বলল,’ঐ মেয়ের নাম নেবে না মুখে! আর কখনো যেন আমি ওর নাম না শুনি। ভালোবাসা এত সহজ?’
অর্ষা চমকে যায়। মুহূর্তেই কাজলটানা নেত্রে অশ্রু জমা হয়। ছলছল দৃষ্টিতে সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,’আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?’
‘এরচেয়ে ভালো ব্যবহার তোমরা ডিজার্ভ করো না। বিরক্ত লাগছে আমার! সত্যিই আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
পরক্ষণে অশ্রুতে টইটুম্বুর অর্ষার চোখজোড়া দেখে আহনাফ রাগ দমন করার চেষ্টা করে।
সে শীতলকণ্ঠে বলল,’তোমার একটু ভুল হচ্ছে। ভালোবাসতাম না। ভালো লাগতো। ভালোবাসা এত সহজ নয়।’
অর্ষা জড়ানো কণ্ঠে বলল,’তাহলে আপনি আমার সাথে কেন এমন ব্যবহার করছেন?’
‘কারণ তোমাকে দেখলেই আমার কেয়ার কথা বেশি বেশি মনে হয়। যেটা আমি সহ্য করতে পারি না।’
অর্ষা কান্না করে ফেলে। দু’হাতে চোখের ও গালে লেপ্টে থাকা অশ্রু মুছে বলল,’দুঃখিত। আপনি ঘুমান।’
‘লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম আসে না।’
অর্ষা গিয়ে লাইট বন্ধ করে সোফায় বসল। আহনাফও কিছু বলল না। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ ঘুটেঘুটে আঁধার রুমটিতে বসে রইল। অর্ষা যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সেটা নিস্তব্ধ রুমে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। আহনাফেরই বা কী করার? সেও তো পরিস্থিতির শিকার। অন্ধকারে এক সময় দুজনেরই চোখ সয়ে আছে। দুজন দুজনকে দেখতে না পেলেও অবয়ব ঠিক বুঝতে পারছে। বারবার অর্ষাকে খাটে শুতে বলাতেও আহনাফের স্বভাববিরুদ্ধ এবং ইগোতে লাগছে। এছাড়া অর্ষাও বিষয়টা খারাপভাবে নিতে পারে। তারচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা হচ্ছে আহনাফ চায়, অর্ষা তার থেকে দূরে থাকুক। ততটাই দূরে থাকুক, যতটা দূরে থাকলে তার কেয়ার কথা মনে পড়বে না। কেয়ার করা অপমানের কথা মনে পড়বে না। কেয়ার কথা মনে আসতেই রাগে, জিদ্দে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বালিশে মাথা রেখে চুপচাপ রাগ নিয়ে শুয়ে থাকে সে। অপরদিকে সোফাতে পা তুলে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকে অর্ষা। অর্ধেক রাত্রি কাটে হাঁটুতে মাথা ভর দিয়েই। শেষ সময়ে সে ঐভাবেই সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। ভাগ্য, সময়, পরিস্থিতি কতদিন দুজনকে একসাথে রাখতে পারবে অথবা কতদূর নিয়ে যেতে পারবে তা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে থাকা মানব-মানবীর কেউই জানে না।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here