যেদিন তুমি এসেছিলে – পর্ব 4+5+6

0
717

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৪+৫+৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
‘আপনি কি মানুষ? মানুষ হয়ে কোনো মানুষকে কেউ এমনভাবে অত্যাচার করতে পারে?’ আহনাফ রেগে কথাগুলো বলল কুসুমের উদ্দশ্যে।
কুসুম এতক্ষণ কেয়ার সাথে ধস্তাধস্তি করছিল। আহনাফের কথা শুনে সে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,’আপনি কে? আপনার সাহস হয় কীভাবে আমার বাসায় এসে আমাকে কথা শোনানোর?’
‘আমার সাহস সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই। আমি যে আর কী কী করতে পারি আর পারব সেটাও আপনি কল্পনা করতে পারবেন না।’
‘হুমকি দিচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, দিচ্ছি।’
কেয়া এবার আহনাফের কাছে এসে বলে,’প্লিজ! এখানে অযথা তর্ক করে সময় নষ্ট করবেন না। ও’কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলুন।’
আহনাফও তাই করল। অর্ষাকে পাঁজাকোলা করে গাড়ির কাছে যায়। কেয়া যাওয়ার পূর্বেই কুসুম ওর হাত খপ করে ধরে ফেলে বলে,’এই অসভ্য ছেলেটা কে? ওর সাথে তোর কীসের সম্পর্ক?’
কেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,’না জেনে কোনো কথা বলো না তো আপু। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। হাত ছাড়ো।’
কুসুম হাত ছাড়ে না। চোখ রাঙিয়ে বলে,’তুই এক পা-ও বাড়ির বাইরে যাবি না। চুপচাপ ঘরে যা।’
‘তোমার মধ্যে মনুষ্যত্ব না-ই থাকতে পারে আপু। কিন্তু আমার মধ্যে আছে।’ বলে জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কেয়াও গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
এমনিতে কোনো ফার্মেসিতে না নিয়ে অর্ষাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় আহনাফ। এখানে ওর পরিচিত ডাক্তার রয়েছে। অর্ষাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে সে নার্সকে বলে,’ওর গায়ের জামা-কাপড় ভেজা। জামা-কাপড়গুলো পাল্টে হাসপাতালের পোশাক পরিয়ে দিন।’
‘জি, আচ্ছা।’ বলল নার্স।
আহনাফ গেল ডাক্তারের কাছে আর কেয়া বাইরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে অর্ষাকে দেখে যায়। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। আহনাফকে সে জানিয়েছে,’সমস্যা না থাকলে, আজ রাতটা যেন অর্ষাকে হাসপাতালেই রাখে। রাতে জ্বর আবার বাড়তে পারে।’
আহনাফ কেয়ার সাথে কথা বলে রাজি হয়েছে।
.
অর্ষার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, এলোমেলো। তার মনে হচ্ছে এখনো ভাবি তাকে প্রহার করছে। ঠিক কী কী হয়েছিল সমস্ত ঘটনা সে জ্বরের ঘোরে পূণরায় স্মরণ করে।
রেডি হয়ে আহিলের সঙ্গে বের হয়েছিল অর্ষা। আহিলের মন তখনো খারাপ। সে অর্ষাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। আহিলকে এভাবে চুপচাপ দেখে অর্ষা হেসে বলে,’ব্রেকাপ হলেও তো কেউ এমন করে না রে!’
আহিল এক পলক অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলে,’তুই আমার কষ্ট বুঝবি না। আপুকে ছাড়া বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।’
‘তাহলে আপুর কাছে যা। কয়েকদিন বেড়িয়ে আয়।’
‘পরীক্ষার পর যাব। আর শোন, স্যরি দোস্ত।’
অর্ষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’স্যরি কেন?’
‘কালকে কথা দিয়েও তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারিনি।’
‘ধুর! প্যারা নিস না।’
‘তুই ঠিকমতো বাড়িতে যেতে পেরেছিলি তো?’
‘বেঠিকভাবে গেলে কি এখন তোর সামনে বসে থাকতে পারতাম?’
আহিল হেসে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,’এখন কী খাবি বল?’
‘কিছু খাব না।’
‘বললেই হলো? চোখমুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। খাবার অর্ডার দিচ্ছি চুপচাপ খাবি।’
খাবার অর্ডার দিয়ে আহিল বলে,’তুই আজ সকালে আমায় ডাকতে যাসনি কেন?’
‘গেছিলাম। তুই ঘুমিয়েছিলি তাই আর ডাকিনি।’
‘তাহলে কি তুইও কলেজে যাসনি?’
‘গেছিলাম তো!’
‘টাকা পেলি কোথায়?’
‘তোর ভাইয়া দিয়ে এসেছে।’
আহিল অবাক হয়ে বলে,’সত্যিই? বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
‘কেন? উনি মানুষটা ভালো।’
আহিল ভাব নিয়ে বলে,’ভাইটা কার দেখতে হবে তো!’
‘ঢং।’
দুজনে খেতে খেতে আরো অনেক গল্প করে। গতকাল রাত থেকে আহিলের যেই পরিমাণ মন খারাপ, কষ্টটা ছিল তা এখন ভ্যানিশ হয়ে গেছে। অর্ষার সাথে থাকলে তার প্রতিটা মুহূর্ত ভালো কাটে। নিজেকে সুখী সুখী মনে হয়। ভাগ্যিস অর্ষাকে সে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিল! খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অর্ষাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আহিল নিজের বাসায় চলে যায়। অর্ষার আগেই কুসুম বাড়িতে চলে এসেছে। অর্ষা ভেবেছিল ভাবির ফিরতে বোধ হয় রাত হবে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই ভাবি ফিরে এসেছে।
বাইরে তখন ভীষণ মেঘ। তারচেয়েও অন্ধকার দেখাচ্ছিল ভাবির মুখ। সে শীতলকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’কোথায় গিয়েছিলি?’
অর্ষা ভয়ে ভয়ে বলে,’একটু বাইরে গেছিলাম।’
ভাবি বসা থেকে উঠে আসে। চোখের পলকে চড় বসায় অর্ষার গালে। হিরহির করে টানতে টানতে উঠানে নিয়ে আসে। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড় করিয়ে লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে। দু’বছরের তিয়াস কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। মায়ের আঁচল ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,’ফুপিতে মেলো না মা! ফুপি ব্যতা পাবে। ফুপি কষ্ত পাত্তে।’
তিয়াসের কথাও যেন কুসুমের কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছাল না। তিয়াসকে তার নজরে এলো তখন, যখন ছোট্ট তিয়াসও বৃষ্টির মধ্যে উঠানে নেমে অর্ষার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। কুসুমের রাগ বেড়ে যায়। তিয়াসকে কোলে নিয়ে ঘরে আটকে রেখে আবারও এসে অর্ষাকে মারতে শুরু করে আর বলে,’তোকে বলেছিলাম রান্না করতে। তুই রান্না না করে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াস। এখন আমি খাব কী বল? আর কত জ্বালাবি তুই আমায়?’
ভাবির কথা অর্ষার কানে যাচ্ছিল না। তার কানে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দের সঙ্গে তিয়াসের চিৎকার করা কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। সে অনুনয় বিনয় করে ভাবিকে বলেছিল,’তিয়াসকে আগে থামাও ভাবি! ও একা ঘরে ভয় পাচ্ছে।’
কুসুমের নির্যাতন কমে না। সে কাঠ কাঠ গলায় বলে,’আমার ছেলেকে নিয়ে তোর এত ভাবতে হবে না অলক্ষী কোথাকার!’
তিয়াসের কান্নার শব্দ ফের শুনেই অর্ষার চেতনা ফিরে আসে। সে চিৎকার করে ওঠে। মাথা ব্যথায় যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। নার্স ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’উঠবেন না। শুয়ে থাকুন।’
ধীরে ধীরে অর্ষা পূণরায় ঘুমে তলিয়ে যায়।
______
হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দিয়ে আহনাফ কেয়ার পাশে এসে দূরত্ব বজায় রেখে বসে। কেয়া তখন কপালের ওপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ছিল। আহনাফ কেঁশে গলা পরিষ্কার করে বলল,’শুনছেন?’
কেয়া চমকে তাকায়। তার চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। জড়ানো গলায় বলল,’হ্যাঁ, বলুন।’
‘আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঘুম পেয়েছে?’
‘না। চোখ লেগে এসেছিল একটু।’
‘কফি খাবেন?’
‘খাওয়া যায়।’
আহনাফ আর কেয়া কেন্টিনে যায়। দুজনে কফি নিয়ে বসে। কফিতে চুমুক দিয়ে আহনাফ জিজ্ঞেস করে,’অর্ষা আপনার কী হয়?’
