#পর্ব_৪
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
দুইদিন পর চয়নিকার দুয়ারে একটা চিঠি এলো। চিঠিটা এসেছে ভোর পাঁচটায়! এতো ভোরে কোনো ডাকপিয়ন চিঠি বিলি করে বলে চয়নিকার জানা নেই। অনবরত কলিংবেলের তীব্র শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠতে হয়েছে তাকে। মিসেস রেহমান এখনও গভীর নিদ্রাতে। দরজা খুলে একটা সাদা খাম দেখে চয়নিকার মেজাজটাই তুঙ্গে! খামটা হাতে নিয়ে দরজা লাগিয়ে নিজের রুমে ফিরে এসে খুলে দেখে র*ক্ত! ঘাবড়ে উঠে চয়নিকা। হাত থেকে খামটা ছুঁ*ড়ে ফেলে চিৎকার দিয়ে নিজের হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে দৌঁড় লাগায়। একটা ছোটো প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতর র*ক্ত ছিল যা চাপ লাগাতে বেরিয়ে এসেছে। চয়নিকা র*ক্ত ভয় পায় খুব। মিনিট পাঁচেক পর ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বিছানায় বসে। বমি করে এসেছে সে। তার ব্লা*ড ফোভিয়া আছে। চয়নিকা ভাবতে লাগল কে তাকে এসব পাঠাবে? খামের ভিতর একটা চিঠিও ছিল। ধীর পায়ে খামটার কাছে যায়। কম্পিত হাতে খামটা তুলে। র*ক্তের প্লাস্টিকের ব্যাগটা আরও কিছুটা দূরে পরে আছে। চিঠিটা খুলে দেখে কম্পিউটার টাইপিং করা চিঠি। চয়নিকা ভাবল, যে চিঠি দিয়েছে সে চতুর বুদ্ধিসম্পন্ন! চিঠিটা হাতে লেখা হলে চয়নিকা নিজের সোর্স কাজে লাগিয়ে ঠিক বের করে ফেলতে পারত। হতাশ হয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করে।
“খামটা খুলেই র*ক্তে পরিপূর্ণ প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখে ভয় পেয়েছিলে? একটু ভাবো, তুমি সম্পূর্ণ র*ক্তে মা*খামা*খি! উফ! কি ভ*য়ংকর। এবার তোমার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে তাই না? শুকরান করো রবের, ওটা ফে*ই*ক ব্লা*ড ছিল। আমি নিজে স্পেশিয়ালি তোমার জন্য ল্যাবে বানিয়েছি। কিনে আনলেও পারতাম কিন্তু নিজের হাতে বানানোটার এক আলাদাই মজা আছে!
বাদ দাও সেসব, যা বলতে তোমার সুখনিদ্রা কেড়ে নিলাম তা তো বলি! চয়নিকা! ডটার অফ পদ্মলিকা। তোমার নামটাও তোমার মায়ের নামের মতো অদ্ভুত সাথে চরিত্রও! মায়ের চরিত্রই পেয়েছ তুমি। এই চরিত্রের জন্য না আবার নিজের মায়ের মতো অকালে ঝড়ে যাও! সাবধানে থেকো। পারলে নিজেকে শুধরে নিও নয়তো ফেইক ব্লা*ডের বদলে তোমারটাই না থাকে!
