সে -পর্ব অন্তিম

0
381

#সে
#অন্তিম_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
কয়েক মাস পরের কথা। কলেজ থেকে ফেরার পর হঠাৎ-ই বৃষ্টি নামে। ছাতা মাথায় থাকলেও ব্যাগ আর মাথাই শুধু বৃষ্টির থেকে রেহাই পাচ্ছে। অন্যদিকে আমার সাদা ড্রেস বৃষ্টিতে একদম মাখামাখি। বৃষ্টি হলে তখন রিকশাওয়ালাদের দাম বেড়ে যায়। দ্বিগুণ ভাড়া দিলেও তারা যেতে নারাজ। অন্যদিকে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পথে। বৃষ্টি থামারও কোনো নামগন্ধ দেখছিলাম না বিধায় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটা শুরু করেছি। আমার পাশাপাশি আরও কয়েকটা ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল। তারা আমায় দেখে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যও করছিল। কয়েক ঘা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেই উপায় নেই কারণ রাস্তাঘাট প্রায় একদম ফাঁকা। অদূরে দু’একজন দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা তাদের মতো ব্যস্ত। হঠাৎ তখন আমার সামনে এসে একজন বাইক থামায়। ছেলেগুলোকে ছেড়ে একটার কলার ধরে দু, চারটা থাপ্পড় দিতেই বাকিরাও লেজ গুটিয়ে পালায়। ওরা চলে যাওয়ার পর যখন সে হেলমেট খুলে তখন আবিষ্কার করি লোকটি শুভ্র। আমার বুকের বাঁ পাশটায় কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে। রুদ্রর কথা মনে পড়ে যায় আমার। সেও একদিন ঠিক এভাবেই আমায় বাঁচিয়েছিল। সেফ করেছিল। সেই মানুষটা আজ নেই। ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে শুভ্র বলে,’রিকশা না নিয়ে এমন ভিজে ভিজে কেন যাচ্ছেন?’
‘রিকশা পাইনি।’ ধীরসুরে বললাম আমি।
সে বলল,’বাইকে উঠুন। আমি পৌঁছে দেই।’
আমি রাজি হয়ে গেলাম। রুদ্রর কথা মনে পড়ার পর থেকেই আমার হাত-পা অস্বাভাবিক রকমভাবে কাঁপছে। আমি আসলে বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে। এই অবস্থায় হেঁটে বাড়ি পৌঁছানোও সম্ভব নয়। আমি শুভ্রর পেছনে উঠে বসি। সে বাইক চালাচ্ছে। এতটা সময়ের ব্যবধানে আমি নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছি। মনকে শক্ত করেছি। কিন্তু এখনও হঠাৎ হঠাৎ রুদ্রর প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। ওর কথা মনে পড়লে চাপা কষ্ট অনুভূত হয়। সবসময় কিন্তু এমনটা হয় না। কখনও কখনও মনে পড়লে ‘ধুর’ বলেও এড়িয়ে যেতে পারি আমি। কিন্তু এখনও কেন পুরোপুরিভাবে তাকে ভুলে থাকতে পারি না সেই উত্তরই আমার মিলে না।
বাড়ির সামনে এসে বাইক থেকে নামার পর শুভ্র বলল,’এখন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে দেখলে আমায় ফোন করবেন। আমি আপনাকে নিয়ে আসব।’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’আপনার কষ্ট করতে হবে না।’
‘যে যেচে কষ্ট পেতে চায় তাকে সেই কষ্ট পাওয়া থেকে কি বঞ্চিত করা ঠিক?’
‘কষ্ট পাওয়াটা সার্থক হতো যদি উদ্দেশ্যও সফল হতো।’
‘তার মানে?’
‘তার মানেটাও পরিষ্কার। আপনি তো আমায় পছন্দ করেন তাই না?’
‘না। স্রেফ পছন্দ নয়। ভালোওবাসি।’ এই কথাটা শুভ্র আমার চোখের দিকে তাকিয়েই বলল।
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম,’এজন্যই বলেছি কষ্ট পাওয়া তখনই সার্থক হয় যখন উদ্দেশ্য সফল হয়। আপনি আমায় ভালোবাসেন। কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না।’
‘কেন? আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?’