‘সম্পর্কে আমরা বেয়াইন হই। মানে আপুর ননোদ অর্ষা।’
‘মেয়েটা কি পাগল? মাথায় কোনো সমস্যা আছে?’ সে অর্ষাকে যেমন ভাবে তেমনটাই বলল কেয়াকে। লুকোচুরি স্বভাব তার পছন্দ নয়। তাছাড়া মেয়েটাকে নিয়ে অজান্তেই মনে অনেক কৌতুহলের দানা তৈরি হয়েছে।
কেয়া একটু অবাক হয়। বিস্মিতকণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’এ কথা বলছেন কেন?’
‘সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হলে তো এভাবে এত কঠিন মাইর হজম করার কথা না। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছিল। ও তো চাইলে সরে যেতে পারত। প্রতিবাদ করতে পারত। তা না করে চুপচাপ মার খাচ্ছিল! এত বোকা কেন এই মেয়ে?’
কেয়া হতাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’অর্ষা পাগল নয়। সুস্থ-ই। তবে অনেকটা সহজ-সরল। মার না খেয়ে কোথায় যাবে বলেন? দিনশেষে তো বাড়িতেই ফিরতে হবে। আপু ছেড়ে দেবে তখন ও’কে? ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে বকা, মাইর খাবারের মতোই ডেইলি রুটিন হয়ে গেছে ওর। কখনো তো তিনবেলা খাওয়া’ও ঠিকমতো হয় না; তবে নিয়ম করে প্রতিদিন বকা, মাইর খেতেই হয়। এই তিক্ত সত্য আর রুটিন যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকে চুপচাপই মার খায় আর নিরবে কাঁদে।’
আহনাফের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বাবা-মা যে সন্তানের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা সে উপলব্ধি করতে পারছে। যার বাবা-মা নেই সে-ই বোঝে বাস্তবতার আড়ালে চাপা পড়ে কীভাবে পিষ্ট হতে হয় প্রতিনিয়ত! অর্ষার জায়গায় আফরিনের কথা ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে ওঠে তার। অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। অর্ষার প্রতি থাকা তার ভুল মনোভাবও বদলায়।
নিজেকে স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করে,’ওর ভাই কিছু বলে না?’
কেয়া তাচ্ছিল্য করে হাসে। শ্লেষেরসুরে বলে,’কী বলবে? দুলাভাই নিজেও তো মারধোর করে। বউয়ের কথায় চলে।’
‘কিছু মনে করবেন না একটা কথা বলি। ওরা আপন ভাই-বোন তো?’
‘হ্যাঁ।’
আহনাফ এবার অবাক না হয়ে পারল না। আপন ভাই হয়েও এমন আচরণ? এত পরিবর্তন বাবা-মা না থাকায়?
দুজনের কথার মাঝে কেয়ার ফোনটা বেজে ওঠে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে কুসুম ফোন করেছে। তাই সে ফোন রিসিভ করে না।
আহনাফ অনধিকার চর্চার বশে জিজ্ঞেস করেই বসল,’কে ফোন করেছে?’
‘আপু।’
‘রিসিভ করুন।’
‘রিসিভ করলেই বাড়িতে যেতে বলবে।’
‘তবুও দেখুন কী বলে।’
প্রথম কল কেটে যাওয়ার পর দ্বিতীয় কল রিসিভ করে কেয়া। কুসুম বলে,’তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। তুই এখনই বাসায় আসবি।’
‘পরে আসব।’
‘আমি এখনই আসতে বলেছি কেয়া।’
কেয়া রাগে ফোন কেটে দিলো। আহনাফ বলল,’আপনি বরং বাড়ি চলে যান।’
‘অসম্ভব। অর্ষাকে রেখে আমি যাব না।’
‘আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি ক্লান্ত। চোখে অজস্র ঘুম। আপনার বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। অর্ষার জন্য নার্স আছে। আর প্রয়োজনে আমি থাকব। আপনি বাসায় যান।’
কেয়া প্রথম প্রথম বারণ করলেও পরবর্তীতে আহনাফের জোড়াজুড়ির কাছে হার মানে। সত্যি বলতে সে আসলেই অনেক ক্লান্ত। ঘুমের জন্য চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতেও সমস্যা আর কষ্ট হচ্ছিল।
আহনাফ বলল,’বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব?’
‘না। বৃষ্টি তো নেই। একাই যেতে পারব। আপনি কিন্তু প্লিজ রাতে হাসপাতালেই থাকবেন। আর কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই আমায় ফোন করবেন।’
‘অবশ্যই। আপনি চিন্তা করবেন না।’
অর্ষাকে একবার দেখে কেয়া বাড়িতে ফিরে আসে গম্ভীরমুখে। বোনের দিকে ফিরেও তাকায় না। এতে অবশ্য কুসুমের কিছুই যায় আসে না। সে কেয়াকে শাসিয়ে বলল,’তোর দুলাভাই বাসায় আসলে ও’কে কিছু বলবি না। অর্ষার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।’
কেয়া ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়। কুসুম সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে কঠোর হয়ে বলে,’যা বললাম তা যেন মনে থাকে।’
_____
কেয়া চলে যাওয়ার পর আহনাফ ভাবে কী করবে। কেবিনে যাবে নাকি বাইরে বসে থাকবে। তার আগে পরনের ভেজা জামা-কাপড়গুলো বদলানো দরকার। গাড়িতে এক্সট্রা টি-শার্ট আর ট্রাউজার থাকার কথা। থাকলে তো ভালোই। নতুবা সারা রাত এই ভেজা কাপড়েই থাকতে হবে। সে গাড়িতে খুঁজে টি-শার্ট আর ট্রাউজার পেয়ে যায়। ভাগ্য ভালো ছিল বলা যায়। গাড়িতে বসেই জামা-কাপড় পাল্টে আবার ফিরে আসে। ওয়েটিংরুমে বসে ফেসবুকে নিউজফিড স্ক্রল করে চুপচাপ।
বেশ কিছুক্ষণ ওয়েটিং রুমে বসে থেকে এবার সে কেবিনে যায়। অর্ষা ঘুমিয়ে রয়েছে। নার্স নেই এখন। সে একা একা কী করবে বুঝতে পারছে না। পরক্ষণে মনে হলো ছোটো থেকে বই পড়ুয়া হওয়ার সুবাদে গাড়িতেও সে বই রাখে। আজ রাতটা না হয় বই পড়েই কাটিয়ে দেবে। সে বাইরে যায় বই আনতে। তখন আমেনা বেগমের ফোন আসে। সে গাড়ি থেকে বই নিয়ে ফেরার পথে মাকে কলব্যাক করে।
আমেনা বেগম অস্থির হয়ে বলেন,’কত রাত হয়ে গেছে বাবু। তুই বাড়ি ফিরবি কখন?’
আজ অস্বস্তি ফিল করার বদলে হাসল আহনাফ। বলল,’আজ বাড়িতে ফিরব না মা।’
‘কেন? কোথায় আছিস তুই?’
সে মাকে সত্যিটা বলল না। হাসপাতালে আছে বললে হাজারটা প্রশ্ন করবে। তাই বলল,’এক বন্ধুর বাসায়।’
‘হঠাৎ তোর বন্ধুর বাসায় কী? আগে তো বলিসনি।’
‘আগে ভাবিনি যে রাতে থাকব।’
‘এটা কেমন কথা? তুই বললি আফরিনের জন্য কসমেটিক্স কিনতে যাবি। এখন বলছিস বন্ধুর বাসায়। ঘটনা কী? বাবু সত্যি করে বল না, তুই লুকিয়ে প্রেম করছিস?’
