চন্দ্ররঙা প্রেম -Part 17+18

0
449

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ17+18
#আর্শিয়া_সেহের
আজ দুইদিন ধরে রুশানের কোনো‌ খোঁজ খবর নেই।‌ গতকাল ফোনে রিং হলেও আজ সেটাও হচ্ছে না। ফোন সুইচ অফ। মেঘাও অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল শুন্য। রুমঝুম চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে।
গতকাল মেহেদীর হলুদ সন্ধ্যা ছিলো। রুমঝুম সেখানেই ব্যাস্ত ছিলো। তাই ব্যাপারটাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সারারাতেও যখন রুশানের খোঁজ পেলোনা তখন অস্থির হয়ে উঠলো সে।
রুমঝুম গতকাল রাতেই তার বাবাকে কল করে রুশানের কথা বলেছে। কিন্তু তিনি তখন মোংলায় থাকার জন্য রুশানের খোঁজ করতে পারেনি। সকালে বাড়ি ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী সদর দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। বিদ্ধস্থ অবস্থা তার। তাকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো প্রকার নড়াচড়া করলেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলেন।
রুমঝুমের বাবা পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও রুশানকে কোথাও পায়নি।‌ তিনি ব্যাপারটা রুমঝুমকে জানানোর পর থেকেই রুমঝুমের অবস্থা শোচনীয়। রুমঝুম মনস্থির করেছে,আজ মেহেদীর বিয়ে শেষ হলেই সে বাপের বাড়িতে যাবে। তার মন বলছে আরমানই রুশানের সাথে খারাপ কিছু করেছে।
শান রুমঝুমের অবস্থা সহ্যও করতে পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না। গতকাল‌ সকালেই মেঘা রুশানের পাঠানো ছবিগুলো শান আর মেহেদীকে দেখিয়েছে। তারপর সারাদিন তারা তিন জন রুমঝুমের আড়ালে রুশানের ফোনে কল‌ করেছে কিন্তু কল তোলেনি‌ কেউ। মেঘা আর শানও নিজেকে সামলে‌ রেখেছে শুধুমাত্র মেহেদীর বিয়ের জন্য।
মেহেদী বেশ‌ কয়েকবার ওদের বলেছে রুমঝুমকে নিয়ে যশোর চলে যাওয়ার কথা তবে ওরা যায়নি।‌ বিয়ে বাড়িতে মানুষ নানা রকম কথা বলতে পারে এজন্য।
সন্ধ্যার মধ্যেই মেহেদী সিন্থিয়াকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরলো। রুশানের জন্য আপাতত কেউই মজা করার মুডে নেই। বিয়ে বাড়িটাও শান্ত হয়ে আছে। প্রান্ত আর তিহানও ঠিক করেছে যশোর যাবে।
রাত আটটার দিকে রুমঝুম চুপচাপ বসে ছিলো মেহেদীদের বাড়ির পেছন দিকটায়। সিন্থিয়া আর মেহেদী বাদে সবাই এখানেই বসে আছে। শিরীন মেঘার সাথে হেঁসে হেঁসে গল্প করছে।তবে মেঘার মুখে হাঁসি নেই। রুমঝুমের প্রতি রুশানের ভালোবাসা দেখে ও নিজেও কখন যে রুশানকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছে সেটা ও জানে না। ওর হাঁসি বিহীন মুখে রুশানের জন্য গভীর দুঃশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
শিরীন মেঘার সাথে গল্প করলেও ওর চোখ দুটো প্রান্ততেই আটকে আছে। বিয়ে বাড়ির রংবেরঙের আলোতে প্রান্তকে এক একসময় এক একরকম লাগছে। শিরীন মুগ্ধ চোখে দেখছে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে।
রুমঝুমের উদাসীন দৃষ্টি শিরীনে গিয়ে আটকালো। শিরীন আজও প্রান্তর দিকে আগের দিনের মতোই তাকিয়ে আছে। প্রান্ত মাঝে মাঝে উঁকি মারছে তবে সেটা শিরীনের অগোচরে। রুমঝুমের আজ খুব ইচ্ছে করলো প্রান্ত-শিরীনের এই লুকোচুরি খেলা সম্পর্কে।
রুমঝুম নিজের জায়গা থেকে উঠবে তখনই দেখলো শান তার দিকে আসছে। হাতে একটা চেয়ারও আছে। রুমঝুমের মুখোমুখি বসে বললো,
-“আমার বউয়ের খুব মন খারাপ?”
রুমঝুম মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। শান একটু এগিয়ে রুমঝুমের মাথাটা টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো।‌ ধীর কন্ঠে বললো,
-“মন‌ খারাপ করো না। আমরা সকালেই যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। রুশানের কিছু হবে না।”
রুমঝুম চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর শানের বুক থেকে মাথা তুলে বললো,
-“আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো?”
শান মুচকি হেঁসে বললো,
-“যে কয়টা পারো করো।”
রুমঝুম ইতস্তত করে বললো,
-“শিরীন কি প্রান্ত ভাইয়াকে ভালোবাসে?”
