#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_উনত্রিশ
সদ্য বাবা-মা হারা মেয়ে’টা ভাইয়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চুপে চোখের জন্য ফেলছে। ভাই পরম আবেশে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাথার উপর সিলিং শব্দ করে ঘুরছে। ফাইজার দৃষ্টি সেদিকে রেখে বলে উঠলো……..
–আমরা এখান থেকে চলে যাব ভাইয়া….
ফাইজার কান্না মাখা কন্ঠ স্বরে চলে যাব কথা’টা শুনে জেহের অবাক স্বরে বলে উঠলো……
–চলে যাব মানে? আমরা আমাদের বাসা ছেড়ে কোথায় যাব?
জেহের কথা শুনে ফাইজা পূর্নরায় বিস্ফোরিত স্বরে বললো…
–আমরা গ্রামের বাড়ি চলে যাব। এখানে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাব ভাইয়া। এই বাড়ির প্রত্যেক’টা কোনায় কোনায় বাবা-মায়ের স্মৃতি’তে জর্জরিত। আমি এখানে থাকতে পারব না ভাইয়া। প্লিজ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো প্লিজ…….
বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। জেহের চোখ ও অশ্রুসিক্ত। বোনের আবেগ জড়ানো কথাগুলো শুনে চুপ করে আছে। কি উওর দিবে ও? সত্যি’ই তো এই বাড়ি’টা যে বাবা খুব সখ করে টাকা জমিয়ে একটা ফ্লাট কিনেছিলো। কষ্ট করে অর্জন করা টাকা দিয়ে কেনা এই ফ্লাটে রয়েছে হাজার মধুমাখা স্মৃতি, ভাই বোনের খুনশুটি, আর চারজনে মিলে হাসির স্মৃতি। কি করে ভুলবে এগুলো? কথাগুলো ভাবতে’ জেহেরের ও দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছিলো। নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বললো…..
–আমরা চট্রগ্রাম চলে যাব। আমি তো ফ্লাটে একা থাকি। এখন থেকে তুই আর আমি থাকব। আর এই বাসা’টা না হয় ভাড়া দিয়ে দিব….
জেহের কথা শুনে ফাইজা জোরে বলে উঠলো……
–“নাহ” এই বাসায় আমার বাবা-মা’য়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই বাসায় আমি অন্যের হাত লাগতে দিব না। এমনি থাকবে বাসা….
জেহের ও আর কথা বাড়ালো না। বোনের কথা মেনে চুপ করে রইলো। বাবা-মা চলে গেছে দুইদিন হলো। বোন’টা এখনো প্রতি মুহূর্ত চোখের পানি ফেলছে। দুইদিনের ফাইজার চেহারা’ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ গুলো ফুলে উঠেছে। ফারদিন হাজার বার ফোন দিয়েছে কিন্তু ফাইজা ফোন বন্ধ করে রেখেছে। তনুজা ফাইজা আর জেহেরের সাথে রয়েছে। জেহের মনে মনে ঠিক করলো কালকে’ই চলে যাবে। ফাইজার ফারদিনের উপর এক অজানা রাগ জমে আছে। ফারদিনের কথা মাথায় এলেও পাত্তা দিচ্ছে না। ফারদিন প্রতিদিন বাসায় এসেছিলো কিন্ত ফাইজা নিজের রুমের দরজা এক মিনিটের জন্য ও খুলে’নি।
____________________________________________
ফারদিন নিজের রুমের বেলকনি’তে বসে আছে গিটার নিয়ে। দুই রাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে ওর চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। বার বার ফাইজা’র পাগলামি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ফাইজা’র অবহেলা গুলো মেনে নিতে পারছেনা ও? কিন্তু মেয়ে’টার এই বা কি দোষ? ফারদিনের ও নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। ও যদি সময়ের অপেক্ষা না করে তিথী’কে তখনি শাস্তি দিতো তাহলে আজ ফাইজার এমন অবস্থা হতো না। ফারদিন ভাবতে ভাবতে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। শূন্য লাগছে মনের ভেতর’টা। চোখ বন্ধ করে সুর তোলার চেষ্টা করতে লাগলো। গুমড়ানো গলায় গাইতে লাগলো…….