‘হ্যাঁ বললে মিথ্যে বলা হবে, আবার না বললেও মিথ্যা বলা হবে। আমার আল্লাহ্ ভালো বলতে পারবেন।’
‘আমি বুঝিনি।’
‘যখন আমরা সিলেটে থাকতাম তখন একজনের সঙ্গে পরিচয় আমার। নাম রুদ্র। একটা সময়ে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসাও তৈরি হয়। আমি তাকে বলিও। কিন্তু ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা নয় বরং অবহেলা পেয়েছি। যতবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলে তার কাছে ফিরে গিয়েছি ততবার সেও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে। তার থেকে দূরে থাকার, তাকে ভুলে থাকার জন্য কত কিছুই না করেছি। সফল হতে পারিনি। যতবার তার খোঁজ-খবর নিয়েছি আমি নিরাশ হয়েছি। তার ঐ রঙিন দুনিয়ায় নবনী বলতে কারো স্থান ছিল না। নেইও। তাকে তো ভুলতে পারিনি। তবে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। এখন আমি নিয়মিত নামাজ পড়ি। একবারও কিন্তু আমি আল্লাহ্’র কাছে এটা বলি না যে আমি তাকে ভুলে যেতে চাই। বরং প্রতিবার আমি তার কাছে মানসিক শক্তি চাই। আল্লাহ্ আমায় নিরাশ করেনি। মনের জোর, মানসিক শক্তি নিয়েই এখন আমার পথচলা। সেখানে আমি আর পারব না অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে।’
শুভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এতক্ষণ সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি তার দিকে তাকানোর সাথে সাথে সে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, সে কান্না অথবা কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে। আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমি খুবই শান্তস্বরে বললাম,’আপনার হয়তো এখন খারাপ লাগছে। হতে পারে কষ্টও হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ভবিষ্যৎ-এ যেই কষ্টগুলো পেতেন সেগুলো এই কষ্টের কাছে কিছুই না। এখনও কিছুই হয়নি। আপনি মুভ অন করতে পারবেন।’
সে মুচকি হেসে বলল,’নবনী আপনি আল্লাহ্’র কাছে মানসিক শক্তি চেয়েছেন নামাজ পড়ে। আল্লাহ্ আপনাকে দিয়েছে। আমিও যদি নামাজ পড়ে আল্লাহ্’র কাছে আপনাকে চাই তাহলে কি উনি আপনাকে আমায় দেবে না?’
‘আমি যে রুদ্রকে চাইনি তাও কিন্তু নয়। প্রথমদিকটায় আমি রুদ্রকেই চেতাম। খুব করে! কিন্তু যতবার দেখতাম সে আমায় ছাড়া ভালো আছে, অন্য মেয়েদের মাঝে আমার কথা স্মরণ করার সময়ই তার নেই তখন থেকেই হয়ে উঠলাম আমি অন্য নবনী। আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরতে লাগল, আমি তো ফেলনা নই, সস্তা নই। তাহলে বারবার কেন আমিই ছোটো হব? এটাকে ইগো ভাববেন না। সেল্ফরেসপেক্ট জেগে ওঠে আমার মধ্যে। তখনই থেকেই আমি আল্লাহ্’র কাছে মানসিক শক্তি আর মানসিক শান্তি ছাড়া অন্য কিছু চাইনি।’
‘রুদ্রর কাছে অন্য মেয়েদের প্রায়োরিটি আছে। কিন্তু আপনার কাছে অন্য ছেলেদের প্রায়োরিটি নেই। আপনার জগৎ অন্য রকম। আপনি ভুল মানুষকে মোনাজাতে চেয়েছেন বলেই হয়তো আল্লাহ্ আপনায় রুদ্রকে দেয়নি। হতেই পারে সে আপনার জন্য সঠিক মানুষ নন। এবার দেখি কার মোনাজাতে জোর বেশি। আল্লাহ্ আপনায় আমায় দেয় নাকি না দেয়!’
‘শুধু একজনের চাওয়ার ভিত্তিতেই কিন্তু পূর্ণতা পাওয়া যায় না। যখন দুটি মানুষই মোনাজাতে দুজনকে চায় তখনই কেবল সম্ভব হয়। হতে পারে আপনার মতো আরও অনেকেই নামাজ পড়ে আমায় চায়। হতে পারে অন্য অনেক মেয়েই নামাজ পড়ে আপনাকে চায়, অথচ আপনি চাচ্ছেন আমাকে। সেখানে কী করে পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব?’
শুভ্র চুপ করে আছে। আমি বললাম,’শুনুন অনেকেই বলবে এক তরফা ভালোবাসায় শান্তি আছে। এখানে হারানোর ভয় নেই। যারা এ কথা বলে তারা কখনও কাউকে ভালোইবাসতে পারেনি। এক তরফা ভালোবাসায় সবচেয়ে কষ্ট বেশি। এখানে আপনি একজনকে সবটা দিয়ে ভালোবাসেন কিন্তু অপর পাশের মানুষটা আপনার এই ভালোবাসা বুঝতে নারাজ। সে আপনার ভালোবাসা বোঝে না বা বুঝতে চায় না। তখন ঠিক কী পরিমাণ কষ্ট হয় আপনি বুঝতেও পারবেন না। কতশত বার ইচ্ছে করবে একটাবার তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু সেই ইচ্ছে অধরাই রয়ে যাবে। একদিকে আপনি কষ্টে কষ্টে মরলেও অন্যদিকের মানুষটা হ্যাপি থাকবে। আপনি এটা সহ্য করতে পারবেন না। সহ্য করার মতোও নয়। আমি এই সিচুয়েশনটা পার করে এসেছি। এখনও মাঝে মাঝে একই সিচুয়েশনে পড়তে হয়। কাজেই আমি চাই না একই কষ্ট অন্য কেউ পাক এবং সেটা আমারই জন্য!’
