#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_ছত্রিশ [Mehendi_special]
সময় সময়ের তালে বয়ে চলেছে। সব বিষন্নতা কষ্ট ভুলে শুরু হতে চলেছে নতুন অধ্যায়। আজ ফাইজা আর ফারদিনে’র মেহেন্দী। দুজনের মেহেন্দীর অনুষ্ঠান ফারদিনের বাড়ি’তে’ই আয়োজন করা হয়েছে। গায়ে হলুদ মেহেন্দী দুই’টাই ফারদিনের বাড়ি’তে হবে। আর বিয়ে’টা দুজনের বাড়িতে। ফারদিন আজ সাদা আর কালো কম্বিনেশনে পাঞ্জাবী পড়েছে। চুল গুলো শ্যাম্পু করায় আরো বেশি সিল্কি হয়ে গেছে। হাতে একটা কালো ঘড়ি। মুখে রয়েছে সেই ভুবন ভুলানো হাসি। যা দেখে কোনো মেয়ে ক্রাশ খেলেও খেতে পারে। জেহের ও ফারদিন’কে আজ মনে হচ্ছে জমজ ভাই। দুজনেই সেম ড্রেস,ঘড়ি,জুতা। ওরা দুজন সব ঠিক ঠাক সাজানো হয়েছে কিনা তা তদারকি করছে। উপরের রুমে সাজানো হচ্ছে ফাইজা’কে। ফাইজা সিল্কের একটা সাদা শাড়ি পড়েছে। সাথে তাজা লাল গোলাপ ফুলের গহনা। মুখে হালকা সাজ। দেখতে বেশ মিষ্টি লাগছে। কাকতালীয় ভাবে আজ আরজা’কেও ফাইজা’র মতো সাজানো হয়েছে। সেদিনের পর আরজা আর জেহের সামনে আসে’নি। জেহের কয়েকবার গিয়েছিলো ওদের বাড়ি। কিন্তু, আরজা জেহেরের সামনে আসে’নি। আজ যত’ই হোক বেস্ট ফ্রেন্ড এর মেহেন্দী না এসে কি থাকা যায়। আরজা প্রথমে আসতে রাজি হয়’নি৷ কারন, জেহের’কে দেখে নিজেকে সামলাতে পারবে না। কিন্তু, ফাইজা তো আর শুনবার পাত্রী নয়। পার্লার থেকে লোক এসে ওদের সাজিয়ে দিয়েছে। আরজা প্রথমে বুঝতে পারে’নি। সাজানোর আগে অনেক বার বারন করেছে। কিন্তু কেউ শুনে’নি। তাই সাজানো শেষ হতে’ই ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নিজের সাজ দেখে মুখ হা করে অবাক স্বরে বলে উঠলো…..
—আজ কার মেহেন্দী। আমার নাকি তোর তাই তো বোঝা যাচ্ছে না। সবাই তো ভাববে আমাদের দুজনের এই বিয়ে?
আরজার কথা শুনে ফাইজা মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো…..
— হ্যা, দুজনের এই তো বিয়ে…..
এইটুকু বলেই মুখে হাত দিয়ে থেমে গিয়ে মনে মনে বলে উঠলো….
–এই রে এক্ষুনি সত্যি ফাঁস হয়ে যাচ্ছিলো৷ ভাইয়া আমাকে গনোধোলাই দিবে। ফাইজা, কন্ট্রোল কন্ট্রোল……
ফাইজা পূর্নরায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরজা সন্দিহান দৃষ্টি’তে ফাইজার দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো…..
–থেমে গেলি কেনো? দুজনের বিয়ে মানে?
এইবার ফাইজা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বললো…..
–ইয়ে হ্যাঁ। মানে না। ধুর হ্যাঁ, দুজনের এই তো বিয়ে আমার আর উনার।
বলেই লাজুক হাসলো ফাইজা। এই প্রথম ফাইজা ফারদিন’কে উনি বলে সম্মোধন করলো। এতে আরজা চোখ বড় বড় তাঁকিয়ে থেকে বললো…..
–আরে বাহহ। উনি আহা কি মধুর প্রেম। দোয়া করি তোরা সারাজীবন এমন করে’ই সুখে থাক।
বলতে’ই আরজার গলা আটকে এলো। চোখে জল এসে ভীড় করলো। বুকের ভেতর’টা চে’পে আসলো। অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব হতে লাগলো। আজ যদি জেহের ও আমাকে ভালোবাসতো তাহলে আমাদের বিয়ে’টাও এত’টাই সুখের হতো। এইটুকু ভেবে’ই আরজা চোখের জল লুঁকাতে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর ফাইজা ওর দিকে অসহায় চোখে তাঁকিয়ে থেকে বলে উঠলো…..
