যেদিন তুমি এসেছিলে – পর্ব 19

0
621

#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
অর্ষা অশ্রুশিক্ত নয়নে আহনাফের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আহনাফ হতবাক হয়ে জানতে চায়,’কাঁদছ কেন তুমি?’
দৃষ্টি নামিয়ে নেয় অর্ষা। জড়ানো কণ্ঠে বলল,’কই? না তো!’
আহনাফ নির্বাক হয়ে যায়। কথা বলার ভাষা আপাতত নেই। বলার মতে সে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা। মাথায়, শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় এখন তার রাগের আধিপত্য।
সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’আচ্ছা তুমি রুমে যাও।’
অর্ষা নিরবে যেমন বারান্দায় উঁকি দিয়েছিল সেরকমই নিরবে ঘরে ফিরে আসে। কী যে হচ্ছে তার সাথে! ঐটুকু কথায় চোখের কোণে পানি কেন আসতে হবে? আজকাল কি চোখের পানিও বেশি হয়ে গেছে? দুঃখের সাথে সাথে বুঝি অশ্রুও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
বাড়িভর্তি এত মানুষ। তবুও তার নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ, একাকি লাগছে। ইচ্ছে করছিল বন্ধুদের থেকে যেতে বলবে। কিন্তু ওদের-ও তো পরিবার, এছাড়া অন্যান্য কাজকর্ম থাকতে পারে। এসব ভেবেই মূলত সে এই আরজি করেনি। অপরদিকে এই বাড়িটিতে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, প্রিয় বন্ধুটি আহিল। সে এখন থেকেও না থাকার মতো। অন্য অনেকের মতোই সেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অর্ষার থেকে। অভিমান হয়েছে হয়তো। কতদিনই বা থাকবে? অর্ষার ধৈর্যশক্তি প্রবল। সে তার বন্ধুর ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকবে।
বিছানায় পা গুটিয়ে বসে থেকে নানাবিধ চিন্তা করছিল অর্ষা। চিন্তার রাজ্য থেকে ফিরে আসে রেণুর ডাকে।
রেণু ঘরে প্রবেশ করে বলল,’আপা, আপনার ভাই-ভাবি আসছে।’
অর্ষা খুশি হয়। ঠোঁটের কোণায় এক ছটা হাসি ফুটিয়ে জানতে চায়,’কোথায় এখন?’
‘বসার ঘরে আছে। আপনে আহেন।’
রেণুর সাথেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অর্ষা। ড্রয়িংরুমের সোফায় তখন ভাই-ভাবি আর তিয়াস বসে ছিল। ওদের সামনে হরেক রকমের খাবার। কুসুম এদিক-সেদিক তাকিয়ে বাড়ির সাজসজ্জা দেখছে। সে আজকের পূর্বে কখনো এই বাড়িতে আসেনি। রুহুলের মুখে অবশ্য অনেক গুনগান আর প্রসংশা শুনেছিল। তবে আজ স্বচক্ষে দেখে সে বশীভূত হয়ে গেছে। মনে মনে কেয়াকে সে ভীষণভাবে তিরস্কার করল। কতটা বোকা হলে এত বড়ো বাড়ি, রাজ্যের রানি হওয়ার সুযোগ পেয়েও এমন সুযোগ হাতছাড়া করে? এদিক থেকে অর্ষাকে তো নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী বলাই যায়।
অর্ষা সামনে এসে ভাই-ভাবিকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কেমন আছো?’
রুহুল অর্ষার হাত ধরে পাশে বসাল। আদরের কমতি নেই যেন। তিয়াস লাফিয়ে গেল অর্ষার কোলে। তার নিজস্ব ভাষায় এবং আধো আধো বু্লিতে সে অনেক কিছু বলছে অর্ষাকে। অর্ষাও সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে তিয়াসের সব কথা শুনছে। কখনো বা শব্দ করে হেসে উঠছে।
আমেনা বেগম অর্ষাকে বললেন,’কুসুম তো এই বাড়িতে প্রথম এলো। যাও ও’কে বাড়িটা ঘুরিয়ে আনো।’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। কুসুমও আমেনা বেগমের এই প্রস্তাবে বেশ খুশি হয়। তিয়াস অর্ষার কোলে। আর অর্ষা কুসুমকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাচ্ছে। সব রুম দেখানো শেষ হলে ওরা ছাদে আসে। ছাদে ফল-ফুলের বাগান। পুরো ছাদ জুড়েই গাছ-গাছালি। মাঝখানে একটা দোলনা রয়েছে। কুসুম গিয়ে দোলনায় বসল। আরাম করে দোল খেতে খেতে বলল,
‘তোর তো দেখি রাজ কপাল রে অর্ষা।’
কুসুমের কথাটি বুঝতে না পেরে অর্ষা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কেয়া বলল,’কার ভাগ্য কে নেয় তাই না? তোর জায়গায় থাকার কথা ছিল কেয়ার। আর এখন রাজ্যের রানি হয়ে গেলি তুই।’
একটু থেমে ফের তাচ্ছিল্য করে হেসে বলল,’তুই অবশ্য এমনিতেও এই বাড়ির রানি হতি। বাড়ির ছোটো রানি। তা আহিল কোথায়? তোর শোকে দেবদাস হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?’