শুভ্র এবারও নিশ্চুপ। আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,’বাড়ি যান। অবশ্যই আল্লাহ্’র কাছে চান। তবে সেটা শান্তি! আমায় নয়। আমি চাই আপনি ভালো থাকুন।’
আমি চলে আসার মুহুর্তে সে পেছন থেকে বলে,’দেখাই যাক শেষটা কী হয়! যদি না পাই ধরে নেব, এরচেয়েও ভালো কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,’কথায় আছে কায়া(মুখ) দেখলে মায়া বাড়ে। রুদ্রর থেকে দূরে থাকার জন্যই কিন্তু আমি অনেকটা ভালো আছি। কারণ তার সঙ্গে এখন আমার দেখা হয় না। আমি চাই, আজ থেকে আপনার সঙ্গেও আমার দেখা না হোক।’
‘কাজটা আমার জন্য কষ্টকর। তবে চেষ্টা করতে তো আপত্তি নেই। আমি চেষ্টা করব।’
আমি বাড়ির ভেতর চলে আসি আর সেও চলে যায়। এরপর থেকেই তার সাথে আমার যোগাযোগ কমতে থাকে। ম্যাসেজ করলেও তেমন একটা রেসপন্স করি না। সে নিজেকেও গুটিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আমিও তো ব্যস্ত আমার নিজের জীবন নিয়ে। প্রতিটা ভালোবাসার মানুষই ভালো থাকুক।
শুভ্রর সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তবে ফায়াজের মাঝে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সে রিলেশনশিপে থাকার পরও আমার সাথে কথা বলেছে। যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছে। আমি যতটা পেরেছি এড়িয়ে গিয়েছি। তার সপ্তাহ্ দুয়েক পরই আবার তার মাঝে আমূল পরিবর্তন আসে। সে ঘনঘন আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। আমার কাছে এই ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। আমি তাকে সরাসরিই বলে দিয়েছিলাম তার এই পাগলামি আমার পছন্দ নয়। এর মাঝে সেও চুপসে গেছে। কমিয়ে দিয়েছে তার পাগলামি।
.
.
প্রাইভেট থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর আদিবের কাছে জানতে পারলাম অজানা একটি কথা। আমার জন্য নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। বাবা-মা কেউই রাজি নয়। তবুও পাত্রপক্ষরা নাকি একবার দেখে যেতে চায় আমায়। আমি সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আদিবকে জিজ্ঞেস করলাম,’তোকে এসব কে বলল?’
‘কেউ বলেনি। আব্বু-আম্মু আমার সামনেই বলছিল। তখন শুনেছি। আচ্ছা আপু তোমার কি বিয়ে হয়ে যাবে?’
আদিবের প্রশ্নে আমি হেসে ফেললাম। ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,’এখনই নয়। দেরি আছে।’
‘বিয়ে হলে কি তুমি আমায় ভুলে যাবে?’
‘কখনই না। তোকে সাথে করে নিয়ে যাব।’
‘সত্যি?’
‘৩ সত্যি।’
আমি ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বিয়ে নিয়ে কোনো মাথা-ব্যথা নেই আমার। আর এটাও জানি, বাবা-মা’ও এখন আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছে না। অন্তত আমার অমতে তো কখনই বিয়ে দেবে না। তাই বাড়তি দুশ্চিন্তা না নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ফ্যানের ভনভন শব্দ করে ঘোরা দেখছিলাম। আমার মাঝে মাঝে নিজেকে রোবট মনে হয়। একটা লিখিত রুটিনের মাধ্যমে চলছে আমার জীবনের গতিধারা। যতটুকু লেখা আছে ঠিক ততটুকুই কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। এর বেশি নয়। অথচ এমনটা আমার কাম্য ছিল না। আমারও ইচ্ছে করে আগের মতো হাসি-খুশি সময়টা ফিরে পেতে। আমি কি পাব কখনও?
ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার দিকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের-ই পাইনি। চোখ মেলে দেখি মা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘুমটা হয়তো এজন্যই ভেঙেছে। মা মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করে,’নামাজ পড়বি না?’
‘হুম।’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম আমি।
চুলের মাঝে বিলি কাটতে কাটতে মা বলল,’রোবটের মতো জীবনযাপনে কোনো শান্তি নেই। হয়তো ব্যস্ততার মাঝে ক্ষণিক সময় কষ্ট ভুলে থাকা যায়; তবে সেটা চিরদিনের জন্য নয়।’
কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। মা আবার বলা শুরু করল,’তোর অনুমতি ছাড়াই তোর ডায়েরী পড়ে ফেলেছি। এজন্য দুঃখিত। একটা কঠিন সত্য কি জানিস নবনী? যার জন্য তুই নিজেকে পাল্টাবি সেই একদিন তোকে ভেঙে চলে যাবে। তাই যদি পাল্টাতেই হয়, তাহলে নিজের জন্য নিজে পাল্টাবি। অন্য কারো জন্য। এবার উঠে নামাজ পড়।’
মা চলে গেল। আমি সেভাবেই কিছু্ক্ষণ শুয়ে রইলাম। মায়ের প্রতিটা কথা বোঝার চেষ্টা করলাম। আসলেই এটা কি কখনও কোনো জীবন হতে পারে? যাকে ভুলে থাকার জন্য আমার এত ব্যস্ততা দিনশেষে তো তাকে একবার হলেও মনে পড়ে। কিছুটা হলেও খারাপ লাগে। তাহলে পুরোটা সময় ব্যস্ততায় রোবটের মতো কাটিয়ে লাভ কী? মনে যখন পড়বেই পড়ুক। বাকিটা সময় নিজেকে হাসি-খুশি এবং ভালো তো রাখতেই পারি আমি। শোয়া থেকে উঠে বসে দীর্ঘশ্বাস নিলাম। এরপর টেবিল থেকে ডায়েরীটা তুলে নিয়ে কিছু্ক্ষণ আনমনে হাত বুলিয়ে রান্নাঘরে চলে যাই। যেই যেই পাতায় রুদ্রকে নিয়ে লেখা ছিল সেইগুলো পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছিলাম। যেই মানুষটা সবার জন্য উন্মুক্ত সেই মানুষটা কখনও আমার ব্যক্তিগত সে হতে পারে না।
এরপর ডায়েরীটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে অজু করার জন্য ওয়াশরুমে চলে যাই। নামাজ পড়ে ড্রয়িংরুমে আসার পর আদিব জানালো ফায়াজ এসেছিল বাসায়। বাইরে দেখা করতে বলেছে। আমি গেলাম। সে দরজার বাইরে পায়চারি করছিল। আমায় দেখে অস্থির হয়ে বলল,’তুমি কেমন আছো নবনী?’
