#পর্ব_৯
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
রাত দশটার পর প্রহর বাড়ি ফিরে চয়নিকাকে দেখে তাচ্ছিল্য মিশ্রিত বাঁকা হাসে। সে ঠিকই জানতো চয়নিকা আসবে তাও তার অনুপুস্থিতিতে! মুখে অবাক হওয়ার ভান করে চয়নিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আরে চয়নিকা যে? কখন এলে? জানালে না তো?”
“সন্ধ্যায় এসেছি। আলোর কাছে মাফ চাইতে। কিছুদিন ওর সাথে থেকে বন্ধুত্বটা গাড়ো করব।”
প্রহর আলোর দিকে তাকায় অতঃপর চয়নিকাকে বলে,
“ভালো সিদ্ধান্ত। বন্ধুত্ব করাটা অনেক কঠিন একটা কাজ। সবার সাথে বন্ধুত্বটা ঠিক হয় না। যদি তুমি এফোর্ড বেশি দেও তবে হতে পারে। বেস্ট অফ লাক।”
এবার আলোকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আলো চয়নিকাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দিয়ে একটু রুমে আসোতো।”
আলো কিছু বলার আগেই চয়নিকা বলে ওঠে,
“গেস্টরুমের কী দরকার? তোমাদের পাশের রুমটাতেই ব্যাবস্থা করা যায়। কাছাকাছি থাকলে বন্ধুত্ব বাড়বে।”
প্রহর রম্যস্বরে বলে,
“ওই রুমে থাকলে তুমি তোমার সিঙ্গেল লাইফের উপর হাঁপিয়ে যাবে। ইউ নো ম্যারিড কাপল…! তাই গেস্টরুমটাই তোমার জন্য।”
চয়নিকা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করল। আলো লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নিজেই আগে রুমে চলে গেল। ওর পিছু পিছু প্রহরও চলে গেলে রঞ্জনা খালা এসে বলেন,
“চলেন আপামনি। আমি আপনেরে গেস্টরুম দেখায় দেই। জামা-কাপড় তো আনেন নাই। আমি আমার একটা কাপড় দিতাম?”
চয়নিকা রেগে বলে,
“ইউ ষ্টু*পিড। আমি তোমার ড্রেস পড়ব! ভাবলে কী করে তুমি?”
“তয় কি বউরানীর কাপড় পড়বেন? নিজের জামা-কাপড় আনলে আজকা আর মাইনষের জামা-কাপড় নিয়া টানাটানি করতে হইতো না।”
রঞ্জনা খালা আর জবাবের অপেক্ষা করে না। দ্রুত সটকে পরে। গেস্টরুমের লক খুলে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়।
__________
“আমার সাথে তুমি এমন করছ কেনো? আমি তোমার সাথে ওর ক্লোজনেস নিতে পারছি না। তোমায় ভালোবাসি বলে কতোকিছু করলাম। আর তুমিই আমাকে…..!”
অপরপাশ থেকে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব,
“কী আমি তোমাকে? আজ পর্যন্ত কোনো কাজও সঠিক ভাবে করেছ? তোমার খরচ সবতো আমিই দেই। এই লাক্সারিয়াস লাইফ লিড করছো কোনো কষ্ট ছাড়াই সেটা কোথা থেকে আসছে? আর এখন যা করছি তা কার জন্য করছি? আমাদের জন্যই তো।”
চয়নিকা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমি আবারও প্রেগন্যান্ট। প্লিজ এবার বাচ্চাটা নষ্ট করতে বলো না। তিনবার এবরশন করিয়েছ। এবার না। ”
ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তিটি নিরব রইলে চয়নিকা উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,
“প্লিজ কিছু তো বলো। আগেরবার চারমাসের বাচ্চাটা এব*রশন করিয়েছ। এবারেরটা করিয়ো না। আমি তো…”
চয়নিকাকে থামিয়ে অপরপাশের লোকটি বলে ওঠে,
“তাহলে খুব দ্রুত নিজের কাজটা করে ফেল। নয়তো আমি আমার উপায়ে কাজটা নিজে করব। যদিও তুমি আমার উপায়টা সহ্য করতে পারবে না!”
