সে -পর্ব 13

0
220

#সে
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
মেঘলা আকাশের ঘন মেঘ কেটে গিয়ে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামছে এখন। এদিকে কমলাপুর স্টেশনে আমরা পৌঁছেও গেছি। মা আর আদিব ঘুমাচ্ছে। মায়ের এই সময়ে ঘুম আসাটা স্বাভাবিক নয়। রাত জেগে ঘরের সব জিনিসপত্র গুছিয়েছে। কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য আমি নিজেও বাবা-মায়ের অনিচ্ছায় রাত জেগে সাহায্য করেছি। সেই হিসেবে আমারও ঘুম আসার কথা। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। মনের মধ্যে পাহাড়সম কষ্ট চেপে রাখলে কারোরই দু’চোখের পাতা এক হওয়ার কথা নয়। মাঝে মাঝে একটা জিনিস ভেবে অবাক হই আমি। আপনারা বিষয়টা খেয়াল করেছেন কীনা জানিনা। তবে খেয়াল হলে স্বল্প পরিমাণে আপনাদেরও অবাক হওয়ার কথা। একমাত্র সন্তান হওয়ায় হোক কিংবা তাদের সন্তান হওয়ায় যেটাই হোক না কেন আমি কিন্তু আমার বাবা-মায়ের ভীষণ আদরের মেয়ে। প্রত্যেকটা সন্তানই বাবা-মায়ের কাছে আদরের হয়। কিন্তু আমার মনে হয়, তাদের কাছে আমার আদর এবং ভালোবাসার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। কোনো কিছুর কমতি তারা রাখেন না। সবকিছু পেয়েও আমি এমন একজনের পিছু ঘুরেছি যার মনে আমার জন্য ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নেই। অদ্ভুত!
আদিব যেন কেমন ভুসভুস শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকছে না। শব্দটা কেমন যেন মুখ দিয়েই করছে বলে মনে হচ্ছে। এই ছেলেটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। একটু সময় আর সুযোগ পেলেই হলো; দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে যেভাবে হোক ঘুমাবে। ওর বয়সী থাকতে আমিও এমন ঘুমকাতুরে ছিলাম। তখন আলাদা কোনো চিন্তাই আমার ছিল না। এখন যেই চিন্তার জন্য আমার দিন-রাতের ঘুম, শান্তি সব উধাও হয়ে গেছে সেটাও কোনো কাজের চিন্তা নয়। একদম ফাউ একটা চিন্তা। সুখে থাকতে ভূতে যাদেরকে কিলায় তারাই ভালো সময়ে এই ফাউ চিন্তাকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে আসে। এখন আপনারা হয়তো ভাবছেন এই মেয়ে তো দেখি পল্টিবাজ! কিছু্ক্ষণ আগেও রুদ্রর জন্য হায় হুতাশ করছিল আর এখন কীনা বলছে ফাউ চিন্তা! আপনাদের এরকমটা ভাবাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এটা বলে রাখি, অবশ্যই আমি পল্টিবাজ নই। মনের সুখশান্তির জন্য নিজেই নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম এসব আসলে ফাউ চিন্তা। এতে তো আর কারো ক্ষতি হচ্ছে না তাই না?
আরও একজনের কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমি আসলে এই মহাশয়ের কথা স্কিপ করে যেতে চেয়েছিলাম। আবার ভাবলাম, এতটা পথ সেও সাথে ছিল তাই একেবারে তার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার নাটক করাও বৃথা। মা আর আদিব ঘুমালেও শুভ্র নামক ছেলেটিও আমার মতো ঘুমায়নি। আলগা পিরিতও করেনি। কিংবা আগ বাড়িয়ে খেজুরে আলাপও তিনি আমার সাথে করতে আসেননি। যতক্ষণ আদিব জেগে ছিল ততক্ষণ ওর সাথেই গল্প করেছে। দুজনে ফোনে লুডু খেলেছে। আদিব ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে কানে হেডফোন গুঁজে বসে থেকেছে। তার এই ভদ্র গুণগুলোর জন্যই তার কথাও আপনাদের জানালাম।
ট্রেন কমলাপুর পৌঁছে গেছে। মানুষজনও নামতে শুরু করেছে। শুধু আমিই গালে হাত ঠেকিয়ে বসে রয়েছি। আপনারা তো জানেনই কাদাপানিতে আমার শুচিবায়ু রয়েছে। একবার রুদ্রর প্রসঙ্গে তুলেছিলাম কথাটা। বৃষ্টি থামবে তো দূরের কথা; এখনও কমেওনি। মায়েরও ঘুম ভাঙেনি। ওদের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছেও করছে না।
‘একি গালে হাত দিয়ে বসে আছেন যে? নামবেন না?’