আমি শান্তভঙ্গিতেই বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনি?’
‘আমি ভালো নেই। তোমাকে ছাড়া আমি কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারছি না।’
আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে নিচুস্বরে বলল,’কতদিন দেখা হয়নি আমাদের! এতটা কাছাকাছি থাকার পরও। তুমি কি আমায় একটুও মিস করোনি?’
‘না।’
‘না?’
কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললাম,’আপনাকে মিস করার মতো কি কোনো কারণ আছে? অথবা আপনি কি আমার এমন কেউ হোন যে মিস করতেই হবে?’
‘তুমি আমার ওপর রাগ করে আছো তাই না?’
‘মানে? আপনার ওপর আমি কেন রাগ করব?’
‘দেখো নবনী তিয়াশার সাথে আমি রিলেশনশিপে গিয়েছি তোমার ওপর রাগ করে। তোমায় কতবার করে বলেছি আমি ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু তুমি…তুমি বারবার আমায় নিরাশ করেছ। আমায় ফিরিয়ে দিয়েছ। তাই জেদ করে আমি রিলেশনে জড়াই তোমায় দেখানোর জন্য যে, আমার জন্যও অনেকেই পাগল। আমায়ও অনেকে ভালোবাসে। তবুও আমি শুধু তোমার পেছনেই ঘুরেছি।’
আমি হেসে ফেললাম ফায়াজের কথা শুনে। মুচকি হাসতে হাসতেই বললাম,’সরি আপনার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। আচ্ছা আপনাকে তো আমি রুদ্রর কথা বলেছিলাম তাই না?’
‘হু।’
‘এটাও নিশ্চয়ই বলেছিলাম সে আমায় প্রতিবার কীভাবে অবহেলা করতো? অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলতো। বলেছিলাম না?’
‘হু।’
‘আমি এই পর্যন্ত কতগুলো প্রপোজাল পেয়েছিলাম। এখনও পাই। আপনি তো সবই জানেন। জানেন না?’
‘হু।’
‘এরপরও কিন্তু আমার একবারও মনে হয়নি আমি কোনো রিলেশনশিপে যাই। রাগ,জেদ আমারও হতো। তবে এরকম নয় যে,রুদ্রকে দেখাই সে ছাড়াও আরও অনেক ছেলেই আমার দিওয়ানা।আরও অনেকেই আমায় চায়। ইভেন আমার ভাবনায়ও কখনও এসব আসেনি। রাগ, জেদ হতো এটা ভেবে আমার নিজেকে ভালো রাখতে হবে। তবে সেটা রিলেশনশিপে গিয়ে নয়। এখন আপনার আর আমার মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝতে পেরেছেন?’
ফায়াজ অসহায়ের মতো বলল,’বুঝতে পেরেছি। আমি সরি সব কিছুর জন্য।আমি তিয়াশার সাথে ভালো ছিলাম না। বারবার শুধু তোমার কথা মনে পড়ত। তাই ব্রেকাপ করে ফেলেছিলাম। ব্রেকাপের পরও আমি ভালো নেই নবনী। আমার তোমাকে চাই।’
‘ওয়েট ওয়েট! রিলেশন থাকাকালীন আপনি ভালো ছিলেন না। ব্রেকাপ করার পরও আপনি ভালো নেই। ঠিক এজন্যই আপনি আমার কাছে ফিরে এসেছেন তাই না? হাহ্! তার মানে তো এটাই দাঁড়ায় আপনি যদি তিয়াশার সাথে ভালো থাকতেন অথবা ব্রেকাপের পরও ভালো থাকতেন তাহলে কখনই ফিরে আসতেন না। অর্থাৎ আমাকে আপনার প্রয়োজন ভালো থাকার জন্য। সরি টু সে, আমি কারো প্রয়োজনের প্রিয়জন হতে রাজি নই। আপনাকে আগেও আমি চাইনি আর এখন তো প্রশ্নই আসে না। মাফ করবেন।’
ফায়াজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি বাড়ির ভেতর চলে আসি। মায়ের বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে নিজেকে অন্য নবনী মনে হচ্ছে। অন্য রকম শান্তি আমার মধ্যে এখন বিরাজমান। এই নবনী কারও প্রয়োজন হবে না। এই নবনী কারও প্রয়োজনের প্রিয়জন হতেও রাজি নই। এই নবনীর কারো দয়ার প্রয়োজন নেই। সে নিজেই নিজের রাজ্যে মূল্যবান ব্যক্তি।
.
