#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেত্রিশ
–তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না যেতে তাহলে আজ আমার জীবন’টা এমন হতো না মা। তুমি স্বার্থপরের মতো কেনো আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? ছোট থেকে ধোকা খেতে খেতে আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি মা। আর পারছিনা। যাকে ভাই ভেবেছিলাম দেই সব থেকে বড় আঘাত’টা দিলো আমাকে। আমি সত্যি পারছিনা মা। অপরাধবোধে ধুকে ধুকে ম’রে যাব। আমি খু/নী হয়ে বাঁচতে পারব না মা। আবার ম’রতেও পারব না। তাহলে আমি কি করব মা? প্লিজ বলে দাও তুমি?
ফারদিন ওর মায়ের ছবির সামনে দাড়িয়ে কথা গুলো বলতে বলতে কেঁদে উঠে হাটু ভেঙে বসে পড়লো। নিঃশব্দে চোখের পানি টুপটাপ করে পড়ছে ওর। বুকের ভেতরের যন্ত্রনা অপরাধ বোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মন’কে কিছুতেই বুঝাতে পারছে না যে, ও অন্যায় কারীদের নিজের হাতে শাস্তি দিয়েছে। তাহলে, কেনো নিজেকে অপরাধী ভাবছে? ফারদিনের প্রতি মুহূর্ত মনে হচ্ছে ও খু’নী। অন্যায় করেছে৷ শাস্তি পাওয়া দরকার। শাস্তি পাওয়া দরকার কথা’টা মাথায় আসতে’ই ফারদিন পাগলের মতো উঠে রুমে কিছু খুঁজতে লাগলো। ড্রয়ার খুলতে’ই একটা ধারালো ছু’ড়ি নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাতের তালুতে একের পর এক আঘাত করতে লাগলো। চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তাও থামছে না। ফাইজা নিচে নেমে ফারদিনের রুমের সামনে এসে এই দৃশ্য দেখে ওর হার্টবিট থেমে গেলো। ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে ফারদিনের হাত থেকে ছু’ড়ি’টা ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….
–কি করছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন? মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার? কি করব এখন? কত রক্ত বের হচ্ছে।
ফারদিনের হাত থেকে রক্ত পড়া দেখে ফাইজা’র মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেলো। ভয়ে হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেলো। মাথা কাজ করছেনা। আর ফারদিন নিশ্চুপ হয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রয়েছে একই ভাবে। আর ফাইজা চারপাশে কিছু খুঁজে না পেয়ে ওড়না দিয়েই হাত প্যাচানো শুরু করলো। গলা ফা’টিয়ে চিৎকার করে সায়মা খানম’কে ডাকতে লাগলো। ফারদিন’কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফাস্ট এইড বক্স বের করলো। সায়ম খানম চেঁচামেচি শুনে হন্তদন্ত হয়ে প্রানের টুকরো নাতি’কে এই অবস্থায় দেখে ভয় পেয়ে গেলো।
—কি করে হলো এসব? কত র’ক্ত বের হচ্ছে। কি করে হলো এসব নানুভাই?
সায়মা খানমের অস্থিরতা দেখে ফারদিন বড়ো একটা নিশ্বাস ছাড়লো। তারপর ঠোঁট চেপে নিজেকে শান্ত করে বলে উঠলো…..
–আমি ঠিক আছি দীদা।
সায়মা খানম চিন্তায় অস্থির হয়ে বলে উঠলো…..
–তুমি ঠিক নেই। আমি এক্ষুনি ডাক্তার’কে ফোন দিচ্ছি…..
বলে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো….
–তুমি একটু দেখো রক্ত পড়া’টা অফ করতে পারো কিনা….
বলেই হন্তদন্ত পায়ে আবারো বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। সায়মা খানম চলে যেতে ফাইজা ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে সেভলন আর সামান্য তুলো নিয়ে ক্ষত স্থানে চেপে ধরলো। ফারদিন ব্যাথায় আর জ্বালায় চোখ মুখ খিচে আছে। ফাইজা টলমলে চোখে একবার ফারদিনের দিকে আরেক বার ক্ষত স্থানে ভালো করে সেভলন লাগাচ্ছে কিন্তু কিছু’তেই রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছেনা। ফাইজার মনে হচ্ছে ওর কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। ছেলে’টা খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছে? ফারদিনের হাতে মনে মচ্ছে কেউ মরিচের গুড়ো ঢেলে দিছে। ওর এই সামান্য আঘাতে’ই এত’টা যন্ত্রনা হচ্ছে তাহলে নিরব’কে যেভাবে আঘাত করেছিলো ওর কত’টা যন্ত্রনা হয়েছে। ভাবতে’ই ফারদিন আবারো এক টানে ফাইজার থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। পাগলের মতো উঠে রুমের সব জিনিস পত্র ভাঙ্গতে লাগলো। ফাইজা নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে টলমলে চোখে সব’টা দেখছে কিন্তু ফারদিন’কে থামানোর চেষ্টা করছে না। ফারদিন শেষ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় একটা ভাজ ছুড়ে মা’রতেই আয়না’টা ভেঙে চূর্নবি-চূর্ন হয়ে গেলো। ফারদিন তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে একটা কাচ নিয়ে আবারো নিজের হাতে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত হতে’ই এইবার আর ফাইজা চুপ করে রইলো না। ছুটে গিয়ে ফারদিনের থেকে কাচ ‘টা ফেলে দিয়ে সজোরে ফারদিনের গালে একটা থা’প্প’ড় মে/রে বসলো। ফারদিন অশ্রু ভর্তি চোখে নিচে তাঁকিয়ে আছে। ফাইজা এইবার রেগে ফারদিনের দুই গালে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো……
–আমার দিকে তাঁকান।
ফারদিনের দৃষ্টি এখনো নিচের দিকে। এইবার ফাইজা পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন জোরে চেঁচিয়ে বললো…..
