#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বোনাস_পার্ট(২)
প্রায় বিশ মিনিট ধরে কান ধরে উঠবস করছে ফারদিন। ওর সামনে’ই বুকে হাত গুঁজে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে ফাইজা।
টিচা’র হয়ে স্টুডেন্টের সামনে কান ধরে উঠবস করার মতো বিরল দৃশ্য এই প্রথম ঘটলো মনে হচ্ছে ফাইজা’র কাছে। ফারদিনের অবস্থা এখন “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি”। আরজা, তনুজা, আর সায়মা খানম পাশেই সোফায় বসে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ সেই তখন থেকে ফাইজা’ রাগ করে ছিলো। কিছুতে’ই বিয়ে করবে না আজ বলে’ই দিয়েছে। ঘড়ির কাটা চার’টা ছুঁইছুঁই। ফারদিন বেচারা ফাইজা’র হাতে পায়ে ধরার মতো অবস্থা হয়েছিলো। শেষ অব্দি ফাইজা শাস্তি হিসেবে একশো বার কান ধরে উঠবস করতে বলেছে। নিজের বিয়ে বাঁচানোর জন্য এখন ফারদিন’কে কান ধরে উঠবস করতে হচ্ছে। ফারদিনের চেহারা’টা এখন এত’টা অসহায় লাগছে যা দেখে’ই ফাইজা কিছু’তে হাসি থামিয়ে রাখতে পারছেনা। তাও, অনেক কষ্ট হাসি দমিয়ে রেখে মুখে গম্ভীর্য ধরে রেখেছে। আরজা’র হাসি দেখে ফারদিন ওর দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁতে দাত চে’পে বলে উঠলো…..
–আজ আমার মতো অসহায় একটা ছেলে পেয়ে তোমরা দুই হিটলার অত্যাচার করছো। কিন্তু, কলেজে। ভুলে যেও না আমি তোমাদের টির্চার। সেখানে আমি যেইটা বলব সেইটাই করতে হবে। মাইন্ড ইট শা’লিকা……
বলে চোখ টিপ মা’রলো আরজা’কে। ফারদিনের কথা শুনে আরজা’র হাসি মুখ’টা চুপসে গেলো। সত্যি, তো কলেজে গিয়ে না জানি এইসবের শোধ কিভাবে তুলবে ফারদিন? এইসব ভেবে’ই আরজা’র মুখ’টা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। ফাইজা’ আরজার অবস্থা দেখে ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাঁকিয়ে বললো…..
–লিস্টেন, মিস্টার ফারদিন আবসার বাড়িতে আপনি সম্পর্কে আমার হবু বর আর আমার বেস্টুর একমাত্র জিজু। তাই বাড়িতে আমরা যা খুশি করতে পারব। বাড়ির সম্পর্ক আর কলেজের সম্পর্ক গুলিয়ে জগা-খিচুড়ি বানাবেন না……
বলে মুখ বাঁকালো। ফাইজা’র কথা শুনে আরজা এইবার একটু মনে জোর পেলো। জেহের অনেক ক্ষন আগেই এদের মাঝ থেকে উঠে চলে গিয়েছিলো। মনের মধ্যে শান্তি নেই ওর। তাই ঘুমাতে চলে গেছে। ফারদিন কান ছেড়ে দিতে’ই আরজা জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
–এই চিটিং চিটিং। মাত্র ৩০ বার হয়েছে। আরো ৭০ বার বাকি হ্যা মেরি জিজু……
আরজা ও এইবার এইটুকু বলে ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে চোখ টিপ মা’রলো। ফারদিন কোমরে হাত দিয়ে ন্যাকা স্বরে বলে উঠলো…..
–বিয়ের আগে’ই যদি বুড়ো বানিয়ে দিতে চাও তাহলে আমি আরো ৭০ বার কান ধরে উঠবস করতে রাজি।
আরজা ফারদিনের কথা শুনে কিছু একটা ভাবলো তারপর ভাবুক স্বরেই বললো……
–থাক থাক আপনার শাস্তি মাফ। আমার এই স্মার্ট জিজু’টাকে আমি বুড়ো বানাতে চাইনা….
বলে লাজুক হাসলো। ফারদিন যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফাইজাও আরজা’র তালে তাল মিলিয়ে ফারদিন’কে মাফ করে দিলো। ফারদিন খুশিতে লাফিয়ে উঠে দৌড়ে গিয়ে আরজা’কে জড়িয়ে ধরে ওর গালে চু’মু খাওয়ার জন্য কাছে যেতে’ই আরজা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো……
–ফাইজু রে বাঁচা…….