শান কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকালো। শিরীন তখনো প্রান্তর দিকে তাকিয়ে মেঘার সাথে কথা বলছে। শান মুচকি হেঁসে পুনরায় ঘাড় ঘুরিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“হুম। তবে শিরীন ভালোবাসার আগে থেকে প্রান্ত শিরীনকে ভালোবাসে। ”
রুমঝুম অবাক হয়ে তাকালো শানের দিকে। কপাল কুঁচকে বললো,
-“তবে সেদিন শিরীন যে বললো প্রান্ত ভাইয়া নাকি ওকে ইগনোর করে। ভালোবাসে না।”
শান হাঁসি মুখেই বললো,
-“একটা গল্প শোনাই চলো।”
রুমঝুম শুনতে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করলো। শান বলতে শুরু করলো,
-“প্রায় চার বছর আগের কথা। সেদিন একটা ছেলে প্রথম তার বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে আসে। কারন সেদিন ছেলেটির জন্মদিন ছিলো। ছেলেটির সদ্য কিশোরী বয়সে পদার্পণ করা একটি বার্বি ডলের মতো দেখতে বোন ছিলো। সেই বার্বি ডলকে দেখে সেদিন ছেলেটির দুটো ফ্রেন্ড তার প্রেমে পরে যায়। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে একটা চলন্ত মানবী পুতুলের দিকে।
তারপর থেকে প্রায় দিনই ছেলেটির বন্ধু দুইটা তার বাড়িতে আসতো। একদিন ছেলেটি বুঝতে পারে তার এক বন্ধুর মনের কথা। অন্য বন্ধুটির সামনেই তাকে জিজ্ঞেস করে সে ছেলেটির বোনকে ভালো বাসে কি না। বন্ধুটি অকপটে স্বীকার করে নেয় ভালোবাসার কথা। মূহুর্তেই ভেঙে খানখান হয়ে যায় অন্য ছেলেটির মন।
সেই মন ভাঙা ছেলেটি কে জানো চন্দ্রকন্যা?”
শানের শীতল প্রশ্নে রুমঝুমের ধ্যান ভাঙলো। সে গল্পটা এতো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো যে শানের প্রশ্নটা সে বুঝতে পারেনি। রুমঝুম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো শানের দিকে। শান একবার পেছনে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
-“ছেলেটি ছিলো তিহান। তিহানও শিরীনকে ভালোবেসেছিলো কিন্তু প্রান্তর মনের কথা জানার পরই ও নিজের ভালোবাসা শেষ করে দিয়েছিলো। ভাগ্যের পরিহাস দেখো। শিরীনও দুবছরের মধ্যে প্রান্তের মায়ায় আটকে গেলো।
সেদিনের পর থেকে তিহান হয়ে ওঠে অন্য তিহান। ওর জীবনে সিরিয়াস বলে আর কিছুই থাকে না। সবকিছুতে হাসি ঠাট্টা করেই কাটছে ওর। সম্পর্কে বিশ্বাসটাও সেদিনই উঠে গেছিলো ওর। শিরীনের দিকে ভুলেও তাকায়না তিহান। আমি খেয়াল করি ওকে জানো?
আমি জানিনা ওর পরবর্তী জীবনে কি হবে। তবে আমি চাই ও ভালো থাকুক।”
রুমঝুম কখন কেঁদে ফেললো বুঝে ওঠেনি সে। জীবন কত খেলাই না খেলে। রুমঝুম চোখ মুছে বললো,
-“প্রান্ত ভাইয়া শিরীনকে ভালোবাসে তবে সেটা প্রকাশ করে না কেন?”
-“ও আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। শিরীনও এই বয়সে প্রেমের চক্করে পড়ে পড়াশোনা মাথায় তুলবে ভেবে ও বেশি‌ করে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।”
-“শিরীন উনাকে ভালোবাসে এটা কিভাবে জেনেছিলেন ,আপনারা?”
-“এইতো গতবছরই শিরীন ওকে লাভ লেটার দিয়েছিলো।‌ সেখানেই সব লেখা ছিলো। তারপর থেকেই ওরা আমাদের বাড়িতে আসে না ।”
রুমঝুম ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। সে প্রায়ই দোয়া করে যেন দুনিয়ার সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। কিন্তু সেটা আর হয় না। দুনিয়া এক আজব জায়গা ।এখানে সব রহস্যের খেলা চলে।
রুমঝুমের মনটা আবারও ঘুরে ফিরে রুশানে গিয়ে আটকালো। তার ভাইটা কোথায় আছে? কোন পরিস্থিতিতে আছে? কেমন আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করলো তার।
..
