#পর্ব_৫
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
১০৫ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে বেঁহুশ অবস্থা আলোর। প্রহর স্টাডিরুম থেকে রাত দশটার দিকে এসে দেখে আলো লেপ মুড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রহরের খটকা লাগে। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে হলেও এতোটা তো শীত লাগার কথা না। প্রহর আলোর কাছে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখল। হাত রাখা মাত্রই ঘাবড়ে গেলো কারণ প্রচণ্ড তাপ। আ*গুনের মতো গরম হয়ে আছে। ভয় পেয়ে প্রহর আলোকে কয়েকবার ডাকলো কিন্তু ওর কোনো সারা শব্দ নেই! এতে প্রহর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আলোর নাকের কাছে হাত রাখে। নিঃশ্বাস চলছে ধীর গতিতে। জ্বর মেপে তাজ্জব হওয়ার দশা। কোনো কিছু না ভেবেই দৌঁড়ে নিচে গিয়ে ফ্রিজ থেকে কতোগুলো বরফের টুকরো এনে এক বালতি জলে দিয়ে দেয়। আলোকে বালিশের উপর প্লাস্টিকের ক্লথ রেখে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে থাকে। সিলেটের রাত দশটা আর কাছাকাছিতে কোনো দোকানপাট খোলা নেই। আলোকে রেখে এই মূহুর্তে দূরে কোথাও যাওয়াও যাবে না। এই অবস্থায় সাপোজিটরি দিতে হবে কিন্তু ফ্রিজে যেটা আছে সেটার ডেইট এক্সপায়ার হয়ে গেছে। তাই এখন জ্বর নামাতে অন্য উপায় করতে হবে। প্রায় আধঘণ্টার মতো মাথায় পানি ঢেলে শরীর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছিয়ে জ্বর মেপে দেখল ১০৩ ডিগ্রির কিছুটা উপরে নেমে এসেছে। আলোর ঠোঁট কাঁপছে মানে জ্ঞান ফিরেছে। স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে প্রহর। লেপ ও আলমারি থেকে আরেকটা কম্বল বের করে আলোর শরীরে পেঁচিয়ে দিয়ে রিওকে বিছানার উপর আলোর মাথার কাছে বসিয়ে দিয়ে সে রান্নাঘরে যায় টমেটো ও চিকেন সুপ বানাবে। পিকুও ওর পিছনে ছুটেছে।
কিছুক্ষণ প্রয়াস করে অবশেষে সুপ বানাতে সক্ষম হয় প্রহর। নিজে একবার টেস্ট করে দেখলো একটু বেশি টক স্বাদযুক্ত তবে জ্বরের জন্য টকটা জরুরী। একটু লেবুর শরবতও করে নিলো। সবকিছু নিয়ে ঘরে যেতে নিলে মোবাইলে মেসেজ আসে। প্রহর ভ্রুঁ কুঁচকে ট্রে টা রেখে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে,
“আজকে রাত তিনটা নাগাদ জাফলং এর কাছে ইন্ডিয়ার বর্ডার দিয়ে সে দেশ ত্যাগ করবে। তার কাছে অনেক ইনফরমেশন আছে প্রহর। তোমাকে সেখানে যেতে হবে।”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আলোকে এই অবস্থায় একা একা কিভাবে রেখে যাবে? ভেবে পাচ্ছে না সে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো ধপধপ করে জানান দিচ্ছে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভুগছে সে। ঘড়িতে সময় দেখল রাত এগারোটার একটু বেশি। জাফলং যেতে রাত একটা নাগাদ বের হতে হবে তাছাড়া গাড়ি আসবে ওকে নিতে। লম্বাশ্বাস নিয়ে আপাততো আলোকে সুস্থ করার দিকে মনোনিবেশ করে। আলোর কাছে গিয়ে আলোর মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে সুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। টকের জন্য আলোর মুদিত নয়নজোড়া কুঁচকে আসে মুখ বিকৃত করে ফেলে কিন্তু তাতে লাভ তো হয়না। প্রহর ওকে জোর করেই খাওয়াচ্ছে।
আধঘণ্টা পর খাওয়ানো শেষ হলে একটা ইনজেকশন পুশ করে দেয় তাতে কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বর নেমে যাবে। আলো ঘুমাচ্ছে দেখে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে একটা নকশা নিয়ে বসে। বর্ডার দিয়ে সরাসরি দিনের বেলা যেতে পাসপোর্ট লাগবে। যেহেতু লোকটার কাছে পাসপোর্ট নেই তাই এই পন্থা। প্রহর বাঁকা হেসে নিজে নিজে স্বগতোক্তি করে,
“পাসপোর্ট থাকবে কী করে? আমিই তো তোমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার পেছোনে। তোমাকে তো দেশ ছাড়তে দেওয়া যাবে না। ইন্ডিয়ায় একবার পৌঁছে গেলে তোমার জন্য নেপাল যাওয়া কোনো ব্যাপারই না। সহোযোগি তো কম না তোমার!”
প্রহর কাউকে ফোন করে বলে,
“জাফলংয়ের কাছে আগেই ফোর্স পাঠান। তারা যেনো লুকিয়ে থাকে। আগে আ*ক্রমণ যেনো না হয়।”
অপর পাশ থেকে খবর আসে,
“তুমি কেনো আসছ না প্রহর?”
