#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সাইত্রিশ[প্রথমাংশ]
[Holud Special]
হলুদ লেহেঙ্গার সাথে লাল আর হলুদ কম্বিনেশনে গহনা পড়েছে ফাইজা। খোলা চুলে সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ফারদিনের আবদারে চুল খোলা রাখতে হয়েছে। আরজা আজো ফাইজার মতো সেম কালার লেহেঙ্গা আর গহনা পড়েছে। কিন্তু ওর চুল গুলো স্টাইল করে বেনুনী করে বাধা আর বিভিন্ন রঙিন ক্লিপ লাগানো চুলে। আরজা’কেও দেখতে খুব মিষ্টি লাগছে। কাল অনুষ্ঠান শেষে ফাইজা জোর করে আরজা’র হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছিলো। হাতের মাঝে [AJ] খুব সুন্দর করে লিখে দিয়েছে। এতে অবশ্য আরজা’র খটকা লাগে’নি কারন আরজা যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার নাম ও J দিয়ে। আরজা’র মুখে আজ চওড়া হাসি। মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিক ঠাক আছে আজ। খুব সহজে’ই মেনে নিয়েছে সব আরজা। কেনো যেনো এই ব্যাপার’টায় জেহেরের খটকা লাগছে। জেহের, ফারদিন আজ বাসন্তী আর লাল কম্বিনেশনে পাঞ্জাবী পড়েছে। হাতে আজ সিলভার কালার ঘড়ি। ফারদিন সব কিছুর তদারকি করছে আর জেহের মন ম’রা হয়ে এক কোনে চেয়ারে বসে বসে ভাবছে…..
–একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার ড্রামাকুইন’টা খুব কষ্ট পাচ্ছে। মুখের হাসি বিলিন হয়ে গেছে। চঞ্চল মেয়ে’টা শান্ত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো, আমার ও তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু, জানো তো, কষ্টের পর স্বস্তি আছে। আর এটা তোমার শাস্তি। কি শাস্তি জানো, আমাকে ভালোবেসেও অন্য একজনের সাথে টাইম পাস করার শাস্তি…….
কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে জেহের হকচকিয়ে উঠে ঘুরে তাঁকিয়ে দেখে আরজা’র মা দাড়িয়ে আছে। আরজা’র মা’কে দেখে’ই জেহের দাড়িয়ে পড়ে সালাম দিয়ে অন্য একটা চেয়ার তার দিকে এগিয়ে দিলো বসার জন্য। আরজার মা বসতে বসতে জেহের’কেও বসার জন্য ইশারা করলো। জেহের মাথা নিঁচু করে শান্ত কন্ঠে বললো….
–আমাকে ক্ষমা করবেন আন্টি। আমি জানি আমি আপনাদের মেয়ে’কে খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছি। আর মাত্র একটা দিন তারপর আর কোনোদিন আপনার মেয়ে’কে কষ্ট দিব না আন্টি প্রমিস…
জেহেরে’র নিঁচু স্বর শুনে আরজা’র একটু হেসে জেহের’কে বলে উঠলো……
–আমি জানি বাবা তুমি আমার মেয়ে’কে খুব বেশি ভালোবাসো। আর, এই সারপ্রাইজ’টা পেয়ে আমার মেয়ে তোমার উপর রেগে থাকতে’ই পারবে না। আমি তো শুধু তোমার সাথে কথা বলার জন্য আসলাম।
আরজা’র মায়ের কথায় জেহের এইবার স্বস্তির হাসি হাসলো। ভেবেছিলো মেয়ের কষ্টে হয়তো উনারা ও কষ্ট পাচ্ছে। তাই আগেই অনুতপ্ত হয়ে কথা গুলো বলেছে।
___________________________________________
তনুজা আর সায়মা খানম মিলে ওদের দুজন’কে নিয়ে নিচে নামলো। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। আজো কালকের মতো আরজা আর ফাইজা এক সোফায় আর ফারদিন জেহের এক সোফায়। জেহের’কে আজ খুব সুন্দর লাগছে। না চাইতেও আরজা’র চোখ বার বার ওই দিকে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ফারদিন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্য হাসি মুখে বলে উঠলো…..
