সে -পর্ব 2

0
289

#সে
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
বন-জঙ্গলের বিটপীর ন্যায় আমিও সেই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া-বাতাসে কিংবা মৃদু বাতাসে পাতাগুলো যেমন নড়েচড়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় আমার অবস্থাও এখন তেমনই। শুধু পার্থক্য এইটুকুই যে পাতারা মনের আনন্দে নড়ে আর আমি নড়ছি ভয়ে। নড়ছি না বলে কাঁপছি বলাটাই মানানসই। হ্যাঁ, রুদ্রের ভয়েই আমি কাঁপছি। কিন্তু তার দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সাহস কিছুতেই সঞ্চয় করতে পারছি না। আমি জানি, আপনারা এখন আমায় ভীতু ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মোটেও ভীতু নই; উপরন্তু বড্ড সাহসী। সেটা অবশ্য আস্তে আস্তে আপনারাও জেনে যাবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এখন যে আমার কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারছি না। তবে এতটুকু শিওর যে, আমায় দেখতে এখন চুপসে যাওয়া বেলুনের মতোই দেখাচ্ছে।
আমি তো আমার জায়গা থেকে নড়লাম না ঠিক আছে; কিন্তু রুদ্র নিজেই এসে আমার সামনে দাঁড়াল। এবার আমার হাত-পায়ের সাথে সাথে দাঁত, ঠোঁটও কাঁপতে শুরু করেছে। যে কেউ দেখলেই ভাববে গরমের মধ্যে মাঘ মাসের শীত বোধ হয় আমার উপরেই হামলে পড়েছে।
‘ডাকলাম যে শুনতে পাওনি?’ রুদ্রের গলায় বিরক্তের আভাস। আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না। তবে এটাই বুঝতে পারছি না উনি আজ আমায় তুমি করে বলছে কেন? সেদিন তো আপনি করে বলেছিল! মাস্ক পরার কারণে উনি আমার পুরো মুখ দেখতে না পারলেও চোখ দেখে নার্ভাসনেস ঠিক বুঝে ফেলল। এবার তার কুঁচকে যাওয়া কপালখানা আগের ন্যায় বিস্তৃত হলো। আমায় অবাক করে দিয়েই সে আমার কপালে হাত রাখল। এবার আর আমায় কেউ আটকাতে পারবে না। আমি শেষ! আপনারা কি ভাবছেন আমি মরে যাওয়ার কথা বলছি? একদম নয়। আমি বরফ হওয়ার কথা বলছি।’
‘শরীরের তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।’ কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল সে।
আমায় চুপ থাকতে দেখে আবার বলল,’কথা বলছ না কেন? তুমি কি বোবা?’
এই লোকটার সমস্যা কী আমি বুঝি না। প্রথমদিন আমায় কাজের বুয়া বানিয়ে দিল আর আজ বোবা! আমি বড়ো করে শ্বাস নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। তবুও মাস্ক খুললাম না। আমায় কথা বলতেই হবে এখন।
‘না, আমি বোবা নই। অসুস্থও নই।’ বললাম আমি।
‘তাহলে এতক্ষণ চুপ করে ছিলে কেন? যাই হোক, তোমার হাতের পানির বোতলটা দাও। পানি ভালো তো?’
নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। স্কুল থেকে ফেরার পথে পানির বোতল বের করে যে পানি খেয়েছিলাম এখনও হাতেই রয়েছে। তার মানে উনি তখন পানির জন্যই আমায় ডেকেছিল? হায়রে নবনী! আর কত কী-ই না তুই ভেবে নিলি।
সব ভয় কাটিয়ে আমি পানির বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে ঢকঢক করে এক চুমুকে পুরো বোতল ফাঁকা করে ফেলল। আমি পলকহীনভাবে শুধু চেয়েই রইলাম। বোতলটা আমার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,’থ্যাঙ্কিউ পিচ্চি।’
এরপর সে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করল। আমি আহাম্মক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কী বলে গেল আমায়? পিচ্চি!