আমার সাথে বারবার ফায়াজের যোগাযোগ এবং কথা বলার চেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন ফায়াজ নিজেও কিছুটা দমে গিয়েছে। একটা বড়ো পরীক্ষা রয়েছে আমার সামনে। আমি নিজেও বেশ উত্তেজিত এটা জানার জন্য যে আমি কতটা পেরেছি নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে। তবে হ্যাঁ, আগের মতো রোবটের ন্যায় জীবন আমি কাটাচ্ছি না। আগে যেমন কলেজে গিয়ে এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকতাম, কারো সাথে কথা বলতাম না এখন আর তেমনটা নেই আমি। এখন আমার একঝাক ফ্রেন্ডস রয়েছে। আমরা একসাথে কলেজে যাওয়া-আসা করি, একসাথে টিফিন খাই, আড্ডা দেই। মন চাইলেই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাইরে ঘুরতে যেতে পারি। এখন আমার জীবনের আরও একটা মানে রয়েছে। জীবন মানেই শুধু কষ্ট নয়। জীবন মানে আনন্দও। সুখ এবং শান্তি। আপনি কীভাবে আপনার জীবনকে ভালো রাখবেন সেটা নির্ভর করে আপনার ওপর। নিজের ইচ্ছেশক্তির ওপর। যেটা আমি করতে পেরেছি।
আমার সামনের পরীক্ষাটা কি জানেন? রুদ্রর মুখোমুখি হওয়া। আমরা আজ সিলেট যাচ্ছি। রোজের বিয়ের দাওয়াতে।আমি যদি আগের নবনী থাকতাম তাহলে হয়তো কখনই রোজের বিয়েতে যেতাম না। তবে আগের আমি আর এখনকার আমির মধ্যে বিস্তর তফাৎ। ঠিক কতটুকু তফাৎ সেটাও একটু ঝালাই করে নিতে চাই আমি। আজ রোজের গায়ে হলুদ। আমরা আজই যাচ্ছি সিলেটে। আমাদের যেতে যেতে সম্ভবত গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। বাবা কাজের জন্য যেতে পারেনি। মা, আমি আর আদিব যাচ্ছি। বাবা স্টেশনে এসে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে গেছে। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে একজন এসে আমার পাশে বসে। মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে সে হাঁপাচ্ছে। সে কিন্তু অন্য কেউ নয়। শুভ্র! মা আর আদিব দুজনই শুভ্রকে চিনতে পারে। ওদের মধ্যে কথাও হয়। আদিব বোধ হয় বেশি খুশি হয়েছে শুভ্রকে দেখে। মা যেহেতু জানে না আমাদের পরিচয় রয়েছে তাই শুভ্র আগ বাড়িয়ে আমার সাথে কোনো কথা বলল না।
সেদিনের মতো আজও মা ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুভ্র ওর ফোনটা আদিবকে গেম খেলতে দিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলে,’মীরাক্কেল কীভাবে হয় দেখেছেন? আমি তো ভাবতেই পারিনি আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে। সবই আল্লাহ্’র ইচ্ছে বুঝলেন। তবে যাই বলেন, আমি কিন্তু ব্যাপক খুশি।’
আমি চুপচাপ তার কথা শুনে যাচ্ছি। আমার দৃষ্টি বাইরের দিকে। সে বলল,’কিন্তু…আপনি এমন নিশ্চল কেন? অবাক হননি একটুও? নাকি আমার উপস্থিতি আপনার মাঝে বিরক্তের সৃষ্টি করছে?’
আমি এবার তার দিকে তাকালাম। কিছু না বলে ফোন বের করে আমার আর তিথির ম্যাসেজ বক্স বের করে তার সামনে ধরলাম। সে ঢোক গিলে জিভ কাটল। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,’শুধু শুধু নাটক করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি জেনেশুনেই এসেছেন।’
‘ধুর! তিথি সব বলে দিল।’
‘আপনি প্লিজ চুপচাপ বসে থাকেন।’
‘আচ্ছা চুপ থাকলাম।’
এরপর সত্যি সত্যি আর কোনো কথা বলেনি শুভ্র। শেষ কথা বলল ট্রেন থেকে নামার পর। প্রায় ফিসফিস করে কানের কাছে বলে গেল,’বিয়ে বাড়িতে দেখা হচ্ছে।’
আমি অবাক হলাম। রোজের বিয়েতে সে আসবে কেন? সে কি রোজেরও পরিচিত?
