#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-15+16
#আর্শিয়া_সেহের
শান্তর কোনো হেলদোল নেই। সে আজকে পন করেছে, ম্যাথ না করে এক পা ও নড়বে না। শান এই ঘর থেকে যাওয়ার জন্য অনেকক্ষণ ধরে বুঝাচ্ছে শান্তকে কিন্তু শান্ত তো শান্তই। সে ও নাছোড়বান্দা। ম্যাথ না করে ও এই ঘর ছাড়বে না।
শান হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। রুমঝুম তো দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে রিতিমত বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুমঝুমকে এভাবে হাসতে দেখে শানও মুচকি হাসলো। শান্তর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ম্যাথ বই খুলে নিয়ে বসেছে।
-“তোর ভাবি খুব টায়ার্ড। তোর ঘরে চল। ওখানে গিয়ে ম্যাথ করাবো”।
শানের কথা শুনে শান্ত ভ্রু কুঁচকে রুমঝুমের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পরখ করে বললো,
-“ভাবি তোমাকে বলেছে যে সে এখন টায়ার্ড?”
শান ভরকে গেলো এই পিচ্চির কথায়। এখন তার মেজাজ গরম হলেও সে নিজেকে সামলে নিলো। ব্যাপারটা সফটলি হ্যান্ডেল করতে হবে। শান্তর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“আরে দেখিসনি ওকে কেমন সারাক্ষণ সোফায় বসিয়ে রেখেছিলো? এখনো কত ভারি ড্রেস পড়ে আছে। বুঝতেছিসই তো ওর কষ্ট টা।”
শান্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“কোথায় ভাবলাম ভাবি কে দেখবো আর ম্যাথ করবো ,তা আর হলো কই? সে নাকি এখন ক্লান্ত। আর হয় নাহ। চলো আমার রুমেই চলো।”
শান্তর কথার স্টাইলে শান রুমঝুম দুজনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এই ছেলে এতো পাকা কিভাবে হলো সেটাই ভেবে পায়না শান।
শান্ত বইখাতা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শান পেছন থেকে বললো,
-“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।”
শান্ত কাঁদাহীন সাদা মন নিয়ে যেই না বাইরে গেলো অমনি শান ভেতর থেকে দাড়াম করে দরজা আটকে দিলো।
শান্ত কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো দরজার বাইরে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। একটু ম্যাথ করতে এসে তার মানসম্মান শেষ হয়ে গেলো। ভাবির সামনে তার ভাই তাকে ঘর থেকে বের করে মুখের উপর দরজা আটকে দিলো?
শান্ত বাইরে থেকে চিৎকার করে বললো,
-“আমার বিশ্বাসের এমন মূল্য দিলে ভাইয়া? তোমার কাছে আর কখনো আসবো না ম্যাথ করতে।”
শান একই রকম চিৎকার করে বললে,
-“বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।”
এরকম উত্তর বোধহয় শান্ত আশা করে নি। ভেবেছিলো ভাই বাইরে এসে সরি বলবে । শান্ত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করতে করতে দরজার সামনে থেকে প্রস্থান করলো।
.
শান এতোক্ষণে রুমঝুমকে ভালো ভাবে দেখলো। বিছানায় রুমঝুমের সামনাসামনি বসে আছে সে। রুমঝুমের হাত দুটো আলতো করে ধরলো শান। হাতের পিঠে চুমু খেলো। রুমঝুম কাঠ হয়ে বসে আছে। ওর সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গেছে। শান আরেকটু এগিয়ে রুমঝুমের কপালে চুমু খেলো।
রুমঝুম চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। শানের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার সারামুখে। চোখ খোলার সাহসটাও হারিয়েছে রুমঝুম।
শান অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে রুমঝুমের ঠোঁটের দিকে। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে ঠোঁটজোড়া। মাঝে মাঝে দুই ঠোঁট একসাথে চেপে ধরছে রুমঝুম। শান মুচকি হেঁসে চুমু খেলো রুমঝুমের ঠোঁটে।
সাথে সাথেই রুমঝুমের দেহে বয়ে গেলো এক অদ্ভুত শিহরণ। চোখ খুলে গেলো আপনাআপনিই।
রুমঝুম চোখ মেলে দেখলো শান ঘোর লাগা চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। রুমঝুম আজ আর সেই চোখ থেকে নিজের চোখ লুকালো না। শানের চোখে চেয়ে রইলো খানিক সময়। কারো মুখেই কথা নেই।
আচমকা রুমঝুম এক ভয়ানক কাজ করলো। শানের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো শানের ঠোঁটের মাঝে।
রুমঝুমের এই কাজ শানের কল্পনাতীত ছিলো। সে প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে মুচকি হেঁসে দুহাতে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো রুমঝুমকে।