রুদ্র চলে যাওয়ার পর তিথিরা আমার কাছে আসে।
‘কাহিনী কী হলো বল তো?’ জিজ্ঞেস করল তিথী। এখন আমি কী করে বলি আমি যে ভয়ে কাবু হয়ে গেছি? পুরো ঘটনা না শুনে আমায় ছাড়বে বলেও মনে হচ্ছে না। সংক্ষেপেই আমি বিবৃতি দিলাম। সব শুনে ওরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আগেই বলেছিলাম একেকটা কী পরিমাণ বজ্জাতের হাড্ডি! আমায় মনমরা থাকতে দেখে তিথি বলল,’আহারে! থাক মন খারাপ করিস না। ডেয়ারে যখন জিততে পারিসনি তখন কালকের ট্রিট যেন মিস না যায়। আর হ্যাঁ, পিচ্চি বলেছে বলে এত ভাউ খাইস না। স্কুল ড্রেস পরা থাকলে বাচ্চাই তো মনে হবে। তোর ভাগ্য ভালো যে আপু না ডেকে পিচ্চি ডেকেছে।’
তিথির শেষ কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলাম। যাক বান্ধবীগুলা হারামি হলেও সান্ত্বনা তো দিতে পারে! ট্রিট দেবো বলে ফাইনাল করে ফেললাম ডিসিশন। এরজন্য অবশ্য এখন আমায় বাবার পকেট কাটতে হবে।
.
বাবার বাড়ি ফিরতে রাত নয়টার মতো বাজবে। এখন বাজে আটটা পঁয়তাল্লিশ। এখনো আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে টম এন্ড জেরী কার্টুন দেখছিলাম। টিভি আছে আমাদের। ড্রয়িংরুমে সেটা। এখন টিভি মায়ের দখলে। সন্ধ্যে হলেই তিনি সিরিয়াল দেখতে বসেন। এমনকি এড আসলেও একই চ্যানেলে রেখে দেন। চ্যানেল পাল্টে দিলে যদি নাটকের কোনো সীন মিস হয়ে যায়? তাই অযথা টাইম ওয়েস্ট করে আমিও যাই না টিভি দেখতে। তাছাড়া নেট থাকতে সবকিছুই যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় তখন টিভির আর কী দরকার?
শুয়ে বসে কার্টুন দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম গলাটা কেমন যেন খুসখুস করছে। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে পান করলাম। তাতেও কোনো কাজ হলো না। মায়ের হাতে এখন লেবু চা খেলেই ম্যাজিকের মতো গলা খুসখুস করা সেরে যাবে। আমি তো ভয় পাচ্ছি এটা ভেবে, সিরিয়াল দেখার সময় ডাকার ফল আবার ভয়ানক না হয়! যা হয় হবে। একটু বকলে বকতে পারে। কিন্তু বারণ করবে না।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে মাকে বললাম,’মা এক কাপ লেবু চা করে দাও তো। গলাটা ভীষণ খুসখুস করছে।’
মা এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল,’একটু পরই এড দিবে। যা বলার তখন বলবি।’
বুঝলাম সিরিয়ালে হয়তো টান টান উত্তেজনা চলছে। কী আর করার? এড আসার আশায় সোফায় বসে রইলাম। মায়ের একটু পর শেষ হয়েছে পাক্কা ছয় মিনিট পর। অর্থাৎ ঠিকঠাক ছয় মিনিট পর এড এসেছে। এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কী করে বললাম সেটাই তো ভাবছেন? আমার গায়েবি কোনো গুণ নেই। দেয়াল ঘড়িতে বসে বসে সময় গুণেছি। এড আসার পর মা বলল,’বল এখন কী বলবি।’
‘বলছিলাম যে গলাটা কেমন জানি খুসখুস করছে। এক কাপ লেবু চা বানিয়ে দাও।’
‘আমি সিরিয়াল দেখতে বসলেই তোর গলা খুসখুস করে, মাথা ব্যথা করে, পেট ব্যথা করে। কাহিনী কী বলতো?’