চোরাবালি মন তোমার,
কেনো শুধু লুঁকিয়ে থাকো?
একটু আড়াল হয়ে আমায় দেখো?(২)
যদি কোনো চিত্র আঁখি
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী
সেই চিত্র’তে তুমি…
Perfectly বসো……
কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো?
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?
কেনো লাগে শূন্য শূন্য বলো?
তোমায় ছাড়া এত
তুমি কি তা বলতে পারো?
এইটুকু গেয়ে গিটার’টা বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে দিয়ে বলে উঠলো…..
–আমার খুব শূন্য লাগছে জান। কেনো এমন করছো তুমি আমার সাথে? আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছিনা। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার…..
বলেই নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। কয়েকদিন আগেও রাতে যখন ফাইজা’র রুমে যেতো তখন ফারদিন মেইন দরজা দিয়েই যেতো। আর দরজা খুলে দিতো ফাইজা’র মা নিজে। যেহেতু ফারদিন ফাইজা’র স্বামী সেহেতু ফারদিন’কে আটকানোর প্রশ্ন উঠেনা। ছেলে’টা আকুল আবেদন ফেলতে পারে’নি সে? তাই প্রতি রাতেই ফারদিন যখন তাদের বাসায় যেতো তখন সে দরজা খুলে দিতো। এটা কেউ জানতো না তারা দুজন বাদে। না খেয়ে প্রথম দিন গিয়েছিলো তাই ফাইজা’র মা নিজ হাতে ও’কে জোর করে খাইয়ে দিয়েছিলো। কথা গুলো মনে উঠতে’ই ফারদিনের নিজের মায়ের কথা মনে পড়লো। ফাইজা’র মায়ের ভালোবাসা দেখে ভেবেছিলো এই বুঝি এক মায়ের ভালোবাসা পেতে চলেছে। কিন্তু কে জানতো ওর ভাগ্য’টা এত খারাপ যে কোনো মায়ের আদর,স্নেহ,ভালোবাসা ওর কপালে নেই। ছেলে’টা ভালো নেই। কি করে বুঝাবে সবাই’কে? ফাইজা’কে ছাড়া যে ও শূন্য। কি করে বাঁঁচবে ও? কথা গুলো ভাবার সময় রুম থেকে ফোনের আওয়াজ ভেসে আসতে’ই ফারদিন চোখের জল গুলো মুঁছে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। চেনা নাম্বার পেয়ে তড়িঘড়ি করে ফোন রিসিভ করে বলে উঠলো…..
–গট এনি ইনফরমেশন? টেল মি কুইক……
ফারদিনের অস্থির কন্ঠ শুনে ওপাশ থেকে ছেলে কন্ঠে ভেসে আসলো….
–স্যার পেয়ে গেছি। তিথী ম্যাডামের বড় গ্যাং রয়েছে। স্যার আপনার পেছন থেকে আপনার আপন মানুষ’টাই আপনাকে ছু’ড়ি মে/রেছে। …..
এইটুকু বলে ছেলেটা থেমে যেতেই ফারদিন উত্তেজিত কন্ঠে একটু চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–স্যা এভ্রিথিং ক্লিয়ার’লি……
ফারদিনের রাগী স্বর শুনে ছেলে’টা থমকানো কন্ঠে বললো…..
–স্যার তিথী ম্যাডামের সাথে নিরব স্যার ও যুক্ত।
নিরব নাম’টা শুনেই ফারদিনের মাথা হালকা ঘুরে গেলো। নিজের কান’কে যেনো নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। নিরব ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে ওর সাথে বেঈমানী করতে পারলো? কথাটা কেনো যেনো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা ফারদিনের? ফারদিন চিৎকার করে বলে উঠলো…..