আহনাফ শব্দ করে হেসে বলে,’তুমি পাগল হয়ে গেছ মা। তোমাকে না বললাম, এখন আর আমার প্রেম করার বয়স নেই। কাল সকালে আফরিনকে কসমেটিক্সগুলো দিয়ে তারপর বাড়িতে ফিরব। তুমি খেয়ে নিও। রাখছি এখন আমি।’
কেবিনের সামনে এসে কল কাটে আহনাফ। ভেতরে এসে দেখে অর্ষা ঘুমের ঘোরে কাঁদছে আর আবোল-তাবোল কিছু বলছে। সে ফোন পকেটে রেখে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যায়। অর্ষার মুখের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করে কী বলছে। তবে কথাগুলো জড়ানো এবং অস্পষ্ট হওয়ায় সে কিছুই বুঝতে পারে না। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর আরো বেড়েছে। ডাক্তারকে খবর দিয়ে আনে তখন। ডাক্তার নার্সকে বলে ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিতে। আহনাফ এক কিনারে চুপচাপ বসে থাকে। নার্স জোর করে অল্প একটু খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেয়। এরপর অর্ষা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। নার্স চলে যাওয়ার পর চেয়ার নিয়ে অর্ষার মাথার কাছে বসে আহনাফ। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বই পড়ায় মন দেয়।
অর্ষার হাত কাঁপছিল। সে আড়চোখে খেয়াল করে শুধু হাত নয়, শরীরও কাঁপছে। সে অর্ষার বাম হাতটা আলতো করে ধরতেই অর্ষা হাত চেপে ধরে শক্ত করে। আহনাফ নার্সকে ডেকে বলে আরো কম্বল আনিয়ে ওর গায়ে দিয়ে দিতে। নার্স এসে কম্বল দিয়ে যায়। অর্ষার হাতের মুঠোয় তখনো আহনাফের হাত। অর্ষা জ্বরের ঘোরে কাঁদতে কাঁদতে ‘বাবা, মা’ বলে কাঁদছে।
আহনাফের বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মেয়েটার জন্য তার মনে মায়ার সঞ্চার হতে শুরু করে ধীরে ধীরে।
চলবে…
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
কেবিন দো’তলায় হওয়ার সুবাদে এক ফালি রোদ্দুর এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল অর্ষার চোখে-মুখে। সে বন্ধ চোখ কুঁচকে ফেলে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ। শোয়া থেকে উঠে বসে চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে হাসপাতালে রয়েছে। মাথার মধ্যে এখনো ঝিমঝিম করছে। হাতের ওপর লেপ্টে থাকা রোদ্দুর দেখতে গিয়ে দেখতে পায় মারের দাগগুলো। কষ্টের মাঝেও সে হেসে ফেলে।
‘তুমি উঠে গেছ?’ ভেতরে আসতে আসতে বলল আহনাফ।
আহনাফের উপস্থিতি অর্ষাকে বিস্মিত করে। চোখের পলকেই গতকালের দৃশ্যপট চোখের পাতায় ভেসে ওঠে। তবে সকালেও যে লোকটাকে সে এখানে পাবে সেটা আশা করেনি। অথচ অর্ষা জানলই না, লোকটা শুধু সকালেই নয় বরং সারা রাত জেগে হাসপাতালেই ছিল।
সে দৃষ্টি নত করে বলল,’হুম।’
‘শরীর কেমন এখন?’ পাশের চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল আহনাফ।
অর্ষা এবারও ছোটো উত্তরে বলল,’ভালো।’
‘সম্পূর্ণ ভালো নয়। শরীরে জ্বর নেই। তবে শরীর কিন্তু দুর্বল। বাড়িতে ফিরে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। সময়মতো ওষুধও খাবে।’
‘জি আচ্ছা।’
আহনাফ ভালোমতো খেয়াল করে দেখল, অর্ষা তার দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের হাতের দিকে দৃষ্টি রেখে কথা বলছে। কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করছে? নাকি মেয়েটা এমনই? তার চিন্তাচেতনা শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা জিজ্ঞেস করল,’কেয়া আপু কোথায়?’
‘সম্ভবত শো-রুমে। সকালে তোমায় দেখতে এসেছিল।’
‘কয়টা বাজে এখন?’
আহনাফ হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’৯:৪০।’
‘বাড়ি ফিরতে হবে। কলেজে যেতে হবে।’
আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,’একদিন কলেজে না গেলে কিছু হবে না। আজ যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আজকের দিনটা রেস্ট নাও। চাইলে তুমি হাসপাতালেই রেস্ট নিতে পারো। বাড়িতে তো মনে হয় না রেস্ট নেওয়ার সুযোগ হবে।’
অর্ষা উত্তর করল না। চুপ করে রইল। আহনাফ নিজেই জিজ্ঞেস করল,’থাকবে এখানে?’
‘না।’
‘ঠিকাছে। তুমি নিজের জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও। আমি হাসপাতালের বাকি বিল মিটিয়ে আসছি।’
অর্ষা কিছু বলল না। আহনাফও উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরে বেরিয়ে যায়।
_________
৯:২৫ থেকে আহিল বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে। অর্ষার এতক্ষণে চলে আসার কথা। লেট করছে কেন? আর অপেক্ষা না করে সে নিজেই অর্ষার বাড়িতে চলে যায়। তিয়াস বারান্দায় বসে খেলছিল। আহিলকে দেখে সে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেওয়ার জন্য।
আহিল হেসে ও’কে কোলে নেয়। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো চাচ্চু?’
তিয়াস কিছু না বলে আহিলের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। তার মন খারাপ বোঝা যাচ্ছে। আহিল তিয়াসের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,’বাবার মন খারাপ?’
তিয়াস নিরব,নির্বিকার। আহিলের কণ্ঠস্বর শুনে কুসুম ঘর থেকে বের হয়। আহিল মনে মনে প্রচণ্ড রকম ঘৃণা করে কুসুমকে। কুসুম যে বোঝে না তা নয়। আহিলের চোখের দৃষ্টিই বলে দেয় সে কুসুমকে কতটা ঘৃণা করে। শুধুমাত্র অর্ষার জন্যই সে সবসময় কুসুমের সঙ্গে ভদ্রতা দেখিয়ে নম্রভাবে কথা বলে।
আহিল জিজ্ঞেস করে,’অর্ষা কোথায় ভাবি?’
কুসুমের চোখ-মুখ অন্ধকার। সে আহিলের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়। আবার না বলেও উপায় নেই। তাই গম্ভীর হয়ে বলল,’জানি না।’
আহিল বোঝে, এই ‘জানি না’র পেছনেও কুসুম সব জানে। তবে সে আহিলকে কিছু বলবে না। তাই সে কুসুমকেও ঘাটায় না। তিয়াসকে কুসুমের কোলে দিয়ে বাড়ি থেকে হয়ে কেয়াকে ফোন করে। কেয়া তখন কাস্টমার সামলিয়ে ব্যস্ত। ফোন তোলারও সময় নেই। আহিল ফোনের ওপর ফোন করছে বলে কেয়া উপায় না পেয়ে ফোন রিসিভ করে।
আহিল সোজাসুজি অর্ষার প্রসঙ্গে চলে যায়। জিজ্ঞেস করে,’অর্ষা কোথায় জানো?’
কেয়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকায়। ভাবে আহিলকে সে কী বলবে। সত্যিটা বললে ঝামেলা বাড়বে। সিদ্ধান্ত নিল মিথ্যাই বলবে। তাই সে বলল,’অর্ষা আমার সাথে আছে। আজ কলেজে যাবে না। আর শোন, আমি তোকে পরে ফোন দিচ্ছি। ব্যস্ত আছি এখন।’
আহিল কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল। কেয়ার কথাকে সে ভরসা করেনি। সোজা চলে গেছে ওর শো-রুমে। লোকজনের ভিড় তো রয়েছে ঠিক; তবে কোথাও এখানে অর্ষা নেই। আহিলকে দেখে কেয়া থতমত খেয়ে যায়। ওর সহকারি এক মেয়েকে পাঁচ মিনিটের জন্য একটু কাস্টমারদের সময় দিতে বলে সে আহিলের কাছে আসে।
আহিল চোখমুখ শক্ত করে বলে,’তুমি আমায় মিথ্যে বললে কেন? কোথায় অর্ষা?’
কেয়া বুঝে যায় এই পর্যায়ে আহিলকে মিথ্যে বলে আর লাভ নেই। সে কুসুমের অত্যাচার সম্পর্কে সবই জানে। এইটুকুই বা লুকিয়ে লাভ কী। সে সব বিস্তারিত বলে আহিলকে। রাগে আহিলের মুখ লাল হয়ে গেছে। সে পারে না শুধু কুসুমকে খু’ন করে ফেলতে। কেয়ার থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে সে হাসপাতালে চলে আসে।
রিসিপশনে আহনাফের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তবে আহিল অবাক হয় না। কেয়ার কাছে সে বিস্তারিত সবই শুনেছে। এ কথাও সত্য যে, ভাইয়ের ওপর তার চাপা রাগও রয়েছে। একটাবার কি আহিলকে তার এসব জানানো প্রয়োজন ছিল না?
আহিলকে দেখে আহনাফ অবশ্য একটু অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,’তুই এখানে?’
আহিল এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,’অর্ষা কোথায় ভাইয়া?’
‘কেবিন নং ২০৪।’
আহিল আর কথা না বাড়িয়ে ২০৪ নং রুমে চলে আসে। অর্ষা রেডি হয়ে একপাশে কাৎ হয়ে শুয়ে ছিল। তার চোখের পাতা বন্ধ। অর্ষাকে সে কতবার বলেছে তাদের বাড়িতে চলে আসতে। অর্ষা রাজি হয়নি। প্রতিটা দিন ভাই-ভাবির অত্যাচার সহ্য করে। এজন্য অর্ষার ওপরও তার গোপন ক্ষোভ রয়েছে। অর্ষার শুকিয়ে যাওয়া রোগা রোগা মুখটা দেখে আহিলের রাগ গলে যায়। রাগের স্থান দখল করে নেয় একরাশ মায়া। সে অর্ষার মাথার কাছে বসে। মাথায় হাত রাখতেই অর্ষা চমকে তাকায়। সে ভেবেছিল আহনাফ! আহিলকে দেখে তার ভাবনাকে সে ধিক্কার জানাল বারংবার। শোয়া থেকে উঠে বসে অবাক হয়ে বলল,’তুই এখানে কেন?’