শান চুমু খেতে খেতেই রুমঝুমের বেশ কিছু জুয়েলারি খুলে ফেললো। রুমঝুম ঠোঁট ছেড়ে শানের বুকে মুখ লুকিয়ে হাঁফাতে লাগলো। শানের বুকের মাঝে শীতল শিহরণ খেলে গেলো তখন। তার প্রেয়সী তার বুকের মাঝে। তার চন্দ্রকন্যা এখন থেকে শুধুমাত্র তার।
শান শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুমকে। রুমঝুমও মিশে গেলো শানের বুকের সাথে।
এভাবে কেটে গেলো অনেকটা সময়। শান রুমঝুমকে বললো,
-“তোমার ড্রেসটা পাল্টে নাও। এটা পরে কিভাবে আছো এখনো? আমারে শরীরে তো কাঁটা কাঁটা ফুটছে।
রুমঝুম শানকে আরেকটু ঝাপ্টে ধরে বললো,
-“আমার জামাকাপড় নেই তো এই ঘরে। আম্মু শিরীন কে দিয়ে যেতে বলেছিলো। ও বোধহয় ভুলে গেছে।”
শান রুমঝুমের হাত থেকে চুড়ি খুলতে খুলতে বললো,
-“তাহলে আজ রাতের জন্য আমার টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ো। মন্দ হবে না কিন্তু।”
রুমঝুম শানের বুক কিল ঘুষি মেরে বললো,
-“চুপ করো পাজি ছেলে। শুধু লজ্জায় ফেলার ধান্দা।”
শান সবগুলো চুড়ি খুলে রুমঝুমকে বিছানায় বসিয়ে উঠে পড়লো। জুয়েলারি সব খোলা শেষ হয়ে গেছে। সে নিজের ঢোলা একটা টিশার্ট আর একটা ট্রাউজার এনে রুমঝুমকে দিলো। রুমঝুম তা দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে শানের দিকে তাকালো। মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“আমি এসব পড়বো না। আমি ফ্রেশও হবো না।”
শান এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“ওয়াশরুমে যাবে নাকি কোলে করে নিয়ে যাবো?”
রুমঝুম লজ্জায় আর কিছু বলতে পারলো না। জামাকাপড় নিয়ে দৌড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো।
শান মুচকি হেসে রুমেই কাপড় পাল্টে ফেললো।
মিনিট দশেকের মাথায় ছিটকিনি খোলার শব্দে শান ওয়াশ রুমের দিকে তাকালো। ছিটকিনি খুললেও দরজা এখনো খোলে নি। শান এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। দরজা ঠেলে দেখলো রুমঝুম গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমঝুম মাথা না তুলে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে এলো। শান পেছন থেকেই রুমঝুমের হাত ধরে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দাড় করালো। রুমঝুমের দুপাশে হাত রেখে বললো,
-” আমার কাছে এতো লজ্জা কিসের হু? সারাজীবন আমিই তো দেখবো?”
রুমঝুমের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। শানকে তার দিকে এগুতে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
পানি পড়ার শব্দ পেয়ে রুমঝুম চোখ খুললো। সে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকলেও শান কোথাও নেই। সে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়েছে।
রুমঝুম নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বেলকনির দিকে হাঁটলো।
আজ এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। আকাশের বুকে নকশা কেটে অনেকগুলো তাঁরাও আছে। সেগুলো দেখতে দেখতেই রুমঝুম অনুভব করলো দুটো বলিষ্ঠ হাত পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরেছে। রুমঝুম আকাশের দিকে মুখ করেই চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো শানের বুকে।
শান রুমঝুমের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“আকাশ দেখা হলে এবার এই অধমের দিকে একটু তাকান চন্দ্রকন্যা। ”
রুমঝুম কথা বললো না। পেটের উপর থাকা শানের হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো সে। শান রুমঝুমকে নিজের দিকে ঘুরালো। থুতনি ধরে মুখটা উচু করে চোখে চোখ রাখলো। বললো,
-“তোমাকে ভালোবাসার পূর্ন অধিকার দেবে চন্দ্রকন্যা? দেবে আমার চন্দ্ররঙা প্রেম কে নিজের রঙে রাঙাতে?”
কি মধুর আকুতি। রুমঝুম হাঁসলো। রাতের আঁধারেও সে হাঁসিতে আরেকবার হারিয়ে গেলো শান।
রুমঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো । ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে মুখ গুজে দিলো রুমঝুমের গলায়। রুমঝুমও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শান কে।
দুজনে ডুবে গেলো ভালোবাসার অতল গহ্বরে।
কেটে গেলো সময়। অনুভবে রয়ে গেলো জীবনের ভালোবাসাময় প্রথম রাত্রিটি।
….
দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙলো রুমঝুমের। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করছে। দেয়াল ঘড়িতে সময় তখন নয়টা সাইত্রিশ । রুমঝুমের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এতো বেলা হয়ে গেলো কখন। অবশ্য ঘুমিয়েছেই তো ভোরের দিকে।
দরজা অনবরত ধাক্কিয়েই চলেছে কেউ। রুমঝুম পাশ ফিরে দেখলো শান খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সমস্ত পিঠে আঁচড়ের দাগ। রুমঝুম বুঝলো এই দাগের ক্রেডিট তার নখের ।
নিজের দিকে তাকিয়ে খানিকটা লজ্জা পেলো রুমঝুম। বিছানার চাদরে ঢেকে আছে দুজন।
রুমঝুম শানকে ডেকে তুললো।
শান আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। পাশে চোখ ফুলিয়ে বসে আছে রুমঝুম। তার বউ। এখনো তার চোখে ঘুমের রেশ।
শান মুগ্ধ চোখে রুমঝুমকে দেখছিলো তখনই আবার দরজা ধাক্কানোর শব্দ এলো। রুমঝুম মিনমিন করে বললো,
-“অনেকক্ষণ থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে কে যেন। আমি কিভাবে যাবো বলুন? এদিকে বেলাও হয়েছে অনেক। তাই ডেকে তুললাম।”
শানের তখন মাথায় এলো রুমঝুমের কাপড়ের কথা। শান চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঝে থেকে টিশার্ট তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। রুমঝুম ততক্ষণে চাদর দিয়ে নিজেকে একদম মুড়ে নিয়েছে। শান মুচকি হেঁসে এগিয়ে এসে রুমঝুমের কপালে চুমু দিলো। দুহাতে চাদরে আবৃত রুমঝুমকে কোলে তুলে ওয়াশ রুমে নামিয়ে দিলো।
-“তুমি ফ্রেশ হও। আমি তোমার কাপড় আনার ব্যবস্থা করছি।”
রুমঝুম মাথা হেলিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো। শান দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখলো সিন্থিয়া আর তিহান দাঁড়ানো। সিন্থিয়া দরজা খুলতে দেখেই মুখ ভেঙচি দিয়ে একগাদা কাপড় তুলে দিলো শানের হাতে। শান এতো গুলো কাপড় কোনো রকমে সামলে বললো,
-“এভাবে মুখ ফুলিয়ে আছিস কেন?”
সিন্থিয়া কর্কশ কন্ঠে বললো,
-“এতো অল্পতে কিভাবে উঠলি? আরেকটু ঘুমাতি। মাত্র আধঘন্টা ধরে দরজা ধাক্কালাম।”
বলেই হনহন করে চলে গেলো।
শান বেক্কল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এভাবে দরজা না ধাক্কিয়ে ফোন তো করতে পারতি।”
তিহান গমগমে সুরে বললো,
-” দুজনের মধ্যে একজনের ফোনও সুইচ অফ রাখলে না দিবো?”
-“চার্জ শেষ মনে হয়।”
-“দুজনেরই?”
শান চোখ পাকিয়ে তাকালো তিহানের কথা শুনে। তিহান শানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“গলা-টলা একটু ঢেকে ঢুকে আসিস।”
বলেই অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যদিও আমি কিছু দেখিনি।”
শানের দুঃখ হয় মাঝে মাঝে এরকম একটা ফাজিলের পাল্লায় পড়ার জন্য। কি কুক্ষণে যে পাইছিলো এটারে।
শান কাপড়গুলো বিছানায় রাখলো। বেশিরভাগই শাড়ি। কয়েকটা থ্রিপিসও আছে।
রুমঝুমকে শাড়িতে দেখতেই শানের ভালো লাগে । তাই সবগুলো শাড়ি থেকে বেছে বেছে একটা ক্রিম কালারের শাড়ি দিয়ে এলো রুমঝুমকে। রুমঝুম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। ব্লাউজটা তার গায়ে কিছুটা ঢিলা হয়েছে। তবুও কম্ফোর্টেবল।
সদ্য গোসল করা রুমঝুমকে দেখে শান বিষম খেলো। একধ্যানে চেয়ে রইলো তার দিকে। এমন রুপবতী তার ঘরে থাকলে সে অফিস -কাজ এগুলোতে মন দিবে কিভাবে? সারাক্ষণ তো এই রুপবতীর আশেপাশেই থাকতে ইচ্ছে করবে।
রুমঝুম শানের চোখের সামনে এসে তুড়ি বাজালো। সেই শব্দে শানের ধ্যান ভাঙলো। শান এক হাত মাথায় তুলে ঘাড়টা হালকা কাত করে বললো,
-“এতো সুন্দর কে হতে বলেছে তোমার? আমার তো সারাক্ষণ আদর করতে ইচ্ছে করে।”
রুমঝুমের গাল লাল হয়ে উঠলো। শান টুপ করে গালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
-“এখনো এতো লজ্জা? কাল রাতের পরও এতো লজ্জা আসছে কোথা থেকে, আমার লজ্জাবতী?”
রুমঝুম মাথা নিচু রেখেই শানকে ঠেলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলো। নিচু স্বরে বললো,
-“সবসময় শুরু লজ্জা দেওয়ার ধান্দা। যান তো,গোসল সেড়ে নিন।”
শান উচ্চ শব্দে হেঁসে গোসলে ঢুকে পড়লো। মেয়েটাকে লজ্জাতে ফেলতে তার খুব ভালো লাগে। মেয়েটার লজ্জামাখা মুখটা শানের ভীষণ প্রিয়।
.
