প্রহর শেষে আলোয় রাঙা – Part 23

0
377

#পর্ব_২৩
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
আরও একটা প্রিন্টেড মেসেজ যায় যা দেখে প্রহর সত্যি সত্যি বছর আগের সবকিছু ঘাটাঘাটি শুরু করেছে। শিতলকে ফোন করে বলে,
“আজকে মনে হয় বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হবে। তোরা জেগে থাকিস না। আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে।”
শিতল বলে,
“আসতে হবে না। আমি সবার খেয়াল রাখব। তুই মন দিয়ে কাজ কর। আর হ্যাঁ, ত্রিশাল স্যারের ট্রিটমেন্ট শুরু করে দিয়েছে। আলোরটা কাল দেখবে।”
“সম্ভব হলে চলে আসব। আমি ল্যাবে আছি।”
ওদের কথোপকথন শেষ হলে শিতল বাড়ির সদর দরজা ভালো করে লক করে আলোকে বলে ঘুমাতে চলে যায়।
ল্যাবে বসে প্রহর সেকেন্ড মেসেজটা বারবার পড়ছে,
“ধরেন, আপনার একজন বেস্টফ্রেন্ড আছে। যে কীনা সবসময় আপনার সাথে নিজের জীবনের সব গোপন কিছু শেয়ার করে। কিন্তু হঠাৎ তার আরেক বেস্টফ্রেন্ডের উদয় হয় এবং সে আপনার সাথে কথা শেয়ার করা বন্ধ করে নতুন বেস্টফ্রেন্ডের সাথে শেয়ার করা শুরু করে। এমনকি একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তাও সে আপনাকে দেয় না। এমতাবস্থায় কি আপনার খারাপ লাগবে না? মনে হিংসা হবে না? এবার তাহলে নিজের শত্রুর ব্যাপারে এমনটাই ভাবুন!
ডার্ক বাটারফ্লাই”
প্রহর তারপর রেদোয়ানের হিস্ট্রি খোঁজা শুরু করে। স্কুল-কলেজে ভর্তির সবকিছু। তার এই খোঁজাখুঁজিতে জানতে পারে রেদওয়ান যাদের বাবা-মা বলত, সে তাদের দত্তক নেওয়া সন্তান। সকালে ঘুমঘুম চোখে বাড়ি ফিরে। বাড়ি ফিরেই ঘরে গিয়ে আলোকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরে। এমনিতেও তার গায়ে জ্বরজ্বর ভাব। এতো শারীরিক ধকল ও মানসিক চাপের জন্য শরীর ও মন দুটোই অবসন্ন। আলো আজও জেগে আছে। প্রথমে ভয় পেয়েছিল যে প্রহর বুঝে গিয়েছে কীনা? পরে যখন বুঝল প্রহর সেই অবস্থাতেই নেই তখন চিন্তা হতে শুরু করে। ঘরের দরজাটাও প্রহর লক করেনি। আলো শিতলকে মেসেজ করে দেয় প্রহরের জন্য একটা ঘুমের ইন*জে*কশন আনতে। ঘুম হলে ভালো লাগতে পারে।
শিতল ও ত্রিশাল এসে প্রহরকে ঘুমের ইন*জেক*শন দিয়ে যায়। ত্রিশাল মুচকি হেসে বলে,
“শিতল আমাকে গতকালকেই বলেছে তোমার এভাবে কোমাতে থাকার অভিনয় করার কারণ। আজকে শিতল, নিয়াজ ও কয়েকজন ফ্রেন্ড কিয়া ও রেদোয়ানের বাড়িতে যাবে। রেদোয়ানের চুলের স্যাম্পল ঠিক কালেক্ট করে নিবে।”
“ধন্যবাদ ভাইয়া। শিতল আপুকে তো ধন্যবাদ দিলেও কম হবে। এতোকিছু করার জন্য আমি সত্যি কৃতঙ্গ।”
“এমনিতে তো শুনব না। তোমার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিবে বুঝেছ। তারপর মানব।”
আলো জোড়ে হাসতে নিয়েও মুখ চেপে হাসি কন্ট্রোল করে বলে,
“সিরিয়াসলি? তুমি ওসব ভেবে বসে আছো? আগে নিজের ছেলেকে তো আনার ব্যাবস্থা করো। তারপর বাকিসব।”
শিতল লাজুক কণ্ঠে বলে,
“ব্যাবস্থা হয়ে গেছে।”
আলো ও ত্রিশাল অবাক হয়ে একসাথে বলে,
“সিরিয়াসলি? কনগ্রেটস।”
“থ্যাংকিউ। আমি কয়েকদিন আগে জানতে পারলাম। এতোকিছুর মধ্যে নিয়াজ ছাড়া কেউ জানেনা। সবে দুইমাস।”
আলো বলে,
“তোমাকে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে হবে না। এক কাজ করো। ত্রিশাল ভাইয়া ও নিয়াজ ভাইয়া যাক কিয়া আপুদের বাড়িতে। তুমি বাসায়ই থাকো। প্রহরের ঘুমের ইন*জেকশ*নটার রেশ ছয় ঘণ্টা পরে কে*টে যাবে। যাবে তো দুপুরে।”
“কিন্তু নিয়াজ এসব জানেনা আর ত্রিশাল কি পারবে?”