‘এখানে কাহিনীর কী হলো মা? আমি কি ইচ্ছে করে সমস্যাগুলো আননি?’
‘এক্সাক্টলি! আমার মনে হয় তুই ইচ্ছে করেই সমস্যাগুলি আনিস। নয়তো মিথ্যে বাহানা করিস।’
‘শুধু শুধু এতগুলো কথা শোনাচ্ছ মা। বিরক্ত লাগলে রেসিপি বলে দাও। আমিই বানিয়ে নিচ্ছি।’
‘তার আর কোনো প্রয়োজন নেই! রান্নার তো ‘র’-ও জানিস না। পরে হাত-পা পুড়িয়ে তোর বাবার বকুনি খাওয়াবি।’ কথাগুলো বলতে বলতে মা রান্নাঘরের দিকে গেল। আমিও পিছু যেতে যেতে বললাম,
‘বাবাকে দোষ দিচ্ছ কেন? রান্না শেখানোর দায়িত্ব সবসময় মায়েদের হয়। বাবার নয়। তুমি রান্না শেখাওনি, এমনকি এখনও শেখাচ্ছ না। বাবার সাথে সাথে তুমিও আমায় বেশি আহ্লাদ দিয়ে ফেলছ।’
মা তখন খুন্তি হাতে নিয়ে বলল,’বেশি বকবক করবি না নবনী। যা এখান থেকে।’
আমি রান্নাঘরের দরজার বাইরেই ছিলাম। কথা বাড়ালাম না আর। ফিরে আসার পথে কলিংবেলের আওয়াজ শুনলাম। বাবা এসেছে। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম আমি। আমায় দেখে বাবা মিষ্টি করে হাসল। একটা প্যাকেট আমার হাতে দিল। মুখ আলগা করে দেখলাম কচকচে পেয়ারা। বাবা জুতা খুলতে খুলতে বলল,’তোর মা কোথায়?’
‘চা বানাচ্ছে।’
পেয়ারাগুলো টেবিলের ওপর রেখে আমি সোফায় বসে পড়লাম। বাবা ঘরে যাওয়ার আগে শব্দ করে মাকে বলল,’আমার জন্য এক কাপ চা বানিও তো।’
টুং করে জোড়ে একটা শব্দ এলো রান্নাঘর থেকে। এরপর ঝনঝন করা শব্দ শুনতে পেলাম। মা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এসে বলল,’বাপ-মেয়ে মিলে একটার পর একটা বায়না করেই যাচ্ছ। তোমাদের জন্য একটু শান্তিতে টিভিও দেখতে পারি না। পেয়েছ তো কলুদ বলদ। যেভাবে পারছ খাটাচ্ছ!’
মা রাগে ফোঁসফোঁস করছে। বুঝলাম রান্নাঘরে থালা-বাসনগুলো মা ইচ্ছে করেই ফেলেছে। বাবা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল,’মাত্র একটা আবদারই তো করলাম নয়না। এজন্য তুমি এতগুলো কথা শোনালে?’
বাবার এভাবে কথা বলায় আমার ভীষণ হাসি পেল। হাসলামও মুখ চেপে। কারণ মা দেখতে পেলে একদম রক্ষে নেই। মা কিন্তু হাসল না। সে আবার রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,’এই বয়সেও তার ঢং-এর শেষ নেই।’
বাবা এবার বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমায় বলল,’নবনী তুই-ই বলতো আমার এমন কী আর বয়স হয়েছে? তোর মা কথায় কথায় আমায় বুড়ো বলে। এটা কি ঠিক?’
‘না। একদম না। এটা তো ঘোর অন্যায়।’ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ধরে বললাম আমি।
মা দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এল। আমার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,’বাপের চামচ একদম বাপের মতোই হয়েছে।’
‘মা ওটা চামচি হবে।’
‘তুই চুপ কর।’
‘করলাম।’
বাবা তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,’আহ্! চা তো নয় যেন অমৃত। নয়না তুমি আর রাগ করে থেকো না। কাল শুক্রবার। কালই আমি একটা কাজের লোক নিয়ে আসব। সে সব কাজে তোমায় সাহায্য করবে।’
‘দেখব নে। এখন চুপ করে থাকো। সিরিয়াল শুরু হয়েছে।’
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে গেল। এখন সে গোসল করবে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম বাবার গোসল শেষ হওয়ার। বাবা-মায়ের ঘরেই বসে রইলাম। গোসল শেষ করে আমায় দেখে বলল,’কী ব্যাপার? কিছু বলবি?’