আহিলকে জড়িয়ে এসব বাজে কথা শুনে অর্ষার মেজাজ চটে যায়। সে চোখমুখ শক্ত করে বলে,’উলটা-পালটা কথা বলবে না ভাবি। আর কতবার বলব আহিল আর আমি শুধুই বন্ধু?’
কুসুম শ্লেষেরসুরে বলল,’হয়েছে। বন্ধু নাকি কি তা বুঝি আমি।’
‘আজকাল অনেক ভুল বোঝা শুরু করেছ।’
কুসুম চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,’বাপরে! বড়ো লোক বাড়ির বউ হয়ে কি সাহস বেড়ে গেছে নাকি তোর? মুখে মুখে তর্কও করিস দেখি।’
অর্ষা বাঁকা হাসি প্রদান করে বলল,’আল্লাহ্ যদি এই সাহসটুকু আমায় বিয়ের দিনও দিত! তাহলে অনেক বাঁচা বেঁচে যেতাম।’
‘ঢং করিস না তো। আহনাফকে আমার পছন্দ ছিল না এ কথা ঠিক। কারণ ঐ ছেলে চরম বেয়া’দব। অবশ্য বেয়াদ’দবিও তো তোর জন্যই করেছিল। কেয়ার বর হিসেবে পছন্দ না হলেও তোর জন্য তো ঠিকই আছে। মিথ্যে বলব না, কেয়ার ওপর এখন আমার রাগ লাগছে। ও তো দেখছি তোর চেয়েও চরম বোকা। নয়তো এই সুবর্ণ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে? যাই হোক শোন, কান্নাকাটি, মন খারাপ করা এসব বাদ দে। আহিলের চেয়ে আহনাফ কোনো অংশে কম না।’
কুসুমের নিচু মানসিকতার সামনে কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না অর্ষা। সে নিশ্চুপ থেকে হার মানতে বাধ্য হয়। লোভী, স্বার্থপর ব্যক্তিদের সাথে সত্য-মিথ্যা নিয়ে তর্ক করা বৃথা। সে আদতে জানে, তাদের অগোচরে অনেকেই হয়তো ভাবে আহিল এবং অর্ষার মাঝে অদৃশ্য অথবা নামহীন কোনো সম্পর্ক রয়েছে। তবে এসব চিন্তা-ভাবনা মিথ্যা বৈ অন্যকিছুই নয়। মেয়েদের যে তৃতীয় নয়ন থাকে, এই নয়ন দ্বারা তার প্রতি আকৃষ্ট যেকোনো ছেলের হাভভাব, মনোভাব চট করেই ধরতে পারে। সেখানে এত কাছাকাছি থাকার পরও অর্ষা বুঝতে পারবে না? সে এটাও জানে, মানুষের ভাবনার ওপর জোর করা যায় না। যার যা ইচ্ছে ভাবুক; সত্যটা নিজেরা জানলেই হবে।
.
ভাই-ভাবি রাতের খাবার খেয়ে একেবারেই গেল। যাওয়ার পূর্বে রুহুল আমেনা বেগমকে বলল,’আন্টি আমি কিন্তু কাল সকাল সকালই আসব। এসে বোন আর বোন-জামাইকে আমার গরীবের বাড়িতে নিয়ে যাব। দুটো দিন থাকবে ওরা আমার বাসায়।’
এই বাড়িতে এসে কুসুমেরও পরিবর্তন হয়েছে। সেও রুহুলের সাথে সহমত পোষণ করে হেসে হেসে বলল,’হ্যাঁ, একদম কোনো বারণ শুনব না। আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ননোদ আর ননোদ-জামাইকে আপ্যায়ন করব। কোনো ত্রুটি রাখব না।’
আমেনা বেগম হেসে বললেন,’তোমাদের বোন, তোমাদের বোন-জামাই। তোমরা নেবে; সমস্যা কী? ধনী-গরীব কিছুই না রুহুল। আন্তরিকতা আর ব্যবহারই আসল।’
রুহুল সন্তুষ্টচিত্তে হাসল। যাওয়ার পূর্বে তিয়াসকে অর্ষার কোল থেকে নিয়ে অর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’সকালে তৈরি থাকিস কেমন?’