ত্রিশাল হাসিমুখে বলে,
“অবশ্যই পারব। তবে ওদের বেডরুমে ঢুকতে আমার রিওকে লাগবে। রেদোয়ান ভাই বাড়িতে না থাকা অবধি আমি কাজ সেড়ে ফেলব।”
“ঠিক আছে তবে সাবধানে। এখন আমাকেও ইন*জেক*শন পুশ করে দিন।”
ত্রিশাল চিন্তিত হয়ে বলে,
“প্রহরকে জানিয়ে রাখো। এটা ক্ষতিকর তুমি জানো।”
আলো দোটানায় পরে যায়। তার মনে ভয়ও কাজ করছে যদি প্রহর ব্যাপারটা ঠিক ভাবে না নেয়? আলোকে ভাবতে দেখে শিতলও বলে,
“চেষ্টা করে দেখো। তখন আমরা সরাসরি রেদোয়ানের কথা বলতে পারব। আজকে প্রহরের রিয়াকশন দেখো। প্রহরের স্বভাব তুমি জানো। আর একদিন তো সব সামনে আসবেই।”
আলো শঙ্কিত সব জানার পর প্রহরের অনুভূতি কেমন হবে। তারপরেও রিস্ক নিয়ে নেয়।
————
কিয়া ও ওর মা মিলে সবকিছু গোঁছগাছ করছে। রেদোয়ান অফিসে। কিয়া ওকে বলেছে জলদি আসতে কিন্তু রেদোয়ান বলেছে সে চেষ্টা করবে। রাত্রী, রিহাব, পরশ ওরা ওদের পার্টনারদের নিয়ে আসবে আর নিয়াজ ও ত্রিশাল একা যাবে। শিতলের শরীর খারাপের কথা শুনে কিয়া চেয়েছিল আজকের দাওয়াতটা ক্যান্সেল করে আরেকদিন করতে কিন্তু শিতল তা হতে দেয়নি। রেদোয়ান আজ ব্যাস্ত আর এটাই সুযোগ।
এদিকে রেদোয়ান চয়নিকার খোঁজ করছে সাথে ল্যাবে সেই ভাই*রাসটা এক্টিভ করার চেষ্টা করছে।আজ সে অফিসে যায়নি। এর আগেও দুই-তিনবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু অসফল হয়েছে।
_______
দুপুরে প্রহরের ঘুম ভাঙে। আলোকে যেভাবে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল এখনও সেভাবেই আছে। ঘুম ভাঙার পর আলোর মুখপানে অনিমেষনেত্রে চেয়ে আছে। আলো জেগে থাকলেও চোখ খুলতে পারছে না। নিঃশ্বাসও আটকে রেখেছে। প্রহর আলোর বুকে মাথা রেখে মুচকি হেসে বলে,
“বেশিক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে রাখলে অক্সিজেন স্বল্পতায় আমার সাহায্য নিতে হবে মুনলাইট!”