আমার বামদিকে শুভ্র নামক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আমি। প্রশ্নটি উনিই করেছেন। চকিতে তখন মায়েরও ঘুম ভেঙে যায়। হন্তদন্ত হয়ে বলে,’কোথায় কোথায়? কোথায় আছি আমরা? আসিনি এখনও?’
আমি মাকে শান্ত করব কী নিজেই হকচকিয়ে গিয়েছি। যদিও মায়ের এরকম স্বভাবে আমি অভ্যস্ত। দিনে ঘুমালেই মা হুট করে জেগে বলবে,’এখন কয়টা বাজে? আমি কোথায়? রাত হয়ে গেছে?’ আরও অনেক আবোল-তাবোল তো বকেই।
শুভ্র ছেলেটি মুচকি হেসে মাকে শান্ত করে বলল,’শান্ত হোন আন্টি। আমরা মাত্রই পৌঁছেছি। সবাই নামুক। তারপর আস্তেধীরে আমরাও নামব।’
মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল উনার কথায়। তবুও আমায় মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’তুই আমায় ডাকিসনি কেন?’
আমি একবার শুভ্র নামক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম। বারবার ‘শুভ্র নামক ছেলেটি’ বলে উনাকে সম্বোধন করছি বলে আপনারা বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আসলে অচেনা একজন মানুষকে আপনাদের সামনেও নাম ধরে ডাকতে আমার আনইজি ফিল হচ্ছে।
মা এবার তাড়া দিয়ে বলল,’চল আস্তেধীরে নামি। ঐ ছেলে বোধ হয় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
‘কোন ছেলের কথা বলছ মা?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘তুই চিনবি না। আমিও চিনি না। কেয়ারটেকারের ছেলে এইটুকুই জানি শুধু। কী যেন একটা নাম বলল তোর বাবা!’
‘থাক নাম মনে করতে হবে না এখন। চলো নামি।’
‘ছাতা এনেছিস?’
‘না। সকালে তো আকাশ একদম পরিষ্কার ছিল।’
‘আপনাদের সমস্যা না হলে আমার ছাতা নিতে পারেন।’ এই প্রস্তাবটিও শুভ্র নামক ঐ ছেলেটিই করল। মা এক গাল হেসে তড়িঘড়ি করে বলল,’না, না বাবা। লাগবে না। তুমি বলেছ আমরা এতেই খুশি।’
‘সমস্যা নেই আন্টি। নিন।’
আদিবের বৃষ্টিভীতি রয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসবে। তাই অগত্যা মা রাজি হয়ে যায়। মা কিন্তু রাগী হলেও আমার সঙ্গে সঙ্গে আদিবকেও ভীষণ ভালোবাসে। ছাতাটি নিয়ে মা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’তুই আদিব ছাতা নিয়ে যা। আমি আসছি।’
আমি ছাতাটি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম,’তুমি আদিবকে নিয়ে যাও। তোমার তো নিজেরও বৃষ্টিভীতি রয়েছে। ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসবে আবার। আমার কিছু হবে না।’
আমার জোড়াজুড়িতে মা আদিবকে নিয়ে আগে ট্রেন থেকে নামল। তারপর নামল শুভ্র নামের ছেলেটি। আমি নামার সময় উনি একটি অবাক করা কাণ্ড করে বসলেন। আমার মাথার ওপর উনার দু’হাত রেখে বৃষ্টির পানি থেকে আমায় আড়াল করার চেষ্টা করলেন। আমার চোখেমুখে বিস্ময়। পেছন থেকে যাত্রীরা নামার জন্য তাড়া দিচ্ছে। তাদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না। উনি আমায় তাড়া দেওয়ার পর হুঁশ ফিরল। বললেন,’আরে আসুন। পেছনের যাত্রীরাও তো নামবে।’