প্রহর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আপনি তো জানেন স্যার আমার ওয়াইফ বাড়িতে একা থাকে। তাছাড়া আমি আর্মি বা কোনো প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নেই। আমাকে ইনফরমেশনটা রক্ষা করতে হবে যার দায়িত্ব প্রফেসর আরমান শেখ আমায় দিয়ে গেছেন।”
“তাহলে তোমাকে আরও আগে আসা উচিত।”
প্রহর এবার মলিন কণ্ঠে বলে,
“প্রফেসর আরমান শেখের সবচেয়ে প্রিয় একজনকেও আমার দায়িত্বে রেখে গেছেন। তার অবস্থা খুব নাজুক। এমতাবস্থায় তাকে ফেলে আসতেই আমার ভয় হচ্ছে। তাও আমি চেষ্টা করব দ্রুত আসার। আশেপাশে সবাইকে মাস্ক ও প্রপার ভেন্টিলেশনের ব্যাবস্থা নিয়ে যেতে বলবেন।”
অফিসার কামাল বুঝলেন। বললেন,
“টেক কেয়ার অফ হার। তার সুস্থতা কামনা করি।”
প্রহর ফোন রেখে দেখে পিকু ওর পায়ের কাছে এসে লেজ নাড়াচ্ছে। পিকুকে জায়গামতো রেখে এসে আলোর কপালে হাত দিয়ে দেখে আলোর শরীর ঘেমে উঠেছে। তার মানে জ্বর নেমে গেছে প্রায়। তাও মনের সন্তুষ্টির জন্য থার্মোমিটার এনে মেপে দেখল ১০০ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে। প্রহরের ঠোঁটে হাসি ফোটে। আরেকবার গা মুছিয়ে দিয়ে নিজে তৈরি হলো। ঘড়ির কাঁটা জানান দিল এখন রাত একটা বাজে। বাহির থেকে গাড়ির হর্নের শব্দ আসছে। আলোর কাছে প্রয়োজনীয় সব রেখে ললাটে উষ্ণ স্পর্শ এঁকে বাড়ি লক করে বেরিয়ে যায়।
____________
“বর্ডার ক্রস করেছ? আশেপাশে কেউ দেখেনি তো?”
লোকটা বিকৃত হেসে বলে,
“নাহ। বর্ডারে কেউ নেই। ওই ডাক্তার না বিজ্ঞানী প্রহর শেহমাত ভেবেছিল আমাকে আটকাবে! আমার পাসপোর্ট নষ্ট করিয়েছে। কতো পদ্ধতি যে বের করছে আমাকে আটকানোর! আমার সব লাইসেন্স কেড়ে নিয়েছে। এবার ওর নাকের ডগা দিয়ে আমি পার হয়ে যাবো আর ও কিচ্ছু করতে পারবে না। শা*লা ***** একটা। ওর ওই স্যার আরমান শেখও আমার কিচ্ছু করতে পারে নাই আর ও তো মাত্র শিশু।”
লোকটা খিকখিক করে হেসে উঠল সাথে ফোনের অপরপাশের ব্যাক্তিও। উনারা কথা বলায় এতোটাই মগ্ন ছিল যে পেছোনে যে কেউ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁটকোলে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে তাদের কথা শোনছে তার খেয়াল নেই। লোকটার নাকের কাছে ক্লো*রোফর্ম স্প্রে করে দিলে লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পরে। অতঃপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার যোগ্য স্থানে।
_______
সকাল হলে আলো মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে। বিছানার আশেপাশে বালতি, প্লাস্টিক, সুপের বাটি, সিরিঞ্জ দেখে বুঝে যায় প্রহরের কাজ সব। তার জন্য প্রহরকে কতোটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ভেবেই দাঁত দিয়ে জিভ কা*টে। কাল একবার শাওয়ার নেওয়ার পর তিন-চার ঘণ্টা না খেয়ে তীব্র রোদে বসে থাকার ফল ছিল এটা।
তখনি হাতে নাস্তার ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলো প্রহর। আলোর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,
“উঠে পড়েছেন ম্যাম? এখন কেমন বোধ করছেন?”
“এখন অনেক ভালো। ডক্টর প্রহর শেহমাতের সেবায় সুস্থ না হয়ে পারি?”
“তাই তো! এবার ভালো মেয়ের মতো সুপটা খেয়ে নাও তো। রাতেরটা টক বেশি ছিল এবারেরটা ঠিক আছে।”
আলো উঠে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
“সরি সরি। এতোগুলা সরি। আমি বুঝিনি জ্বর চলে আসবে। আমার জ্বরের জন্য তোমাকে কতো ভুগতে হয়েছে তাই না?”
প্রহর আলোর নাকের ডগায় আলতো চুমু দিয়ে বলে,
“উহুম। শুধু ভয় হচ্ছিল তোমার যদি কিছু হয়ে যায়! আমি……”
প্রহরকে আর বলতে না দিয়ে নিজের ওষ্ঠ দ্বারা প্রহরের মুখ বন্ধ করে দেয়। কিয়ৎক্ষণ পর হাঁপিয়ে বলে,
“ওতো সহজে তোমার ঘার থেকে নামছিনা মিস্টার। সো নো চিন্তা। চলো একসাথে ব্রেকফাস্ট করব। তোমার জন্যও কি সুপ?”
প্রহর নিরব হেসে মাথা নাড়ায়।
“আচ্ছা। সমস্যা নেই। অসুস্থ বউয়ের সাথে তুমিও নাহয় একদিন একটু সুপ খাও। দুপুরে তোমার পছন্দের সব রান্না হবে।”
প্রহর দ্বিমত করে বলে,
“একদম না। তুমি আজ রান্নাঘরের আশেপাশেও যাবে না। আমি আজ সারাদিনের ছুটি নিয়েছি। কিছু একটা বানিয়ে নিবো। এখন নাস্তা শেষে মেডিসিন নিবে।”
আলো কথা শুনতে না চাইলে প্রহর বলে,
“ইটস মাই অর্ডার।”
কি আর করা! ঠোঁট উলটিয়ে প্রহরের হাত থেকে সুপ খেতে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,