#পর্ব_১৫
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
বধূবেশে নিজের ঘরে বসে আছে আলো। বাবার মুখে শুনেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বর ও হুজুর চলে আসবে অতঃপর বিয়ে পড়ানো হলে আলো কারও অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে। ফুঁস করে সকল হতাশা ঝেড়ে ফেলে নিজের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগল। উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে এক ধ্যানে সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করল,
“মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়। হয়তো আমি তার ব্যাক্তিত্বের মোহে পরেছি। বাস্তবতার ভীড়ে এই খনিকের মোহ ঠিক কেটে যাবে।”
অনেকটা সময় চোখ বুজে সূর্য অভিমুখে থাকার পর চোখ খুলে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসে। নিজেই নিজে উৎসাহ দিয়ে বলে,
“এতো ভেঙে পরলে চলবে না। এতোদিন এতো দুঃখ সামলাতে পেরেছি যখন ভবিষ্যতেও পারব। আলো কখনও নিভবে না।”
প্রহর এসে পরেছে তার বধূকে তার প্রাসাদের রানী করতে। হুজুর, রেজিস্টার ও সাক্ষীও তৈরি। প্রহরেরই দুই বন্ধু শিতল ও নিয়াজ হবে সাক্ষী আর আরমান শেখের পুরোনো একজন বন্ধুও। আরমান শেখ ওদের বসার ঘরে বসিয়ে আলোকে দেখতে এসে দেখেন আলো বারান্দায়।
“আলো।”
আলো পিছু ঘুরে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য চোখে এখন আঁধার দেখছে। আরমান শেখ লাল শাড়ি পরিহিত নিজের কন্যাকে দেখল। মেয়েকে দেখে চোখের কার্নিশে নোনাজলেরা ভীড় জমিয়েছে। আলতো হাতে তা মুছে নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
“বাইরে এসো। সবাই চলে এসেছে।”
আলো আলতো হেসে বলে,
“বিয়ে পড়ানোর পরেই আমি বাহিরে যাব। ততক্ষণ এখানেই থাকতে চাই। আপনি হুজুর এখানে নিয়ে আসুন।”
“কিন্তু!”
আরমান শেখের চিন্তির বুলির জবাবে আলো বলে,
“আমি বিয়ের পরেই বরকে দেখব। আপনার কথায় যখন বরকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছি তাই বিয়ের আগে আর বরকে দেখার ইচ্ছে নেই।”
আরমান শেখ চুপচাপ চলে গেলেন। আলো বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসল। তার মস্তিস্কে এখন কোনো কথা, প্রশ্ন কিছু নেই। কেমন অদ্ভুত নিরব সব।
আরমান শেখ বাহিরে গিয়ে আলোর ইচ্ছা জানানোর পর প্রহর কোনো দ্বিমত করেনি। শিতল আলোর ঘরের দিকে গেলো তার পিছু পিছু আরমান শেখ ও হুজুর। আলো দরজার দিকেই চেয়ে ছিল। এক অচেনা মেয়েকে দেখে চোখে-মুখে প্রশ্নরা ভীড় জমিয়েছে। শিতল নিজেই বলল,
“আমি তোমার হবু হাসবেন্ডের বান্ধুবী। ওর পরিবার বলতে কেউ নেই তাই আমি ও আমার হবু বর এসেছি।”
আলো মুচকি হাসলে শিতল ওর পাশে গিয়ে বসে। হুজুর বিয়ে পড়ানো শুরু করে। বিয়ের সময় বরের নাম শুনে আলোর কেমন কেমন লাগলেও বরকে না দেখা পর্যন্ত স্বস্থি পাচ্ছে না। বিয়ে পড়ানো শেষে শিতল আলোকে নিয়ে বসার ঘরে যায়। আলোর দৃষ্টিতে বরকে দেখার উৎসুকতা। কিন্তু একি! বরের মুখের উপর ফুলের মালার পর্দা! আলো হতাশ হয় এদিকে প্রহর আড়ালে ঠোঁট চেপে হাসছে। রেজিস্ট্রি শেষে প্রহর ও আলোকে নিয়ে শিতল আলোর ঘরে রেখে আসে। উদ্দেশ্য একে অপরের সাথে একটু কথা বলুক ও দেখুক।
ঘরের ভিতরে ঢোকার পর আলো ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়ায় এদিকে প্রহর দরজা লক করে ব্যালকনিতে চলে যায়। মুখে তার এখনও ফুলের পর্দা! আলো অপ্রতিভ হয়ে যায় এমন সব কান্ডে। হঠাৎ ব্যালকনি থেকে ভেসে এলো পরিচিত সুর,
“আলো! একটু বারান্দায় আসবেন?”
আচমকা হকচকিয়ে উঠে আলো। এতো প্রহরের কণ্ঠস্বর! বরের নামও ছিল প্রহর শেহমাত। আলোর হৃৎপিন্ডের গতি যেনো আকস্মিক দ্রুত হলো। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বুকে হাত দিয়ে ধীর পায়ে সেই হৃদয়কারা কণ্ঠস্বরের সাড়া দিতে এগিয়ে গেলো। ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক পুরুষের পিঠ! এখনও মুখাবয়ব দেখতে পাচ্ছে না। মনের ভিতর অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। হাত-পা কেমন কাঁপছে। দরজাতেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। প্রহর বুঝল তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর মনের অবস্থা তাই বাঁকা হেসে নিজেই পিছনে ঘুরে। হাতে তার ফুলের পর্দা। আলোর অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখে তার চোখে-মুখে চমৎকার হাসি ফুটে ওঠে। আলো তোঁতলানো স্বরে অবাক হয়ে বলে,
“প্র..হ..র!”