উনার দিকে তাকিয়েই ট্রেন থেকে নামলাম আমি। দু’পা আগানোর পর কেউ একজন ছাতা ধরল আমার মাথার ওপর। আমি এবং শুভ্র নামক ছেলেটি দুজনই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেই মানুষটির দিকে তাকালামও দুজন। সামনের আগন্তুকটি একজন ছেলে। ঘন আঁখিপল্লব তার। গাম্ভীর্য বজায় রেখে আমার উদ্দেশ্যে বলল,’আসুন।’
আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পেছন থেকে মা বলল,’তাড়াতাড়ি আয় নবনী।’
এবার ছাতা ধরে রাখা ছেলেটি বলল,’চলুন।’
আমি তখনও বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি আসলে বুঝতে পারছি না এটাই সেই ছেলে নাকি যার কথা একটু আগে মা আমায় বলেছিল। মাকে দেখলাম একটা গাড়িতে গিয়ে বসতে। ছেলেটি শুভ্রর দিকে আরেকটি ছাতা এগিয়ে দিয়ে বলল,’এই ছাতাটি সম্ভবত আপনার।’
শুভ্র নামক ছেলেটিও এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। এবার বাড়িয়ে রাখা ছাতাটি হাতে নিয়ে সে বলল,’জি আমার।’
আমি আর চুপ থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,’আপনাকে কি বাবা পাঠিয়েছে?’
‘জি।’ ছেলেটির উত্তর।
‘ও।’
আমি এবার শুভ্রর নামক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে বললাম,’ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আপনাকেও স্বাগতম। তবে আমার ধারণা ছিল আপনি আমায় চিনবেন।’
‘সরি? আপনাকে কি আমার চেনার কথা ছিল?’
‘ছিল হয়তো! চিনেননি যখন তখন থাক। অন্য কোনোদিন দেখা হলে আমি-ই না হয় বলে দেবো।’
আমাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে রেখে সে ছাতা ফুঁটিয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে গাড়ি থেকে ক্রমাগত মা তাড়া দিচ্ছে। আমি তখনও শুভ্র নামের ঐ ছেলেটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রয়েছি। উনাকে আমি কী করে চিনব? সারা পথ পাড়ি দেওয়ার পর তীরে এসে তরী ডোবার মতো ঘটনা ঘটে গেল। সামনের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আমি আরও অবাক হলাম। এই ছেলে কি বোকা নাকি কে জানে! ছাতা শুধু আমার মাথার ওপর ধরে রেখেছে। আর নিজে এতক্ষণ ধরে ভিজছে। আমি ছাতাটি তার দিকেও সামান্য এগিয়ে দিতেই সে সরিয়ে দিয়ে বলল,’আমি বৃষ্টিতে ভিজলে সমস্যা হবে না। আপনি আসুন প্লিজ!’
আমার মনে হচ্ছে, আমি ঢাকা-শহরে নয় বরং বোকার শহরে প্রবেশ করেছি। একজন বোকা বানিয়ে যাচ্ছে আরেকজন বোকা হয়ে সঙ সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার যা ইচ্ছে করুক। এক টেনশন নিয়েই সিলেট থেকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। আরও বাড়তি টেনশন নিয়ে এবার বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। ছেলেটি যখন ঠিক করেছে ভিজেই যাবে তাই ছাতাটি আমিই হাতে নিলাম। গাড়িতে গিয়ে বসার পর শুরু হলো মায়ের বকুনি।
‘এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী গল্প করছিলি? দেখ তো ছেলেটার ভিজে কী অবস্থা হয়েছে!’