–তুমি ঠিক বলছো তো?
–জ্বী স্যার কোনো সন্দেহ নেই। আমার কাছে সব প্রমান আছে। এই দুইদিন তারা কোথায় গেছে? কি কি বলছে সব কিছুর প্রমান আমার কাছে আছে। আপনি বললে এক্ষুনি আপনাকে সব মেইল করে দিচ্ছি……
ছেলে’টার দৃঢ় কন্ঠ স্বর শুনে ফারদিন কিছুক্ষন থমকে দাড়ালো। ছেলে’টাকে সব মেইল করতে বলে ফোন’টা রেখে ঘাড়ের দুইপাশে হাত রেখে বিছানায় বসে পড়লো। আপন মানুষ’রা কেনো সব সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে? নিরব কেনো এইসব করলো? ভেবে দাতে দাত চেপে ফারদিন বলে উঠলো……
–বিশ্বাস ঘাতকতা’র শাস্তি তোকে খুব ভয়ংকর ভাবে দিতে হবে। তোদের দুজনের মৃত দেহ দেখেও মানুষ কেঁপে উঠবে। সময় ফুরিয়ে এসেছে তোদের…..
বলেই হালকা রহস্যময় হাসি দিয়ে উঠলো।
____________________________________________
পরের দিন সকালে উঠে’ই ফারদিন ফাইজা’দের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আজ যে করে হোক ফাইজা’র সাথে কথা বলে ছাড়বে? ওর অভিমান ভাঙাবে। তাই সকাল সকাল উঠে’ই রওনা হলো। ফাইজার বাসার সামনে এসে গাড়ি’ থামিয়ে উপরে উঠে বাসার দরজায় তালা ঝুলানো দেখে ওর মাথায় বাজ পড়লো। আবার ভাবলো ওরা হয়তো বাইরে গেছে? তাই কিছু না ভেবে ফাইজার নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে কেউ “ফোন বন্ধ আছে ” বলে উঠলো। ফারদিন বুকের ধুকপুক বেড়ে চলেছে। হারানোর ভয় জেগে উঠছে। জেহের নাম্বারেও কল দিয়ে বন্ধ পেলো। উপায়ন্তর না পেয়ে অনেক ভেবে চিন্তা তনুজার নাম্বারে কল দিয়ে উঠলো। একবার রিং হয়ে কে’টে গেলো। দ্বিতীয় বার কল দিতেই ওপাশ থেকে তনুজা ব্যস্ত গলায় বললো…..
–হ্যা,কে বলছেন?
ফারদিন থমকে থমকে বললো….
–আন্টি আমি ফারদিন। একটা কথা জানার জন্য ফোন দিলাম….
তনুজার হ্যা সূচক বানীর পেয়ে’ই ফারদিন নিঃশ্বাস আটকে বলে উঠলো….
–ফাইজা’রা কি আপনার ওইখানে? আসলে বাসায় তালা ঝুলানো তাই?
তনুজা এইবার করুন স্বরে বলে উঠলো…..
–ফাইজা তো জেহেরের সাথে চট্রগ্রাম চলে গিয়েছে কাল রাতে। মেয়ে’টা খুব ভেঙে পড়েছে এখানে থেকে। তাই জেহের নিজের সাথে নিয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করোনা। ওর নিজেই তোমাকে ফোন দিবে মন’টা ঠিক হোক একটু….
বলেই ব্যস্ত আছি বলে তনুজা ফোন রেখে দিতে’ই। ফারদিনের হাত থেকে ফোন’টা নিচে পড়ে গেলো। ওর কানে বাজছে “ফাইজা চট্রগ্রাম চলে গিয়েছে “। হাটু ভেঙে দরজার সামনে বসে পড়লো। সাথে সাথে চোখ বেয়ে পানির ফোটা গড়িয়ে পড়লো।
#চলবে