শান্ত বাদে এখনো কেউ ব্রেকফাস্ট করেনি। সবাই টেবিলে বসে শান-রুমঝুমের অপেক্ষা করছে। শিরীন আর মেঘার বেশ ভাব জমে গেছে ইতিমধ্যে। দুজন বসে বসে দুনিয়ার সব গল্প জুড়ে দিয়েছে।
মাহেরা খাতুন সকালেই বাড়িতে চলে গেছেন। মেহেদী বাড়িতে একা আছে। সারারাত ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়েছে তার। বাইরে নিজেকে যতই শক্ত দেখাক,তিনি জানেন ছেলেটা ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে।তাই সকাল সকাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে সে।
মেঘাকে সবাই জোর করে রেখে দিয়েছে। আজকে তারা সারাদিন হৈ হুল্লোড় করবে এজন্য। মেঘাও আপত্তি করেনি। এদের সাথে থাকতে তার ভালোই লাগে।
ইমতিয়াজ মাহমুদ টেবিলে বসে অফিসের এক কর্মচারীর সাথে কথা বলছিলেন। কথার মাঝখানেই তিনি সিঁড়ির দিকে চেয়ে বললেন,
-“মাশাআল্লাহ।”
শাফিয়া আক্তার খাবার গোছাচ্ছিলেন। স্বামীর কথা শুনে তিনিও তাকালেন সিঁড়ির দিকে। শান আর রুমঝুম পাশাপাশি হেঁটে নেমে আসছে। চোখ জুড়িয়ে গেলো শাফিয়া আক্তারের। মুগ্ধ চোখে সেদিকে চেয়ে বললেন
-” আমার রাজপুত্রের সাথে আমার ঘরের লক্ষীকে কি দারুন মানিয়েছে। ওদের দিকে কারো নজর না পড়ুক।”
শান আর রুমঝুমকে পাশাপাশি বসালেন শাফিয়া আক্তার। সবাই বসে পড়লো যার যার জায়গায়। রুমঝুম কখনোই এমন একটা পরিবার পায়নি। আজ নিজের এরকম সুন্দর একটা পরিবার আছে ভেবেই আনন্দে কান্না পাচ্ছে তার।
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই গার্ডেনে গিয়ে বসলো আড্ডা দেওয়ার জন্য। রুমঝুমের চোখ পড়লো সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। মাটি থেকে বেশ উঁচুতে মোটাসোটা একটা ডাল আছে। গাছটা কম করে হলেও বিশ-ত্রিশ বছর আগের।
আড্ডার একপর্যায়ে প্রান্ত বললো ,
-“তোদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে স্পেশাল হানিমুন প্যাকেজ দেওয়া হবে। তোদের বিয়ের গিফট হিসেবে। এখন বল কোথায় যাবি? দেশেই নাকি দেশের বাইরে কোথাও?
শান দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“অবশ্যই দেশের বাইরে।”
প্রান্ত নিচু কন্ঠে বললো,
-“জানতাম তো। ”
বিথী বললো,
-“আচ্ছা পাহাড় নাকি সমুদ্র?”
শান রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এটা তুমিই বলো।”
রুমঝুম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মেঘা পাশ থেকে গুঁতা মেরে বললো,
-“আর লজ্জা পেতে হবে না। বলে দে।”
রুমঝুম কিছু সময় ভেবে বললো,
-“সমুদ্র।”
তিহান লাস্ট চিপসটা মুখে পুরতে পুরতে বললো,
-“তাহলে তো মিটে গেলো। শান আর রুমঝুমের হানিমুনের জন্য আইল্যান্ড বীচ স্টেট পার্কই বেস্ট। সমুদ্র সৈকতের জন্য এটাই উপযুক্ত জায়গা। তাহলে ওটাই ফিক্সড ওকে?”
শান্ত ঝড়ের গতিতে দৌড়ে এলো রুমঝুমের কাছে। রুমঝুমের হাত ধরে বললো,
-“এ্যাই ভাবি। আমিও তোমাদের সাথে হানিমুনে যাবো। নিবে তো?”
রুমঝুম কি বলবে খুঁজে পেলো না। শান মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো ঘাসের উপর। বিরবির করে বললো,’ যার এমন একটা ভাই থাকে তার বেঁচে থেকে কি লাভ?
চলবে………
(রুশান নাদান বাচ্চা। ওর জন্য গার্লফ্রেন্ড কোথায় খুঁজবো আমি? ওকে সিঙ্গেলই মেনে নাও জনগন।
আর মেঘার জন্যও কেউ আসবে। অপেক্ষা করো একটু।)
#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১৬
#আর্শিয়া_সেহের
রুমঝুম রুশানকে কল করতে গিয়ে দেখলো ওর ফোন অফ। চার্জ শেষ হয়ে গেছে । ফোন চার্জে লাগিয়ে রুমঝুম রুমের বাইরে এলো। প্রান্ত,তিহান,শান,সিন্থিয়া,বিথী সবাই এখনো গার্ডেনে আড্ডা দিচ্ছে।
রুমঝুম গেস্ট রুমে গিয়ে দেখলো মেঘা আর শিরীন গল্প করছে আর হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
রুমঝুমকে দেখে শিরীন বলে উঠলো,
-“আরে ভাবি, দাঁড়িয়ে না থেকে এদিকে এসো। গল্প করি।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে ভিতরে ঢুকে বললো,
-“তোমরা গল্প করো। আমি পরে যোগ দিবো তোমাদের গল্পে।”
তারপর মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“মেঘা তোর ফোনটা একটু দে। রুশানকে কল করবো। আমার ফোনে চার্জ নেই।”
-“হ্যাঁ,চার্জ দেওয়ার সময় পেলেই না চার্জ দিবি আর ফোনে চার্জ থাকবে।”
রুমঝুম চোখ পাকিয়ে তাকালো মেঘার দিকে। শিরীন পাশে বসে ঠোঁট চেপে হাসছে।
রুমঝুম মেঘার পাশ থেকে ছো মেরে ফোনটা নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বাইরে চলে গেলো।
রুমে এসে নিরিবিলি বসে তারপর কল করলো রুশানকে। রুশান তখন বিছানায় শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ফোন বাজার শব্দে ঘোর কাটলো তার। আননোন নাম্বার দেখে প্রথমে রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না তার। তৃতীয় বারের সময় রিসিভ করলো।
রুমঝুমের কন্ঠ শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো রুশান।বললো,
-“এটা কার নাম্বার আপু? তোমার নাম্বার তো না।”
-“কেন রে? আননোন বলে রিসিভ করিসনি বুঝি? কোনো মেয়ে আবার ফোন দিয়ে জ্বালাতন করে না তো?”
