সে -পর্ব 12

0
229

#সে
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
সকালঃ ১০টা
বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চুপচাপ চারিপাশ পর্যবেক্ষণ করছি। আর হয়তো কখনো এই জায়গায় আসা হবে না। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট এখন অনুভূত হচ্ছে যে, এই স্কুল লাইফ আর ফিরে পাব না। তিথি,লিমাদের সাথে আর সামনা-সামনি দেখা হবে না। এই কথাগুলো আগে তেমনভাবে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি। বান্ধবীরা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এই মুহূর্তে আমার একদমই ইচ্ছে করছে না সিলেট থেকে চলে যেতে। এখন আর কিছু করারও নেই।
তিথি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’নবনী তুই চলে যাস না প্লিজ! থেকে যা। আমাদের বাসায় থাকবি তুই।’
ওর আকুতিগুলো বাচ্চাদের মতো শোনালেও ভীষণ আবেগীয় ছিল। ওর অনুরোধ রাখার যে উপায় নেই আমার সেটাও মুখ ফুটে বলতে পারছি না। শুধু ওদের জড়িয়ে ধরে চুপচাপ কেঁদেই চলেছি। রোজকেও দেখলাম বার কয়েক ওড়নায় চোখ মুছল। একসঙ্গে অনেকটা সময় থাকলে এমনিতেই মায়া জন্মে যায়। যেমনটা ওদের প্রতি আমার মায়া জন্মেছে আর আমার প্রতি ওদের। শুধু একটা মানুষের মনেই আমি জায়গা করে নিতে পারিনি। বুকের ভেতর থেকে তীব্র দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
বাবা-মা গিয়ে রুদ্রদের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। আমি যাইনি। যদিও রুদ্রর এখন বাসায় থাকার কথা নয়। বাবা এসে তাড়া দিয়ে বললেন,’চলো চলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলের সঙ্গে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে পাড়ি জমাতে হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেই গাড়িতে আমাদের আসবাবপত্র যাচ্ছে বাবা ড্রাইভারের সঙ্গে সেই গাড়িতে যাবে। আমরা যাব ট্রেনে। আদিব বেশ কয়েকবার বাবার সাথে যাওয়ার জন্য বায়না করেছিল। কিন্তু কষ্ট হবে বিধায় বাবা আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সকলের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। এখান থেকে মা, আমি আর আদিব যাব স্টেশনে। বাড়ির মেইনগেটের কাছে এসে আরও একবার পিছু ফিরে তাকালাম। উদ্দেশ্য কাঙ্ক্ষিত মানুষের মুখটি শেষবারের মতন দেখে যাওয়া। কিন্তু এবারও আমায় হতাশ হতে হলো। একবুক আক্ষেপ নিয়ে আমি গাড়ির সিটের সাথে মাথা এলিয়ে দিলাম। দু’চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু।
স্টেশনে গিয়ে টিকিট মিলিয়ে আমরা আমাদের সিটে বসে পড়ি। কিছু্ক্ষণ পর আদিব মাকে বলল, ওয়াশরুমে যাবে। ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। মা ওকে নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার পর কানে হেডফোন গুজে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। অস্থরিতা, কষ্ট, অস্বস্তি সব একসাথে এসে হানা দিচ্ছে। যেই দহন নিরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছুটি করার নেই আমার।
চোখ বন্ধ করা মাত্রই একটা ভারী পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,’ম্যাম এটা আমার সিট।’
আমি চোখ মেলে একবার তাকালাম মাত্র ছেলেটির দিকে। সৌজন্যমূলক হেসে বললাম,’দুঃখিত। সিট ফাঁকা ছিল তাই জানালার কাছে বসে পড়েছিলাম।’
‘ইট’স ওকে। আপনার যদি খুব দরকার হয় তাহলে জানালার পাশে বসতে পারেন।’
‘আপনার অসুবিধা হবে না?’