ভোর বেলাতেই রুমঝুমের ঘুম ভেঙে গেছে। মাথা ভর্তি চিন্তা থাকলে কি আর কারো ঘুম হয়? রুমঝুম উঠে ঘরে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। এর মধ্যে রুশানকে প্রায় আটবার কল করেছে। প্রতিবারই ভেসে আসছে এক নারী কন্ঠ। রুমঝুম ফজরের নামাজ পড়ে মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে ভাইয়ের সুস্থতা কামনা করলো। বারবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো তার ভাই যেন সুস্থ থাকে। রুমঝুমের কান্নার সূক্ষ্ম আওয়াজে শান ঘুম থেকে উঠে বসলো। তার চন্দ্রকন্যাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুকের পাঁজরে ব্যাথা অনুভূত হলো তার।
রুমঝুম চোখ মুছে জায়নামাজ তুলে পেছনে ফিরে দেখলো শান তার দিকে তাকিয়ে আছে। জায়নামাজ রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কখন উঠলে?”
শান হাতের ইশারায় রুমঝুমকে ডাকলো। রুমঝুম কাছে যেতেই তার হাত ধরে বিছানায় বসালো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে। রুমঝুমও গুটিসুটি মেরে পরে রইলো শানের বুকে। এই একটা জায়গায় সে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারে তার গোটা জীবন।
বেলা আটটার মধ্যে শান সবাইকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো। তারা এখনো মেহেদীদের বাড়িতেই আছে। এখান থেকেই রওনা হবে। তিহান আর প্রান্তও হাজির হয়েছে। মেঘা নিজের আর রুমঝুমের জন্য কিছু কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে।
বাড়ির লোকদের আসল কাহিনী জানানো হয়নি। তারা শুধু জানে রুমঝুমের ছোট ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। মেঘা, মেহেদী,শান, প্রান্ত আর তিহানই শুধুমাত্র রুশানের পাঠানো ছবির কথা আর তারপরেই তার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা জানে। বাকিদেরকে চিন্তায় ফেলবে না বলেই জানানো হয়নি।
শানদের মাইক্রোবাসেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। সব ব্যাগপত্র গাড়িতে উঠানো হয়ে গেছে। সিন্থিয়া আর শিরীন রুমঝুমকে শান্তনা দিচ্ছে। সিন্থিয়া রুমঝুমকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“ভয় পেয়ো না ঝুম। তোমার ভাইয়ের কিচ্ছুটি হবে না। তুমি তো ব্রেভ গার্ল ।এতো ভয় পেলে হবে?”
রুমঝুম নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর কষ্টটা চাইলেও অন্যরা বুঝবে না।
মেহেদী একটু দূর থেকে মেঘাকে ইশারা করে বললো,
-“আমি তোদের সাথে আসি?”
মেঘাও ইশারায় বুঝালো,
-“কোনো দরকার নেই। তুমি এদিকটা সামলাও।”
মেহেদী ফের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
-“তুই রুমঝুমকে সামলাতে পারবি তো?”
মেঘা চোখ বুজে মাথা হালকা হেলিয়ে বুঝালো,”সে পারবে।”
মেহেদী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তবুও মনের মধ্যে ভয় রয়েই গেছে। ছেলেটা ওদের হাতে পড়লে এতক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছে তো?
সবাই গাড়িতে উঠতে যাবে এর মধ্যে শান্ত গাড়ির সামনে বসে গগনবিদারী চিৎকার করে কান্না শুরু করলো। রুমঝুম নিজের কান্না থামিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত সকলেই শান্তর এমন কান্ডে হতবাক।
শাফিয়া আক্তার দৌড়ে গিয়ে শান্তকে তুললো। শান্তর মোটাসোটা শরীরটা টেনে তুলতে বেশ কসরত হলো তার।
শান্ত গাড়ির সামনে থেকে সরলো‌ না। সেখানে দাঁড়িয়েই কাঁদছে। তিহান এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“আরে ভাই এভাবে কাঁদতেছিস কেন? কি হইছে তোর?”
সবাই একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু শান্ত কান্নার জন্য কোনো উত্তর দিতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কোনো রকমে বললো,
-“তো.. তোমরা সব্বাই আ.. আমাকে রেখে হ.. হানিমুনে চলে যাচ্ছো কেন?”
সবারই বেশ সময় লাগলো কথাটা বুঝতে। শান মাথায় হাত দিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। শিরীন তো হেঁসে কুটিকুটি।
সবাই মিলে শান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে ওরা হানিমুনে যাচ্ছে না ,তবে শান্ত সেটা মানতে নারাজ। তার দৃঢ় বিশ্বাস এরা তাকে রেখে হানিমুনেই যাচ্ছে। শাফিয়া আক্তার শান্তকে বোঝাতে না পেরে বকবক করতে করতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। উদ্দেশ্য একটা লাঠি খোঁজা।
শান বুঝলো শান্তর কপালে মাইর আছে। তাই নিজেই এগিয়ে এসে শান্তর কাঁধ চাপড়ে বললো,
-“আমরা হানিমুনে যাচ্ছি না ভাই। বিশ্বাস কর।”
শান্ত অকপটে বললো,
-“তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না।”
শান উপায় না পেয়ে বললো,
-“আচ্ছা আমি তোকে প্রমিস করছি তোর বিয়ে হলে আমরা একসাথে হানিমুনে যাবো। এর আগে না।”
শান্ত এবার চুপ করলো। সে জানে তার ভাই প্রমিস করে কিছু বললে সেটা ঠিকই করে। শান্ত মিষ্টি হেঁসে বললো
-“তাহলে যাও।”
পেছন থেকে প্রান্ত বিরবির করে বললো,
-“শালা আমার একের চিজ। কি সুন্দর করে আমার টাকা বাঁচিয়ে দিলো।”
শান চোখ, ভ্রু, কপাল কুঁচকে তাকালো প্রান্তর দিকে। প্রান্ত সেটা না দেখার ভান করে গাড়িতে উঠে বসলো।
..