প্রহরের মুখ নিঃসৃত বুলি শোনামাত্র আলো নিঃশ্বাস ছেড়ে দেয়। হতবাক হয়ে নয়নজোড়া খোলে। ততক্ষণে প্রহর মুখ তুলে আলোর চোখের দিকে তাকিয়েছে। আলোর দৃষ্টিতে অবাকের রেশ ও দ্বিধা। প্রহর মুচকি হেসে বলে,
“আমি যতো অসুস্থ থাকি না কেনো, তোমার নিঃশ্বাসের কম্পন বুঝি। সেখানে তোমাকে জড়িয়ে রেখেও তোমার নিঃশ্বাসের কম্পন বুঝব না! যদি লা*শ হতাম তাহলে হয়তো তুমি সফল হতে।”
শেষোক্ত কথায় আলো হকচকিয়ে চায়। অনুশোচনা করে বলে,
“অ্যাই ডিডেন্ট মিন টু হার্ট ইউ প্রহর।”
“বাট ইউ ডু।”
আলো অসহায় দৃষ্টিতে প্রহরের নেত্রযুগলে নির্নিমেষ চেয়ে আছে। প্রহর উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে শিতল ও রঞ্জনা খালাকে ডাকে। রঞ্জনা খালা আসলে প্রহর বলে,
“খালাজান, আপনার বউমাকে খাবার দিয়ে আসেন।’
রঞ্জনা খালা অবাক হয়ে বলেন,
“কী বলছ তুমি? আলোমা তো কো*মাতে। ওকে খাওয়াব মানে?”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে খাবার বেড়ে নিয়ে যায়। রঞ্জনা খালা অবাক হয়ে সবটা দেখেই গেলেন। প্রহরের হুট করে কী হয়েছে বুঝতে পারছেন না।
“নাও। খেয়ে নাও। অনেকটা সময় গড়িয়েছে।”
আলো এখনও শান্ত ভাবে বসে আছে। খুব শান্ত দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকালো। তাতে অবশ্য প্রহরের ভাবমূর্তির কোনো পরিবর্তন লক্ষণীয় হলো না। প্রহর আবার বলে,
“এখন তুমি কো*মাতে নেই যে না খেয়ে থাকতে পারবে। অবশ্য সত্যি সত্যি কখনোই ছিলে কীনা জানা নেই।”
আলো ঠোঁট চেপে চোখের পাতা মুদন করতেই দুই ফোঁটা অশ্রুবিন্দু জলের ধারার নেয় টুপ করে গড়ালো। প্রহর পাশে এসে বসল। নিজের তর্জনী আঙুলি দিয়ে নিজের মুনলাইটের নেত্রকোন দিয়ে গড়ানো অশ্রুধারার পথ রোধ করল।
“ভেবোনা, এতে তোমার থেকে আমার দূরত্ব বাড়বে! নাহ্। যতোকিছুই হোক, আমার মন তোমাতেই মত্ত। তাই অতিরিক্ত চিন্তা না করে খেয়ে নাও।”
আলো ঢোক গিলে কণ্ঠে ধীরতা এনে বলে,
“আমি যা করেছি তোমার কাজ সহজের জন্য করেছি। রেদোয়ান ভাই যাতে আমাকে নিয়ে তোমাকে কোনো ব্ল্যা*কমে*ইল করতে না পারে। এটা ভেবোনা যে চয়নিকার বি*ষ দেওয়াটা অভিনয় ছিল! বি*ষ ঠিকই আমি খেয়েছিলাম। তারপরেই অ্যা*ন্টিডোট নিয়েছি যখন শরীর খারাপ করতে শুরু করেছিল তখনি। সেদিন আমার এই অভিনয়ের জন্যই জানতে পেরেছি রেদোয়ান ভাই সবকিছুর পেছনে। শিতল আপু আমাকে আগে থেকে জানত। ত্রিশালদাকে গতকাল জানানো হয়েছে।”
আলো থামলে দেখে প্রহর ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আলো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে প্রহর বলে,
“রেদোয়ান ভাই? আমার কাছে গতকাল দুইটা প্রিন্টেড মেসেজ এসেছে। শেষ মেসেজে রেদোয়ান ভাইকে ইঙ্গিত করেছে ভেবে আমি সার্চ করেছি। তারমানে তুমিই সেই ডার্ক বাটারফ্লাই?”
আলো কাঁচুমাচু দৃষ্টিতে প্রহরের চোখ থেকে নজর হটায়। প্রহর বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরে হতাশ কণ্ঠে বলে,
“চার বছর! চারটা বছর এক বাড়িতে, এক ছাদের নিচে একই ঘরে একসাথে থেকেও নিজের সঙ্গিনীকে চিনতে পারলাম না। কতো চতুরতার সাথে সব লুকিয়ে গেলো। হাহ্!”
আলো বলে,
“তুমিও অনেককিছু লুকিয়েছ যেমন, রঞ্জনা খালাজান তোমার মায়ের বান্ধবী ও তোমার ফুফিও হয় সম্পর্কে। শিতল আপু রঞ্জনা খালার মেয়ে। আমার মা তোমার মায়ের বান্ধবী।”
“দুজনেই লুকিয়ে গিয়েছি তবে সেটা তোমাকে কষ্ট দেয়নি। বাদ দাও সেসব। আমি ল্যাবে যাচ্ছি। সাবধানে থেকো। ইশ! ভুলেই যাই। ডার্ক বাটারফ্লাই নিজেকে সেভ করতে পারে।”
প্রহর ল্যাব কোট নিয়ে বেড়িয়ে যায়। আলো সেভাবেই চুপ করে বসে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here