–আমি জানি তুই অনেক কষ্ট পাচ্ছিস। ভাইয়া’টা কেনো তোকে এত’টা কষ্ট দিচ্ছে কে জানে? তবে বিয়ের দিন যেই সারপ্রাইজ’টা পাবি সেদিন তোর সব দুঃখ ঘুঁচে যাবে…….
বলে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।
____________________________________________
আরজা সিড়ি সামনে এসে নিচে তাঁকিয়ে থেমে গেলো। জেহের’কে আজ কি সুন্দর লাগছে। মুখের হাসি’টা মন কেড়ে নেওয়ার মতো। আরজা ওর দিকে তাঁকিয়ে আনমনে বলে উঠলো…..
–কি হতো আমাকে একবার ভালোবাসলে জেহের ভাইয়া? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনাকে ছেড়ে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
বলতে না বলতে ওর চোখ বেয়ে শ্রাবন ধারা নামতে শুরু করলো। কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেয়ে আরজা তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে পেছনে তাকালো। ফাইজা’কে দেখে মুখের হাসি’টা চওড়া করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কোথা থেকে তনুজা এসে তাড়া দিয়ে বলে উঠলো….
–তোরা এখনো এখানে দাড়িয়ে কেনো? ওইদিকে সবাই বসে আছে তোদের জন্য। তাড়াতাড়ি চল….
বলেই ওদের দুজন’কে নিয়ে নিচে নামতে লাগলো। আরজা’কে না চাইতেও মুখে হাসি ধরে রাখতে হচ্ছে।
____________________________________________
ফারদিন আর জেহের পাশাপাশি বসে আছে। স্টেজের সোফায়৷ চারদিকে নানা রকম ফুল বাতি দিয়ে সাজানো। সিড়ি দিয়ে ফাইজা আর আরজা দুজন’কেই নামতে দেখে ওরা দুজনে’ই হাবলার মতো চেয়ে রইলো। ফাইজা নিচে নেমে এসে ফারদিনের দিকে তাঁকাতেই ফারদিন হাত দিয়ে ওয়াও দেখালো। ফাইজা লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে উঠলো। ফারদিনের বরাবর অন্য একটা স্টেজে সোফা বিছানো। সেখানে আরজা আর ফাইজা’কে পাশাপাশি বসানো হলো। ওরা সবাই বসতে’ই জেহের মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো…….
–আজ সবাই’কে আরেক’টা খুশির খবর দিতে চাই। আমরা ভাই বোন মিলে একটা ডিসিশন নিয়েছি যে, আমরা দুজনে এক সাথে দুজনের ভালোবাসার মানুষ’টাকে বিয়ে করব। আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন আমার কথা। মানে আজ আমার ও মেহেন্দীর অনুষ্ঠান হবে……
জেহের কথা শেষ হতেই চারদিকে কড়ো-তালির শব্দে মুখরিত হতে লাগলো। আরজা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। মুহূর্তে’ই চারদিক ঘূর্নিপাকের মতো ঘুরতে লাগলো। গলায় এসে নিঃশ্বাস আটকে রইলো। চারপাশের কোনো শোরগোল ওর কান অব্দি পৌঁছালো না। কিছু সময়ের জন্য ও নিথর পাথরে পরিনত হলো। আরজা’কে নিস্তব্ধ দেখে জেহের ফাইজা’র দিকে অসহায় চাহনী দিতে’ই ফাইজা চোখের ইশারায় কিছু বুঝালো। তারপর আরজা’কে ধাক্কা দিয়ে খুশি মনে বলে উঠলো……
—কিরে তুই চুপ করে গেলি কেনো? আমার যে কি খুশি লাগছে। তোর খুশি লাগছে না।
ফাইজা’র কথায় আরজা নিজের ধ্যানে ফিরে এসে হকচকিয়ে বলে উঠলো….
–হ্যাঁ, খুশির খবর তো। আমার ও খুব খুশি লাগছে। দুটো বিয়ে খাবো……..