আহিল রাশভারী কণ্ঠে বলল,’তোরা সবাই এত স্বার্থপর কেন অর্ষা? আমাকে কেউ তোরা কিছু বলিস না। এমনকি আমার ভাইয়াও আমায় কিছু জানায়নি।’
পেছন থেকে আহনাফ আহিলের কাঁধে হাত রেখে বলল,’আমায় ভুল বুঝিস না। আফরিনের জন্য এমনিতেই তুই ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া, ঘুম সব বাদ দিয়েছিস। তাই অত রাতে অর্ষার বিষয়টা তোকে জানিয়ে বাড়তি টেনশন দিতে চাইনি।’
ভাইয়ের ওপর থেকেও আহিলের রাগ কমে যায়। সে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলল,’অর্ষাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।’
আহনাফ ওর পিঠ চাপড়ে মৃদু হেসে বলল,’মেনশন নট ব্রো!’
অর্ষাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো আহিল নিজেই। বন্ধু-বান্ধব সবাই আহিলের কাছে অর্ষার অসুস্থতার খবর শুনে কলেজ ছুটির পর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী অর্ষার জন্য পছন্দের খাবার কিনে এনেছে। অর্ষার এই বন্ধুমহলটাকেও কুসুমের একদম পছন্দ নয়। তবে এখানে ওর কিছু বলারও নেই। ওরা সবাই ভালো ভালো পরিবারের ছেলে-মেয়ে। রুহুল আমিনও সাবধান করে দিয়েছে, সে যেন ওদের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার না করে। তাই ওরা কখনো বাড়িতে আসলে তিয়াসকে নিয়ে কুসুম দরজা আটকে ঘরে বসে থাকে। মাঝে মাঝে তিয়াসকে আটকে রাখা যায় না। সে ওদের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে।
আজ তিয়াস ঘুমে। তাই কুসুম দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে তিয়াসের পাশে শুয়ে পড়ে।
লামিয়া অর্ষার পাশে বসে বলে,’বোকারানী হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলি কেন?’
আশিক ও’কে ধমক দিয়ে বলল,’বোকার মতো প্রশ্ন করিস কেন? অসুস্থ কি কেউ ইচ্ছে করে হয়? আর কেন হয়েছে তুই জানিস না?’
জুঁই বলল,’খবরদার আর বৃষ্টিতে ভিজবি না। এভাবে অসুস্থ হয়ে থাকতে ভালো লাগছে? তোকে আর আহিলকে ছাড়া ক্লাসে আমাদের ভালো লাগে না জানিস না?’
‘তোকে যে আমার অ্যাসাইনমেন্ট করতে দিয়েছিলাম। তুই তো আজ গেলি না। স্যারকে অ্যাসাইনমেন্ট দেখাতে পারিনি বলে পুরা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ব্যাটায় আমারে দাঁড় করিয়ে রাখছে জানিস?’ মনমরা হয়ে বলল রেশমি।
ওর কথায় সবাই হেসে ফেলে। দিদার চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে বলে,’ভালো হইছে। স্যারের জায়গায় আমি হলে তো তোরে কান ধরিয়ে বেঞ্চের ওপর এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখতাম।’
রেশমি কটমট করে তাকিয়ে বলে,’চুপ কর আঙ্কেলের বাচ্চা খবিশ! তোর স্যার হওয়ার যোগ্যতা আছে? তুই হবি টোকাই। রাস্তায় রাস্তায় ভাঙা বোতল, কাগজ এগুলা টোকাবি।’
‘মাইর কিন্তু মাটিতে পড়বে না চুমকির বাচ্চা!’
জুঁই দিদারের হাতে চাপড় দিয়ে নাম সংশোধন করে বলে,’রেশমি!’
দিদার জিভ কেটে বলে,’ও থুক্কু। রেশমি।’
ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে অর্ষা হাসতে হাসতে শেষ। জুঁই আর অর্ষা শব্দ করে হাসছিল। ওরা হাসলে মনে হয় সাথে বাড়ি-ঘরও কাঁপে।
আশিক আহিলের উদ্দেশ্যে বলল,’দোস্ত দেখ তো বাইরের কুত্তাগুলা এখনো আছে নাকি ওদের হাসির শব্দে ভয়ে পালাইছে।’
অর্ষা আর জুঁই দুজনই আশিকের পিঠে কিল বসাল। আশিক পিঠ বাঁকিয়ে বলল,’শা’লার সত্যি কথা বললেও মাইর খাইতে হয়।’
আহিল বলল,’এজন্যই তো আমি নিরব দর্শক।’
দুম করে তখন আহিলের পিঠেও এক কিল পড়ল। আহিল আহত দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বলল,’মুখ খুলেই মনে হয় ভুল করলাম।’
‘একদম।’ বলল অর্ষা।
‘জুঁই তোরে একটু ছুঁই?’ জুঁইকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল আশিক।
জুঁই তেড়ে এসে মারমুখী হয়ে বলে,’একদম উলটা-পালটা কথা বলবি না বেয়া*দবের বেয়া*দব, আঙ্কেলের বাচ্চা!’
আশিক আহতকণ্ঠে বলল,’তুই আমাকে আঙ্কেল বললি?’
‘গাধা! তোকে আঙ্কেল বলব কেন? তোর বাবাকে বলেছি। তোর বাবা আমার আঙ্কেল না? তাহলে তুই আঙ্কেলের বাচ্চা না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক। কারেক্ট। রেশমির থেকে এমন উলটা-পালটা কথা শিখেছিস বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তুই আমাকে বকবি কেন?’
‘একশো বার বকব। তুই আমাকে ফাউল কথা বললি কেন?’
‘আজব! এটা একটা বাংলা নাটকের নাম। নায়ক-নায়িকা নিশো আর মেহজাবিন। বিশ্বাস না হলে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখিস। তোকে টাচ করতে চাইব, আমার রুচি এত বাজে না বুঝেছিস।’
‘তোর রুচি সম্পর্কে জানা আছে। বেশি ঘ্যানঘ্যান না করে রুচির ওষুধ খা যা।’
আহিল চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে খেয়াল করে আশিক বলে,’আহিল, তোকে কেন লাগছে এত কাহিল?’
রেশমি দাঁতমুখ খিঁচে বলে,’তোর উলটা-পালটা ছন্দ শুনলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’
‘ছন্দ নয় মূর্খ নারী। কবিতা। কবিতা বলে এগুলোকে। একেকটা লাইন জুড়ে আমি কবিতা বানাব বুঝেছিস?’
‘তোর এসব ফালতু কবিতার জন্য কী করা উচিত জানিস?’
‘অবশ্যই। অস্কার, নোবেল কিছু তো একটা পাবই আমি।’
‘জু*তার বারি পাবি শা’লা!’
‘মুখ সামলে কথা বলবি চুমকি! থুক্কু রেশমি।’
অর্ষা আর আহিল নিরব দর্শক হয়ে ওদের ঝগড়া দেখছিল। ওদের গ্যাং এর অদ্ভুত একটা নাম রয়েছে। ওরা দেয়নি অবশ্য। আশেপাশের মানুষেরা রেখেছে। ‘গ্যাঞ্জাম পার্টি’। এই কয়েকজন একসাথে হলে ঝগড়া লাগবেই লাগবে। সেটা ক্লাস, ছাদ, বাড়ি কিংবা ওয়াশরুম যেটাই হোক না কেন। এজন্য ওদের দেখলেই লোকে বলবে,’ঐতো গ্যাঞ্জাম পার্টি সব একসাথে হয়েছে।’
প্রথম প্রথম ওরা রেগে গেলেও এখন রাগে না। উনারা তো একদম পার্ফেক্ট নামই রেখেছে। শুধু ওরাই বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছে।
.
.
সন্ধ্যায় একসাথে আহনাফ, আহিল, আমেনা বেগম নাস্তা করতে বসেছে। আহিল খেতে খেতে আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,’মা একটা কথা বলব।’
‘হ্যাঁ, বল। অনুমতি নেওয়ার কী আছে?’
‘অর্ষাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসো। এটলিস্ট পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকুক। আমি বললে শুনবে না। তোমার কথা অর্ষা রাখবে।’
আমেনা বেগম এবং আহনাফ দুজনেই বিস্ময় নিয়ে তাকায় আহিলের দিকে। আহনাফ বলে,’ও’কে এখানে রাখার কী দরকার?’