‘বলব তো।’
‘তাহলে বলে ফেল।’
‘আমার কিছু টাকা লাগবে।’
‘নিবি। বারণ করল কে?’
‘তাহলে দাও।’
‘কত দেবো?’
‘এক হাজার হলেই হবে। কাল বান্ধবীদের ট্রিট দেবো।’
‘কীসের ট্রিট? পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে নাকি প্রেম-ট্রেম কিছু করিস?’
‘উফফ! বাবা। কোনোটাই না। একটা ডেয়ার নিয়েছিলাম। কিন্তু হেরে গিয়েছি। তাই ওদের ট্রিট দিতে হবে।’
‘তুই আমার মেয়ে হয়ে হেরে গেলি? ছিঃ, ছিঃ! ভেরি ব্যাড।’
‘তুমি আর কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিও না তো বাবা।’
‘আচ্ছা যা দেবো না। টাকা কাল সকালে নিয়ে যাস।’
‘পাক্কা তো?’
‘একদম পাক্কা।’
আমি বাবার গালে চুমু খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আপনারা হয়তো বাবার সাথে আমার এমন কথোপকথন শুনে অবাক হয়েছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাবা আমার প্রথম বেষ্টফ্রেন্ড। আমি প্রায় সব কথাই বাবাকে শেয়ার করি; যে কথা হয়তো মাকে বলতেও ভয় পাই।
ঘরে এসে আমি শুয়ে পড়লাম। রাত আটটার মধ্যেই আমি রাতের খাবার খেয়ে ফেলি। বাবা অফিস থেকে আসলে মা আর বাবা একসঙ্গে খায়।
___________
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুম থেকে হৈচৈ শুনতে পেলাম। হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি ১০/১১ বছরের এক ছেলের সাথে বাবা কথা বলছে। তার মানে সত্যি সত্যি বাবা সকাল হতে না হতেই কাজের জন্য এই ছেলেকে ধরে এনেছে।
বাবা ছেলেটিকে প্রশ্ন করছে,’বল তো ওয়াই(Y) এর আগের অক্ষর কী?’
ছেলেটি বলল,’জানিনা।’
বাবা আবার প্রশ্ন করলেন,’তাহলে বল তো ৫০ এর আগের সংখ্যা কত?’
ছেলেটি এবারও বলল,’জানিনা।’
বাবা হতাশ হয়ে বলল,’তুই তো দেখি কিছুই পারিস না। ওকে, নো প্রবলেম! আমি তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।’
আমি এবার এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,’এই ছেলে কে বাবা?’
‘ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। আয় তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ওর নাম হচ্ছে রাজ্জাক।
আর রাজ্জাক, এইযে সামনে দাঁড়ানো পরীর মতো সুন্দরী মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছিস ও হচ্ছে আমার একমাত্র রাজকন্যা। ওর নাম নবনী। তুই ওকে আপা বলে ডাকবি।’
‘আচ্ছা।’ মাথা নাড়িয়ে বলল রাজ্জাক।
আমি বেশ ভালো করেই জানি, বাবা এই ছেলেকে কাজ করার জন্য আনলেও কাজ করাবে না। বাবা ওর সম্পর্কে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে বললাম,’সময় নেই বাবা। গোসল করে রেডি হতে হবে। বাহির থেকে ফিরে এসে তোমার গরীবের রাজ্জাকের সম্পর্কে সব শুনব।’
‘গরীবের রাজ্জাক! বেশ ইন্টারেস্টিং নাম তো!’ বিড়বিড় করে বলল বাবা।
ঘরে যাওয়ার আগে শুনতে পেলাম বাবা আবারও রাজ্জাককে প্রশ্ন করছে,’আচ্ছা এইটা বলতো ‘ঋ’ এর পরের অক্ষরটি কী?’
