#পর্ব_৭
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
আলো টেবিলে খাবার সাঁজিয়ে বসে আছে কিন্তু প্রহর আসছে না। প্রহরকে সে নিজে গিয়েও একবার ডেকেছে তারপর রিও ও পিকুকেও পাঠিয়েছে কিন্তু সে আসছে না। আলো বুঝলো প্রহরের রাগ পরেনি। তাই নিজেও না খেয়ে সব গুঁছিয়ে রেখে উঠে গেলো। রুমে গিয়ে বিছানার একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পরলো। প্রহর বিছানার হেডবোর্ডের হেলান দিয়ে বই পড়ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানী বইটা। হুট করে নিজের পাশে কারও অস্তিত্ব পেয়ে নজর হটালো অতঃপর আলোকে অপরদিকে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বুঝলো, ওর মনে অভিমান জমেছে। প্রহর হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। ওর ভালোর জন্যই একটু বকাঝকা করল আর! বইটা বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আলো এক চোখ স্বল্প খুলে প্রহরের প্রস্থান দেখে ঠোঁট চেপে হাসল কারণ সে জানে প্রহর এখন কি করবে।
মিনিট দশেক পেরিয়ে গেলো তাও প্রহর লাপাত্তা! আলো আর অপেক্ষা করতে না পেরে উঠে বসে। মুখ ফুলিয়ে বারংবার দরজার অভিমুখে চেয়ে আছে। শেষে আর না পেরে উঠে যায়। খাবার রুমের বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে প্রহর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। এভাবে বসে থাকতে দেখে আলো ভ্রুঁদ্বয় কুঁচকে আসে।
“এই! এই! অভদ্র লোক! এখানে ভূ*তের মতো বসে আছেন কেনো?”
কিন্তু প্রহর কোনো প্রত্যুত্তর করল না। এতে আলো কোমড়ে হাত গুঁজে প্রহরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কিন্তু তাতেও যেনো প্রহর নিরুত্তর। আলো এই মৌনতা আর নিতে পারছে না বিধায় নিজেও চেয়ার টেনে গালে হাত দিয়ে বসে পরলো। ওদের দুজনের নিরবতার যখন প্রায় অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় তখন আলো মিনমিন করে বলে,
“পেটে যেনো ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। সেই কোন দুপুরে খেয়েছি! তারপর চা ছাড়া পেটে কিছুই পরেনি।”
প্রহর কথাটা শুনে আবার উঠে গেলো আর এদিকে আলো ভাবলো প্রহর বিরক্ত হয়ে উঠে গেছে! সবসময় তো আলো অভিমান করে শুয়ে থাকলে প্রহর খাবার এনে নিজেও খায় আলোকেও খাওয়ায়। কিন্তু আজ তেমনটা ঘটলো না। মন খারাপ করে টেবিলেই মাথা ঠেকিয়ে নিরব রইল।
“এবার খেয়ে নাও।”
আলো মাথা তুলে দেখে প্রহর প্লেটে ওর জন্য খাবার সাঁজিয়ে নিয়ে এসেছে।
“আমি একা খাব না। আরেকজনকেও খেতে হবে। আমি অতো পাষাণ না যে কাউকে অভুক্ত রেখে খেয়ে নিবো!’
বাধ্য হয়ে প্রহর নিজের জন্যও আরেক প্লেট সাঁজিয়ে আনলো। এবার আলোকে ইশারা করল খেতে কিন্তু আলো তো নিজের হাতে খাবে না! ইশারায় হাত কা*টার অজুহাত দেখায়। প্রহর লম্বাশ্বাস ফেলে আলোকে খাওয়ানো শুরু করে সাথে নিজেও খায়। আর আলো খুশিমনে খেতেও থাকে। খাওয়ানো শেষ হলে প্রহর বলে,
“জানতাম না কেউ বাম হাতেও খায়!”
এই বলে সে উঠে গেলো। আলো জিভ কাঁ*মড়ে হাতের আড়ালে মুখ লুকায়। তার তো বাহাত খানিকটা কে*টেছে।
____________
নির্জন ও শিতল সব বন্ধুদের নিজেদের বাড়িতে দাওয়াত করেছে। নির্জনের পৈত্রিক বাড়ি প্রহরদের বাড়ি থেকে তিন-চার ঘণ্টার দূরত্ব। সবাই রাতে সেখানে থাকবে এমন প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছে। চয়নিকা আলোর উপর ক্ষিপ্ত। সে সুযোগ খুঁজছে আলোকে কিছু করার কিন্তু বারবার নিজেকে সংযত করে নিচ্ছে। শিতল চয়নিকাকে বলে,
“আগের সব ভুলে যা। অর্ধমাস হয়ে গেলো ঘটনাটার। এবার ভুলে যাওয়াই শ্রেয়।”
চয়নিকা রেগে বলে,
“আমি পারব না। আমি রাতে থাকবও না। আমার বাড়ি কাছেই। আমি চলে যাব।”
শিতল হতাশ স্বরে বলে,
“তোর যা ভালো মনে হয়। তোকে আমি জোড় করব না। তোর জেদ আমার জানা আছে। দেখা যাবে, জোড় করে থাকলি তারপর কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসলি।”
শিতল নিজের কাজে চলে যাওয়াকে চয়নিকা বিরক্তিতে বলে ওঠল,
“আর দুয়েকবার বললেই থেকে যেতাম। এখন চলে যেতেই হবে! ব্যাপার না আলো, তোমার সর্বনাশ তো আমি করেই ছাড়ব।”
দুপুরের খাওয়া শেষে সকলে আড্ডাতে বসেছে। চয়নিকা হুট করে বলে বসলো,
“আচ্ছা প্রহর, তোমার রিদ্ধিমাকে মনে আছে?”