রুমঝুমের কথায় ফিক করে হেসে ফেললো রুশান। সাথে সাথেই টান লাগলো ঠোঁটের কাঁটা অংশে। ব্যাথা পাওয়ার দরুন ছোট্ট করে ‘আহ’ শব্দ বের হলো তার মুখ থেকে। রুমঝুম উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে ভাই? ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও?”
রুশান কাঁটা জায়গাটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরলো। বোনের কাছে গতকালকের ব্যাপারগুলো বলা যাবে না। রুমঝুম এতে ভয় পেয়ে দূর্বল হয়ে পড়বে। খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে রুশান বললো,
-“আরে না আপু। মশারা ইদানিং কত্ত জোড়ে কামড় দেয় জানোই তো। আমাকেও মাত্রই একটা মশা খুব জোড়ে কামড়ে দিলো। এজন্য ব্যাথা পেয়েছি ,বুঝলে?”
রুমঝুম বিন্দুমাত্র সন্দেহ করলো না রুশানের কথায়। কারন রুশান কখনোই তাকে মিথ্যা বলে না।
এর মধ্যেই মেঘা একবার এসে বললো ,
-“আমি আর শিরীন গার্ডেনে যাচ্ছি। কথা শেষ করে তুই ও আয়।”
রুমঝুম ঘাড় কাত করে আচ্ছা বুঝালো।
রুশান ওপাশ থেকে বললো,
-“কে রে আপু?”
-“মেঘা এসেছিলো। ওর ফোন থেকেই কল করেছি তোকে। বাদ দে এসব। এখন বল কেমন আছিস?”
রুশানের আর ইচ্ছে করছে না বোন কে মিথ্যা বলতে। ব্যাথাগুলো আড়াল করে মুখে মিথ্যে হাঁসি টেনে বললো,
-“আমার কথা ছাড়ো তো। তোমার কথা বলো। বিবাহিত জীবনে কেমন লাগছে?”
ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথায় রুমঝুম বেশ লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে এক নখ দিয়ে অন্য নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো,
-“এরা সবাই অনেক ভালো রে রুশান। মাথায় তুলে রেখেছে আমাকে। তোর দুলাভাইও খুব ভালো। সবাই ভীষণ ভালবাসে আমাকে। আমি আগে কখনো এতো ভালোবাসা পাইনি যতটা এ বাড়িতে এসে পেয়েছি।”
রুশানের বুকটা শীতল হয়ে গেলো রুমঝুমের উত্তর শুনে। ও তো এমনই চেয়েছিলো। ওর বোনটা যেন অনেক সুখ পায়। ওর সারাজীবনের দুঃখটা যেন দূ্র হয়। এবার ও সেই সুখের মুখ দেখেছে। এখানে কারো নজর পড়তে দেবে না রুশান। প্রয়োজনে যা কযতে হয় সে করবে।
রুমঝুম রুশানের সাড়াশব্দ না পেয়ে বললো,
-“চুপ করে গেলি কেন? আচ্ছা মা কেমন আছে?”
রুশানের শরীর জ্বলে উঠলো এই প্রশ্নে। তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া না করে বললো,
-“আছে ভালো। এই আপু শুনো?”
-“হ্যাঁ শুনছি তো। বল ।”
-“দুলাভাইকে তো দেখালে না। একটা ছবি দাও না তোমাদের।”
রুমঝুম হেঁসে বললো,
-“আচ্ছা দিচ্ছি। মেঘার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে পাঠাচ্ছি। চেক করে নিস। এখন রাখছি কেমন?”