–আজ অনুষ্ঠান শুরু হবে আমার একমাত্র শা’লিকার একটা মন মাতানো গান দিয়ে সাথে সুর মেলাবে তার ওয়ান এন্ড অনলি জিজু ফারদিন। সবাই রাজি তো……..
ফারদিনের কথা শুনে সবাই এক সাথে কড়ো তালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে সম্মতি জানালো। আর আরজা অস্বস্তি’তে পড়েছে। গান’টা ও বরাবর খুব ভালো গায়। ছোট বেলা থেকে’ই গানের প্রতি জোঁক বেশি ওর। গান ও শিখেছে কয়েক বছর। কিন্তু অনেক দিন গানের সাথে ওর দেখা সাক্ষাত নেই। এই মুহূর্তে কি গান গাইবে তা নিয়ে খুব বেশি ভাবনায় পড়ে গেলো। ফারদিন স্টাইল করে গিয়ে আরজার দিক্ব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো……
–কাম ইন মাই হাফ-ঘাড়ওয়ালি…..
সবাই আরেকবার করোতালি দিয়ে উঠলো। আরজা’র অস্বস্তি নিয়ে ফারদিনে’র হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। মাইক্রোফোন’টা হাতে নিয়ে জেহেরের দিকে একবার নজর দিলো। জেহের এক দৃষ্টি’তে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে তা দেখে তাড়াতাড়ি আরজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ফারদিনের কাছে গানের’ নাম’টা বলতে’ই ফারদিন অসহায় ফেস করে ফিসফিসিয়ে আরজা’র কানে বললো…..
–আজ এত সুন্দর একটা দিনে তুমি এই ছ্যাকা খাওয়া মার্কা গান গেয়ে সবাই’কে ইমোশনাল করে দিবে তো শা’লিকা…….
ফারদিনের কথা আরজা স্বশব্দে হেসে উঠলো। দুষ্টুমি ভঙ্গিমাতে বলে উঠলো….
–আমি তো আর আমার জিজুর মতো রোমান্টিক নই যে রোমান্টিক গান গেয়ে সবাই’কে রোমান্টিক বানিয়ে দিব। এই দায়িত্ব’টা বরং আমার জিজুর থাকুক আর আমি না হয় দুঃখ বিলাশ করার জন্য এই গান’টাই গাইলাম……..
আরজার এহেতুক কথা শুনে ফারদিনের মুখ’টা চুপসে গেলো। উওর দেওয়ার শব্দ খুঁজে পেলো না। হাফ ছেড়ে বললো…..
–যথা আজ্ঞা। আপনি যাহা বলিবেন তাহা’ই হইবে…..
বলে দুজনে’ই একসাথে হেসে উঠলো। আরজা’র কথা মতো ফারদিন গিটারে সুর তুলতে লাগলো। আর আরজা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গান’টা শুরু করতে যেয়েও কয়েকবার থেমে গেলো। ওর বুকের ভেতরে সুনামি শুরু হয়েছে। এলোমেলোহীন ঢৈউ এসে বার বার তীরে আছড়ে পড়ছে। চোখের পাতা দুটো নোনা জল দ্বারা ভারী হতে লাগলো। তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে জেহেরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাইতে শুরু করলো……
“তুমি যাকে ভালোবাসো”
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়…
তোমার কথায় শব্দ দূষন
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর….
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘুর….
এইটুকু গেয়ে থেমে গেলো ওর গলার স্বর আটকে আসচ্ছে। বুকের ভেতর চে’পে আসচ্ছে। জেহেরের দিকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে দিয়ে আবার গাইতে শুরু করলো…….
তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্য দল
বাঁচার লড়াই…..
আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে
একটা চালের ভুল
কোথায় দাড়াই……?
কথার উপর কেবল কথা
সিলিং ছুঁতে চায়..
নিজের মুখে আয়না আদল
লাগছে অসহায়….
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান….