চেষ্টা করেও মুখে হাসি ফুটাতে পারলো না আরজা। ভেতরে যেই ঝড় বইছে তা কি করে বুঝাবে ও সবাই’কে। এই যন্ত্রনা বুঝার মতো কেউ নেই ওর। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষ’টাকে অন্যের সাথে বিয়ের পিরিতে বসতে দেখতে হবে। এই মৃ/ত্যু যন্ত্রনা ও কি করে সহ্য করবে? সব যন্ত্রনা ভেতরে চে’পে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে শুরু করলো মেহেন্দী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শুরু হলো ফারদিন আর ফাইজা’র কাপল ডান্স দিয়ে।
“Tumko paya hai to ”
jaise khoya hoon
kehna chahoon bhi
to tumse kya kahoon”
গান’টায় বেশ রোমান্টিক একটা ডান্স হলো ফারদিন ফাইজা’র। নাচ শেষ হতে’ই আরজা নিজেই ফাইজার হাতে খুব সুন্দর করে মেহেদী লাগিয়ে দিতে লাগলো। হাতের মাঝে ফারদিনের নামের অক্ষর’টা বসিয়ে দিলো। ফাইজা’র মেহেদী দেওয়া শেষ হতে’ই আরজা ফারদিনের হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিলো। আর ওদের কিছু কাজিন আত্মীয় স্বজন মিলে গান বাজনা নাচে ব্যস্ত। সবাই মিলে তা উপভোগ করছে। ফারদিনের হাতে মেহেদী লাগানো শেষ হতে’ই আরজা স্টেজ থেকে নামার জন্য পা বাড়াতে’ই জেহের বলে উঠলো…..
–আজ তো আমার মেহেন্দী। তাহলে আমাকেও মেহেদী লাগিয়ে দাও তো বাচ্চা।
জেহের কথা শুনে আরজা ভেতর থেকে ভেঙে গেলেও মুখে চওড়া একটা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো……
—হ্যাঁ দিচ্ছি জেহের ভাইয়া।
বলেই বুকের ভেতরে চা’পা যন্ত্রনা জেহেরের জাতে মেহেদী লাগিয়ে দিতে লাগলো। শেষ পর্যায়ে জেহের হাতে পিয়াঙ্কা নামের অক্ষর লিখতে গেলে জেহের বাধা দিয়ে বলে উঠলো…..
–আরে আরে কি করছো? “পি” লিখছো কেনো?
জেহের এই প্রশ্নে আরজা অবাক হয়ে জবাব দিলো
..
–আপনার ভালোবাসার মানুষ’টার নাম তো পিয়াঙ্কা তাই “পি” লিখছি…
এইবার জেহের একটু বিরক্ত নিয়ে উওর দিলো…..
–তোমাকে কে বলেছে এক লাইন বেশি বুঝতে। ওর ডাক নাম পিয়াঙ্কা কিন্তু আসল নাম “এ” দিয়ে তাই “এ” লিখো……
এইবার আরজার বুক’টা খানিক’টা কেঁপে উঠলো। নিজের নামের অক্ষর’টা জেহের হাতে লিখতে ওর বুক কাঁপছে। কি আশ্চর্য নামের অক্ষর এক কিন্তু মানুষ দুটো ভিন্ন। এইটুকু ভেবে একিটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে জেহেরের হাতে সুন্দর করে “Aj” লিখে দিলো। মেহেদী দেওয়া শেষ হতে’ই আরজা নিচে নেমে সবার সাথে নাচে যোগ দিলো। চারদিকে সাউন্ডবক্সে গান বাজচ্ছে।
“mehendi hai Rachne waali”
haathon mein gehri lali”
গান’টা বাজছে। আর আরজা তালে তালে সবার সাথে নেচে যাচ্ছে। জেহের মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে।
____________________________________________
সবার চোখের আড়ালে ফারদিন এসে ফাইজা’র হাত ধরে লুঁকিয়ে উপরে নিজের রুমে নিয়ে আসলো। এক হাত দিয়ে দরজা’টা বন্ধ করে ফাইজা’কে দরজার সাথে চে’পে ধরে মুগ্ধ নয়নে ওর দিকে তাঁকিয়ে রইলো। আর ফাইজা হা করে বলে উঠলো…..
–দিদা যদি দেখেছে আমরা একসাথে আপনাকে…..
আর বলতে পারলো না তার আগেই ফারদিন ফাইজা’র ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ডিপলি একটা চুমু খেয়ে নেশাময় কন্ঠে বলে উঠলো…..
–অর্ধেক পাগল তো আগে’ই করে দিয়েছিলে। এখন কি পুরো পা’গল করার ধান্দায় নেমেছো জান…..
বলে ফাইজা’র গলায় মুখ ডুবালো। ফাইজা মুহূতে’ই আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। দুই হাত মেহেদী ভর্তি। তাই চাইলেও ফারদিন’কে সরাতে পারছে না।আর ফারদিন সে তার প্রেয়সীর শরীরের ঘ্রানে ব্যস্ত………
#চলবে