তাকে নিয়ে মাথা ঘামালাম না। অনেকটা সময় বাদে পরিচিত জায়গায় এসে পুরনো দিনের গন্ধ পাচ্ছিলাম যেন। আমাদের সিলেট পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেছে। গেটের কাছ থেকে এসে রোজের বাবা আমাদের রিসিভ করেছে। এক পা এক পা করে বাড়ির দিকে এগোচ্ছি আর আমার হৃদপিণ্ড যেন একটু একটু করে লাফাচ্ছিল। রোজের বাসায় প্রচুর মেহমান। তবুও আমাদের রেস্ট করার জন্য আলাদা একটা রুম ছেড়ে দেওয়া হলো। অনেকদিন বাদে রোজকে দেখে কান্না পেয়ে গেছে আমার। রোজ নিজেও কেঁদে ফেলে। সেই রাতে অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে বসে গল্প করেছি ওর সাথে। কাল বিয়ে। আজ সারা রাত জাগলে সকালে আবার উঠতে পারবে না তাই দুজনই ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম ভাঙে রোজের মায়ের ধাক্কাধাক্কিতে। একবার আমায় ধাক্কাচ্ছে আরেকবার রোজকে। দুজনই রাতে সবার পরে ঘুমিয়েছি বলে এখন ঘুম কাটাতে কষ্ট হচ্ছে। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর পার্লারে যাওয়ার জন্য রেডি হতে বলল। আমি ব্যাগ থেকে গাউন বের করছিলাম তখন মা একটা লাল জর্জেট শাড়ি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,’এটা পর।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’শাড়ি পরব? কিন্তু আমি তো গাউন নিয়ে এসেছি মা।’
‘আমি চাই তুই আজ শাড়ি পরবি।’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,’আচ্ছা যাও শাড়ি-ই পরব।’
যারা যারা পার্লারে যাব সবাই মিলে নিচে নামছিলাম। নিচে এসে আমি থমকে যাই। রুদ্র গাড়ি থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোজ বলে,’কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল।’
আমি মৃদুস্বরে বললাম,’উনিও কি যাবেন?’
আমার ইাশারা করা জায়গায় তাকিয়ে রোজ বলল,’রুদ্র ভাইয়ার কথা বলছিস? হ্যাঁ, সে-ই তো পার্লারে নিয়ে যাবে।’
সবাই গিয়ে গাড়িতে বসেছে। আমি আর রোজ-ই রয়েছি। রোজ তাড়া দিয়ে নিজেও এগিয়ে গেল। রুদ্ররও ফোনে কথা বলা শেষ। রোজের দিকে তাকানোর পর তার দৃষ্টি এসে আঁটকে যায় আমার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে যেন তার চোখেমুখেও বিস্ময় ভর করে। যেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি একটু একটু করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’নবনী! তুমি! তুমি কখন এসেছ? কেমন আছো?’
আমি ছোটো করে বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌।’
পাল্টা তাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি সে কেমন আছে। সে নিজেই বলল,’আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না তো!’
‘আপনি সবসময় ভালো থাকেন আমি জানি। আপনার সব খোঁজ-খবর পাই তো।’
মুচকি হাসলো রুদ্র। আমি গিয়ে গাড়িতে বসলাম। রুদ্র আর ড্রাইভার বসলো সামনে। মেয়েরা রুদ্রর সাথে দুষ্টুমি করে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। রুদ্র নিজেও ওদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে। কেবল মাত্র আমিই ফোন ঘাটাঘাটি করছিলাম। তাদের সঙ্গ দেওয়া বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করলাম না। তবে রুদ্র বেশ কয়েকবার আমায় খোঁচা মেরে কথা বলেছে। যার নমুনা এমন,’নবনী দেখি ঢাকায় গিয়ে আরও বড়োলোক হয়ে গেছ। কথাই বলো না এখন। আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছ। বয়ফ্রেন্ড বুঝি কথা বলতে বারণ করেছে?’
আমি তার প্রতিটা কথা উপেক্ষা করে তিথিকে কল দিয়ে ওর সাথে কথা বলেছি। ওরাও পার্লারে আসছে। রুদ্রর কিছুটা হলেও বোঝার কথা আমি তার সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্ট নই। পার্লারের সামনে গাড়ি থামতেই আমি সবার আগে নামি। তিথি আর লিমা আমাদের আগেই চলে এসেছে। তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না আটকাতে পারিনি।
এক এক করে সবাই আগে সাজছিল। আমি তিথি আর লিমা বসে বসে গল্প করছিলাম। চার-পাঁচজনের একত্রে সাজা শেষ হলে ওরা আগেই কমিউনিটি সেন্টারে চলে যায়। এরকম করে বেশির ভাগই চলে গেছে। এখন আছি শুধু আমি রোজ, তিথি, লিমা আর রোজের দুইটা বান্ধবী ও দুজন কাজিন। আমরা সবাই একসাথে বের হয়েছি। তার আগে বলে রাখি, সাজার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমি এর আগে কখনও চুল খোঁপা করিনি। আজ চুলের খোঁপায় গুঁজে দেওয়া হয়েছে তিনটে লাল টকটকে রক্ত গোলাপ। কানের দুলের এবং গলার মালার সাদা পাথরগুলো হীরের মতো চকচক করছে। লাইটের আলো পাথরের ওপর পড়ায় সেগুলো আমার মুখে, গলায় কিরণ ছড়াচ্ছিল। আমার ভেতরকার সে(আমি) যেন আমার প্রসংশা করছিল।
আমরা আটজন একসাথে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে পৌঁছাই। কত মানুষজন সেখানে! যারা আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল কিছু সময়ের জন্য হলেও তাকিয়েই ছিল। হতে পারে রোজের জন্য। কারণ বউ সাজে আজ তাকে কতটা সুন্দর লাগছে সেটা আমি বলে প্রকাশ করতে পারব না। আমার দৃষ্টি কিন্তু একজনের দিকে আটকে গিয়েছিল। রুদ্রর পলকহীন চাহনী আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সে আমার দিকে এগিয়ে আসার আগেই মাঝখানে শুভ্র এসে দাঁড়ায়। ব্যস্তভঙ্গিতে বলে,’দাঁড়ান, দাঁড়ান। আগে আপনাকে নয়ন ভরে দেখি।’
এরপর আমার দিকে কিছু্ক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলে,’হায়ে! দিলে চোট লেগে গেছে। ইচ্ছে করছে লাল পরীকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। বুকের মাঝে আটকে রাখি।’
শুভ্র হাত দুটো প্রসারিত করে দাঁড়ায়। আমি তার বুকে কিল দিয়ে রোজের কাছে চলে যাই। রুদ্রকে দেখতে পাই ক্ষুব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সে। শুভ্র বিয়েতে এসেছে তিথির কাজিন সেজে। তাও শুধুমাত্র আমার জন্য। বিয়ে বাড়িতেও মেয়েরা রুদ্রকে জেঁকে ধরেছে। একসাথে ছবি তুলছে। আড্ডা দিচ্ছে। ওদের পছন্দের গান শোনাচ্ছে। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগছে না। বরং স্বাভাবিক-ই লাগছে। কারণ আমি অভ্যস্ত তার সম্পর্কে সব জানার পর।
বরযাত্রী আসার পর সবাই যখন বর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন রুদ্র আমায় টেনে একপাশে নিয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,’ইগনোর কেন করো? বয়ফ্রেন্ড শিখিয়ে দিয়েছে?’