রুমঝুমদের বাড়িতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো। রুমঝুম তার বাবাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিলো আসার খবর। তিনি বাড়িতে তাদের জন্য রান্নাবান্না করিয়ে রেখেছে। ওরা খেয়েই রুশানের খোঁজে নেমে পড়বে।
তাহমিনা বেগম প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দরজার কাছেই বসে থাকেন। তার শরীর ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়েছে। কোনো মতে নিজেকে টেনে নিয়ে বেড়ায়। তিনদিন ধরেই কিছু খায় না । অসুস্থ হয়ে গেছে ভীষণ সে।
আজও সে দরজায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো।হুট করেই তার চোখে আবছায়া ভাবে ধরা পড়লো পরিচিত একটা মুখ। তাহমিনা বেগম নড়ে বসলেন। কোনো মতে উঠে দৌঁড়ে রুমঝুমের দিকে যেতে গেলেন। তবে পারলেন না। দু কদম এগিয়েই পড়ে গেলেন মাটিতে। রুমঝুম দৌঁড়ে এসে তাঁকে তুললো। তাহমিনা বেগম বিলাপ করে বললেন,
-“আমার ছেলেটা হারিয়ে গেছে রে রুমঝুম। ওই আরমানই ওকে নিখোঁজ করেছে। আমার পাপের ফল আমার ছেলেটা পেয়েছে। ওরে খুঁজে দে না রুমঝুম। আমি আর কোনোদিন তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। আমার বুকের মানিকটারে এনে দে না ।তোর পায়ে ধরতেছি আমি,ওরে এনে দে। আমার কলিজার টুকরাটারে খুঁজে দে। ”
রুমঝুম তাহমিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এর মধ্যে রুমঝুমের বাবাও বেরিয়ে এলেন। মেঘা আর রেজাউল সাহেব মিলে থামালেন রুমঝুম আর তাহমিনা বেগম কে। মেঘা বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
-“আন্টি আমরা রুশানকে খুঁজে বের করবো। আরমান শয়তানটাকেও শাস্তি দিবো। এর জন্য আপনার সাহায্য প্রয়োজন আমাদের। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে আমাদের কে সাহায্য করবে?”
তাহমিনা বেগম চুপ করলেন। সত্যিই তো এভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে? তিনি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। শান এগিয়ে এসে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সালাম করলো। তাহমিনা বেগম ছলছল চোখে তাকিয়ে শানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“বেঁচে থাকো বাবা।আর আমার মে.. মানে রুমঝুমকে দেখে রেখো।ওকে সুখে রেখো। আমি কখনো ওকে শান্তি দেই নি।”
রুমঝুম বললো,
-“মা থামেন। ভেতরে চলেন। তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হতে হবে।”
তাহমিনা বেগম সায় জানিয়ে সবার সাথে ভেতরে ঢুকলেন।
মেঘা খেতে খেতে বললো,
-“আন্টি আপনি কি আরমানের কোনো গোডাউন বা ফার্ম হাউস চেনেন ?”
তাহমিনা বেগম মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এখানে যেটা সেটা চিনি। তবে আরো একটা আছে ।ওটা চিনি না।”
প্রান্ত কিছু ভেবে বললো,
-“ইয়েস। ইটস্ এনাফ। একটা পেলে সেখানে অন্যটারও কোনো না কোনো ক্লু পাওয়া যাবে।”
শান অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আম্মা আপনি রুশানকে খুঁজতে সেখানে গিয়েছিলেন?”
-“গিয়েছিলাম। তবে ওদের পাইনি।”
শান আগেই ভেবেছিলো ওরা জায়গা পরিবর্তন করবে। এখন সেই জায়গাটা খুঁজতে হবে শুধুমাত্র।
..
