চন্দ্ররঙা প্রেম -Part 23+24

0
462

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ23+24
#আর্শিয়া_সেহের
একে একে চারদিন পার হয়ে গেছে। তাহমিনা বেগমের আত্মার শান্তি কামনা করে রেজাউল সাহেব ছোট একটা মিলাদ দিয়ে দিয়েছেন। সে চান না তার ছেলেমেয়েদের উপর আর কোনো অশুভ ছায়া পড়ুক। তাহমিনা বেগমের ব্যবহৃত সবকিছু তার রুমে রেখে রুমটা অস্থায়ী কালের জন্য তালাবন্ধ করে দিয়েছে রুশান। সে শোক কাটিয়ে উঠেছে মোটামুটি। এমন পাপীদের জন্য কষ্ট পাওয়াও পাপ।
রুমেলের অসুস্থতা তেমনই আছে। মাঝে মাঝেই উন্মাদ হয়ে উঠছে সে। মেঘা খুব দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে রুমেলকে। বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে গেলে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয় ।
মেঘার রুমেলকে সামলানোর ধরন,তার ধৈর্য্য মুগ্ধ করছে সবাইকে। সবার বিশ্বাস,মেঘাই রুমেলকে সুস্থ করে তুলতে পারবে।
মেহেদীরও ছুটি শেষ হয়ে আসছে। শান্তর স্কুল, শিরীনের কলেজ, ইমতিয়াজ আহমেদের অফিস সামলানো সবকিছুতেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই তারা দ্রুত চট্টগ্রাম ফিরতে চান। রেজাউল সাহেব ঘরোয়া ভাবে সেদিন রাতেই মেঘা আর রুমেলের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
হঠাৎ এভাবে বিয়ের জন্য রুমেল প্রস্তুত ছিলো না। তার অসুস্থতা জানার পরও সবাই মেঘার সাথে তার বিয়ে দিচ্ছে এটা মানতে পারছিলো না সে। তাছাড়া তার মনে হচ্ছিলো মেঘা তাকে করুনা করে বিয়ে করছে।
রুমেল রুমঝুম আর রুশানকে ডেকে পাঠালো। রুমঝুম দুই হাতে মেহেদী ভর্তি করে ভাইয়ের কাছে আসলো। রুশান রুমঝুমের হাত দেখে ভেঙচি কেটে বললো,
-“ঢং দেখে বাঁচি না। এমন সাজ সাজতেছে,মনে হয় যেন ওরই বিয়ে হচ্ছে।”
-“বাঁচতে বললো কে তোকে? মরে যাহ,হুহ।”
রুমেল ধমক দিয়ে দু’জন কে থামালো। রুশান আর রুমঝুম ঝগড়া থামিয়ে ভাইয়ের কথায় কান দিলো।
রুমেল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে আছে। একটু সময় নিয়ে ভাই-বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমি এই বিয়ে করবো না। তোরা বাবাকে বোঝা। আমি এখন বিয়ে করার অবস্থায় নেই।”
রুশান আর রুমঝুম দু’জনেই ভাইয়ের কথায় ঘাবড়ে গেলো। আজ রাতে বিয়ে আর এখন তাদের ভাই কি বলছে এসব?
রুশান কিছুটা রেগে বললো,
-“মেঘাপু স্বেচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে ভাইয়া। তোমার অবস্থা তো সে জানে । জেনে শুনেই….”