‘আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। সরুন আমি যাব।’
‘দাঁড়াও।’ রুদ্র দু হাত দিয়ে বেরি দিয়ে বলল।
চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ঐ ছেলে কে? যার সাথে একটু আগে কথা বললে। সেই কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
‘বললাম না আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই? তাহলে সে কী করে আমার বয়ফ্রেন্ড হবে?’
আমার রাগেও রুদ্র বিচলিত হলো না। বরং ওকে খুশি দেখাল। মৃদু হেসে বলল,’তাহলে কি ঐ ছেলে তোমায় ভালোবাসে?’
‘ভালোবাসতেই পারে। আপনি ভালোবাসতে পারেননি বলে কি আর কোনো ছেলে ভালোবাসতে পারবে না?’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’তোরে আমি মেরেই ফেলব। এখনও তোর রাগ কমেনি একটুও।’
‘কমবেও না। যারা আমার রাগ, জেদ মেনে নিতে পেরেছে তারা এখনও অব্দি আমার জীবনেই আছে। আপনি পারেননি বলেই আমরা আলাদা হয়েছি।’
‘যদি বলি আমিও ভালোবাসতাম?’
‘তাহলে সেটাই হবে আজকের দিনে সবচেয়ে বড়ো মিথ্যা কথা।’
রুদ্র এবার আমার দু’গাল চেপে ধরে বলে,’সুন্দর হওয়ার সাথে সাথে রাগও বেশি বেড়ে গেছে। তুই জানিস আজকে তোকে কতটা সুন্দর লাগছে? ইচ্ছে করতেছে তোর ঠোঁট দুটো খেয়ে ফেলি।’
আমি তার হাতে নখ ডাবিয়ে খামচি দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিলাম। রাগী রাগী গলায় বললাম,’নিজের লিমিট ক্রস করবেন না একদম। আপনার আমার ওপর কোনো অধিকার নেই। তাই আমার সাথে কীভাবে কথা বলা উচিত সেটা আগে ভেবে নিবেন।’
আমি চলে আসার মুহূর্তে সে আমার হাত টেনে ধরে। আমি ধমক দিয়ে হাত ছাড়তে বলি। সে ছাড়ে না। এক হাতে আমার হাত ধরে রেখে অন্য হাতে মোবাইল বের করে। গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে আমায় দেখায়। ছবিটা দেখিয়ে বলে,’মনে পড়ে কিছু?’