‘খুব একটা অসুবিধা হবে না। মানিয়ে নিতে পারব। আপনি বসুন।’
‘ধন্যবাদ।’
শুকনো একটা ধন্যবাদ দিয়ে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। ছেলেটি আমার পাশে বসল। কয়েকবার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম রুদ্র কোনো ম্যাসেজ বা কল দিয়েছে নাকি। না! দেয়নি। ফেসবুকে লগিন করে আমার মেইন একাউন্ট ডিলিট করে দিলাম আমি। যেসব ফেইক একাউন্ট থেকে রুদ্রর আইডি চেক করতাম ঐগুলাতেও রুদ্রকে ব্লক করে আইডিগুলো ডিএক্টিভ করে রাখলাম। সর্বশেষ যেটা করলাম তা হলো সীম খুলে দু’টুকরো করে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। মনে হচ্ছিল একটু একটু হালকা হতে পারছিলাম আমি। কোন মুভিতে যেন একটা ডায়লগ শুনেছিলাম,’যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয় না তখন মায়া কাটানো শিখতে হয়।’ ফেসবুকেও এই পোষ্টটি বেশ ভাইরাল। কথার সত্যতা এবং মর্মার্থ অনেক বেশি। সত্যিই তো মায়া বাড়িয়ে যদি লাভ-ই নয় হয় তাহলে মায়া কাটাতে তো হবেই। আর যতদিন আমি পিছুটানে পড়ে থাকব ততদিন মায়া কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
হোয়াটসঅ্যাপ আনইন্সটল করে গ্যালারিতে ঢুকলাম। রুদ্রর ছবি রাখার জন্য আলাদা একটা ফোল্ডার বানিয়েছিলাম। ওকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। কান্নাগুলো কেমন দলা পাঁকিয়ে আসছে। আশেপাশে তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছি আমি। ঝাপসা চোখে দেখলাম পাশের ছেলেটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার এহেন কর্মকাণ্ড-ই বোধ হয় তাকে আমায় নিয়ে ভাবাচ্ছে। ভাবুক। আমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পিছুটান থেকে বের হতে হবে আমার। ঝাপসা দৃষ্টিতেই আমি পুরো ফোল্ডার ডিলিট করে দিলাম। রুদ্রর যতগুলো গাওয়া গান আমার ফোনে ছিল সেগুলো ডিলিট করে দিয়েছি। হাত কেঁপেছে, কষ্ট হয়েছে। তবুও আমায় পারতে হয়েছে। যার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই তাকে কেন শুধু শুধু জীবনে আটকে রাখব। সবকিছু থেকেই সে মুক্তি পাক। সারাজীবনের জন্য!
ফোন ব্যাগে রেখে চুপ করে বসে রইলাম আমি। ছেলেটি এখনও আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। মা এসে পড়ায় সে চুপসে যায়।
‘তোর চোখমুখ এমন ফুলে গেছে কেন?’ জিজ্ঞেস করল মা। মায়ের প্রশ্নে এবার আমার শব্দ করে কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কোনো রকমভাবে বললাম,’কই? আমি ঠিক আছি।’
‘মিথ্যা বলবি না। কান্নাও করছিস। কেন? তিথিদের জন্য খারাপ লাগছে?’
আমি কিছু বললাম না।শুধু উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালাম। মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,’মন খারাপ করিস না মা। ওদের সাথে যোগাযোগ তো থাকবেই। ওরা ঢাকায় আসবে বেড়াতে। কখনও সম্ভব হলে আমরাও সিলেটে ঘুরতে আসব।’
‘আমি আর কখনও সিলেটে আসব না মা।’
মা এবার আমার পাশে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বলল,’আচ্ছা আসতে হবে না। এবার কান্না থামা। সবাই কী বলবে বোকা মেয়ে?’
‘সবার কথায় আমার কী আসে যায়?’
আদিব তখন কথার মাঝে ফোঁড়ন কেঁটে বলল,’আপারে কাঁদলে সুন্দর দেখা যায়। সিনেমার নায়িকাদের মতো লাগে।’
মা ওকে ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেলে। হাসলো পাশে বসে থাকা ছেলেটিও। শুধু হাসি পেলো না আমার। আদিবের সঙ্গে তার বেশ ভাবও জমে গেছে ইতিমধ্যে। ওদের আলাপ শুনেই জানতে পারলাম ছেলেটির নাম শুভ্র। যাক তার কথা। আমার সবকিছু কেমন যেন বিরক্ত লাগছিল। আমি কোনোমতেই রুদ্রকে পুরোপুরি ভুলে থাকতে পারছি না। এটা আসলে সম্ভবও নয়। একদিনেই কি আর একটা মানুষকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া যায়? তবুও একদিনে কিছু সময়ের ব্যবধানেই যা যা করেছি সেটাই তো অনেকের পক্ষে দুঃসাধ্য প্রায়।
ব্যাগ থেকে খাতা আর কলম বের করে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা কথাগুলো লিখতে শুরু করলাম,
‘আমি তোমায় এক আকাশ ভালোবাসা উপহার দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু দিনশেষে তুমি খুঁজে বেরিয়েছ এক সমুদ্র ভালোবাসা। আচ্ছা এটা বলো তো, সমুদ্র কি আকাশের চেয়েও বিশাল? নয়তো! তবে তুমি কেন আমার ভালোবাসা দেখলে না?