-“আমি জানি মেঘা নিজেই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু ওর হয়তো আমাকে দেখে,আমার অতীত শুনে ,আমার বর্তমান অবস্থা দেখে আমার প্রতি মায়া লেগেছে।হয়তো করুনা করে বিয়ে করতে চাইছে আমাকে ।”
রুশানের কথার মাঝেই রুমেল বললো।
রুমেলের কথায় রুশান ক্ষেপে উঠলো। মেঘার প্রতি রুশানের আলাদা একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। রুমঝুমের মতো মেঘাও এখন তার নিজের বোনের মতোই। নিঃস্বার্থভাবে কতটা খেয়াল রাখে সবার। আর এই মেয়েকে নিয়ে এরকম মন্তব্য ভাইয়ার।
রুশান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমঝুম চোখের ইশারায় থামালো তাকে। দরজার দিকে ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বললো রুম থেকে। রুশান ইশারা বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলো। রুমঝুম গলা ঝেড়ে বললো,
-“আচ্ছা,আমি বলছি সবাইকে যে তুমি বিয়ে করতে চাও না। রুশান আয়।”
রুশান ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকালো। রুমঝুম কি করতে চাইছে এটা তার বোধগম্য হলো না। রুশানকে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে রুমঝুম ওর হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় দাড়াম করে দরজা লাগিয়ে গেলো।
রুমেল সেদিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো বিছানায়। তার ভাই বোন দুটো কি জানে, সে কত কষ্টে বিয়ে না করার কথাটা বলেছে? সে নিজেও ভালোবেসে ফেলেছে মেঘাকে । কিন্তু তার মতো একটা ছেলে কি দিতে পারবে ওই মেয়েটাকে?
সে তো ঠিকমতো পরিবারই চেনে না তাহলে মেয়েটাকে কিভাবে একটা পরিবার দিবে? তাছাড়া তার যোগ্যতাই বা কি? রুমেল দুহাতে মাথা চেপে ধরলো এসব ভাবতে ভাবতে।
দরজার খটখট আওয়াজ রুমেলের কানে এলো। হয়তো রেজাউল সাহেব এসেছেন। বিয়ের জন্য রুমেলকে বোঝাতে। অবশ্য বোঝাবেন নাই বা কেন? এমন ছেলের জন্য আর তো মেয়ে পাবেন না।
রুমেল মাথা নিচু করেই বললো,
-“বাবা,আমি মেঘাকে বিয়ে করতে চাই না। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলো না দয়া করে।”
-“কেন বিয়ে করতে চান না আমায়?”
মেঘার কন্ঠে চমকে তাকালো রুমেল। বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। দু’হাতে মেহেদী দেওয়া। কানে ,গলায় গাঁদা আর গোলাপের সেট। রুমেলের গায়েও বাসন্তী রঙের একটা পাঞ্জাবি। একটু পরেই তাদের হলুদ সন্ধ্যা।
মেঘাকে হঠাৎ করেই এখন একটু বেশি সুন্দর লাগছে। কেন লাগছে রুমেল জানেনা। জানার চেষ্টাও করলো না। চোখ সরিয়ে নিলো মেঘার দিক থেকে।
মেঘা আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,
-“বললেন না তো,কেন বিয়ে করতে চান না আমায়?”
-“আমি তোমার যোগ্য নই, মেঘা। এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করে তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করো না।”
মেঘা বেশ শক্ত কন্ঠে বললো,
-“আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না। কেন বিয়ে করতে চান না সেটা বলুন।”
রুমেল পেছন দিকে ফিরে মেঘাকে দেখলো। মেয়েটার চোখে অসহায়ত্বের ছাপ অথচ কি দৃঢ় কন্ঠ। চোখ আসলেই মিথ্যা বলতে পারে না। রুমেল মেঘার চোখে তাকিয়েই বললো,
-“আমি কারো করুনার পাত্র হত…”
আর কিছু বলার আগেই মেঘা দৌড়ে এসে ঝাপ্টে ধরলো রুমেলকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। এখানে করুনার কোনো স্থান নেই। দয়া করে আমাকে দূরে সরিয়ে দিবেন না । বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”
রুমেলের চোখে অশ্রু ভীর করেছে। এমন ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দিবে কিভাবে ও? সারাজীবন ভালোবাসা না পাওয়া ছেলেটা হঠাৎ এতো ভালোবাসার সাক্ষাৎ পেয়ে কেঁদে উঠলো। নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেঘাকে।
দরজার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখছিলো রুমঝুম আর রুশান। দু’জন কাউকে কিছু না বলে সরাসরি মেঘাকে নিয়ে চলে এসেছিলো এখানে। মেঘাকে ভেতরে পাঠিয়ে দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছিলো দুজনের কান্ড।