“না না। আমি তোমার সান্নিধ্যে আর কাউকে সহ্য করতে পারব না। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই কাজটা করে ফেলব। এখন আমি প্রহরদের বাড়িতেই আছি। আলোর সাথে সম্পর্ক ভালো করতে এসেছি। একটু তো সময় লাগবে ভরসা অর্জনের জন্য।”
অপরপাশের ব্যাক্তিটি শ*য়তা*নি হেসে বলে,
“জানো তোমার প্রতি আমার নেশা বারবার কেনো বাড়ে? তুমি আমার জন্য সব করতে পারো। আমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসো। আমার সব কথা শুনো তাছাড়া ইউ আর হট এনাফ বেইবি! দ্যাটস হোয়াই অ্যাই লাভ ইউ মোর।”
চয়নিকা মলিন কণ্ঠে বলল,
“বিয়ে করে নেও না! আমি সবসময় তোমার সাথে আমাদের বেবিকে নিয়ে থাকতে চাই।”
“করব তো। সবকিছু শেষ করে তোমাকে বিয়ে করব। অপেক্ষা করো। আমি তো তোমাকেই ভালোবাসি। এখন ভালো ও বাধ্য মেয়ের মতো আমার সবকাজ করে ফেলো তো। লাভ ইউ।”
চয়নিকার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে লোকটি ফোন কেটে দিলো। রাগে ফোনটা আছাড় দিয়ে চিৎকার করে বলে,
“এখন আবারও প্রেগনেন্সির ঝামেলা। আগেরবার অনেক কষ্টে এবরশনের জন্য রাজি করিয়েছিলাম। এবার কি করব! আমি চয়নিকাকে আমার জীবনে আনতে পারব না। কাজ শেষ তো চয়নিকাও শেষ। ওর কাছেও কিছু আছে যা হাসিল করতে আমার ওকে চাই। আমি তো আমার বউটাকেই ভালোবাসি! নাহলে কি কোনো প্রফিট ছাড়া ওকে বিয়ে করতাম!”
ওদিকে চয়নিকা খোলা জানালা দিয়ে দূর কৃষ্ণকায় তারকাময়ী অম্বরের এক ফালি বাঁকা চাঁদকে দেখতে দেখতে ভবিষ্যতের সুখচিন্তায় মুখর হয়ে আছে।
________
পরেরদিন খুব ভোরে প্রহর শাওয়ার শেষে নামাজ পড়ে বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছে। বেরোনোর আগে আলোকে জাগিয়ে দিয়ে এসেছে। বাগানের পেছোনের দিকের গেইট দিয়ে বেরিয়ে পিছনের জঙ্গলে গিয়ে দেখে যা আশা করেছিল তাই। রঞ্জনা খালা ওখানেই। প্রহর তাকে ডাক দেয়,
“খালাজান!”
চোখ মুছে পেছোনে ঘুরে প্রহরকে দেখে মলিন হাসেন রঞ্জনা খালা।
“তুমি এতো সকালে এখানে?”