সবাই যখন আরমানের গোডাউনের সামনে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই।
তাহমিনা বেগম আগে আগে হাঁটছেন। গোডাউনের সামনে এসে দেখলো দরজায় অনেক বড় তালা ঝুলানো। প্রান্ত সাথে করে একটা লোহার শাবল এনেছে। শান ফ্ল্যাশ লাইট অন করেছে আর প্রান্ত শাবল পিটিয়ে দিয়ে তালা ভেঙেছে।
ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। তিহান মেইন দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইলো। বাকিরা ভেতরে ঢুকে প্রথমে সুইচ খুঁজে লাইট অন করলো। লাইট জ্বলতেই চমকে উঠলো সবাই। পুরো ঘর জুড়ে একদম বাজে অবস্থা। মনে হচ্ছে কেউ পুরো রুমে দৌঁড়ে বেরিয়েছে আর এক এক করে জিনিসগুলো ছুড়ে ফেলেছে।
টানা আধঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর একটা ফাইলের মধ্যে পাওয়া গেলো আরমানের দ্বিতীয় গোডাউনের খোঁজ। সেটা যশোরে না। যশোরের অদূরে খুলনার সাতক্ষীরা জেলার একদম শেষ প্রান্তে শ্যামনগরে অবস্থিত সেটা।
প্রান্ত প্রতিটি রুমের ছবি তুলেছে। সব ফাইল, ডকুমেন্টস ও সাথে নিয়েছে।
রুমঝুম রুশানের ব্যাপারে এখনো কিছু জানতে না পেরে হতাশ হলো। শরীরটা দূর্বল লাগছে।
সবাই গোডাউন থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ালো। তিহান দরজা টেনে দেওয়ার সময় মেঘা ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সেদিকে ধরলো। তখনই নজরে পড়লো দরজার বাইরে ডানদিকে একটু উপরে একটা খাম ঝুলছে। মেঘা শানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ভাইয়া, দেখুন তো ওটা কি?”
শানের সাথে বাকি সবাই সেদিকে তাকালো। শান এগিয়ে গিয়ে খামটা নিলো। রুমঝুম তড়িৎ বেগে গিয়ে ছো মেরে খামটা নিয়ে নিলো। কাঁপা হাতে খাম খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা চিঠি।
রুমঝুম সবার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে চিঠি খুললো। মেঘা চিঠিটা রুমঝুমের হাত থেকে নিয়ে বললো,
-“আমি পড়ছি। তুই শান্ত হয়ে শোন।”
রুমঝুম চুপচাপ দাঁড়ালো। মেঘা চিঠিটা পড়তে শুরু করলো,
‘হাই রুমঝুম,
আমি জানতাম তুমি আসবে। তবে এভাবে আনতে চাইনি তোমাকে। আমার প্ল্যান ছিলো অন্যরকম। কিন্তু তোমার এই বা*পাকনা ভাই সেটা হতে দিলো কই?
ভুল সময়ে আমার সামনে চলে এলো। তোমাকে বাঁচানোর জন্য সে আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে উঠেপড়ে লেগেছিলো। হাহাহা। পুঁচকে ছেলেটা। আমাকে পুলিশে দিয়ে ও বোনকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।
বিশ্বাস করো, ওকে মারার ইচ্ছে ছিলোনা। ও যেচে মরতে এসেছিলো সিংহের গুহায়।
তবে আমি ওকে মারিনি। আধমরা করেছিলাম শুধু। ওকে মেরেছে অন্য কেউ।
কে মেরেছে সেটাও জানতে পারবে অতি শীঘ্রই।তোমার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে।
আর শোনো,আদরের ছোট ভাইকে খোঁজা বন্ধ করো। এতে কোনো লাভ নেই বুঝলে? কারন ওকে টুকরো টুকরো করে…”
মেঘা হাঁসফাঁস করছে। বাকিটুকু পড়ার শক্তি নেই ওর । রুমঝুম মৃদুস্বরে বললো,
-“আমার ভাই, আমার রুশ…”
পুরোটুকু বলার আগেই ঢলে পড়লো শানের বুকে।
চলবে……..
(মেঘাকে খলনায়িকা বানাতে চেয়েছিলাম। তবে পাঠকদের মেঘাপ্রীতি দেখে সে সাহস পেলাম না।
রি-চেক দেওয়া হয়নি।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৮
#আর্শিয়া_সেহের
রুমঝুমের যখন হুঁশ ফিরলো তখন মধ্যরাত। বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। দূরে কোথাও থেকে হালকা‌ আলো ভেসে আসছে।
ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খোলা। ফুরফুরে হাওয়া ঢুকছে ভেতরে। ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে রুমঝুমের।
চোখ মেলে বেশ কিছু সময় ধরে মনে করলো তার কি হয়েছিলো। রুশানের কথা মনে পড়তেই উঠে বসলো সে। পাশে শান একহাতের উপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে হয়তো।
রুমঝুম চোখ ফিরিয়ে নিলো।
ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে বেশ আলো ছড়ানো। হয়তো জোৎস্না আছে আজকে। জানালাটা হালকাভাবে টেনে দিলো রুমঝুম। পেছনে শানের দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে রুমঝুম। রুশান চাঁদ,তারা, আকাশ ভীষণ ভালোবাসতো। কতশত রাত দুই ভাইবোন ছাদে বসে আকাশ দেখেছে। রুশান বলেছিলো, ও যখন আল্লাহর কাছে চলে যাবে তখন চাঁদের সবচেয়ে কাছের তারাটি ও হবে। সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা থাকবে ওর। রুমঝুম যেন ওই তারাটির দিকে তাকিয়ে ওকে খোঁজে।
রুমঝুম এলোমেলো দৃষ্টি খুঁজে চললো সেই তারাকে।‌ কিন্তু কই? কোথাও তো এমন তারা নেই। সব তারাই তো একইরকম ভাবে জ্বলজ্বল করছে আকাশে।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো রুমঝুম। মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলো। চাঁপাকন্ঠে বললো,
-“আমার ভাই। কোথায় চলে গেলি আমাকে রেখে? একটাবার ফিরে আয় রে ভাই। একটাবার আয়।
তোকে আগলে রাখবো আমি। আমি জানি তুই মরিসনি। আয় না ভাই,ফিরে আয়।”
রুমঝুম কাঁদতে কাঁদতে গড়িয়ে পড়লো ছাদের উপর।
রুমঝুমের হঠাৎই মনে হলো ওকে কেউ দেখছে। হামাগুড়ি দিয়ে রেলিংয়ের ধারে চলে গেলো। দুহাতে চোখ মুছে বাড়ির পেছনদিকের বাগানে নজর দিলো।
নাহ! কোথাও তো কেউ নেই। হয়তো ওর মনের ভুল।
রেলিংয়ে মাথা লাগিয়ে সেভাবেই বসে রইলো রুমঝুম। রুশান ওর জন্যই মরে গেছে। শুধুমাত্র ওর জন্য। কে বলেছিলো ছেলেটাকে ওকে এতো ভালোবাসতে? রুমঝুম আবারও ঠোঁট কামড়ে ধরে কেঁদে উঠলো। নিজের দাঁতেই কেটে গেলো ঠোঁট। সেদিকে খেয়াল নেই রুমঝুমের। ওর মনটা পড়ে আছে ওর ভাইয়ের কাছে। অস্ফুট স্বরে বললো,
-“কোথায় আছিস ভাই? আয় না ফিরে। একটাবার আয় । আমার কলিজাটা ঠান্ডা করে দে।”
আচমকা রুমঝুমের মুখ‌ রুমাল দিয়ে কেউ একজন চেপে ধরলো পেছন থেকে। রুমঝুম কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেতিয়ে পড়লো ফ্লোরে। সম্পূর্ণ অজ্ঞান হওয়ার আগে শুনতে পেলো কেউ ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বলছে,
-“মরা মানুষ কখনো ফিরে আসে না। কখনো না। তোর ভাইও ফির…”
রুমঝুম ততক্ষণে পুরোপুরি সেন্স হারিয়েছে।
..
জানালের ফাঁকা দিয়ে সূর্যের রশ্মি সরাসরি এসে শানের মুখে পড়লো। শান ভ্রু কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সেদিক থেকে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলো ভালোই আলো ছড়িয়েছে চার পাশে। পাশ ফিরে রুমঝুমকে দেখতে পেলো না বিছানায়। দরজা চাপানো তবে লক করা না। ভাবলো ,রুমঝুম হয়তো বাইরে গেছে।
শান শোয়া থেকে উঠে বসলো। রুমঝুমের ঘরের দেয়াল ঘড়িটা নষ্ট। শান বিছানা হাতিয়ে ফোন খুঁজে বের করলো। অন করে দেখলো নয়টা চৌদ্দ বাজে।
অবাক করা বিষয় হলো‌ আটচল্লিশটা মিসড কল ভেসে আছে স্ক্রীনে।
শান তাড়াতাড়ি ফোন আনলক করে দেখলো তিহান আর প্রান্ত এতোগুলো কল করেছে। সে অনতিবিলম্বে কল ব্যাক করলো তিহানের নাম্বারে।
একবার বাজতেই তিহান রিসিভ করলো। রাগী কন্ঠে বললো,
-“এতো কিভাবে ঘুমোচ্ছিস তুই? কখন থেকে কল করছি সে খেয়াল‌ আছে?”
শান একহাতে চোখ ,কপাল ডলে বললো,
-“আমি মাঝরাতের দিকে ঘুমিয়েছিলাম ইয়ার। এজন্য উঠতে পারিনি।”
তিহান সিরিয়াস কন্ঠে বললো,
-“দেখ রুশানের ব্যাপার,ওই ছবি ,চিঠি এগুলো কিন্তু কেউ জানেনা। আমাদের এখনো অনেক কাজ বাকি । রুশানকে ও মারুক বা না মারুক ওকে ছাড়া যাবে না। ও একটা বিষাক্ত কীট।”
কথাগুলো বলতে বলতে তিহান তেতে উঠলো।
শান আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“রুমঝুমকে একটু পাঠিয়ে দে। রুমঝুমের হাতেই শাস্তি পাবে ওই শয়তান। ওকে আগে বুঝাতে হবে।”
তিহান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“রুমঝুমকে পাঠাবো মানে? ও তো এখনো বাইরে বের হয়নি। ঘরেই আছে দেখ।”
শান চকিতে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালো। বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে আটকানো। শানের বুক কেঁপে উঠলো। কম্পমান কন্ঠে বললো,
-“ও ঘরে নেই তিহান। ও কোথায় গেলো?”