—আমার দিকে তাঁকাতে বলছি৷ আপনি শুনতে পাচ্ছেন না। নাকি শুনেও না শোনার ভান করছেন। তাঁকান আমার দিকে….
ফারদিন ফাইজার দিকে করুন চোখে তাঁকাতে’ই ফাইজা চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–কি চান আপনি? কেনো এমন করছেন? ম’রে যেতে চান?
ফাইজার রাগী স্বর শুনে ফারদিন ফাইজা’কে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ওর হাতের রক্ত দিয়ে ফাইজার জামা র’ক্তে ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। ফারদিন ফাইজা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা স্বরে বলে উঠলো….
–আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার এইটুকু আঘাতে যন্ত্রনায় ছটফট করতে মন চাচ্ছে। আর আমি পা’ষানের মতো নিরব’কে কতগুলো আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছি। ওর খুব কষ্ট হয়েছিলো। আমি এইসব থেকে বের হতে পারছিনা। বার বার চোখের সামনে নিরবের চেহারা’টা ভেসে উঠছে। আমি কিছুতে’ই এইসব ভুলতে পারছিনা। দম আটকে যাচ্ছে আমার। আমি এই বোঝা বয়ে বেড়াতে পারছিনা। কিছুতেই পারছিনা। পারছি……
আর কোনো শব্দ কানে আসলো না ফাইজা। ফারদিন শান্ত হয়ে যেতেই ফাইজা সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো তাড়াতাড়ি বুঝতে পারলো অতিরিক্ত চাপে ফারদিন সেন্সলেস হয়ে গেছে। এত ভারী একটা শরীর ফাইজার একার পক্ষে সামলানো কষ্টকর। সারা ঘরে জিনিসপত্র ভর্তি। কাচ গুলো পায়ের সামনে যেকোনো সময় কে’টে যেতে পারে। সামনে খাট ছিলো বিধায় ফাইজার একটু সুবিধা হলো। কষ্ট করে খুব সাবধানে ফারদিন’কে বিছানায় সুয়ে দিলো। হাত’টা’কে কোনো মতে রক্ত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ প্যাঁচাতে লাগলো। যে করে হোক ডাক্তার আসা অব্দি তো র’ক্ত পড়া বন্ধ করা লাগবে। ফারদিনে অবস্থা দেখে ফাইজার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তাও নিজেকে সামলে ফারদিনের হাত’টা কোনোমতে ব্যান্ডেজ প্যাচিয়ে রেখে সারারুম গুছানো শুরু করলো। কয়েক মিনিটের মাথায় একজন সার্ভেন্ট’কে ডেকে এনে দুজনে মিলে রুম’টা গুছিয়ে নিলো। রুম’টা গুছানো শেষ হতে না হতে সায়মা খানমের সাথে একজন ডাক্তার ভেতরে ঢুকলো। ফাইজা আর সায়মা খানম দুজনে’ই এক কোনে দাড়িয়ে আছে৷ দুজনের চোখেই পানি। সায়মা খানম ফাইজা’কে এক হাতে জড়িয়ে রেখেছে নিজের সাথে। ফারদিনের হাতে দুইটা সেলাই লেগেছে। ডাক্তার ফারদিন’কে ভালোভাবে চেক করে বলে উঠলো…..
–হয়তো ও কোনো ট্রোমার মধ্যে আছে। এই অবস্থায় ওর মেন্টালি সার্পোট দরকার। সব সময় ও’কে হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করো৷ নয়তো এমন কয়েকদিন থাকলে ও সু’ই’সা’ইডের মতো ভয়ংকর ডিসিশন নিতেও একবার ভাববে না।
কথাগুলো শুনে ফাইজা কেঁপে উঠলো ভয়ে। ছেলে’টাকে আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে। ছোট থেকে তো কম কষ্ট পায়’নি। আর কত কষ্ট পাবে। ডাক্তার সব ওষুধ বুঝিয়ে চলে যেতে’ই সায়মা খানম তার সাথে সাথে বেরিয়ে গেলো ফাইজা’কে রেখে। সবাই যেতেই ফাইজা ফারদিনের মাথায় সামনে বসে ওর মাথায় আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ছেলে’টা সত্যি এই আঘাত’টা সহ্য করতে পারছেনা। সর্বশেষ নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড নামক ভাই’টা এভাবে ভেঙে দিবে ও’কে ভাবতেও পারেনি ছেলে’টা। ফাইজা ফারদিনের মুখ পানে তাঁকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
–আপনি প্লিজ ঠিক হয়ে যান। আপনাকে এভাবে আমি দেখতে পারছিনা। কষ্ট হচ্ছে আমার। সব ভুলে খুব শিঘ্রই আমরা নতুন করে সব শুরু করব। আপনি ঠিক হয়ে উঠুন প্লিজ……..
#চলবে