আরজা’র চিৎকারে ফারদিন থতমত খেয়ে থেমে গেলো। খুশির চোটে বউ’কে রেখে শা’লি’কে চুমু খেয়ে ফেলছিলো ভেবে জিভে কামড় দিয়ে কান ধরে নিঁচু স্বরে বললো……
–স্যারি স্যারি শা’লিকা। বউ’কে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে হাত ফস্কে শা’লিকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। ক্ষমা করে দাও প্লিজ প্লিজ……
সরে এলো আরজা’র কাছ থেকে। পেছনে ঘুরে দেখলো ফাইজা’র রাগী ফেস করে কোমড়ে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে৷ তা দেখে ফারদিন ঢোঁক গিলে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো…..
–বিশ্বাস করো বউ হাত ফস্কে হতে গেছিলো সর্বনাশ’টা। আমার কোনো দোষ নেই….
ফারদিনের মুখের রিয়েকশন দেখে এইবার উপস্থিত সবাই উচ্চোস্বরে হেসে দিলো। পুরো ঘর জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেলো। আর ফারদিন লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। তনুজা আর সায়মা খানম সবাই’কে তাড়া দিতে লাগলো ঘুমানোর জন্য। আর ফারদিন চোখের ইশারায় ফাইজা’কে ঘুমাতে বারন করছে। তাই ফাইজা’ আমতা আমতা করতে’ই আরজা বুঝতে পারলো। দুষ্টুমি ভঙ্গি’তে ফারদিনের সামনে দাড়িয়ে বলে উঠলো…..
–জিজু তখন উড়ে আসা লা’থি’ খাওয়ার সাধ কেমন ছিলো……
এইটুকু বলে’ই ফারদিন’কে ভেংচি কেটে আরজা দিলো দৌড়। ব্যাপার’টা বুঝতে ফারদিনের কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। যখ’নি বুঝতে পারলো তখনি জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..
—“তবে’রে আজ দেখাচ্ছি মজা দাড়াও”
সেও আরজা পেছন পেছন ছুটলো। ফাইজা’ও ওদের পেছন ছুটলো। তনুজা আর সায়মা খামন দুজনে ওদের কান্ডে হাসতে লাগলো।
____________________________________________
ছাদে এসে তিন’টায় মিলে এক সাথে হাসতে লাগলো। ফারদিন হাটু’তে ভর দিয়ে ঝুঁকে হাঁপাচ্ছে। ফাইজা’র যেনো কিছুতে’ই হাসি থামছেনা। পুরো বাড়ি রঙিন বাতি’তে ঝলমল করছে। আরজা হাসি থামিয়ে বলে উঠলো…..
–এইবার আপনারা দুজন প্রেম করুন আমি আসচ্ছি….
বলে নাচতে নাচতে চলে গেলো। আরজা চলে যেতে’ই ফারদিন দুষ্টু’মি ভঙ্গিতে ফাইজা’র দিকে তাঁকিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে বলে উঠলো….
–এইবার তুমি কোথায় যাবে জান….
ফারদিনের মুখের ভঙ্গি’মা দেখে’ই ফাইজা’র এতক্ষনের সব হাসি উড়ে গেলো৷ ঢোঁক গিলতে লাগলো একের পর এক। হৃদ যন্ত্রনা লাফাতে শুরু করলো। আমতা আমতা করে পেছনে যেতে গিয়ে দোলনার সাথে লেগে দোলনায় বসে পড়লো।।ফারদিন এগিয়ে এসে ফাইজা’র দুই পাশে হাত রেখে ফাইজা’র দিকে ঝুঁকলো। এতটাই কাছে ঝুঁকে আছে ফারদিন এক্ষুনি কথা বললে ঠোঁট ফাইজা’র ঠোঁট স্পর্শ করবে। ফাইজা ফারদিনের কলা’র চে’পে ধরে বলে উঠলো….
–কি ভেবেছেন শুধু আপনি’ই পারেন সব কিছু করতে। আর আমি শুধু ভয় পেয়ে যাব। কাবি নেহি…….
বলে এই প্রথম ফাইজা ফারদিনের ঠোঁট ঠোঁট রাখার প্রস্তুতি নিতে’ই ফারদিন সরে আসলো ফাইজা’র কাছ থেকে। এতে ফাইজা মুখ টিপে হাসলো। ফারদিন ফাইজা’র থেকে দূরে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো….
–ইয়ে মানে আজকে’ই যদি সব রোমান্স করে ফেলি তাহলে কালকের জন্য কি রাখব জান……
ফারদিনের কথা শুনে ফাইজা নিঃশব্দে হাসলো। ফারদিন ও একটু হেসে মাথা চুলকে ফাইজা’র পাশে এসে বসে পড়লো। এক হাতে ফাইজা’কে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো। ফাইজা ও দুই হাতে আকড়ে ধরলো ফারদিন’কে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো…..