তিহান অবাক হয়ে বললো ,
-“ঘরে থাকবে না তো কোথায় যাবে? আরে ভালো করে দেখ।”
শান একটু ভেবে বললো,
-“ছাদে আয় তো।”
বলেই ফোন বিছানায় ফেলে ছাদের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলো। তিহানও বিনা বাক্য ব্যয়ে ছাদে এলো।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই শানের চোখে পড়লো রুমঝুমের স্যান্ডেল। জোড়া নয় ,একটা। শানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে বহুগুণ।‌ ছাদের দরজায় পড়ে আছে আরেকটা জুতো। পুরো ছাদের কোথাও রুমঝুম নেই।
তিহান ততক্ষণে চলে এসেছে। প্রান্তও তিহানের পিছু পিছু এসেছে। শান দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। রুমঝুম এখানে এসেছিলো আর ওর সাথে কিছু একটা হয়েছে সেটা ওরা বুঝে গেছে।
তিহান‌ মেঘাকে ফোন করে পুরো বাড়িতে রুমঝুমকে খুঁজতে বললো।
শান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো খোলা আকাশের নিচে। দম বন্ধ হয়ে গেছে ওর । প্রান্ত দৌড়ে এসে শানের পাশে বসলো। শান প্রান্তর স্পর্শে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
মেঘা হাঁফাতে হাঁফাতে ছাদে উঠে এলো। শানকে এভাবে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়ালো দরজাতেই। কতখানি ভালোবাসলে একটা ছেলে একটা মেয়ের জন্য এভাবে কাঁদতে পারে।
তিহান মেঘার কাছে গিয়ে বললো,
-“সবজায়গাতে দেখেছো?”
মেঘা কান্নাভেজা চোখে চেয়ে বললো,
-“ও কোথাও নেই। ও এই বাড়িতেই নেই। ওর চুলে আটকানো কাঁটাটা বাড়ির বাইরে গেটের কাছে পড়ে ছিলো।”
শান কান্না থামিয়ে উঠে এসে মেঘার হাত থেকে কাঁটাটা নিয়ে নিলো। একনজর তাকিয়ে বললো,
-“এটা ওর মাথায় ছিলো রাতে।”
চারটা মানুষই ভয় পাচ্ছে রুমঝুমের কি অবস্থা সেটা ভেবে। তিহান তড়িঘড়ি করে বললো,
-“আমাদের দেরি করা উচিৎ হবে না। এখনি আরমানের দ্বিতীয় গোডাউনের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। বেশি দেরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
মেঘা প্রান্ত আর তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বাড়িতে জানাবো একবার?”
শান তড়িৎ গতিতে বললো,
-“একদম না। এই কথা যেন কেউ না জানে। এসব জানলে রুমঝুমের দিকে আঙুল তুলবে মানুষ। এগুলো শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে।”
বাকি তিনজন সম্মতি দিলো সে কথায়। সবাই কালবিলম্ব না করেই সাতক্ষীরায় যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো।
তাহমিনা বেগম কাল রাতে দরজা আটকেছেন তারপর আর খোলেননি। মেঘা কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়া পাননি। রুমঝুমের বাবা মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। শান এসে তার সামনে দাঁড়ালো। রেজাউল সাহেব মাথা উঁচু করে শানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নিলেন। ধীর কন্ঠে বললেন,
-“আমার সংসারটা এমন ছিলো না। এমন হতোও না যদি ওই নাগিনকে এই সংসারে আনতাম।”
একটু থেমে চোখ মুছলেন রেজাউল সাহেব। শানের হাত দুটো ধরে বললেন,
-“আমার ছেলে-মেয়েদুটোকে এনে দিবে বাবা? আমি আর কত সহ্য করবো হারানোর ব্যাথা? এক সন্তানকে বহু আগে হারিয়েছি ,আর কাউকে হারাতে পারবো না।”
তিহান একবার হারানো সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। এখন এসব জিজ্ঞেস করার উপযুক্ত সময় না।
শান রেজাউল সাহেবকে আশ্বস্ত করে বললো,
-“আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনার মে.. ছেলেমেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আপনি দোয়া করবেন শুধু। ”
শান,মেঘা, প্রান্ত, তিহান হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। রেজাউল সাহেব তাদের পিছু পিছু এসে দাঁড়ালেন গাড়ির কাছে। গাড়ি স্টার্ট করার আগে বললেন,
-“তোমাদের কথায় আমি পুলিশ ইনফর্ম করিনি। তোমরা সাবধানে যা করবা কইরো। ”
শান তাঁকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
মেঘা অবাক হয়ে শান, প্রান্ত আর তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার পুলিশকে ইনফর্ম করতে দেননি কেন ভাইয়া? প্ল্যান কি আপনাদের?”