‘এটা তো…’
‘হ্যাঁ এটা রেস্টুরেন্টের ছবি। প্রথম যেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়। আমি লুকিয়ে সেদিন তোমার ছবি তুলেছিলাম। যদিও পরে জেনেছিলাম সেদিন তুমিও লুকিয়ে লুকিয়ে আমার অনেকগুলো ছবি তুলেছ।
তুমি সিলেট থেকে ঢাকায় যাওয়ার দিন আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ফোন করেছিলাম তোমায়। কিন্তু ফোনও বন্ধ পাই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তোমার কোনো চিহ্ন ছিল না।
কমবেশি সময় কিন্তু আমি তোমাকে দিতাম। কিন্তু যখন তুমি নিজেই যোগাযোগ রাখতে চাইলে না তখন থেকে আমিও আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।’
আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে বললাম,’একটু যে কিছু মিসিং করলেন। কিছু বলতে বোধ হয় ভুলে গেছেন। আচ্ছা সমস্যা নেই, আমিই বলে দিচ্ছি।
আপনি আসলে আমায় ভালোবাসতেন না। ভালো লাগতো আমায়। একটা মোহ কাজ করতো আমার প্রতি। অন্য সবার থেকে আলাদা একটা টান ছিল আমার প্রতি। কিন্তু যখন এবং যেদিন থেকে আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি আপনার ওপর দুর্বল সেদিন থেকেই একটু একটু করে আপনি আমায় অবহেলা করতে শুরু করেন। যেদিন থেকে বুঝতে পারলেন আপনাকে ছাড়া আমায় চলবেই না সেদিন থেকে পুরোদমে অবহেলা শুরু করলেন। বাকিদের মতো আমায়ও তখন থেকে অপশন বানিয়ে ফেললেন। আপনার ধারণা ছিল যতখুশি অবহেলা করেন না কেন আমি সব সহ্য করে থেকে যাব। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আপনি একটা মানুষকে দিনের পর দিন অবহেলা করে যাবেন আর অপর মানুষটিও অবহেলা সহ্য করে রয়ে যাবে? আপনি যদি অল্প একটুও ভালোবাসা দিতেন তবুও আমি থেকে যেতাম। কিন্তু আমি কী করেছেন? বারবার আমায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি আসলে চাননি একজনের জন্য আরও দশজনকে হারাতে। আমার সঙ্গে আপনার রিলেশন হলে আপনি একটা দায়িত্ববোধে আটকে যেতেন। বাকি মেয়েদের থেকে যেই পরিমাণ প্রায়োরিটি,দাম পান সেগুলো আর পেতেন না। কিন্তু এগুলো তো আর আপনি আমায় এক্সকিউজ হিসেবে দেখাতে পারেননি। আপনি তখন আরেক চাল চাললেন। আপনার ক্যারিয়ারকে আপনি ইস্যু করলেন। অথচ সেই সময়টা আপনি অন্যদের সঙ্গে যেই সময় ব্যয় করেন তার থেকে অল্প একটু সময় পেলেও আমি থেকে যেতাম। আমি চলে যাওয়ার পরও আপনার জীবনে বিন্দুমাত্র কোনোরকম প্রভাব পড়েনি। কেউ না কেউ এসে সেই জায়গা ভরাট করেছে। আর আজ যখন এতগুলো দিন বাদে আমায় দেখলেন, তখন আবারও আপনার মোহ কাজ করা শুরু করেছে। আপনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, স্বার্থের পাগল। আপনার কথা হচ্ছে, বাকি সবাইকে মেনে নিয়ে থাকতে পারলে আপনার কোনো সমস্যা নেই। আপনি মেয়েদের সাথে ইচ্ছামতো ফান করবেন সেগুলো মেনে নিয়ে থাকতে পারলে তবেই আপনার উত্তর হ্যাঁ হবে। কিন্তু কোনো ভালোবাসার মানুষ তো এটা মেনে নিতে পারবে না। আমি ঠিক বললাম তো সব?’
রুদ্র নিশ্চুপ। আমি একটু থেমে দম নিয়ে বললাম,’যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অনেক কিছু শিখতে পেরেছি আমি। আপনি জীবনে এসেছিলেন বলেই মানুষ চিনতে পেরেছি। নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছি। মনকে নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা লাভ করেছি। আর সবশেষে সামনে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। পিছু ফিরে আর কখনই তাকাবো না। আপনার মিথ্যে ক্যারিয়ারের ইস্যু, বর্তমান জীবনযাত্রাও একটা মোহের মাঝে আটকে আছে। খুব বেশিদিন এগুলো ভালো লাগবে না। কোনো একদিন একটুখানি সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বুকের ভেতর হাহাকার করবে। সেদিনও হয়তো অনেক মেয়েই আসবে নিসঙ্গতা দূর করতে কিন্তু মন যাকে চায় তাকে পাবেন না। আপনার আগামী দিনের জন্য শুভকামনা রইল।’
রুদ্র আর একটা টু শব্দ পর্যন্তও করেনি। তবে তার নিরবতায় এটা তো স্পষ্ট এতদিন ধরে মনের মাঝে সুপ্ত যেই ধারণাগুলো আমার ছিল সব সত্যি।
আমি সেখান থেকে চলে আসার সময়ে হঠাৎ করে পা ফসকে যায়। আমি খেয়াল করলাম রুদ্র এগিয়ে এসেছে ধরার জন্য। সে আসার আগেই আমি নিজেকে সামলে নিই। তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বললাম,’ভয় নেই। পড়ব না। এমন হোঁচট জীবনে অনেকবার আমি খেয়েছি। ক্ষতি হয়নি। কিছু না কিছু তো শিখেছিই।’
ফিরে আসার সময় আচমকা শাড়ির আঁচলে টান লাগে। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলের ঘড়ির সাথে আঁচল আটকে গেছে। পেছন ঘুরে তাকাতেই ছেলেটি অপরাধীর ন্যায় হাতটা দেখিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,’আমি কিন্তু কিছু করিনি। এই দেখুন। তবে হ্যাঁ, পঁচিশটা বসন্ত অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটেছে। ভেবেছি কবে আসবে এই দিন। ফাইনালি কারো আঁচল ঘড়িতে আটকালো!’
আমি কিছু বললাম না। রুদ্র রাগী এবং জেলাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি আঁচলটা ছাড়িয়ে নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে চলে আসি। পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই আমার এই হাসির অর্থ বুঝতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার জীবনে স্ব-ভূমিকায় আমিই ‘সে’, যে নিজেকে নতুনরূপে গড়তে পেরেছি।
(সমাপ্ত।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here