ঐ ছেলেটি সামনে বসে ড্রাইভ করছে। আমি মা আর আদিব বসেছি পেছনে। এই গাড়ি কার সেটাও আমার জানা নেই। সম্ভবত বাবার অফিস থেকেই আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছে। আমি একবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম,’উনাকে তো কেউ ভিজতে বলেনি মা। উনার শখ হয়েছে তাই বৃষ্টিতে ভিজেছে।’
‘এগুলো আবার কোন ধরণের কথা নবনী? ঢাকায় এসে আদব-কায়দা সব ভুলে বসেছিস নাকি?’
‘জি না। আমি তাকে বলেছিলাম ছাতা শেয়ার করতে। উনি রাজি হননি। আমার সাথে ছাতা শেয়ার করলে কি উনার জাত চলে যেত নাকি জিজ্ঞেস করো তো!’
মা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে ঐ ছেলেকে মিষ্টিসুরে বলল,’তুমি ওর কথায় কিছু মনে কোরো না।’
এতক্ষণ সে চুপ করেই ছিল। এবার মুখ খুলে বলল,’না আন্টি। আমি কিছু মনে করিনি।’
আমি গাড়ির সিটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসিয়ে রইলাম। ভাবতেই অবাক লাগছে রুদ্রকে ছেড়ে আমি কতদূরে চলে এসেছি।
‘তোমার নাম কী?’ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল মা। ছেলেটি গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই বলল,’ফায়াজ।’
‘মাশ-আল্লাহ্। কী করছো এখন? মানে পড়াশোনা করো নাকি চাকরী করো?’
‘অনার্স শেষ করেছি আন্টি। চাকরীর জন্য ঘুরছি। এখনও হয়নি। তাই বেকারই বলা চলে।’
‘মাস্টার্স করছো না কেন? বসে যখন আছো মাস্টার্স করে ফেলো।’
‘কী হবে এত পড়ে? টাকা ছাড়া শুধু রেজাল্ট দিয়ে চাকরী হয় না আন্টি।’
‘মন্দ বলোনি!’ বেশ আক্ষেপের স্বরেই কথাটি বলল মা। এরপর সবাই চুপ হয়ে গেছে। ভালো হয়েছে চুপ করেছে। খেজুরে আলাপ শুনতে ভালো লাগছিল না। লং জার্নি করে মাথা ধরে গেছে আমার।
অল্প সময়ের ব্যবধানেই আমরা একটা বাড়িতে পৌঁছালাম। বাড়ি নয়। এটা কোয়ার্টার। তবে জায়গাটা পার্কের মতো। একদম নিরিবিলি জায়গা। বৃষ্টি ততক্ষণে কিছুটা কমে এসেছে। আমরা পৌঁছানোর পর দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক এগিয়ে আসে। ফায়াজ নামের ছেলেটিকে বলেন,’সাবধানে এনেছিস তো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
সে ছোটো করে উত্তর দিল,’না, সমস্যা হয়নি।’
হাভভাবে মনে হচ্ছে ইনারা এই ছেলের বাবা-মা।
আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে না উঠে পাশেই থাকা হাফ বিল্ডিংটায় উঠলাম। এখানে ফায়াজরা থাকে। বারবার শুভ্র নামক ছেলেটি এখন আবার ফায়াজ নামক ছেলেটি বলে ডাকতে বিরক্ত লাগছে। আনইজিকে গোল্লায় পাঠিয়ে নাম ধরেই ডাকা শুরু করলাম। সে না জানলেই হলো। আমাদের যেই রুমটায় বসতে দেওয়া হলো পুরো রুমটা একদম পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো। আমি চুপচাপ একটা সোফা দখল করে বসে রইলাম। এই মুহূর্তে আমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তার আগে দরকার অল্পকিছু খাবার। কিন্তু মুখ ফুঁটে বলার উপায় নেই।
একটা বাচ্চা মেয়েকে বারবার দেখছি দরজার পর্দা ধরে উঁকি দিচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই লুকিয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালোই লাগছে। চোর-পুলিশ খেলার মতো। তখন ফায়াজ পেছন থেকে এসে বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে,’চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছ কেন মামনী?’
বাচ্চাটি খিলখিল করে হাসছে। বাবা ফোন দিয়েছিল বলে বাইরে গিয়েছিল মা। ফিরে এসে দরজার কাছে ওদের দেখে জিজ্ঞেস করল,’কে হয় তোমার?’