‘দরকার আছে ভাইয়া। কিছুদিন পর আমাদের এইচ.এস.সি পরীক্ষা। ওর ভাবি ওর ওপর অনেক অত্যাচার করে। ও’কে দিয়ে অনেক কাজ করায়। আমি যতদূর জানি, পরীক্ষার সময় সে আরো জ্বালাবে অর্ষাকে। আর অর্ষা অনেক ভালো ছাত্রী। ও ভালো রেজাল্ট ডিজার্ভ করে। ওর ভাবির জন্য ওর ক্যারিয়ার নষ্ট হোক সেটা আমি চাই না।’
‘সব বুঝলাম। কিন্তু তোকেও এটা বুঝতে হবে, বিষয়টা অন্যরা ভালোভাবে নেবে না। এমন নয় যে, অর্ষা তোর ছেলে বন্ধু। আফরিন যদি ওর বান্ধবীর জন্য এই সুপারিশ করত তাহলে না হয় মানা যেত।’
আহিল খাবার থেকে হাত সরিয়ে নেয়। চোখমুখ শক্ত করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’কে কী বলবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথা-ব্যথা নেই। আমরা তো জানি, আমরা শুধুই বন্ধু। আমি আমার কথা বলে দিয়েছি।’
একটু থেমে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’আমি এখন বাইরে যাচ্ছি। রাতে বাড়িতে ফিরে যেন অর্ষাকে এখানে পাই।’
তারপর সে আর একটা কথাও না বলে বাইরে চলে যায়। আমেনা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে ওর চলে যাওয়া দেখে আহনাফের দিকে তাকায়। তার দুই ছেলেই প্রচণ্ডরকম জেদি। বড়োজন রাগ, জেদ লুকিয়ে রাখলেও ছোটো ছেলের রাগ সব প্রকাশ্যেই বেরিয়ে আসে। সে পড়েছে এখন দোটানায়। কী করা উচিত তার?
আহনাফ কফি শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মোছে। অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে বলে,’আমার কথা বাদ দাও। আহিল যা চাচ্ছে তাই করো। এছাড়া আমি বিডিতে থাকিই বা কতদিন? আহিল সবসময় তোমাদের সাথে থাকে। ওর চাওয়াকেই প্রায়োরিটি দেওয়া উচিত।’
এরপর সেও চলে যায় তার রুমে। আমেনা বেগম কিছুক্ষণ বসে থেকে হতাশ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন। নিজের রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ে অর্ষার বাসায় যাওয়ার জন্য।
বাড়িতে গিয়ে রুহুল আমিনকে পাওয়া গেল। এই প্রস্তাব অর্ষা নাকচ করলেও রুহুল আমিন মেনে নিল। সে আমেনা বেগমের সামনেই অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,’আন্টির কথা তুই ফেলে দিতি পারবি বনু? সে না মায়ের মতো? পরীক্ষার কয়টা দিনই তো! মায়ের কাছে থেকে পরীক্ষা ভালোমতো দে।’
অর্ষা বোঝে না ভাইয়ের এই নাটকের মানে কী। সে আসলে কী চায়? টাকার জন্য এমন করে? নাকি বাকি সবার মতো সেও ভাবে আহিলের সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক রয়েছে। আর তাই হয়তো চায়, আহিলের দিকে তাকে ঠেলতে। বিয়ে হলে তাদেরই তো লাভ! অথচ ভাই যদি সত্যিই এই আশায় দিনাতিপাত করে থাকে তাহলে সেটা নেহাৎ-ই হবে বোকার স্বর্গে বসবাস। রুহুলের সিদ্ধান্ত কুসুমেরও পছন্দ হয়নি। অর্ষা চলে গেলে বাড়ির সমস্ত কাজ এখন কে করবে? আবার তার এই অবচেতন মনই চায় অর্ষাকে বাড়ি থেকে দূর করতে। মানুষের মন বোঝা বড্ড কঠিন। ক্ষণে ক্ষণে যে মন বদলায় তাকে বোঝার সাধ্যি কার?
সে রাতেই আমেনা বেগমের সঙ্গে এই বাড়িতে আসে অর্ষা। আফরিনের রুমে ও’কে থাকতে দিয়ে আমেনা বেগম বলেন,’এখন থেকে তুমি এই ঘরেই থাকবে। আমার মেয়ের মতো।’
অর্ষা মলিন হাসে। আমেনা বেগম ও’কে বিশ্রাম করতে বলে চলে যাচ্ছিলেন তখন অর্ষা পিছু ডেকে বলে,’আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?’
আমেনা বেগম নিজেই এগিয়ে গিয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’পাগলি মেয়ে। আমার ছোটো ছেলেটাও পাগল আর তার বন্ধু-বান্ধবও!’
অর্ষা এবারও প্রত্যুত্তরে হাসল।
.
সোফায় বসে ফোন চাপছিল আহনাফ। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন আমেনা বেগম। ব্যস্ত দেখাচ্ছে তাকে। প্রায় অনেকক্ষণ আগেই তিনি কাজের মেয়ে রেণুকে অর্ষার ওষুধ, দুধ আর সেদ্ধ ডিম দিয়ে আসতে বলেছেন। রেণুর হাতের কাজই শেষ হয়নি এখনো। আমেনা বেগম পূণরায় বিরক্তকণ্ঠে বললেন,’কিরে রেণু? যাসনি এখনো?’
রেণু রান্নাঘর থেকে উত্তর দিলো,’হইয়া গেছে খালাম্মা। আইতাছি দুই মিনিট।’
আমেনা বেগম বিরক্ত হোন। দুই মিনিট শেষ হবে দশ মিনিটে গিয়ে। জহির চৌধুরীর আসার সময় হয়ে গেছে। রাতের খাবার সবসময় একসাথে যথাসময়ে খাওয়া চাই সকলের। সে কোনদিক সামলাবে? আহিলেরও কোনো খোঁজ নেই। মেয়েটাকে আনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখন সেবাযত্ন না করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে জিদ্দে আল্লাহ্ মালুম।
তিনি উপায়ন্তরহীন হয়ে আহনাফকেই বললেন,’বাবু একটু যাবি?’
বাড়িতে আসার পর এই পর্যন্ত সে অর্ষার মুখোমুখি হয়নি। মায়ের কথা শুনে ফোন থেকে চোখ তুলে তাকাল।সেই দৃষ্টিতে কিছু ছিল। তাই তিনি বললেন,’থাক আমিই দিয়ে আসছি।’
আহনাফ সোফা ছেড়ে উঠল। ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে বলল,’কী দিয়ে আসতে হবে দাও।’
আমেনা বেগম খুশি হলেন। ট্রে হাতে দিয়ে বললেন,’এই ওষুধটাও খেয়ে নিতে বলবি। অর্ষা কিন্তু আফরিনের রুমে।’
‘আচ্ছা’ বলে আহনাফ আফরিনের রুমের দিকে যায়।
আহনাফ যাওয়ার পর রেণু আসে। ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বলে,’দেন খালাম্মা দিয়া আসি।’
আমেনা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,’থাক এখন আর দরকার নেই। তুই গিয়ে তোর জরুরী রান্না কর।’
‘রাগ করলেন খালাম্মা? রাগ কইরেন না। ছোটো ভাইজান ফোন দিয়া কইছে অর্ষা আপার জন্য যেন গুড়ের পায়েস রান্দি। আপার নাকি অনেক পছন্দ। আর জানেনই তো ভাইজানের কী রাগ। আইসা যদি দেখছে রান্দন হয় নাই তাইলে তো আমারে বকব।’
আমেনা বেগম অবাক হলেও মুচকি হাসলেন। বললেন,’রাগ করিনি। আহনাফ নিয়ে গেছে খাবার।’
রেণুর যেন কথাটা ঠিক হজম হলো না। সন্ধ্যার নাস্তর টেবিলে দুই ভাইয়ের বাকবিতণ্ডার সময়ে সে পাশেই ছিল। অর্ষার এই বাড়িতে আসা নিয়ে যার এত মতবিরোধ ছিল সে-ই খাবার নিয়ে গেল?
রেণু চোখ দুটো গোল গোল করে বলল,’কামডা হইল কী খালাম্মা?’
‘কীসের কথা বলছিস?’
‘বড়ো ভাইজান না প্রথমে চাইলই না অর্ষা আপা এ বাসায় আসুক। এহন আবার হেয়-ই আপার খেয়াল রাখতাছে। বাবাগো!’
তিনি মুচকি হেসে বলেন,’তোরা সবাই শুধু আমার বড়ো ছেলের গম্ভীরতাই দেখিস। ভেতরের নরম মনটা কেউ দেখিস না।’
রেণু দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বলল,’ছি, ছি খালাম্মা কী যে বলেন! দুই ভাইজান-ই অনেক ভালো মানুষ আমি জানি।’
.
.
দরজায় দু’বার নক করে আহনাফ বলল,’আসব?’
আমেনা বেগম যাওয়ার আগে দরজা চাপিয়ে দিয়ে গেছিলেন। অর্ষা শুয়ে ছিল। আহনাফের গলা শুনে তার পিলে চমকে যায়। অকারণেই সে মানুষটাকে ভয় পায়। অথচ সে কত্ত ভালো! তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসে। গলা উঁচু করে বলল,’আসুন।’
আহনাফ খাবার নিয়ে ভেতরে ঢোকে। টি-টেবিলের ওপর রেখে বলে,’মা পাঠিয়েছে। খেয়ে নাও।’
‘পরে খাব।’
‘পরে নয়। এখনই। একটু পরই আবার ডিনার করতে ডাকবে। এইগুলো খেয়ে ওষুধ খাও।’
আহনাফের সামনে খেতে লজ্জা লাগছিল অর্ষার। মুখ ফুটে বলতেও পারছিল না কিছু। আর বলবেই বা কী? যার বাড়ি তাকেই মুখের ওপর বলবে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে? এটা তো সম্ভবই নয়!