-“ঠিক আছে,রাখো। নিজের খেয়াল রেখো।”
-“তুইও নিজের খেয়াল রাখিস।”
রুমঝুম কল কেটে মেঘার গ্যালারি থেকে গতকালকের তোলা ছবিগুলো থেকে কয়েকটা ছবি রুশানকে সেন্ড করে দিলো। এরপর গুটিগুটি পায়ে নিচে নেমে এলো।
শাফিয়া খাতুন রান্না করছিলেন কিচেনে। রুমঝুম সেদিকে এগিয়ে গেলো। শাফিয়া খাতুন রুমঝুমকে আসতে দেখে কিচেন থেকেই বললো,
-“এদিকে আসলে পা ভেঙে দিবো,বুঝেছো মেয়ে? যাও গিয়ে সবার সাথে আড্ডা দাও।”
অগত্যা রুমঝুমকে সেখান থেকে ব্যাক করতে হলো। যেচে গিয়ে পা ভেঙে আনার দরকার কি? এর চেয়ে বরং সবার সাথে আড্ডা দেওয়া যাক।
রুমঝুম মেইন ডোরের কাছে আসতেই ভেতরে ঢুকলো শান্ত। রুমঝুমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
-“এখন একটুও বাইরে যাওয়া চলবে না ভাবি। ওদের জন্য তোমার সাথে আমি ভালো করে কথা বলতে পারি না। এখন তুমি আমার সাথে কথা বলবে । শুধু আমার সাথে।”
রুমঝুম হেঁসে বললো,
-“বেশ। এখন আমি তোমার সাথে কথা বলবো। শুধু তোমার সাথে।”
রুমঝুমের এই কথায় শান্ত খুশি হয়ে গেলো। রুমঝুমের পাশে বসে পা দুটোকে সোফায় উঠিয়ে আয়েশ করে বসলো। তারপর বললো,
-“এখন তুমি আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে আর আমি তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবো । প্রথমে আমি জিজ্ঞেস করি। তুমি আগে শিখে নাও কিভাবে প্রশ্ন করতে হয় বুঝেছো?”
রুমঝুম বলদের মতো হাসলো। মানে সিরিয়াসলি? এই বয়সে এই পিচ্চি ওকে প্রশ্ন করতে হয় কিভাবে সেটা শিখাবে? তবুও চুপচাপ মাথা হেলিয়ে বললো,
-“আচ্ছা,শিখাও।”
শান্ত বিজ্ঞদের মতো করে রুমঝুমের চৌদ্দ গোষ্ঠীর ব্যাপারে প্রশ্ন করলো। রুমঝুম ধৈর্য সহকারে সব উত্তর দিলো। শান্ত সবগুলো দাত বের করে হেঁসে ফেললো। সে উত্তর পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট।
রুমঝুম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আচ্ছা, তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
শান্ত ভাব নিয়ে বললো,
-” ক্লাস ফোর এ পড়ি আমি। ক্লাসে আমার রোল কত জানো? থার্টি সিক্স। আমি কখনোই কম রোল করি না। ম্যাথে আমি সবচেয়ে বেশি মার্কস পাই। বাংলা আর ইংলিশে বানান ভুল করার জন্য মার্কস কম পাই। এজন্য ভাইয়া আমায় বকে। আমি নাকি গবেট।
জানো ভাবি,ক্লাসে উর্বিন্তা নামে একটা মেয়ে আছে? আমি ওকে খুব ভালোবাসি। প্রপোজ করবো করবো করে করা হচ্ছে না। ওকে দেখলেই আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি।
উর্বিন্তাও তোমার মতো সুন্দরী জানো? ওকে প্রপোজ করতে সাহায্য করবে আমায়?
উর্বিন্তা একটু একটু রাজি আছে । আমাকে দেখলে মিটিমিটি হাসে। কি যে সুন্দর লাগে।”
রুমঝুম এতোক্ষণ হা করে শান্তর কথা শুনছিলো। ওর একটা প্রশ্নের জবাবে ছেলেটা এতোবড় একটা প্যারাগ্রাফ শুনাবে এটা ওর ধারনাতীত ছিলো।
রুমঝুম একটা ঢোক গিলে বললো,
-“বাবু, তোমার বয়স কত?”
শান্ত এবার দুহাতে মখ ঢেকে ফেললো। মাঝে মাঝে চোখ থেকে আঙুল হালকা সরিয়ে রুমঝুমকে দেখে আবার ঢেকে ফেলছে।
রুমঝুম ভ্রু কুঁচকে শান্তর কাজকাম দেখছে। শান্ত মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বললো,
-“আমার বয়স নয় বছর।”
-“তোর বয়স নয় বছর সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এটা মুখ ঢেকে বলছিস কেন? তুই কি কোনো কারনে লজ্জা পেয়েছিস?”
শিরীনের কথা শুনে শান্ত মুখ থেকে হাত সরালো। লাজুক দৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
-“লজ্জা পাবো না তো কি করবো? ভাবি আমাকে বাবু ডেকেছে জানো? এজন্যই তো লজ্জা পেয়েছি।”
রুমঝুম ভড়কে গেলো। বাবু ডেকেছে বলে এই পিচ্চি লজ্জা পেয়েছে?
গার্ডেনের সবাই ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে। প্রান্ত সোফায় বসতে বসতে বললো,
-“তো তোরে বাবু না ডেকে বুড়ো ডাকতে বলতেছিস? নয় বছরের বাচ্চাকে বাবু ডাকলছ সমস্যা কি? এখানে লজ্জা পাওয়ার কি হলো?”
শান্ত লজ্জামাখা মুখেই বললো,
-“বাবু কে কাকে ডাকে তোমরা বুঝি জানো না?”