প্রহরের হঠাৎ হাসি পায়। হাসি চেপে চোখে মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে বলে,
“এমন ভাবে বলছেন যেনো আমি ম*রে গিয়েছিলাম! বেঁচেই তো আছি। শুধু দশ ঘণ্টা আমাদের দেখা হয়নি। তাতেই এতো অবাক!”
আলোর অবাকের রেশ এখনও কা’টেনি। অবাক হয়েই সুধায়,
“আপনি জানতেন?”
“উমম, কাইন্ড অফ।”
প্রহরের চাপা জবাবে আলো ভ্রুঁ কুঁচকালে প্রহর আবার বলে,
“এটা সত্যি যে আপনার সাথে আমার প্রথম দেখার সময় আমি আপনাকে চিনতাম না। কারণ আমি আপনাকে আগে দেখিনি। আপনার নাম বলার পর কিঞ্চিত সন্দেহ হলে আপনার চেহারা ভালো করে দেখে বুঝলাম আপনিই সে। তারপর থেকে আপনি আমার নজরে।”
“তাহলে বললেন না কেনো? সকালে যখন বললাম তখনও কিছু বললেন না কেনো? আপনি কি আমার অসহায়তার মজা নিচ্ছিলেন?”
আলোর কণ্ঠে স্পষ্ঠ রাগের আভাস। প্রহরের কাছে যেনো বিষয়টা বেশ মজাই লাগল। আলোর দিকে হালকা ঝুঁকে বলল,
“কিছু কথা আড়ালে থাকার জন্যই আপনার মুখশ্রীতে এই অবাক হওয়াটা আমার দৃষ্টিগোচর হলো। বড্ড সুন্দর লাগে জানেন? এই কয়দিনে আপনার বিভিন্ন মুখের ভাব আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছে।”
আলো দূরে সরে কটমট বলল,
“আপনি জানেন আমার সারাদিনের কি অবস্থা ছিল?”
“হ্যাঁ জানিতো! তাইতো বরবেশে হাজির হলাম!”
প্রহরের কণ্ঠে রম্যতার ছাঁপ। আলো রেগে ওর হাত থেকে ফুলের পর্দার মালা নিয়ে ওর মুখেই ছুঁড়ে মারল! তারপর হনহনিয়ে ছাদের দিকে চলে গেলো। প্রহর অভিমানীনির অভিমানে অট্টস্বরে হেসে ওঠে।
সন্ধ্যার পর আলোকে নিয়ে প্রহর, শিতল, নিয়াজরা প্রহরদের বাড়িতে যায়। আলোকসজ্জিত বাড়ি দেখে আলোর ভিষণ পছন্দ হয় কিন্তু মুখে এখনও অভিমান পুষে রেখেছে। প্রহরকে শাস্তি দিতে প্রহরের ঘরে ঢুকে সেই যে দরজা দিয়েছে সেই দরজা প্রহর, শিতল, নিয়াজ শত ডেকেও খোলাতে পারেনি। সকালেই আলো দরজা খুলেছে।
সেই অভিমান ভাঙতে প্রহরের সপ্তাহ খানেকের বেশি লেগেছিল।
ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড____________
হঠাৎ কারও হাতের স্পর্শে প্রহর কল্পনা থেকে বাহিরে আসে। পিছনে ঘুরে দেখে শিতল। প্রহর নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“কিছু বলবি?”
“সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি। কিছু তো খেয়ে নে। নাহলে তুইও অসুস্থ হবি। তখন সব সামলাবে কে?”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“প্লিজ জোর করিস না। তোরা ঘুমিয়ে পর। আমার সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“তোকে স্যারকে খুঁজে বের করতে হবে প্রহর। নেপালে যেতে হবে এই সপ্তাহের মধ্যেই নয়তো ওরা জায়গা বদল করলে আর হয়তো খুঁজে পাবো না।”
প্রহর বলে,
“ওই নাম্বারটা মানে জাহাজের কোডটা নেপালের একটা জায়গার ছিল বুঝেছি কিন্তু ওরা এমন হিনটস কেনো দিলো?”
“হিনটস দিয়েছে কিন্তু আলোরও ক্ষতি করে দিয়েছে। আলোকে তোর দুর্বলতা ভেবে এসব করেছে যাতে তুই ভেঙে পরিস তারপর ওরা ওদের কাজ সেড়ে ফেলবে।”
“বড্ড ভুল করে ফেলেছে ওরা! এর হিসেব ঠিক দিতে হবে ওদের।”
“শোন, তুই আজকেই ভোর হবার আগেই বর্ডার ক্রস কর। হেড অফিসারকে বল চুপিচুপি সব ব্যাবস্থা করতে। তুই যে বাড়ি থেকে বেরোবি এটাও যেনো কেউ না বুঝে।”
প্রহর অবাহ হয়ে বলে,
“আজকেই? কিন্তু আলো?”
শিতল প্রহরকে ভরসা দিয়ে বলে,
“কিছু হবে না। আমি ও নিয়াজ সব সামলে নিব। যার জন্য সাথে নার্সও আনিনি। আমিই সব খেয়াল রাখব।”
প্রহর ভরসা পায় অতঃপর হেড অফিসারকে ফোন করে সবটা সংক্ষেপে বলে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,