দু’জনকে একসাথে দেখে রুমঝুম আর রুশান চৌদ্দ পাটি দাঁত বের করে হেঁসে হাত মিলালো। আবার রুমেলের রুমে উঁকি মারতে যাবে তার আগেই কেউ একজন একহাতে রুমঝুমের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে, অন্য হাতে রুমঝুমের মুখ চেপে ধরে দরজার পাশ থেকে সরিয়ে আনলো। রুশান রুমঝুমের হালকা গোঙানির আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখলো শান রুমঝুমকে মুখ চেপে ধরে উঁচু করে রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুশান শুকনো ঢোক গিললো শানকে দেখে।
শান ভেতরে একনজর উঁকি মারলো। রুমেল আর মেঘার অবস্থা দেখে রুমঝুম আর রুশানের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“এইসব দেখতেছো দুইজনে? লজ্জাশরমের মাথা খাইছো? চলো এখান থেকে।”
শান রুমঝুমের মুখ ছেড়ে দিলো। একহাতে রুমঝুমকে ঝুলিয়ে অন্য হাতে রুশানকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো রুমেলের রুমের সামনে থেকে।
কি বিচ্ছু দুইটা। বড় ভাইয়ের কেমিস্ট্রি দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে।
মেঘা রুমেলকে ছেড়ে অন্য দিকে তাকালো।এখন তার লজ্জা লাগছে ভীষণ।। রুমঝুম কেন‌ লজ্জা পাচ্ছিলো সেদিন এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নিজেও। মেঘা মাথা নিচু করে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। তার সুন্দর মেহেদী মাখা হাত দুটোর এ কি অবস্থা? পুরো হাতে লেপ্টে গেছে মেহেদী।
মেঘা কাঁদো কাঁদো হয়ে পেছন দিকে তাকালো। রুমেলের পুরো পাঞ্জাবীতে মেহেদী মাখামাখি হয়ে গেছে। মেঘা ফিক করে হেঁসে দিলো রুমেলের পাঞ্জাবি দেখে। রুমেল মেঘার হাঁসির কারন না বুঝে পাঞ্জাবির দিকে তাকালো। পাঞ্জাবির সামনে পিছনে মেহেদি মেখে পাঞ্জাবির কালারই চেন্জ হয়ে গেছে।
এই পাঞ্জাবি পরে এখন‌ মানুষের মধ্যে যাবে কিভাবে? রুমেল হতাশ দৃষ্টি মেলে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা তখনো হেঁসে চলেছে। মেঘার হাঁসিতে রুমেলের মনটা হালকা থেকে আরো হালকা হচ্ছে। তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিতেই যেন মেয়েটার আগমন। রুমেল মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো মেঘার হাঁসিমাখা মুখের দিকে।
-“রুমেল?”
প্রান্তর ডাকে রুমেলের ঘোর ভাঙলো। মেঘাও হাঁসি থামালো। দু’জনেই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রান্ত একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রান্ত মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভেতরে এসে বললো,
-“তোমার পাঞ্জাবিতে নাকি মেহেদী মাখামাখি হয়ে গেছে? তাই শান‌ এটা পাঠালো।”
মেঘা মাথা নিচু করে এক সাইড দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এখানে থাকলে লজ্জায় পড়তে পারে।
রুমেল মেঘার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে প্রান্তকে বললো,
-“এই সময়ে পাঞ্জাবি কোথায় পেলে?”
-“শানের কাছে এক্সট্রা ছিলো এই পাঞ্জাবিটা।”
-“ওহ । কিন্তু আমার পাঞ্জাবিতে মেহেদি লেগেছে এটা শান কিভাবে জানলো?”
প্রান্ত ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
-“এটা তো‌ জানিনা। রুমঝুমকে উঁচু করে দোলাতে দোলাতে ছাদের দিকে নিয়ে গেলো আর আমাকে বললো তোমাকে এটা দিতে।”
রুমেল হেঁসে বললো,
-“দাও। ধন্যবাদ তোমাকে। আমার এটার খুব দরকার ছিলো।”
প্রান্ত হেঁসে পাঞ্জাবিটা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
প্রান্ত দোতলা থেকে নামার সময় দেখলো শিরীন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের কোনো কিছুতেই নজর নেই তার। প্রান্ত পান্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকসেদিক তাকাতে তাকাতে শিরীনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
হালকা নিচু হয়ে বললো,
-“দেখার অনেক সময় বাকি। একদিনেই সব দেখে নিবা নাকি?”