উপস্থিত সকলেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। শান ধপাধপ পা ফেলে শান্তর কাছে এসে ওকে চ্যাঙদোলা করে তুলে নিলো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
-“আমার বউয়ের সাথে ফ্লার্ট করতেছিস বসে বসে? দাঁড়া করাচ্ছি তোকে ফ্লাট।”
শান্ত হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে বললো,
-“তোমার বউ যে আমাকে বাবু ডাকলো এতে দোষ নেই না? যত দোষ নন্দ ঘোষ। ছাড়ো আমাকে। নামাও বলছি।”
দুই ভাইয়ের কান্ডে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। শিরীন হাসতে হাসতেই তাকালো প্রান্তর দিকে। তিহানের গায়ের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রান্ত। কি প্রাণবন্ত হাসি। শিরীনের প্রান জুড়িয়ে গেলো সেই হাঁসিতে।
..
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। মূল টপিক শান-রুমঝুমের হানিমুন। শান বললো , হানিমুনে এখন যাবে না। হালকা শীত পড়লে যাবে। বাকিরাও তাতে সায় জানিয়েছে।
রুমঝুম মেঘার পাশে বসে শুধু শুনছে ওদের কথা। আড্ডার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো বিথীর। বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে। বিথী উঠে এক সাইডে গিয়ে ফোনে কথা বলা শুরু করলো।
বাকিরা আবারও আড্ডায় মন দিলো। মিনিট দুয়েক পরে বিথী মুখ কালো করে এসে বসলো নিজের জায়গায়। ঠোঁট দুটো যথাসম্ভব চেপে রাখছে। কাঁদতে চাচ্ছে না বলেই এটা করছে সে।
সিন্থিয়া বিথীর অবস্থা খেয়াল করলো। বিথীর মুখটা উঁচু করে ধরে বললো,
-“কি হয়েছে বিথী? বাড়ি থেকে কি বললো?”
বিথী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-“বিকেলে বাড়ি যেতে বলেছে। সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। বাবার বন্ধুর ছেলে। আমি জানি রে ,এই বিয়েটা হয়ে যাবে ।আটকাতে পারবো না আমি।”
বিথী কথা শেষ করা মাত্রই লাফিয়ে উঠলো তিহান । চেঁচিয়ে বললো,
-“আরে আরে বিয়ে আটকাবি কেন? বিয়ে করে নে বলদী। আহহা.. একটা বিয়ে শেষ হলো তো আরেকটা হবে।”
তিহানের কথা শুনে বিথীর মধ্যে যে কি ঝড় বয়ে গেলো তা কেউ টের পেলো না। চুপচাপ ভালোবেসে যাওয়ার ফল বোধহয় এমনই।
বিথীকে অনবরত কাঁদতে দেখে তিহান আবার বললো,
-“কাঁদিস কেন বাল? আচ্ছা শোন ,তোর বিয়েতেও শানের মতো হানিমুন প্যাকেজ গিফট করবো ওকে? কান্না থামা।”
বিথী কান্না থামালো না। তিহানের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিচে নেমে এলো। ভরদুপুরের তপ্ত রোদেই বেরিয়ে এলো শানদের বাড়ি থেকে। সবাই পিছু ডাকলেও ওর কানে কিছুই ঢোকে নি। এতোবছরের ভালোবাসাটা ও বোঝাতে পারেনি তিহান কে। ওর ভালোবাসাটা তিহানের কাছে ছিলো বিরক্তি। ওর বিয়ে হয়ে গেলে তিহান মুক্তি পেয়ে যাবে । এজন্যই হয়তো এতো খুশি হলো সে।
বিথী ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো,
‘ভালোবাসার মানুষটির বিরক্তির কারন হওয়ার চেয়ে তাকে মুক্ত করে দেওয়াই ভালো।আর ও সেটাই করবে।’
…
সেদিনের পর কেটে গেছে প্রায় এক মাস। এই এক মাসের মাঝে পাল্টেছে অনেক কিছুই।সিন্থিয়া-মেহেদীর সম্পর্ক একটা নাম পেতে চলেছে। দুদিন বাদেই তাদের বিয়ে। আর বিথীও এখন বিবাহিত।
বিথী সেদিন শানদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর কারো সাথে আর যোগাযোগ করেনি। সেই সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ এসে বিথীকে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে দিয়ে যায়। তার এক সপ্তাহ পর বিথীর ইচ্ছেতেই ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়ে যায় তার। বিথী বন্ধুদের কাউকেই জানায়নি বিয়ের কথা। সে এ জন্মে আর তিহানের মুখোমুখি হতে চায় না।
বিথীর সমস্যাটা সিন্থিয়া বুঝতে পেরেছিলো। তবে সেটা অনেক পরে। বিথীর কথা দিনরাত ভাবতে ভাবতেই সিন্থিয়া বুঝেছিলো বিথী কেন হারিয়ে গেলো। তিহানের প্রতি বিথীর পজেসিভনেসটাকে ওরা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হিসেবেই ধরে নিতো। কিন্তু বিথীর মনে যে অন্য কিছু ছিলো তা কখনই বুঝতে পারেনি কেউ।
সিন্থিয়া সবটা বোঝার পর বিথীকে কিছু টেক্সট করে। এরপর কল করলে বিথী রিসিভ করেছিলো। বিথীর বিয়ের তখন আটদিন হয়ে গেছে।
বিথী ফোন রিসিভ করেই কেঁদে ফেলে। কাঁদে সিন্থিয়াও। অভিযোগ করে বলে,