প্রান্ত বললো,
-“শান বারন করেছে পুলিশকে ইনফর্ম করতে। আর প্ল্যান টাও বলেনি।”
শান ড্রাইভিং করতে করতে একবার ওদের তিনজনের দিকে লাল রঙা ফোলা চোখ মেলে তাকালো। তারপর রহস্যময় এক হাঁসি দিলো।
প্রান্ত সেদিকে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকালো। শানের এই রুপ তাদের কাছে একদম নতুন। তিহান পেছনের সিট থেকে সামনে ঝুঁকে বললো,
-“শান ,তুই কি করতে চাইছিস প্লিজ বল আমাদে। এখন কিন্তু খুব টেনশন হচ্ছে ইয়ার।”
শান একই ভঙ্গিতে আবারও হাসলো। তবে সেই হাঁসির আড়ালে একরাশ ভয় আর চিন্তাও রয়েছে তার।
গম্ভীর কন্ঠে শান বললো,
-“চিন্তা করিস না। আমি পুলিশকে ইনফর্ম করেছি। আর আপাতত আমি রুমঝুমের কাছে পৌঁছাতে চাই। আর কিছু না।”
তিনজনই হতাশ হলো। তারা জানে শান অন্য কিছু ভাবছে তবে সেটা বলছে না। শান নিজে যতক্ষণ না কিছু বলবে ততক্ষণ কিছুই জানা সম্ভব না।

রুমঝুম পিটপিট করে চোখ মেললো। চোখ খুলেই আঁতকে উঠলো রুমঝুম। অন্ধ হয়ে গেছে নাকি সে? অন্ধকার ছাড়া কিছুই মিলছে না চোখে। চারপাশে শুধুই অন্ধকার। কোথায় আছে,কয়টা বাজে,এটা দিন নাকি রাত? অনুমান করতে পারছে না সে কিছুই । তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। মুখও বাঁধা। আস্তে আস্তে গতরাতের কথা মনে পড়লো তার। কে ওকে তুলে আনলো এখানে? রুমঝুমের বুক কেঁপে উঠলো।
বেশ কিছু সময় নিজের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেও হাত ছাড়াতে ব্যার্থ হলো রুমঝুম।
একসময় চুপসে পড়ে রইলো সেই জায়গাতেই। হঠাৎ চোখে একঝাঁক আলো এসে পড়লো। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো রুমঝুম। ধীর ধীরে চোখ মেলে দেখলো সামনে সেই জানোয়ার দাঁড়ানো। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো।‌ ঘৃনা লাগছে ওই পশুর দিকে তাকাতে তার।
রুমঝুম আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এতক্ষণ একটা গ্যারেজের মধ্যে গাড়ির ডিকিতে ছিলো সে।
আরমান রুমঝুমকে পাঁজাকোলা করে তুলে গোডাউনের ভেতর ঢুকে পড়লো। রুমঝুমের গা গুলিয়ে উঠলো আরমানের ছোঁয়ায়। তবে এখন তার হাত-পা বাঁধা। কিছু করার নেই।
একটা পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দিলো রুমঝুমকে। হাত -মুখ মুক্ত করে দিলো। হাত খোলার সাথে সাথে রুমঝুম ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো আরমানের উপর। আরমান জানতো এমন হবে। রুমঝুমের এমন রুপে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। রুমঝুম একেরপর এক আঘাত করছে যেভাবে পারছে আর আরমান উচ্চস্বরে হেঁসে সেগুলো গ্রহন করছে। একসময় রুমঝুম থেমে গেলো। কাল বিকেল থেকে না খেয়ে থাকায় সে এখন বেশ ক্লান্ত। রুমঝুম মেঝেতে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো।
আরমান এগিয়ে এলো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুমের পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে বললো,
-” তোমার বিনিময়ে গুনে গুনে পনেরো লক্ষ টাকা দিয়েছি তোমার মা কে। আই মিন সৎ মা। এতো সহজে তোমাকে ছেড়ে দেবো? তোমাকে কাজে লাগিয়ে আমি কত টাকা ইনকাম করতে পারবো জানো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?”
রুমঝুম ঘৃনা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো আরমানের দিকে। ঘৃনা হলো তার সৎ মায়ের প্রতিও। মানুষ কিভাবে এমন হয়?
আরমান রুমঝুমের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,
-“খাবার পাঠাচ্ছি। খেয়ে নাও। আর দেখে নাও তোমার আদরের ছোট ভাইয়ের খুনি কে।”
আরমান একটু উচ্চ কন্ঠে ডাকলো,
-“রুমেল। খাবার নিয়ে আয় ।”
রুমঝুম কেঁপে উঠলো।ঝনঝন করে উঠলো পুরো শরীর। এই নাম? এই নাম তো..
রুমঝুম দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো সেই ব্যাক্তির আসার পথে। সে পথেই এক মিনিটের মতো ব্যয় করে ধীর পায়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো এক যুবক। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক যুবক।
রুমঝুমের সামনে তার চেহারা স্পষ্ট হলো বেশ কাছে আসার পর। তাকে দেখেই থমকে গেলো রুমঝুম। বুকের পাঁজরে কেউ কামড়ে ধরে রেখেছে যেন । খুব কষ্টে টেনে উঠালো একটা শ্বাস। জড়ানো গলায় বললো,
-“ভ.. ভাইয়া।”
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here