আহনাফ ফের গম্ভীর হয়ে বলল,’কী হলো?’
অর্ষা ভয়ে দুধের গ্লাসটা হাতে নেয়। একটু একটু করে চুমুক দেয়। আহনাফ তাকিয়ে থাকে। অসহ্য! লোকটা এভাবে তাকিয়ে থাকে কেন? একটা মেয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে যে লজ্জা লাগে সেটা কি সে জানে না?
অর্ষার এই মনোভাবগুলোও যেন লজ্জার সাথে সাথে মুখে ভেসে উঠছিল। সে গম্ভীরমুখে বলল,’লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকে দেখছি না। তোমার তালবাহানা দেখছি। এভাবে খেলে বছর কেটে যাবে; তবুও তোমার খাওয়া শেষ হবে না।’
‘আসলে দুধ, ডিম আমার পছন্দ না।’ ভয়ে ভয়ে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলল অর্ষা।
‘এজন্যই তো শরীরের এই হাল। বাই দ্য ওয়ে, তোমার হাতের কালসিটে দাগ পড়ে গেছে মারের। মলম লাগিয়েছ?’
‘না।’
‘লাগিয়ে নিও।’
‘আচ্ছা।’ বলে অর্ষার দৃষ্টি গেল আহনাফের হাতের দিকে। যেখানে তার নখের আঁচড় রয়েছে। সে আহত দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনার হাতের দাগটি এখনো যায়নি!’
আহনাফও এবার হাতে দাগটার দিকে একবার তাকিয়ে অর্ষার দিকে তাকাল। বলল,’এত তাড়াতাড়ি? সময় লাগবে। মা এই দাগ দেখে কী বলেছে জানো?’
অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আহনাফ বাঁকা হেসে বলে,’আমায় জিজ্ঞেস করেছে আমি প্রেম করছি কিনা। অর্থাৎ ইনডিরেক্টলি সে আমায় জিজ্ঞেস করেছে, প্রেমিকার নখের আঁচড় নাকি! শুধু জিজ্ঞেস নয়, রীতিমতো সে আমাকে ফোর্স করা শুরু করেছে। অথচ মা তো জানেই না তার ছোটো ছেলের আবদার পূরণ করতে গিয়ে আমার না হওয়া অ’প্রেমিকাকেই আদর-যত্ন করে বাড়িতে তুলে এনেছে।’
আহনাফের কথা শুনে বিষম খায় অর্ষা। আমেনা বেগম সেসময়ে রুমে এসে দেখেন অর্ষা কাশছে। সে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে অর্ষার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। আহনাফকে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে রেগে বলেন,’দেখছিস মেয়েটা বিষম খেয়েছে, তাও এমন করে কীভাবে বসে আছিস বাবু?’
আহনাফ হতাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটার সামনেও ধেড়ে ছেলেকে বাবু সম্বোধন করে ডাকতে হলো? অর্ষাও একটু যেন হাসল। না, মেয়েটা সম্পূর্ণ সহজ-সরল নয়। মনে হচ্ছে একটু দুষ্টুও আছে। নয়তো কাশতে কাশতেও কেন হাসবে?
চলবে…
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
মাঝরাতে ফের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল অর্ষার। সে জ্বরের ঘোরে কিছুই টের পায়নি। ভোর রাত অব্দি ওর শিয়রে বসে ছিল আহিল আর রেণু। জ্বর কমে আসতেই যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়েছে। যখন অর্ষার ঘুম ভাঙে তখন ঘড়ির কাটায় সাড়ে ছয়টা বাজে। মাথার ওপর ফ্যান চলছে, তবুও শরীর ঘামছে খুব। জ্বর ছাড়ছে ধীরে ধীরে। শুক্রবার হওয়ায় কলেজ বন্ধ। তাই তাড়াতাড়ি ওঠারও তাড়া নেই। সে আরেকটু শুয়ে থাকে। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খায়।
আহনাফের ঘুম ভেঙেছে ফজরের আজানের সময়। সে নামাজ পড়ে আর ঘুমায়নি। অর্ষার ঘরের লাইট জ্বালানো দেখে একবার ভেবেছিল গিয়ে দেখে আসবে শরীরের অবস্থা কেমন। পরবর্তীতে মনে হলো ইচ্ছেটা অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি। অর্ষা তার ছোটো ভাইয়ের কলেজ বন্ধু। তার তো আর কেউ নয়। মানবিকতার খাতিরে যতটুকু সাহায্য করার প্রয়োজন ততটুকু সে করেছে। সূতরাং এখন আর তার এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আহিল নিজেই অর্ষার দেখভাল করতে পারবে। এছাড়া মা আর রেণু তো আছেই।
নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ সে ল্যাপটপে অফিসের মেইল চেক করেছে। কাজ শেষ করে বই পড়েছে। এই মুহূর্তে সে অনুভব করেছে এখন আর চা না হলে তার চলবেই না। তাই সে রুম থেকে বের হয় চা খাওয়ার জন্য। ড্রয়িংরুমে যাওয়ার সময় বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে। রেণু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছিল। আহনাফ ইশারায় বলল,’আমি দেখছি।’
এরপর দরজা খুলতে যেতে যেতে বলল,’আমায় এক কাপ চা দিস রেণু।’
‘জে আচ্ছা ভাইজান।’
আহনাফ দরজা খুলে সারপ্রাইজ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়েই থাকে। তার দেখার ভুল নয় নিশ্চয়ই। সামনে কেয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে অফ হোয়াইট রঙের একটা শাড়ি। ওর ডান কাঁধে ব্যাগ আর কোলে তিয়াস। সে মুখে একটা আঙুল ঢুকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো তার কাছে আহনাফকে চেনা চেনা লাগছে, আবার মনে হচ্ছে অচেনা। এর কারণ হচ্ছে আহনাফ এবং আহিলের চেহারায় অনেক মিল রয়েছে।
আহনাফ হেসে অবাক হয়ে বলল,’আরে আপনি!’
প্রত্যুত্তরে কেয়াও হেসে বলল,’হ্যাঁ। উপায় না পেয়ে আসতেই হলো।’
‘বেশ তো। ভেতরে আসুন।’
‘না,না। ভেতরে যাব না। আসতে হলো তিয়াসের জন্য। গতকাল রাতে অর্ষা চলে আসার পর থেকে তিয়াস খুব কান্নাকাটি করছিল। রাতে কোনো রকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাখলেও সকালে আর রাখা যাচ্ছিল না। আসলে তিয়াস অর্ষার খুব নেওটা বুঝলেন। তাই ওর কান্নাকাটি থামাতে আমাকেই আসতে হলো। অর্ষার তো কলেজ ছুটি আজ। তিয়াস ওর কাছে থাকুক। বিকালে দুলাভাই এসে নিয়ে যাবে।’
‘তা না হয় হবে। সমস্যা নেই। আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন?’
কেয়া এবারও হেসে বলল,’নইলে যে শো-রুমে যেতে দেরি হয়ে যাবে।’
‘আজও খোলা?’
‘হ্যাঁ। ছুটির দিন, আজ তো ভিড় আরো বেশি থাকবে।’
একটু থেমে হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,’আর বেশিক্ষণ থাকলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। অর্ষা কোথায়?’
‘মনে হয় ঘুমাচ্ছে। ও’কে আমার কাছে দিন। অর্ষার ঘুম ভাঙলে দিয়ে আসব।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’ বলে তিয়াসকে আহনাফের কোলে দেয় কেয়া। দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আহনাফ অনেকক্ষণ পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেয়া চলে যাওয়ার পর সে দরজা লাগায়।
তিয়াসকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় এসে বসে। এত বড়ো বাড়ি দেখে তিয়াস বেজায় খুশি। কোল থেকে নেমে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। তিয়াস অনেক ফরসা। ওর ফরসা গায়ে নীল শার্ট একদম ফুটে উঠেছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সে। রেণুও তখন চা নিয়ে বের হচ্ছিল। তিয়াস রেণুর পায়ের সঙ্গে ধাক্কা খেতেই রেণু ‘ও বাবা গো’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
তিয়াস ওর চিৎকারে ভয় পেয়ে যায়। আহনাফ এগিয়ে গিয়ে ও’কে কোলে তুলে নেয়। রেণু হা করে তাকিয়ে আছে। অবাক হয়ে বলে,’ও আল্লাহ্! সাঁঝসকালে বাচ্চা টপকাইল কই থেইকা?’
আহনাফ বিরক্ত হয়ে বলল,’কীসব আজেবাজে কথা বলছিস?’
‘এই বাচ্চা কি আপনের ভাইজান?’