ইতি কেউ একজন আড়ালের।”
চয়নিকার হাত-পা সমান তালে কাঁপছে। এই ভোর বেলায় মনে ভয় ঢুকে গেল। আজই তো আলোর শেষ দিন নিশ্চিত করতে প্রহরদের বাড়িতে যেত। তা আর হলো কই! ফোন বন্ধ করে গৃহবন্দি হওয়ার দশা তার! ঘর থেকেই বের হবে না সাথে তার ফোন যাতে না আসে সেই ব্যাবস্থাও করে নিয়েছে।
_______
তপ্ত রোদ্দুর! মাথার উপর সূর্য তার প্রখর তাপ বর্ষণ করছে। সময়টা অক্টোবর মাস। দুপুরে যেনো চামড়া পু*ড়ে যাওয়ার মতো রোদ থাকে। সেই রোদের মধ্যেই বাগানে বসে কাঁদামাটি দিয়ে কিছু আকৃতি দেওয়ার চেষ্টায় আছে আলো। পিকু পানির পাইপের কাছে ঘেউ ঘেউ করছে আর বাগানে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে রিওর সাথে বল নিয়ে খেলছে। রিও বাগান থেকে একটা লাল চন্দ্রমল্লিকা ফুল ও পিকু একটা হলুদ চন্দ্রমল্লিকা ফুল কা*মড়ে ছিঁড়ে আলোর কাছে দৌঁড়ে এসেছে। বাগানে হরেক রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুলের গাছ আছে কিন্তু ফুটেছিল এই দুটোই। চন্দ্রমল্লিকা ফুল নভেম্বর মাসে ও অক্টোবরের শেষে ফোটে। আলোর সামনে মুখে ফুল নিয়ে লেজ নাড়াচ্ছে ওরা। এই দুটোর কান্ডে আলো প্রাণখোলা হাসল। দুজনের মুখ থেকে ফুল নিয়ে নিজের দুই কানের পিঠে লাগিয়ে ওদের গায়ে কর্দমাক্ত হাত না লাগিয়ে আদর করে দিয়ে খেলতে যেতে ইশারা করল। পুরো বাড়িটিতে ওরা তিনজন এখন। বলা বাহুল্য যে, বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন মাত্র দাররক্ষী তাও বৃদ্ধ। উনার জন্য বাড়ির সীমানার বাহিরে ছোটো ঘর করা। পুরো বাড়ির সীমানাতে প্রহর ডিজিটাল সিকিউরিটি লাগিয়েছে সেফটির জন্য।
বহু প্রচেষ্টার পর আলো ছোটো একটা ফুলদানি বানাতে সক্ষম হলো। এখন এটাকে পিকু ও রিওর কবল থেকে বাঁচাতে হবে। ওরা এখানে এসে নষ্ট না করে ফেলে! আলো উঠে ওদের ডেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায় তারপর খাবার দিয়ে ঘুমানোর ইশারা করে আসে। দরজা লাগিয়ে নিজের কক্ষে গেলো। কাঁদামাটির জন্য আবারও শাওয়ার নিতে হবে।
আধঘণ্টা পর শাওয়ার শেষে একটা নীল জামদানী শাড়ি পড়ে বাগানে গেলো। কানের কাছে রিও ও পিকুর আনা ফুল দুটো। বাগানের দোলনাটাতে চোখ বন্ধ করে বসল। অতীতের কিছু স্মৃতি মনের আরশিতে ভেসে ওঠছে।
সতেরো বছর আগে,
আলো তার বাবা-মায়ের সাথে খুব খুশি খুশি ছিল। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে যেনো নয়নের মণি। স্কুল শেষে মা ও দাদীর সাথে বাগানে লুকোচুরি খেলত এমন পড়ন্ত দুপুরে। দাদী মা*রা যাওয়ার পর মায়ের সাথে খেলত। আলোদের ছোটো বাড়িটাতেও অনেক ফুলের গাছ ছিল। সব ছিল আলোর মা জ্যোতির লাগানো। সুখের সময়ে শ*কু*নের কালো নজর লেগে গেল! তছনছ হয়ে গেলো আলোর জীবনটা। সেদিন এমনি এক রৌদ্রদীপ্ত দুপুরে খেলা করছিল আলো ও ওর মা। আলো বড়ো কড়ই গাছটার পিছনে লুকিয়েছিল আর ওর মা ওকে খুঁজছিল। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মা আসছে না তখন আলো পা টিপে টিপে বের হয়ে দেখতে যায় মায়ের অবস্থান! কিন্তু হায়! মাকে তো চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিল সে। মায়ের ছটফট করা র*ক্তাক্ত শরীরটার কাছে গিয়ে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল আলো। একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটা। কতোটুকুই বা বয়স ছিল তার? মাত্র নয় বছর। চোখের সামনে মায়ের বিভীষিকাময় মৃ*ত্যুর প্রহর গোনা দেখে নিশ্চল হয়ে গিয়েছিল তার হৃৎপিন্ড। সাথে সাথে মায়ের জান নিভে আসার আগেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গিয়েছিল। তারপর আলো দুইমাস কোমাতে ছিল। কোমা থেকে জেগেই আলো হয়ে গেলো একাকি।