আমি তোমায় মুঠোভর্তি শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দিনশেষে তুমি খেঁটে চলেছ তোমার ক্যারিয়ার গঠনের পেছনে। একটাবারও তুমি ফিরে তাকাওনি মুঠ করে রাখা আমার ঐ হাতের দিকে। তুমি বুঝতেও পারলে না দূর-দূরান্তের সুখ কুড়িয়ে আনতে গিয়ে; চোখের সামনে থাকা প্রকৃত মানুষটিকেই তুমি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছ।
আমায় ভালোবেসে নাম দিয়েছ মায়াবতী। অথচ আমার মায়ায় তুমি আটকাতে পারোনি। তবে কেন আমার এই নামকরণ বলতে পারো? বাকিদের মতো আমি চাইনি তোমায় অপশোনাল হিসেবে নিজের জীবনে রাখতে। আমি তোমায় ব্যবহার করতে চাইনি। একান্তই নিজের একটা মানুষ বানাতে চেয়েছিলাম। একদম পার্মানেন্টভাবে আমার করে চেয়েছিলাম। কিন্তু দিনশেষে তুমি তাদের কাছেই ফিরে গিয়েছ, যারা তোমায় অপশোনাল হিসেবেই চেয়েছে।
দিনশেষে তুমি নও, আমি এক পরাজিত ব্যক্তি, যে সত্যি ভালোবেসেও তোমায় বোঝাতে সক্ষম হইনি। আমি পারিনি! তবে আমি চাই, খুব করে চাই; একদিন, কোনোদিন দিনশেষে তোমার ঠোঁটে শান্তির হাসি ফুঁটে উঠুক।’
কী লিখলাম জানিনা। শুধু জানি প্রতিটা লাইন রুদ্রকেই উৎসর্গ করেছি। এটাও জানি, এই লেখা কখনও রুদ্র অব্দি পৌঁছাবে না। পৌঁছাতে পারবে না। সে যদি হাতের কাছেও পায় তাও বলবে না, একটাবার পড়ে দেখি কী লেখা আছে। তার এত সময়-ই বা কোথায়?
কোনো একদিন সে বুঝবে। আমায় খুঁজবে। হারিয়ে খুঁজবে। সবকিছু পেয়ে যাওয়ার পর যেদিন সে বিরক্ত হয়ে যাবে সেদিন-ই সে হন্যে হয়ে আমায় খুঁজবে। খুব করে মনে করবে। হয়তো সেদিন সে-ও আমার মতো কাব্য রচনা করে লিখবে,’একটা মেয়ে ছিল
ভীষণ জেদী। দু’চোখ ভর্তি তার রাগ।
কথায় কথায় ছিল অভিমান আর অভিযোগ।
সে মেয়েটা আজ কোথায়? সেই অভিমানি মেয়েটা কি এখনও রাগ দেখায়?
অন্য কাউকে?’
চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাগজটি দু’টুকরো করে ফেললাম। এরপর আরও অসংখ্য টুকরো বানিয়ে বাতাসের সাথে দূরে উড়িয়ে দিলাম। যাদের গন্তব্য আমার মতোই ছিন্নভিন্ন।
‘লেখাগুলো অসাধারণ মনোমুগ্ধকর ছিল। পড়েই মনে হচ্ছিল, হৃদয়ের সুগভীর থেকে কারো জন্য লেখা। ছিঁড়ে ফেললেন কেন?’
শুভ্র নামক ছেলেটি কথাগুলো আমার উদ্দেশ্যেই বলল। তার মানে লেখাগুলো উনি পড়েছে। আমি মেকি হেসে বললাম,’লেখাগুলো যে দেখবে না কখনো।’
‘কে দেখবে না?’
‘সে।’
(প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here