‘আমার ছোটো বোনের মেয়ে।’ বলল ফায়াজ।
মা বাচ্চাটির গাল টেনে দিয়ে আদুরেস্বরে বলল,’নাম কী তোমার?’
বাচ্চাটি মুখে এক আঙুল পুরে লজ্জার ভঙ্গিতে বলল,’ফিহা।’
প্রথম প্রথম বাচ্চামো ভালো লাগলেও এখন বেশ বিরক্ত লাগছে আমার। পেটে ক্ষুধা থাকলে দুনিয়ার সব সুন্দর জিনিসই বিচ্ছিরি লাগে। তখন পাশের রুম থেকে আরেকটি মেয়ে এসে আমায় বলল,’চলো হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নিবে।’
এতক্ষণে যেন শান্তি পেলাম আমি। বিনাবাক্যে মেয়েটির সঙ্গে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে পড়লাম। আমার পিছু পিছু মা আর আদিবও আসলো। আমরা খেতে বসলেও তারা কেউ খেতে বসেনি। মা অবশ্য বেশ কয়েকবার তাদের জোর করেছিল। খাওয়ার ফাঁকে জেনে নিলাম যেই মেয়েটি খেতে ডেকেছে সে ফিহার আম্মু ফাতিমা। সপ্তাহ্ খানেক হবে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। খাওয়ার আইটেম অনেক। ভর্তা থেকে শুরু করে গরুর গোশত, মুরগীর গোশত আর মাছ ভাজা। মন আছে বলতে হবে তাদের। খাওয়ার পর শুরু হলো আমার ঝিমানি। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের জন্য টিকতে না পেরে মাকে ফিসফিস করে বললাম,’আমি একটু ঘুমাব মা।’
মা তখন ফায়াজের মায়ের সঙ্গে গল্প করছিল। উনি ফাতিমা আপুকে ডেকে বললেন,’ফায়াজ কি ঘরে? ঘরে থাকলে বল ওরে বের হতে। নবনী একটু ঘুমাবে।’
‘না,না এত ব্যস্ত হতে হবে না। উনি ঘরে থাকলে থাকুক। আমি সোফায় ঘুমাতে পারব।’ বললাম আমি।
ফায়াজের আম্মু আমার বারণ শুনলেন না। ফাতিমা আপু একটুপর এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেলেন। ছেলে মানুষের ঘর হিসেবে এই ঘরটাও বেশ গোছালো। আমায় রেখে যাওয়ার আগে আপু বলে গেলেন,’কিছু লাগলে আমায় ডাক দিও। আমি পাশের ঘরেই আছি।’
উত্তরে আমি শুধু মৃদু হাসলাম। এরপর চিৎপটাং হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটু আয়েশ করে কাৎ হয়ে শুতেই মনে পড়ে গেল রুদ্রর কথা। আরামে থাকব আর রুদ্রর কথা মনে পড়বে না তা কি হয়? বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। নিমিষেই আরাম-আয়েশ মন খারাপের কাছে পরাজয় গ্রহণ করে নিল। এরপর এপাশ-ওপাশ করতেই কেটে গেল অনেকটা সময়। ঘুম আসার নাম নেই। অথচ একটু আগেই ঘুমের জন্য দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল আমার। চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে ছিলাম তখন আদিব এসে বলল,’আপু ঘুমিয়েছ?’
‘না। কিছু বলবি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমিও ঘুমাব।’
‘ট্রেনে না ঘুমালি? আবারও ঘুম পেয়েছে?’
আদিব হাসলো। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরেই কিছু্ক্ষণের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
.
.
ঘুমের মাঝেই উচ্চশব্দে কারো হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। কিছু্ক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি। চোখ মেলার পর বুঝতে পারলাম স্বপ্ন নয় বরং সত্যি। হাসির শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে। এই রুম এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বালিশের নিচে হাতরিয়েও আমার ফোন পেলাম না। পরমুহূর্তে মনে পড়ল ফোন তো আমি ব্যাগ থেকে বের-ই করিনি। অন্ধকার রুমে কোথায় কী আছে কে জানে! বিছানায় বসেই ফাতিমা আপুকে কয়েকবার ডাকলাম। আপু আসেনি। এসেছে ফায়াজ। আর তার কোলে ফিহা। লাইট জ্বালিয়ে বলল,’ফাতিমা আর আম্মু গেছে আপনাদের ফ্ল্যাটে।’
‘এখন কয়টা বাজে?’