অর্ষা ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলো। রুহুল ফের বলল,’আহনাফ কোথায়? দেখছি না যে?’
অর্ষা নিচুস্বরে বলল,’উনি বাইরে গেছে।’
‘ওহ। আচ্ছা ভালোমতো থাকিস। কাল দেখা হচ্ছে।’
‘সাবধানে যেও।’
ওরা চলে যাওয়ার পর অর্ষাকে নিয়ে নিজের ঘরে গেলেন আমেনা বেগম। জহির চৌধুরী শুয়ে ছিলেন। অর্ষা সালাম দেওয়ায় তিনি উঠে বসলেন।
সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,’ওয়া আলাইকুমুস-সালাম মা। বসো।’
অর্ষা খাটের একপাশে বসল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,’তোমার ভাই-ভাবি চলে গেছে?’
‘জি।’
কী জানি ভেবে একটু চুপ থেকে তিনি সুধালেন,’তুমি কি আমাদের ওপর রেগে আছো?’
অর্ষা ঠিক বুঝতে পারল না, কোন কারণে রাগ করার কথা জিজ্ঞেস করছেন তিনি। তাই চুপ করে রইল। তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,’আসলে তখন কিছুই করার ছিল না মা। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! তবে আমার ছেলেটা কিন্তু খারাপ নয়।’
কারণ জানতে পেরে অর্ষার বুকচিরেও দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আসলে এই প্রসঙ্গে তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ব্যতীত মুখ ফুটে বলার কিছু নেই।
আমেনা বেগম অর্ষার পাশে বসলেন। হাত ধরে বললেন,’শোনো, যেহেতু তোমাদের বিয়েটা এমন হুট করে হয়ে গেছে তাই আহনাফ কিন্তু এখনো রেগে আছে। ওর একটাই কথা, আমরা তোমার জীবন নষ্ট করেছি। কিন্তু তুমি তো সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছ বলো?’
অর্ষা কিছু না বলে এবারও চুপ করে রইল। তিনি বললেন,’আমরা তো ও’কে তোমাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলবই। যতটুকু মনে হয় রাজি হবে না। এক্ষেত্রে তুমি ও’কে রাজি করাতে পারবে। তুমি বললে শুনবে।’
এই পর্যায়ে অর্ষা বলল,’যেতে না চাইলে জোর করাটা কি ঠিক হবে?’
‘বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়ি যাচ্ছ। স্বামী ছাড়া একা যাওয়াটা খারাপ দেখায়। মানুষজন নানান ধরণের কথা বলবে। এমনিতেও এভাবে বিয়ে হওয়াতে কত কুৎসাই তো তারা রটাচ্ছে। তুমি শান্তভাবে বললেই রাজি হয়ে যাবে। পারবে না?’
অর্ষা ছোটো করে বলল,’আচ্ছা।’
রাতে খাবার টেবিলে আজ শুধু পরিবারের লোকজন। মেহমান সবাই আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছে। কাল সকাল সকাল সকলে নিজেদের বাড়িতে রওনা হবে। তাই খাওয়া-দাওয়ার পাট আগেই চুকিয়ে ফেলেছে। আজ ডাইনিংরুমে আহিলও উপস্থিত। কিন্তু সবসময়ের মতো চঞ্চল নয়; একদম স্তব্ধ। না তাকলে ওর উপস্থিতিও বোঝা যাবে না। অপরদিকে আহনাফ গম্ভীর হয়ে বসে আছে।
আফরিন আর অর্ষা সকলকে খাবার বেড়ে দেয়। জহির চৌধুরী বললেন,’তোরাও বোস।’
আমেনা বেগম চোখের ইশারায় জহির চৌধুরীকে প্রসঙ্গটি তুলতে বললেন। জহির চৌধুরী কেঁশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,’কোথায় চলে গেছিলে সন্ধ্যায়?’