প্রহর ভ্রঁ কুঁচকালো। চয়নিকা আবারও উৎসাহ নিয়ে বলে,
“ভুলে গেলে? রিদ্ধিমা সরকার! তোমার কিশোর বয়সের প্রেম! রিদ্ধিমাও কিন্তু তোমাকে পছন্দ করত। হঠাৎ ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো তাই না?”
চয়নিকার কথায় প্রহর অপ্রস্তুত হলো। দশ বছর পুরোনো কাসুন্দি কোনো কারণ ছাড়া ঘাটার কোনো মানে হয় না। আলো প্রহরের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হুট করে প্রহরের সেদিকে নজর গেলে দেখে তার বউয়ের চোখ জ্বলজ্বল করছে সন্দেহের কারণে। প্রহর তাড়াহুড়ো করে বলে ওঠে,
“ওটা একটা মিসআন্ডারস্টেন্ডিং ছিল। স্বল্প সময়ের ভালোলাগা মাত্র। রিদ্ধিমা এসেছিলও স্বল্প কিছু সময়ের জন্য তারপর মাত্র মাস দুয়েকের মাঝে হুট করে গায়েব হয়ে গেল। তাছাড়া আমি ও সে বুঝিনি যে আমরা দুজন দুই ধর্মের।”
পরশ হাসতে হাসতে বলে,
“তোর নাম প্রহর তাই রিদ্ধিমা ভেবেছিল তুই ওর ধর্মের আর তুই ওর সারনেম সরকার দেখে ভেবেছিলি ও তোর ধর্মের।”
নির্জন টিটকারি করে বলে,
“যাই বলিস, মেয়েটা খুব সুন্দর চমৎকার ছিল। কিন্তু কই যে হারালো! শুনেছি ওর বাবার আবার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছিল তাই চলে গেছে।”
শিতল ভ্রুঁ উঁচিয়ে নির্জনকে শাসানো স্বরে বলে,
“তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে! দেখতাম তো সবই। কিভাবে রিদ্ধিমার গুনগান গাইতে।”
নির্জন কপাল চাঁ’পড়ে বলে,
“আরেহহ! ভুল ভাবছ। তখন তো একটু…..”
“হ্যাঁ হয়েছে থামো। আর বলতে হবে না। আমি অন্ধ ছিলাম না হুহ্! ”
প্রহর এবার বিরক্ত হয়েই বলে,
“অতো পুরোনো কথা মনে করারই দরকার নেই। আর আলো, তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ। আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত দুইই তুমি। আমি জীবনসঙ্গিনী হিসেবে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। তুমি এই প্রহরের জীবনের আলো।”
আলো লাজুক হাসে। সবাই ওদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা শুরু করলেও চয়নিকা এতে বিরক্ত হয়। মনে মনে বলে,
“নিজেকে সেফ জোনে রাখার কৌশল ঠিক জানো প্রহর। আলোর মনে উৎপন্ন হওয়া সন্দেহের বীজটাই উপড়ে দিলে। ব্যাপার না। এটা তো এমনিই ছিল। দেখো সামনে কি হয়!”
চয়নিকা সন্ধ্যের আগে বেরিয়ে যায়। পথিমধ্যে সেই লোকটার কল আসে,
“কাজ কতোদূর চয়নিকা?”
“খুব শিগ্রই সব হবে।”
“তুমি এই কথা বিগত পনেরো দিন ধরে বলে যাচ্ছ কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছ না।”
চয়নিকা হতাশ স্বরে বলে,
“অধৈর্য হচ্ছো তুমি। একটু সময় নিয়েই কাজটা করতে হবে। একটা ফ্লপ খেলে ব্যাকআপ তো রাখতে হয়। এতোদিন অপেক্ষা করেছ আর কটা দিন নাহয় অপেক্ষা করলে। সবুরে মেওয়া ফলে জানোতো?”
লোকটি কল কে*টে দেয়। চয়নিকা কপালে হাত ঘষে পরবর্তী পরিকল্পনার ছক কষতে থাকে।
___________
একদিন বিকেলবেলা, আলো ফুলের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে আর প্রহর বাগানের টেবিলের উপর ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। প্রহর আনমনে আলোকে বলে,
“চলো আলো আমরা একটু দূর থেকে ঘুরে আসি।”
কথাটা শোনামাত্রই আলো অতি উৎসাহী হয়ে গাছে পানি দেওয়া ফেলেই ছুটে আসে। উৎসুক কণ্ঠে বলে,
“সত্যি? কোথায় যাবে? বলো না?”
প্রহর হেসে আলোকে একটানে নিজের কোলের উপর বসিয়ে ঘারে মুখ গুঁজে বলে,
“তোমার খালামনিদের কাছে।”
খালামনিদের নাম শুনে আলোর মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ ছোটো করে বলে,
“খালামনি ও খালুজান নিশ্চয়ই আমার উপর রাগ করে আছে। সেই চার বছর আগে দেশে আসলাম আর তাদের সাথে দেখা করতে যাওয়াও হলো না। খালামনি তো আমার সাথে কথাই বলতে চায় না।”
“তাই তো তোমাকে নিয়ে যাবো। খালা শাশুড়ির রাগ ভাঙানোও হবে। জামাই আদর পাওয়াও হবে কি বলো?”
আলো হেসে উঠে। হঠাৎ মেইন গেইট থেকে দারোয়ান ফোন করে বলে কেউ এসেছে। প্রহর তার পরিচয় জেনে ভেতরে আসতে দিতে বলে।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,