প্রহর পকেটে হাত গুঁজে মাথা নুইয়ে হেসে বলে,
“একই প্রশ্ন আমি আপনাকেও করতে পারি।”
“তা করতে পারো। বহু বছর পর এই বাড়িতে আবারও এলাম। এখানে না এসে পারি? আমার প্রিয়জনরা তো এখানেই শায়িত।”
প্রহর একদৃষ্টিতে সামনের কবর তিনটির দিকে চেয়ে রইল। এই তিনজনকেই সে অনেক ভালোবাসত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অন্য কোনো সময় এখানে আসবেন না। আলো যেনো জানতে না পারে। মৃত্যুর কারণটা আমি এখনি আলোকে জানাতে পারব না। আমার মা যে আলোর মায়ের বান্ধুবী ছিলেন তাও আমি ওকে জানাতে পারব না।”
“তুমি আমিরকে শাস্তি দিবে না? তার আগে জেনে নিও তোমার ফুপিজান কোথায়? ”
প্রহর অবাক হয়ে বলল,
“ফুপিজান? ফুপিজানতো দাদাজানের অনুমতি ব্যাতিত পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন। মায়ের কাছ থেকে এতটুকুই শুনেছিলাম।”
“তুমি জানতে না প্রহেলি আমিরকে ভালোবাসত! অবশ্য তাকে চাচাজান ত্যাজ্য করেছিলেন। এই বাড়িতে তার নাম নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আমি, তোমার মা হিয়া, আলোর মা জ্যোতি ও প্রহেলি ছিলাম খুব কাছের বান্ধুবী। আমি অবশ্য তোমার ফুফিও হই। তোমার দাদাজানের চাচার নাতনী। আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর আমাকে ছোটোবেলাতে এখানে এনে রেখেছিলেন তোমার দাদাজান।”
প্রহর সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
“কিন্তু আমির মামার স্ত্রীর নাম তো হীনা। আমি তাকে একবার দেখেছিলাম।”
রঞ্জনা খালা চিন্তিত সুরে বলে,
“তাহলে বলতে পারি না। আমার কাছে প্রহেলির কোনো ছবিও নেই। সব ছবি চাচাজান জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আপনি এখন ফিরে চলুন। আলো এখুনি আপনাকে খুঁজতে বেরোবে। তাছাড়া চয়নিকার উপর বিশেষ নজর রাখবেন। আমার মনে হচ্ছে চয়নিকা কোথাও না কোথাও সবকিছুতে জড়িত। এখানে সে আলোর ক্ষতি করতেই এসেছে।”
“ওর উপর আমার সার্বক্ষণিক নজর থাকবে। তুমি নিশ্চিন্তে তোমার কার্যসাধন করো।”
প্রহর চলেই যাচ্ছিল আর তখনি রঞ্জনা খালা ওকে ডাক দিয়ে বলে,
“আমার মেয়েটা কেমন আছে প্রহর? আমার স্বামীর মৃত্যুর পর এই বাড়িতে এসে উঠলাম তারপর সব অঘটন ঘটলো। এই বাড়ির সাথে সংযুক্ত কাউকেই জীবিত রাখবে না বলে সেই ছোটোবেলায় মেয়েটাকে এতিমখানায় দিয়ে এসেছিলাম। তারপর এক নিঃসন্তান দম্পতি ওকে দত্তক নিলো আর চলে গেলো ঢাকা। আমিও চলে গেলাম আমার বাবার পুরোনো ভিটেতে।”
প্রহর হেসে বলে,
“ভালো আছে ও। সে কিন্তু জানে আপনি ওর মা। ওতোটাও ছোটো সে ছিল না। ঠিকই ফিরেছিল এই শহরে। আপনাকে আর পায়নি। খুব শীঘ্রই তাকে দেখতে পাবেন।
রঞ্জনা খালা তৃপ্তিময় হাসেন। রোদের প্রথম ঝিলিক বাগানে পড়তে পড়তেই রঞ্জনা খালা বাগান থেকে কিছু ঔষুধি পাতা সংগ্রহ করে বাড়িতে প্রবেশ করল। আলো রান্নাঘরে চা বানাচ্ছিল। খালাকে দেখে সহাস্যে বলে,
“আপনাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। পেলাম না। কোথায় গিয়েছিলেন?”
“কী বলব বউরানী, আমার তো ওইযে র*ক্তে চিনি বেড়েছে তাই সকালে এই পাতার রস খাই সবসময়। ওটা খুঁজতেই দেরি হয়ে গেল।”
আলো দেখল উনার হাতে তে’লাকুচা ও সজনে পাতা। আলো বলে,
“ওহ আচ্ছা। খান তাহলে। আমি চা বানিয়েছি। চয়নিকা আপুকে দিয়ে এসে প্রহরকেও দিবো।”
আলো মিষ্টি হেসে চা হাতে চলে গেলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,