সে একবার পেছনে তাকিয়ে বলল,’পৌনে এগারোটা।’
‘রাত হয়ে গেছে?’
‘হুম।’
‘আব্বু আসেনি এখনও?’
‘এসেছে আরও আগেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
প্রথমবার ওয়াশরুমে যাওয়ার কারণে আমি জানি ওয়াশরুমটা কোথায়। তাই চটজলদি গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ফায়াজকে জিজ্ঞেস করলাম,’আদিবও গেছে?’
‘জি।’
ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম সবকিছু গোছানো শেষ। এখন শুধু কাপড়, কাঁচের জিনিসপত্র গুছাচ্ছে মা। মাকে সাহায্য করছে আন্টি আর ফাতিমা আপু। আন্টি আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন,’একি! ঘুম ভেঙে গেছে? খেয়েছ? ফায়াজ ওকে খেতে দিসনি?’
আমি বললাম,’পেট ভরা আছে আন্টি। এজন্য আমিই খাইনি।’
‘ঘুম থেকে উঠলে পেট খালি হয় জানো না?’
আমি কিছু বললাম না। মানুষগুলোকে দেখে অবাক হচ্ছি। কত উদার মনের তারা! মাকে জিজ্ঞেস করলাম,’বাবা কোথায়?’
কাজ করতে করতেই মা উত্তর দিল,’পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন আজ কত খাটনি গেল মানুষটার ওপর।’
একটু চুপ হয়ে আবার বলল,’ভালো কথা। তোর ফোন বন্ধ কেন? তোর বাবাও কয়েকবার ফোন দিয়ে বন্ধ পেয়েছিল। তিথিও কিছু্ক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিল। বলল তোর ফোন বন্ধ।’
তিথির কথা উঠতেই একরাশ মন খারাপ এসে ভর করল আমার ওপর। ও ফোন করেছে শুনে খুশির চেয়ে কষ্টই বেশি হচ্ছে। কত্ত দূরে আমরা! মায়ের ফোন নিয়ে আমি বারান্দায় চলে যাই। তিথিকে কল করার পর ওপাশ থেকে যখন ওর কণ্ঠস্বর শুনি তখন আমি কেঁদে ফেলি। অনুভব করি তিথিও কাঁদছে। বেশ অনেকটা সময় নিয়েই দুজনে কথা বলি। কথার শেষপ্রান্তে এসে জিজ্ঞেস করলাম,’রুদ্রর সাথে কি কথা হয়েছে তিথি?’
‘না রে। আমাদের কারো সাথেই তার কথা হয়নি।’
‘ও।’
‘দেখ নবনী, তুই তার জন্য একদম মন খারাপ করবি না। তার জন্য একদম ভাববিও না তুই। যে তোর কথা ভাবে না, তুইও তার কথা ভাববি না।’
চুপ করে আমি তিথির কথাগুলো শুনলাম। আসলেই কিন্তু আমার এরকমটা করা উচিত। সে কিন্তু তিথি আর লিমার সাথে ফেসবুকে এড আছে। চাইলেই অন্তত একটা খবর নিতে পারতো। কিন্তু নেবে না। তার যে বড্ড ইগো! নিরব দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,’মন খারাপ করছি না। আচ্ছা শোন, কাল আব্বুকে দিয়ে একটা নতুন সীম কিনব। এরপর নতুন আইডি খুলে তোদের এড দেবো। রুদ্র যেন কোনোভাবে জানতে না পারে। যদিও সে কখনো জানার চেষ্টাই করবে না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘এখন তাহলে রাখছি। খেয়ে নিস।’
‘তুইও। আর হ্যাঁ, নিজের খেয়াল রাখিস।’
কল কেটে কিছু্ক্ষণ বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্ফুটস্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,’হায়রে মানুষ!’
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here