আহনাফ কিছু বলার পূর্বেই রেণু ‘খালাম্মা, ও খালাম্মা’ বলে আমেনা বেগমকে ডাকতে লাগল। আমেনা বেগম রুম থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলেন,’কী হয়েছে? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘দেইখা যান খালাম্মা।’
আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,’কী দেখব?’
‘বাচ্চা দেখেন বাচ্চা। বড়ো ভাইজানের বাচ্চা।’
তিনি তিয়াসকে দেখে রেণুকে ধমক দিয়ে বললেন,’না জেনে কোনো কথা বলতে বারণ করেছি না তোকে?’
‘না দেইখা কী আবার? এইতো জলজ্যান্ত বাচ্চা লইয়্যা ভাইজান দাঁড়াইয়া রইছে।’
‘অর্ষার ভাতিজা এটা।’
রেণু জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,’ওপস! ছরি খালাম্মা। ছরি ভাইজান।’
আহনাফ সংশোধন করে দিয়ে বলল,’ছরি নয় স্যরি।’
‘ঐ হইল একটা! আপনের চা তো ঠাণ্ডা হইয়া গেছে ভাইজান।’
‘চা না দিয়ে এত বকবক করলে ঠাণ্ডা তো হবেই।’
‘একটু দাঁড়ান। আমি আরেক কাপ নিয়া আইতাছি।’
রেণু চলে গেল রান্নাঘরে। আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,’তিয়াসকে দিয়ে গেল কে?’
আহনাফ বিস্তারিত সব বলে তিয়াসকে নিয়ে আবার সোফায় বসল।
আমেনা বেগম অর্ষাকে ডাকতে যাওয়ার পূর্বেই অর্ষা ঘর থেকে বেরিয়ে এদিকে আসছিল। ও’কে দেখেই সোফা থেকে নেমে দৌঁড়ে যায় তিয়াস। তিয়াসকে দেখে ভারী অবাক হয় অর্ষা। কোলে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নরম তুলতুলে শরীরটা বুকে নিয়ে শান্তি প্রায় অর্ষা। গালে, মুখে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে,’আমার সোনা বাবা ভালো আছো?’
তিয়াস ডান হাতের তর্জনী তুলে অর্ষাকে শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,’তুপ! তুমি পতা ফুপি। তুমি কুব পতা। আমালে লেকে তলে আসছ!’
অর্ষার সাথে আহনাফ আর আমেনা বেগমও হাসেন। বাচ্চারা যখন নতুন নতুন কথা বলা শেখে, অস্পষ্টভাবে কথা বলে তখন ওদের কথাগুলো শুনলে মনে হয় তোতাপাখি কথা বলছে।
অর্ষা তিয়াসকে নিয়ে এগিয়ে এলো। আমেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কে দিয়ে গেল ও’কে?’
‘কেয়া এসেছিল।’
‘আমার সাথে দেখা করল না কেন?’ মনঃক্ষুণ্ণ দেখাল অর্ষাকে।
উত্তরে আহনাফ বলল,’সময় ছিল না তার। আজও নাকি শো-রুম খোলা।’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’হুম।’
‘এখন তোমার শরীর কেমন মা?’ জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌।’
‘রাতে নাকি আবার জ্বর এসেছিল রেণু বলল। আহিল আর রেণু জেগে ছিল তোমার পাশে। কী পাগল বলো তো, আমায় ডাকবে না ওরা? আহিল ডাকতে দেয়নি।’
অর্ষা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। তবে তার মনে হচ্ছিল এই বাড়িতে এসে শুধু শুধু মানুষগুলোকে কষ্ট দিচ্ছে সে। আহিল বাদে সবাই সকালের নাস্তা একসাথে খেয়ে নিল। রাত জেগেছিল বলে আহিলের ঘুমের রেশ কাটেনি এখনো। খাওয়া শেষে আহনাফ আর জহির চৌধুরী অফিসে গেছে। আহনাফ অবশ্য বাবার সাথে অফিস ঘুরে দেখবে বলে গেছে। আহিল তো ঘুমে। ড্রয়িংরুমে বসে অর্ষা, আমেনা বেগম, তিয়াস আর রেণু টিভি দেখছিল। তিয়াস অবশ্য স্থির নেই। সে এদিক-সেদিক এখনো ছুটোছুটি করছে।
আহিল ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ফোন নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অর্ষাকে বলে,’লামিয়া কথা বলবে। দেখ কী বলে।’
অর্ষা বাদে বাকিদের একটা ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। ওরা গ্রুপের নামটাও দিয়েছে ‘গ্যাঞ্জাম পার্টি’। যেহেতু অর্ষার ফোন নেই তাই সে গ্রুপে এডও নেই।
অর্ষা উঠে গিয়ে ফোন হাতে নেয়। সবাই ভিডিয়ো কলে ছিল। লামিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে,’আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেছে বোকারানী।’
অর্ষা জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে? তুই কাঁদছিস কেন?’
লামিয়া টিস্যুতে নাক মুছে বলে,’সর্বনাশ হলে কাঁদব না?’
দিদার বিরক্ত হয়ে বলল,’বালের সর্বনাশ হইছে।’
জুঁই দিদারকে ধমক দিয়ে বলল,’উ’স্টা খাইবি কইলাম। বন্ধু হয়ে বন্ধুর কষ্ট না বুঝে বকা দিচ্ছিস।’
আশিক বলল,’ঠিক। একদম ঠিক। বন্ধুর সুখে, সুখী হওয়া যেমন দরকার তেমনই বন্ধুর দুঃখে দুঃখী হওয়া উচিত। এই যেমন আমাকে দেখ। লামিয়ার কষ্টে আমি কষ্টিত।’
এই ড্রামাবাজদের ড্রামা দেখলে মানুষ সিরিয়াস মুহূর্তেও হেসে ফেলবে। তবে বিষয়টা যখন লামিয়ার সর্বনাশের, সেখানে ভুল করেও হেসে ফেলা মানে দণ্ডনীয় অপরাধ। পাশ থেকে আহিল ওদেরকে বলল,’এক কাজ কর। সবাই মিলে আমার বাসায় চলে আয়। তারপর শুনি কী সর্বনাশ হয়েছে।’
‘এটা ভালো কথা বলেছিস। তোর ভাই বাসায় আছে তো?’ খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করল রেশমি।
লামিয়া এবার রামধমক দিয়ে বলল,’খবরদার মহিলা! উনার দিকে নজর দিবি না। সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে বলে কি আমি তোদেরকে বিলিয়ে দিয়েছি উনাকে?’
‘ইশ! তুই যেভাবে বলছিস, মনে হচ্ছে উনি লিখিতভাবে শুধুই তোর।’ বলল জুঁই।
এবার আশিক ধমক দিয়ে বলল,’এইযে চুমকি থুক্কু রেশমি! আর জুঁই বেশি না করে কুইকুই; দুজনে ফোন রাখ। রেডি হ আর আহিলের বাসায় আয়। আমিও ফোন রাখছি।’
সবাই মিলে মিনিট পনেরোর মাঝে বাসায় এসে উপস্থিত হয়। আহিল তখন ডাইনিংরুমে নাস্তা করছিল। ভরপেটে দিদার আর আশিকও খেতে বসে যায়।
লামিয়া নাকমুখ কুঁচকে বলে,’আঙ্কেলের বাচ্চা খাদক, তোরা কি এখানে গিলতে এসেছিস?’
আশিক খেতে খেতে বলল,’না। তোর সর্বনাশের সমাধান করতে এসেছি। তার আগে একটু খেতে তো দিবি!’
‘খা। খেয়ে ম’রে যা তোরা। একটু শান্তি পাই আমি।’
‘আমি তোর জন্য একটা গিফ্ট এনেছিলাম। আর তুই আমাকে এভাবে বললি?’
‘কী গিফ্ট?’
আশিক ব্যাগ থেকে বসুন্ধরা টিস্যুর প্যাকেট বের করে বলে,’টিস্যু এনেছি। তোর চোখের পানি, নাকের পানি মুছতে কাজে দেবে। এমনিতে অবশ্য নাক দিয়ে ইয়ে ছাড়া তো আর চোখ থেকে পানি বের হয় না। হবে কীভাবে? কাঁদিস তো কুমিরের কান্না। তবুও নাকের ইয়ে মুছতে কাজে লাগবে। নে ধর।’
লামিয়া ন্যাকিসুরে বলল,’মজা নিচ্ছিস তো? নে। তোদেরই তো সময় এখন।’
অর্ষা বলল,’ওরা খেয়ে আসুক। তোরা আমার ঘরে আয়।’
ঘরে গিয়েও লামিয়ার কুমিরের কান্না কিছুক্ষণ চলল। অবশেষে সকলে গোল বৈঠকে বসে জানতে পারল সর্বনাশটা হলো লামিয়ার বিয়ে ঠিক করেছে ওর বাবা-মা। কিন্তু ও তো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে না।
লামিয়া কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলল। টিস্যু দিয়ে ফের নাক মুছে আহিলকে বলল,’আমাকেও তোর বাসায় নিয়ে আয় না জান। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। বিয়েও করতে হবে না; আবার সারাক্ষণ তোর ভাইকে দেখতে পারব।’
‘ভাইয়ার বউ করে আনি?’