রাজ্জাক কী উত্তর দিয়েছে শুনতে পাইনি। তার আগেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছি। আমার ধারণা এবারও রাজ্জাক বলবে,’জানিনা।’
.
গোসল সেরে একদম রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাবা তখন টেবিলে রাজ্জাককে নিয়ে নাস্তা খাচ্ছিলও। মা-ও সেখানে উপস্থিত। আমায় রেডি দেখে মা বলল,’এত সকালে কোথায় যাস?’
‘রেস্টুরেন্টে যাই মা। বান্ধবীদের ট্রিট দেবো।’ বললাম আমি।
‘দুইদিন একদিন পরপর শুধু ট্রিট। টাকা কি গাছে ধরে?’
বাবা কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,’সেকি নয়না! তুমি জানো না? আমার একটা টাকার গাছ আছে। গোপন গাছ। ঐখান থেকেই তো আমি টাকা পাই।’
মা কটমট করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। বাবা সেদিকে লক্ষ্য না করে আমায় বলল,’আমার ঘরে বালিশের নিচে দেখ পনেরো’শ টাকা আছে। সব টাকা আবার ভাঙিস না। আসার সময় নবরত্ন তেলের বোতল কিনে আনবি তোর মায়ের জন্য। নবরত্ন তেল মাথা ঠান্ডা করার জন্য বেশ উপকারী। আর বাকি সব টাকা তোর।’
মা টেবিলের ওপর জোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল,’সবকিছুতেই তোমার বাড়াবাড়ি।’
আমার বাবা ভীষণ রসিক মানুষ। বাড়িতে থাকলে তার প্রথম এবং প্রধান কাজই হচ্ছে মাকে রাগানো। মানতেই হবে বাবা এই কাজটা খুব ভালো পারে। মা রেগে গেলেও প্রতিবার বাবার রসিকতায় আমি হেসে কুটিকুটি হয়ে যাই। মা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকায়। কিন্তু হাসি থামে না কী করব বলুন! টাকা নিয়ে আমি দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বের হলাম। বলা যায় না কখন আবার মা হুংকার দিয়ে বলে বসে,’নবনী তুই এখন বাড়ি থেকে বের হবি না। খবরদার! আর এক পা-ও আগাবি না।’
মেইনগেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলালাম। আশ্চর্য! একটা ফাঁকা রিকশা-ও নেই। এদিকে একটু পরপর তিথি ফোন করছে। ওরা রেস্টুরেন্টে এসে কখন থেকে নাকি বসে আছে। রাক্ষসের দল পেটুক একেকটা! কিছু্ক্ষণ অপেক্ষা করেও রিকশা পেলাম না। তাই এগিয়ে গিয়ে ভাবলাম সিএনজি নিয়েই যাই। টাকা তো আছেই। ভাগ্য ভালো থাকায় একটা সিএনজি পেয়েও গেলাম। ভেতরে ঢুকতে যাব তখনই ওপাশ থেকে আরেকটি ছেলে আমার সঙ্গে সিএনজিতে বসল। ছেলেটি অন্য কেউ নয়। রুদ্র! কালো জিন্সের সাথে সাদা একটা টি-শার্ট পরেছে। চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। অটোমেটিক আমার হাত বুকের বামপাশে চলে গেল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। আমায় অবাক করে দিয়ে রুদ্র হেসে ফেলল। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,’সরি। আপনি যান।’
আমি তড়িঘড়ি করে বললাম,’শুনুন, শুনুন। সমস্যা নেই। আমি সামনেই নামব। আপনি আসতে পারেন।’
‘আমিও সামনেই নামব। আমি সাথে গেলে সমস্যা হবে না তো?’