–আপনি আমার এক টুকরো সুখের রাজ্য। এই রাজ্য ছেড়ে আমি কখনো দূরে যেতে চাইনা…..
ফারদিন ফাইজা’র থুতনি তুলে ধরলো নিজের দিকে। ফাইজা’র গালে হালকা কামড় দিয়ে বললো…..
–এতক্ষন ইচ্ছে করে আমাকে হেনস্তা করার শাস্তি এটা…..
ফাইজা একটু দুষ্টু হেসে ফারদিনের কলা’র ধরে নিজের কাছে নিয়ে ফারদিনের গালে জোরে কামড় দিয়ে উঠলো। ব্যাথায় ফারদিন “মা’গো” বলে জোরে জোরে গাল ডলতে ডলতে বলে উঠলো…..
–হোয়াট ইজ দিস জান?
ফাইজা আঙ্গুল দিয়ে নিজের চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ডোন্ট কেয়ার ভাবে বললো…..
–অন্য মেয়ে’কে চু’মু খাওয়ার শাস্তি এটা…..
অন্য মেয়ে কাকে আবার চু’মু খেলাম। এই প্রশ্ন’টা করতে গিয়েও ফারদিন থেমে গেলো। কিছুক্ষন আগের ঘটনা মনে করে হেসে দিলো। ফাইজাও তালে তাল মিলিয়ে হেসে দিলো। তারপর দুজনে’ই দুজন’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। ভোরের আলো ফুটতে আর বেশিক্ষন নেই। এই কয়েক মুহূর্ত দুজন নিরবে কাটাবে। এই সময়’টা হবে ওদের দুজনের। দোলনা বাতাসের তালে তালে দুলে যাচ্ছে। কয়েক মুহূত কেটে গেলো এভাবেই নিরব। উপভোগ করতে লাগলো সময়’টা। ফাইজা ফারদিনের বুকে চুপটি করে মাথা রেখে আছে। ফারদিন নিঁচু স্বরে বলতে লাগলো……
–তোমাকে পেয়ে আমি নতুন করে বাঁচতে শিখেছি। তুমি আমার হাসির উৎস। আমি জানি তোমার মনের কোথাও না কোথাও একটা দুঃখ রয়ে গেছে যে, তুমি কোনোদিন মা হতে পারবে না। কিন্তু, বিশ্বাস করো আমার এটা নিয়ে এক বিন্দু আফসোস নেই। কোনো মেয়ে মা হতে পারবেনা এটা জেনে বাইরের লোক যেই আচরণ’টা করে এটা আদৌ কোনো মনুষ্য জাতির কাজ হতে পারেনা। মেয়ে’রা হলো মায়ের জাত। ওদের সম্মানের জায়গা’টা সবার উপরে। ওরা কত সুন্দর দুই হাতে সংসার সামলে রাখে। তাও দিন শেষে সব দোষ মেয়েদের হয়। কত মেয়ে’কে এইজন্য শুশুড় বাড়ি ছাড়া হতে হয়। কিন্তু, কেউ একবার ও ভাবেনা যে, এই মেয়ে’টা নিজে কত’টা কষ্ট পাচ্ছে। সবার যার যার দিক চিন্তা করে স্বার্থপরের মতো। মা হতে হলে কি গর্ভধারণ করতে’ই হবে এমন নয়। মা হতে হলে মায়ের মতো স্নেহ,ভালোবাসা থাকা’টাই যথেষ্ট। আচ্ছা সংসার করতে হলে, কাউকে ভালোবাসতে হলে কি রুপ, সৌন্দর্য, আর মা হওয়ার ক্ষমতা থাকতে’ই হবে এমন কি কোথাও লেখা আছে। দুটো মনের মিল হয় কোনো মানুষের রুপ আর সৌন্দর্যের তো মিল হয়না। আমাদের সমাজ’টা এখনো উন্নত হতে পারলো না। এইসব কথা কেনো বললাম জানো? তুমি প্লিজ কষ্ট পেও না। আমি তোমাকে মাতৃত্বের সুখ হতে বঞ্চিত হতে দিব না। ফুটফুটে একটা সদ্য জন্মানো বাচ্চা তোমাকে গিফট করব দেখো…….
ফাইজা’র চোখ থেকে গড়িয়ে পানি পড়ছে। নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে ভাগ্যবতী মেয়ে মনে হচ্ছে। কোনো ছেলে একটা মেয়ে’কে এমন করে বুঝতে পেরে। এটা ফারদিন’কে না দেখে বুঝতে পারতোনা ফাইজা। কোনো উওর না দিয়ে পূর্বের মতো চুপ’টি করে রইলো ফারদিনের বুকে। ফারদিন ও প্রেয়সীর মাথায় পরম আবেশে হাত বুলাতে লাগলো।
#চলবে