হঠাৎ কাঁধে কারও হাতের স্পর্শে ভড়কে ওঠে। চোখ খুলে দেখে প্রহর হাতে ল্যাব কোট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা আকাশি রঙের শার্ট ও বাদামি ফুলপ্যান্ট পরিহিত সাথে হালকা ঘর্মাক্ত অবস্থায় বিকেলের এই সময়টাতে প্রহরকে দেখে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আলো। অনেকটা সময় চোখ বন্ধ ছিল বলে এখন চোখের সামনে কিছুটা অন্ধকার লাগলেও নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে না সে। কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে খেয়ালি নেই। প্রহর আলোর কপালে, গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করে চিন্তিত হয়ে বলে,
“কতক্ষণ যাবত এই রোদের মধ্যে বসে আছো?”
“রোদ নেই তো।”
“এখন নেই কিন্তু ছিল তো। তোমার গায়ে জ্বর জ্বর ভাব। কতক্ষণ বসেছিলে?”
প্রহরের হুং*কারপূর্ণ ধ*মকে আমতা আমতা করে বলে,
“বেশিক্ষণ না। কিছু সময় মাত্র।”
প্রহর সন্দেহের চোখে বাগানের পশ্চিম দিকে ইশারা করে বলে,
“তাই? তাহলে ওগুলো কী? এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি। দেখে মনে হচ্ছে ঘণ্টা দুয়েক আগে বানিয়েছ।”
আলোর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কথা ঘুরানোর জন্য বলে,
“দেখো না! আমায় কেমন লাগছে? তোমার পছন্দের নীল শাড়ি পড়েছি। রিও ও পিকু বাগানে দুটো চন্দ্রমল্লিকা ফুল ফুটেছিল তা ছিঁড়ে এনেছে। সুন্দর না? তুমি ভিতরে চলো। ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে নাও তারপর একটা সাদা বা হলুদ পাঞ্জাবি পড়ো। কয়েকটা ছবি তুলি একসাথে।”
প্রহর আলোর হাত ধরে টেনে এনে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বলে,
“কথা ঘুরাচ্ছ? খুব বার বেড়েছে তোমার। আমার সাথে চালাকি শুরু করেছ? জ্বর হলে যে তোমার দেখাশোনার জন্য আমায় সারাদিন বাড়িতে থাকতে হবে। সেই খেয়াল আছে?”
আলো প্রহরের বুকে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
“তাহলে তো আমি সারাজীবন জ্বরে ভুগতে চাই। আপনি সর্বদা আমার সাথে থাকবেন সেই লোভে। আমার এই লোভ কখনও না কমুক।”
প্রহর নিরব হাসে।
“আর ম্যাম তখন আপনাকে খাওয়ানোর, ভরণপোষণের দায়িত্ব কে নিবে?”
আলো আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,
“আমি না খেয়ে থাকব দরকার পরলে। আপনার সাথে আমি সবজায়গায়, সবরকম পরিস্থিতে থাকতে রাজি।”
প্রহর আলোর কপালে আসা চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
“আবারও আপনি করে বলা শুরু করেছ? বহুকষ্টে তোমার মুখ থেকে আপনি ডাক ছাড়িয়েছিলাম।”
“আমি আপনাকে সবরকম সম্বোধনে ডাকব কারণ তুমি একান্তই আমার।”
প্রহর হেসে আলোর কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে রেখে এক দীর্ঘ চু*ম্বন শেষে আলোকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,