শিরীন হকচকিয়ে আশেপাশে তাকালো। প্রান্ত তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। তার খেয়াল হতে হতে প্রান্ত মেইন ডোর ক্রস করে বেরিয়ে গেছে।
প্রান্তর বলা কথাটা নিজ মনে কয়েকবার আওড়ালো শিরীন। বেশ খানিকটা সময় লাগলো কথাটার অর্থ বুঝতে। যখন বুঝলো তখন খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তার বহু প্রতীক্ষিত ভালোবাসার নাগাল‌ পাবে ভেবেই খুশির জোয়ার বয়ে গেলো তার মনে।

-“আম্মুউউউ, আব্বুউউ,আপুউউ, প্রান্ত ভাইয়াআআ, তিহান ভাইয়াআআ, মেঘা আপুউউ, আন্টিইই, ভাবির আব্বুউউ তোমরা সবাই কোথায়?? তাড়াতাড়ি আসো।”
শান্তর চিল্লানিতে সবাই একে একে ড্রয়িং রুমে এলো। শাফিয়া আক্তার খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
-“কি হইছে? চেঁচাচ্ছিস কেন?”
শান্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাঁপাচ্ছে। কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে বললো,
-“তাড়াতাড়ি ছাদে চলো। ভাইয়া ভাবিকে তুলে নিয়ে ছাদে গেছে। মনে হয় ছাদ থেকে ফেলে দিবে।”
শাফিয়া আক্তার মুখ বেঁকিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন। বাকিরাও শান্তর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে‌ গেলো। শিরীন যেতে যেতে বললো,
-“তোর মাথা ফেলবে ছাদ থেকে।”
সবাই চলে যাওয়ায় হতাশ হলো শান্ত। সে বুঝতে পারলো‌ কেউ তার ভাবিকে বাঁচাতে যাবে না। তাই নিজেই তার ভাবিকে বাঁচানোর জন্য আবার ছাদের দিকে দৌড় দিলো।
বহু কষ্টে ছাদে উঠে দেখলো রুমঝুম পিলারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার কোলে মাথা রেখে শান শুয়ে আছে। শান্ত কোমড়ে হাত দিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। বেচারা ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। শান আড়চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি হয়েছে? হাপাচ্ছিস কেন?”
শান্ত এগিয়ে এসে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো। তারপর পেছন ঘুরে শানের পাশাপাশি রুমঝুমের কোলে মাথা রাখলো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
-“তুমি না ভাবিকে ফেলে দেওয়ার জন্য এনেছিলে? ফেলোনি‌ কেনো?”
রুমঝুম ঠোঁট বাঁকিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। বলে কি এই ছেলে? শান ঠোঁট কামড়ে হাঁসি আটকে বললো,
-“তা ফেলে দেইনি দেখে কি কষ্ট পাইছিস?”