‘একদম না।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
রুদ্র আমার পাশে এসে বসল। মাঝখানে যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্ব। রুদ্র আপনমনে ফোন চাপছে। সিএনজি চলা শুরু করেছে। আমি চোরের মতো আড়চোখে বারবার রুদ্রকে দেখছি। কেমন ছেলেরে বাবা! কথা বলা তো দূরে থাক; ফিরেও তাকাচ্ছে না! না তাকাক! দুজনে যে একসঙ্গে একই সিএনজিতে যাচ্ছি এটা মনে করেই তো আমি মহাখুশি। কিন্তু অবাধ্য মনটা এরচেয়েও বেশি কিছু আবদার করছে। রুদ্রের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। আমি নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করে মনে মনে বললাম,’কাল তো খুব ভয় পেলি। আর আজ কথা বলার জন্য এত উতলা হয়ে পড়েছিস কেন?’
মনকে বকেও বলে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম। কাল রুদ্র রেগে ছিল। কিন্তু আজ তো রেগে নেই। চোখের সামনে বারবার মিষ্টি হাসিটা ভেসে উঠছে। বলি কথা! গলাটা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন?’
রুদ্র এবার ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। যাক বাবা! তাও তো তাকাল। তারপর আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,’না তো! তবে একটু একটু চেনা মনে হচ্ছে। মানে চোখদুটো আরকী!’
আমি হেসে ফেললাম। প্রথমদিনের কথা তার মনে নেই তাহলে।
‘কাল যে আমার থেকে পানি খেলেন। মনে নেই?’ বললাম আমি। রুদ্র মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ওহ আচ্ছা! আচ্ছা! মনে পড়েছে এবার। স্কুল ড্রেস ছাড়া কিন্তু তোমায় বেশ বড়ো মনে হয়।’
‘এজন্যই বোধ হয় প্রথমদিন আমায় কাজের বুয়া ভেবেছিলেন?’
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। হয়তো সেদিনের কথাটাই! রুদ্র নিজেই এবার শব্দ করে হেসে বলল,’আল্লাহ্!
তার মানে ঐ মেয়ে তুমি? সেদিনের জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। আমি একদম বুঝতে পারিনি। আর সরি বলার সুযোগও দাওনি।’
‘ইট’স ওকে। ব্যাপার না। আমার লুকটাই তখন ওমন ছিল।’
‘তুমি রাগ করোনি তো?’
‘প্রথমে রাগ হয়েছিল। এরপর আয়নার সামনে গিয়ে ভালো করে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম আপনার দোষ নেই।’
রুদ্র এবারও হাসল। এই ছেলে হেসেই আমায় মেরে ফেলবে নাকি বুঝি না!
‘সেদিনের পর তো তোমায় আর দেখলাম না। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার নাম কী?’
‘কিন্তু আমি আপনাকে প্রতিদিনই দেখতাম। আমার নাম নবনী।’
‘সুন্দর নাম। কোন ক্লাসে পড়ো?’
‘টেনে।’
‘গুড।’
সিএনজি এসে রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। আমার সঙ্গে রুদ্রও নামে। আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনি এখানে নামলেন যে?’
‘আমিও তো রেস্টুরেন্টেই যাব।’
কত মিল আমাদের! মনে মনে ময়ূর পেখম তুলে নাচছে। রুদ্র জোর করেই আমার ভাড়া-ও দিয়ে দিল। দুজনে রেস্টুরেন্টের গেটের সামনে যাওয়ার পর একটা মেয়ে হাওয়ার বেগে উড়ে এসে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে। এই দৃশ্য দেখে আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ইশরে! কেউ মনে হয় বুকের বাম পাশটায় তীর ঢুকিয়ে দিল। এই মেয়েটা আবার কে? রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড? এই মেয়ে যদি রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে সত্যি বলছি এখানে বসেই হাত-পা ছড়িয়ে আমি কাঁদব। আমার সান্ত্বনা দেওয়ার বাক্সগুলা যে কোথায়! প্লিজ রুদ্র প্লিজ এই মেয়েকে এক ধাক্কায় পঁচা নর্দমায় ফেলে দাও। আচ্ছা ঐ মেয়ে যদি সত্যিই রুদ্রর গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে আমার এখন কী করা উচিত?
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here