আহনাফ খাচ্ছে চুপচাপ। মুখ না তুলেই গম্ভীর হয়ে বলল,’বাইরে।’
‘কোনো দরকারী কাজ ছিল? দেখলে যে অর্ষার ভাই-ভাবি এসেছে; বিদায় পর্যন্ত থাকা উচিত ছিল।’
আহনাফ নিশ্চুপ। তিনি একটু চুপ থেকে বললেন,’যাই হোক, কাল সকালে অর্ষাকে আর তোমাকে নিতে আসবে রুহুল। তৈরি থেকো।’
আহনাফ খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল,’নিতে আসবে মানে?’
‘মানে বিয়ের পর মেয়েরা যে বাপের বাড়ি যায়? নাইওর যায় যে! আফরিনও তো এসেছিল।’
‘তো যাক। আমি কেন? আমি কোথাও যেতে পারব না।’
‘এটা কেমন কথা বললি বাবু? নিয়ম মানবি না?’ বললেন আমেনা বেগম।
আহনাফ অল্প একটু খেয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। তাচ্ছিল্য করে বলে,’মানুষ কথা দিয়ে কথাই রাখে না; আর তো রইল নিয়ম! এগুলো কোনো বাধা-ধরা নিয়ম নয় মা। আমরা নিজেদের স্বার্থে এসব নিয়ম মেনে থাকি। তবে অর্ষা যাক। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
আহনাফ কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়। জহির চৌধুরী স্ত্রীর দিকে তাকান। আমেনা বেগমও হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকেন। শুধু আহিলই একদম ভাবলেশহীনভাবে খাচ্ছিল। খাওয়া শেষ করে সেও নিজের রুমে চলে যায়। অর্ষা খাবারের প্লেটে অযথা আঁকিবুঁকি করছে। শেষ ভরসা এখন সবাই তাকেই করছে।
রেণু টেবিল গোছাতে গোছাতে বলল,’আরে চিন্তা কইরেন না। অর্ষা আপারে তো আর ভাইজান রাগ দেখাইতে পারব না। আপার প্রতি ভাইজানের অনেক মায়া।’
জহির চৌধুরী আর আমেনা বেগমকে নিয়ম করে খাওয়ার পরে ওষুধ খেতে হয়। তাই তারা নিজেদের রুমে চলে গেছেন। যাওয়ার পূর্বে সবকিছু পূণরায় বুঝিয়ে বলে গেছেন অর্ষাকে। এখন এখানে শুধু অর্ষা, আফরিন আর রেণু।
রেণুর কথা শুনে আফরিন জিজ্ঞেস করল,’তুমি কী করে জানলে?’
রেণু দাঁত বের করে হেসে বলে,’আপনে যে কী কন না আপামনি! এসব কি জানোন লাগে? চোখ দেখলেই কওন যায়।’
‘বাব্বাহ্! তুমি দেখি অন্তর্যামীও হয়ে গেছ।’
রেণু হাসল। আফরিন অর্ষাকে বলল,’তুমি ঘরে যাও। ভাইয়াকে বলো গিয়ে।’
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে রুমে চলে যায়। আহনাফ সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছিল। অর্ষা কীভাবে কথা বলা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। শাড়ির আঁচল ধরে আঙুলে পেঁচাচ্ছিল।
আহনাফ একবার ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,’আজও কি সোফায় ঘুমাবে?’
প্রশ্ন শুনে অর্ষা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আহনাফ বলল,’তাহলে আমি উঠে যেতাম এখান থেকে।’
‘হু। সোফাতেই ঘুমাব।’
‘আচ্ছা।’ বলে আহনাফ বিছানায় চলে যায়।
অর্ষা সোফায় গিয়ে বসে। অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ করে থেকে মনে সাহস সঞ্চয় করে। কণ্ঠ পরিষ্কার করে বলে,’একটা কথা বলতাম।’
আহনাফ ল্যাপটপে কাজ করতে করতেই বলল,’বলো।’
‘আপনি আমাদের বাসায় যাবেন না কেন?’
‘এমনি।’
অর্ষা এতটাই সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছিল যে ফড়ফড় করে বলা শুরু করল,’এমনি কেন? কেয়া আপু থাকত বলে? তার কথা মনে পড়বে বলে? আপনি না বলেছেন আপনি তাকে ভালোবাসেন না? তাহলে সমস্যা কোথায়?’