-“নিজের মনের কথাটা কাউকে অন্তত জানাতে পারতিস। এভাবে কেন চেপে রাখলি? তুই যদি মনের কথাটা প্রকাশ করতি তবে আজ গল্পটা ভিন্নও হতে পারতো বিথী।”
বিথী কেঁদেই চলেছে। উত্তর নেই এসবের। অনেকবার বলতে চেয়েও পারেনি। বন্ধুত্বটাও যদি নষ্ট হয় এই ভয়ে। বিথী সেদিন সিন্থিয়াকেই প্রথম জানায় তার বিয়ের কথা। সিন্থিয়া শুনে থ হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটা এতবড় ডিসিশন নিয়ে বিয়েও করে ফেলেছে? বন্ধুত্বের এই মান রেখেছে সে।
সিন্থিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
-“ভালো। ভালো থাক। শুভ কামনা রইলো।”
বিথী আর কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। কারন সিন্থিয়া ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে। বিথী চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসলো। সে তো জানতো এমন হবে। সবার থেকে দূরত্ব বাড়বে তার। তবে আজ এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? বন্ধুত্বটা আসলেই হৃদয়ে গাঁথা সম্পর্ক। এ সম্পর্কে টান লাগলে কষ্ট তো হবেই।
তিহান অবশ্য সবটা জানার পরও তার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। সে সবসময় বিথীকে ফ্রেন্ডের মতোই দেখেছে। তাছাড়া তিহানের ভালোবাসা, সম্পর্ক, বিয়ে এসবে ইন্টারেস্ট নেই এটা সবাই জানতো। তার কাছে জীবন মানে আনন্দ, আড্ডা, ফুর্তি। সম্পর্কের জটিল ধাঁধা থেকে সে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে।
.
আরমান এই একমাস দেশের বাইরে ছিলো। এই সুযোগে রুশান তার ব্যাপারে অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ফেলেছে। তাহমিনা বেগম বেশ কয়েকবার রুশানকে বলেছে এসব বাদ দিতে কিন্তু রুশানও নাছোড়বান্দা। সে আরমানের সমস্ত কুকীর্তির প্রমান জোগাড় করতে উঠে পড়ে লেগেছে। সে জানে,আরমান দেশে ফিরেই রুমঝুমের জীবন নষ্ট করবে।
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। রুশান চুপিসারে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য আরমানের গোডাউন।
গতকাল রাতেই আরমান ফিরেছে। রুশান গোডাউনের খোঁজ পেলেও ভেতরে ঢুকতে পারে নি। আরমান যেহেতু ফিরেছে এবার তার গোডাউন খোলা পেতেও পারে সে।
রুশান মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে গোডাউনে ঢুকে পরলো। একদমই শুনশান একটা জায়গা। আরমান হয়তো ভেতরেই আছে এজন্য গোডাউনের দরজা খোলা।
রুশান ক্যামেরা অন করে লুকিয়ে পরলো এক সাইডে। আশেপাশে বিশ্রী গন্ধ। ভেতর থেকে করুন কতগুলো কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।
রুশান মূহুর্তেই সতর্ক হয়ে উঠলো। পা টিপে টিপে সেদিকে এগিয়ে গেলো। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো প্রায় তেরো-চোদ্দটা মেয়ে সেখানে। সবার হাত আর মুখ বাঁধা। সেই রুমের এক কোনে আরমানও আছে। দুইজন লোকের সাথে কথা বলছে।
রুশান এর শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। ওর বোনের জীবনটাও হয়তো এমন হবে এই শয়তানের লাগাম না টানলে। রুমঝুমের কথা মনে হতেই রুশানের সাহস বেড়ে গেলো। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো ওই রুমের মধ্যের। ছবিতে আরমানের মুখটাও স্পষ্ট।
রুশান যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই পা টিপে টিপে বের হয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যেই আরমান সেই রুম থেকে বের হয়ে এলো। আরমানের থেকে প্রায় দশ হাত দূরত্বে মাথা নিচু করে বের হলো আরেকজন। তাকে দেখেই থমকে গেলো রুশান। সামলাতে পারলো না নিজেকে। হেলে পড়লো পাশে থাকা বড় একটি ড্রামের উপর। সেই শব্দ আরমান অবধি পৌঁছে গেলো। আরমান তার সাথের লোকদুটিকে পাঠালো শব্দের উৎস খোঁজার জন্য।
রুশানের হাত পা কাঁপছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই ওর। সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
রুশান ওই জায়গাতে বসেই ছবিগুলো কাঁপা হাতে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম যার বক্স আছে তার বক্সে সেন্ড করে দিলো। ছবি সেন্ড হওয়ার সাথে সাথেই আনইন্সটল করে দিলো হোয়াটসঅ্যাপ। ফোন ড্রামের পেছনে মেরে দিলো। কোথায় গেলো সে জানে না। তার চোখে এখন সবটা ধোঁয়াশা।
চলবে…..