‘আমি তো এক পায়ে রাজি? তবুও অন্য কাউকে এখন বিয়ে করব না।’ মেকি কান্না করে বলল লামিয়া।
আশিক আরেকটা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,’ওহে লামিয়া, এখন কী আর হবে কাঁদিয়া? বউ সেজে অন্যের বাড়িতে যা চলিয়া।’
রেশমি খ্যাঁক করে বলে উঠল,’তোরে না বলছি এসব ফালতু কবিতা বানাবি না।’
‘তোর কী চুমকি? উফ! থুক্কু রেশমি। বালের একটা নাম রাখছে। খালি ভুইলা যাই। আমার ক্ষমতা থাকলে তোর জন্য একটা গরু জবাই দিয়া নাম পাল্টাইয়া চুমকি রাখতাম। তারপর গান গাইতাম,’চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে?’ কিন্তু তোর কপাল খারাপ। গরু কেনার টাকা নাই আমার কাছে।’
‘তুই নিজেই তো একটা গরু। আল্লাহর ওয়াস্তে নিজেই নিজেরে জবাই দিয়ে দে।’ বলল জুঁই।
‘জুঁই, তোরে না বলছি বেশি করবি না কুইকুই?’
‘এই বাল থামবি তোরা? আমার সমস্যার সমাধান দে।’ বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলল লামিয়া।
আহিল বলল,’সমাধান আর কী? তুই ঐ ছেলের সাথে দেখা করবি আলাদা। দেখে করে বলে দিবি, তুই এখন বিয়ে করবি না।’
‘আমি একা যাব?’
‘তা কেন? আমরা তো আছি। আমরাও যাব।’
দিদার খুশি হয়ে বলল,’হ মামা। দারুণ হইব। যা মন চায় সবাই মিললা খাইয়া-দাইয়া বড়ো লিস্ট ধরাই দিমু ব্যাটার হাতে। তখন লামিয়ার কথায় বিয়ে ক্যানসেল না করলেও লামিয়ার আমাদের মতো খাদক বন্ধুদের ভয়ে ঠিক ঠিক বিয়ে ক্যানসেল করবে দেখিস।’
এবার সবাই উচ্চস্বরে হাসে। অর্ষা হঠাৎ খেয়াল করে তিয়াস নেই ঘরে। তাই সে তিয়াসকে খুঁজতে বের হয়। এদিকটায় সবার প্রথম রুমটা আফরিনের। মাঝখানের রুম আহনাফের আর শেষেরটা আহিলের। সবাই আফরিনের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
অর্ষা আগে আহনাফের রুমে উঁকি দেয়। দেখতে পায় তিয়াস ড্রেসিংটেবিলের সব পারফিউম, লোশন আরো যা যা ছিল সব নিয়ে ফ্লোরে সাজিয়ে খেলছে। এ দৃশ্য দেখে অর্ষার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা।
অর্ষা দৌঁড়ে ঘরে যায়। সবকিছু আবার ড্রেসিংটেবিলে রাখতে রাখতে বলে,’খেলবি তো খেলবি ভালো কথা। তাই বলে আর রুম পাসনি?’
এদিকে অর্ষা সব নিয়ে নিচ্ছে বলে তিয়াস কান্নাজুড়ে দেয়। অর্ষা ও’কে আদর করে মানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তিয়াস তো তিয়াসই। তার কান্না থামে না। আহনাফ বাড়ি ফিরে আসে তখন। ওদের দুজনকে রুমে দেখে বলে,’কী ব্যাপার?’
অর্ষা থতমত খেয়ে বলে,’না মানে, কিছু না। তিয়াস ভুল করে চলে এসেছে।’
আহনাফ কিছু বলল না। ওয়ারড্রব আর আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় বের করে গোছাতে লাগল। তিয়াস অর্ষার কোল থেকে নেমে আবারও লোশন আর পারফিউমের বোতলগুলো নামিয়ে খেলতে শুরু করে।
অর্ষা ভীরু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’আপনি কোথাও যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। সুইজারল্যান্ড ফিরে যাচ্ছি।’
‘হঠাৎ?’
‘আমি তো ওখানেই থাকি। আফরিনের বিয়ের জন্য এসেছিলাম। অবশ্য আরো সাতদিন বাংলাদেশেই থাকার কথা ছিল। তবে অফিসে জরুরী কাজ পড়ে গেছে। তাই আজই ফিরতে হবে।’
‘এখনই?’
‘না। রাতে ফ্লাইট।’
‘ওহ।’
আহনাফ এবার তিয়াসকে জিজ্ঞেস করল,’কী ব্যাপার? পারফিউম পছন্দ হয়েছে?’
তিয়াস ওর কথায় কান দিলো না। সে তার মতো খেলছে। আহনাফ হেসে বলল,’আমারও ছোটো তুলতুলে একটা বাবু আছে।’
অর্ষা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,’কীহ! আপনি বিবাহিত?’
‘তুমি বিবাহিত?’
‘মানে কী?’
‘তিয়াসকে তুমি তোমার বাবু বলো না?’
‘বলি।’
‘আমিও ক্যাথিওনকে আমার বাবু বলি। তার মানে তো এই নয় যে আমি বিবাহিত।’
অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,’যাক বাবা! এই যাত্রায় আমার তিন বান্ধবী অদৃশ্য ছ্যাকা খাওয়া থেকে বেঁচে গেল।’
মুখে বলল,’ক্যাথিওন কে?’
‘আমার বিড়াল।’
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,’অ্যা!’
‘অ্যা নয় হ্যাঁ। আমি আদর করে ডাকি ক্যাথি।’
‘তার মানে তোর প্রেমিকা আছে? নাম ক্যাথি?’ আহনাফের শেষের কথাটা শুনে দরজায় দাঁড়িয়েই বললেন আমেনা বেগম।
আহনাফ হতাশ দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে তাকায়। আরেকবার অর্ষার দিকে তাকায়। সে ভারী গলায় বলে,’প্রতিটা বার ভুল সময়ে এসে ভুল কথা শোনো কেন বলো তো?’
‘ভুল শুনেছি মানে? স্পষ্টই তো শুনলাম। অর্ষা তুমিই বলো, আহনাফ মাত্রই না বলল, ও আদর করে ক্যাথি ডাকে?’
তারপর তিনি ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,’ক্যাথি নাম তো বিদেশি বিদেশি লাগে। তার মানে তুই একটা বিদেশিনীকে ভালোবাসিস?’ এরপর ওর হাতে থাকা নখের আঁচড়ের দিকে ইশারায় ইঙ্গিত করে বলেন,’আবার সাথে করে দেশেও নিয়ে এসেছিস? কোথায় রেখেছিস বল?’
আহনাফ কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার মা তো অর্ষার চেয়েও এক কাঠি ওপরে সহজ-সরল। বাবা যে কীভাবে এতগুলো বছর মাকে সামলিয়েছে আল্লাহ্ মালুম! তার এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,’মা, তুমি যার কথা বারবার জানতে চাইছ সে তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
কিন্তু মনের কথাটা আর মুখে বলা হয়ে উঠল না। জহির চৌধুরীর ডাক পড়ায় আমেনা বেগম বাধ্য হয়েই চলে গেলেন। নয়তো আজ ছাই দিয়ে তিনি ছেলেকে ধরতেন। কে এই মেয়ে সেটা তিনি জেনেই ছাড়তেন।
মা চলে যেতেই আহনাফ রেগেমেগে বলল,’সব হয়েছে তোমার জন্য।’
‘আমি কী করেছি?’ অবাক হয়ে জানতে চাইল অর্ষা।
‘তোমার নখের আঁচড়ের জন্যই মা আমাকে এত সন্দেহ করছে। ইচ্ছে তো করছে বলে দেই, সেই মেয়েটা অন্য কেউ নয় বরং তুমি নিজেই। সেটাও তো বলতে পারছি না। তুমি তো আর আমার প্রেমিকা নও। ছোটো ভাইয়ের বান্ধবী বলে কথা। এসব বলা যায়? ভাবলেও তো লজ্জা লাগে।’
এতগুলো কথা শুনেও অর্ষাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহনাফ বলল,’আল্লাহ্ ভালো জানে, কার জীবন তেজপাতা করতে তার বউ হবে! তোমাকে সবকিছু বিশ্লেষণ করে বোঝাতে বোঝাতেই তার অর্ধেক জীবন পার হয়ে যাবে।’
‘যার-ই বউ হই না কেন; আপনার তো আর হব না। আপনি এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন?’ নিচুস্বরে বলল অর্ষা। তারপর তিয়াসকে জোর করে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
আহনাফ ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’অদ্ভুত সব নারীজাতি! বিয়েটিয়ে করার চেয়ে সন্ন্যাসী হয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে এক জীবন কাটিয়ে দেওয়া ঢের ভালো।’
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here