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান……
এইটুকি গেয়ে আর গাইতে পারলো না আরজা। চোখ থেকে নেমে এলো অথৈজল। চোখের নোনা জল সবার থেকে আড়াল করার জন্য গান’টা এইটুকু গেয়েই দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেলো। আরজা’কে ওমন ভাবে দৌড়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে আছে। আর জেহের নিস্তব্দ হয়ে মাথা নিঁচু করে আছে। ওর চোখ থেকেও টুপটাপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ফারদিন অসহায় চোখে ফাইজা’র দিকে তাঁকাতে’ই দেখলো ফাইজা’র চোখেও জল। ফারদিন তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–আমার শা’লিকার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এর জন্য একটা হাত তালি অবশ্যই প্রয়োজন………
ফারদিনের কথায় সবাই এক সাথে হাত তালি দিয়ে উঠলো। কেউ কেউ শিষ বাজালো। নিরবতা কেটে গেলো সাউন্ড বক্সের গানে। ফাইজা স্টেজ থেকে নেমে আরজা পেছন পেছন গেলো। আরজা এক কোনে দাড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফাইজা গিয়ে আরজার কাঁধে হাত রাখতে’ই আরজা আচমকা ফাইজা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ফাইজা কি বলে স্বান্তনা দিবে খুঁজে পাচ্ছেনা। নিজেকে অপরাধী লাগছে। কাল আরজা’র কষ্ট দেখতে না পেরে অর্ধেক সত্যি’টা আরজা’কে বলে দিয়েছিলো। আরজা’কে বলে ছিলো জেহের কাউকে ভালোবাসেনা। আর বিয়েও অন্য কাউকে করবেনা। আর এটা বলেছে একটু অপেক্ষা কর তোর জন্য বিরাট একটা সারপ্রাইজ আছে। আরজা ফাইজা’র কথা ভাবার্থ পুরো বুঝতে পারেনাই। তাই আরজা কষ্ট পাচ্ছে কারন জেহের আরজা’র থেকে দূরে দূরে থাকছে তাই। আরজা কাঁদতে কাঁদতে বললো……
–জেহের ভাইয়া কেনো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ফাইজু। আমার সত্যি অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। এর থেকে ম’রে যাওয়া ও বোধহয় ভালো। আমার ম’রে যেতেই ইচ্ছে করছে……
ফাইজা এইবার রেগে আরজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলো….
–ম’রে যাবি তাইনা। কেনো ম’রে যাবি। কেনো এত কষ্ট পাচ্ছিস?
এইবার আরজা চুপ করে গেলো। আরজা কখনো ফাইজা’কে বলে’নি ও জেহের’কে ভালোবাসে। তাও কাল ফাইজা নিজেই বলেছিলো আরজা’কে অর্ধেক সত্যি। আজো আরজা’র নিশ্চুপ থাকা’টা ফাইজা মেনে নিতে পারছেনা। আরজা কথা এড়িয়ে যেতে চোখের জল মুছে নিয়ে বললো……
–গান গাইতে গাইতে আমি বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছি ফাইজু। কি বলতে কি বললাম এইসব নিয়ে ভাবিস না। চল চল ওইদিকে সবাই কি ভাবছে কে জানে? তাড়াতাড়ি আয়……
বলে আরজা সামনে পা বাড়ালো। আর ফাইজা ওর দিকে তাঁকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললো…..
—কাল তোর সব দুঃখ,যন্ত্রনা ঘুঁচে যাবে। আমার ভাই’টা ও কষ্ট পাচ্ছে। তাও কেনো এমন করছে কে জানে? হয়তো কিছু সারপ্রাইজ এমন বিষাদময় হয়…….
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও পা বাড়ালো সেদিকে।
আরজা স্টেজের সামনে এসে জেহের চুপসানো মুখের দিকে তাঁকিয়ে নিজে নিজে’ই হালকা হেসে বললো……
–ভালোবাসারা থাকুক হৃদয়ে লুকায়িত…
প্রকাশ হোক অশ্রুধারার বিষাদিনী যন্ত্রনা…….
#চলবে