কেয়ার নাম শুনে মাথায় রক্ত উঠে যায় আহনাফের। অপমানের কথা মনে পড়ে যায়। দগদগে ঘা আরো দগদগে হয়ে ওঠে। সে ল্যাপটপ ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। অর্ষা ভয়ে চমকে যায়।
আহনাফ চিৎকার করে বলে,’তুমি কি পুরনো ঘা খুঁচিয়ে আরো অপমান করতে চাইছ আমায়? কেয়ার নাম কেন বললে? আমি বলেছি না ওর নাম আমার সামনে বলবে না? এমনিতেই তোমায় দেখলে মাথা ঠিক থাকে না। ওর কথা মনে হয় আর রাগে-জিদ্দে ইচ্ছে করে নিজেকেই শেষ করি। তাও কেন? আমি যাব না তোমাদের বাসায়, সেটা একবারই বলে দিয়েছি। সবার সামনে বলেছি। তাও কেন যাব না ইত্যাদি ইত্যাদি কেন জিজ্ঞেস করা লাগবে বলো?’
অর্ষা ভয়ে কান্নাই করে ফেলে। পাশের ঘর থেকে আহিল অনেকক্ষণ যাবৎ সব শুনছিল। আর সহ্য করতে না পেরে সে এই ঘরে আসে।
আহনাফ তখনো রাগে ফুঁসছিল। আহিল রুমে এসে কান্নারত অর্ষার দিকে তাকায় একবার।
আহনাফের ওপর রাগ দেখিয়ে চিৎকার করে বলে,’তুমি ওর সাথে এভাবে কেন কথা বলছ?’
ছোটো ভাইকে দেখে ওর মাথা আরো গরম হয়ে যায়। অর্ষা উঠে এসে আহিলকে থামানোর চেষ্টা করে। ওদের ঝগড়া শুনে বাড়ির সবাইও এই ঘরে চলে আসে। পরিস্থিতিটা আগে বোঝার চেষ্টা করে। ক্ষিপ্ত আহিলকে ঘর থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে, এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয় আহিল।
আহনাফ গম্ভীরকণ্ঠে বলে,’তুই এখানে কেন এসেছিস?’
‘তুমি ওর সাথে খারাপ আচরণ কেন করছ? ওর দোষটা কোথায়? ও তো বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যায়নি। যতদূর জানি দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছে। ও’কে নিয়ে যখন তোমার এতই সমস্যা তখন কেন ‘না’ করোনি?’
আহনাফের রাগে মাথার রগ কাঁপছে। সে কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছুক নয়। সেদিন তো সে হুশেই ছিল না; যখন জানল কেয়া পালিয়েছে। এভাবে প্রতারণা করার, ঠকানোর তো কিছু ছিল না।
আহিল অর্ষাকে ধমক দিয়ে বলল,’বেরিয়ে আয় ঘর থেকে।’
অর্ষা আহতদৃষ্টিতে তাকায়। সে কী করে বেরিয়ে যাবে? আহিলকে সে কীভাবে বোঝাবে এখন শুধু সে তার বন্ধুই নয় বরং তার বড়ো ভাইয়ের বউ!
অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা-মা আহিলকে জোর করে নিয়ে যায়। অর্ষা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আহনাফের রাগ সীমা অতিক্রম করেছে। সে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে অর্ষার দিকে।
রাগে ফুঁসে উঠে বলে,’যেই মেয়ের প্রতি আমার চেয়ে আমার ভাইয়ের দরদ, মায়া, ভালোবাসা বেশি; তার সঙ্গে আমি সারাজীবন একসাথে থাকতে পারব না।’
এটা বলেই আহনাফ প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র গোছাতে শুরু করে।
অর্ষা কাঁদতে কাঁদতে বলে,’আপনিও কি ভাবেন আহিলের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে?’
আহনাফ এবার ধমক দিয়ে বলে,’লিসেন, আমার ভাইকে আমি চিনি। ও যদি তোমায় ভালোবাসত কিংবা তোমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক থাকত তাহলে আর কেউ না জানলেও মা জানত। আর মা সব জেনেশুনে তোমাকে আমার বউ করে আনত না।’
‘শুনুন, আমার ভুল হয়েছে। আমি আর কখনো তার নাম বলব না। আপনাকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ফোর্সও করব না। প্লিজ আপনি আমার ওপর রাগ করে সবাইকে ছেড়ে যাবেন না। এত রাতে বের হবেন না প্লিজ!’
আহনাফ আর কিছু না বলেই জিনিস-পত্র নিয়ে তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। জহির চৌধুরী, আমেনা বেগম অনেক থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে বাবা-মা কারও বারণই শোনে না।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here