-“কষ্ট পাইনি কিন্তু বাঁচানোর সুযোগও তো পেলাম না।”
শান হাহা করে হেসে উঠলো। শান্ত মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে মুখ ফুলালো। রুমঝুম হালকা হেঁসে দু’জনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
এদের বয়সের ব্যবধান অনেক তবুও কতটা খুনসুটি ওদের মধ্যে। দেখলেই প্রান জুড়িয়ে যায়। রুমঝুম আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,’এরা যেন সারাজীবন এভাবেই একসাথে কাটাতে পারে। কোনো বাধা যেন না আসে ভাই-ভাই বন্ধনের মাঝে।’

রাত আটটার মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো রুমেল আর মেঘার। অল্প কিছু লোক এসেছে বিয়েতে তবুও জাঁকজমক ভাব বাড়িতে। সকলেই প্রান ভরে দোয়া করেছে রুমেল-মেঘাকে। মেঘার মুখে একটা মিষ্টি হাঁসি লেগে আছে।
রুমঝুম মেঘার দিকে এগিয়ে এলো। মেঘার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-“আমার ভাইটার দায়িত্ব আজ থেকে তোর মেঘা। বাকি দশ জনের মতো আমার ভাই তোর দায়িত্ব নিতে পারবে না এখনি। আপাতত তুই তার দায়িত্ব নে। একসময় আমার ভাই তোকে সবটা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিবে দেখিস।”
রুমঝুমের কথার বিপরীতে মেঘা মুচকি হাসলো শুধু।

রুমেলের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে রাত এগারোটার মধ্যেই সবকিছু শেষ করে রুমেল আর মেঘাকে বাসর ঘরে রেখে বাকিরা চলে এলো।‌ মাহেরা খাতুন একবার অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দোয়া করলেন তার মেয়ের সুখের জন্য।
সবাই চলে যাওয়ার পর রুমেল আর মেঘা দু’জনই ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে ফেললো। একসাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলো। রুমেল জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
-“ঘুমুবে এখন? খারাপ লাগছে বেশি?”
মেঘা আড়চোখে তাকালো রুমেলের দিকে। স্নিগ্ধতায় ঘেরা এই যুবকটি তার স্বামী।
মেঘা মুচকি হেসে বললো,
-“না। একটু পরে ঘুমাবো। চলুন একটু বেলকনিতে বসি।”
.
রুমেলের বুকে হেলে বসে আছে মেঘা। আকাশে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান।রুমেলের হাত মেঘার চুলের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরছে। দু’জনেই চুপচাপ নিরবতা উপভোগ করছে।
রুমেল হঠাৎই হাঁসফাঁস শুরু করলো। মেঘা রুমেলের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।রুমেলের হাঁসফাঁসে ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে। রুমেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে আপনার?”
-“পানি খাবো।”
মেঘা রুমেলকে উঠিয়ে রুমে নিয়ে এলো। রুমেলকে বিছানায় বসিয়ে জগ থেকে পানি এনে রুমেলের মুখের সামনে ধরলো। রুমেল রক্তচক্ষু মেলে মেঘার দিকে তাকিয়ে গ্লাস ছুড়ে ফেলে দিলো। মেঘা কেঁপে উঠলো। রুমেল উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে বিরবির করছে। চুল টানছে নিজের।
মেঙা দৌড়ে গিয়ে ঘুমের ইনজেকশন রেডি করলো। ডান হাতে ইনজেকশন নিয়ে ধীরে ধীরে রুমেলের কাছে এসে দাঁড়ালো। বিছানায় বসা রুমেলকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। ততক্ষণে রুমেল মেঘার পিঠ,হাত আর ঘাড়ে ইচ্ছা মতো খামচে দিয়েছে। মেঘা অস্ফুট আর্তনাদ করে সরে এলো। রুমেল আরো বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে পড়লো‌ কিন্তু ইনজেকশনের প্রভাবে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারলো না। ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। মেঘা দু’পা পিছিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। সিরিঞ্জটা বেলকনির দিকে ছুড়ে মারলো।
মেঘার কষ্ট হলো ভীষণ। বুক ফেটে কান্নারা উপচে পড়তে চাইলো। যে রাতে মেয়েরা স্বামীকে একান্ত ভাবে কাছে চায় সে রাতে সে স্বামীর থেকে আঘাত পেলো। ক্ষতস্থানগুলো চেপে ধরে মেঘা ডুকরে কেঁদে উঠলো। এই নিয়তিকে সে নিজেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে সে রুমেলকে পরিপূর্ণ সুস্থ করবে। করবেই।
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২৪
#আর্শিয়া_সেহের
সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি সরাসরি এসে পড়েছে রুমেলের মুখে। রুমেল ভ্রু কুঁচকে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। সূর্যের প্রখর তাপে শরীর পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রুমেল বিরক্তিতে চোখ মেলে তাকালো।
চোখ খুলতেই ভেসে উঠলো মেঘার মায়াবী মুখটা। ফ্লোরে বসে খাটে দুই হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে সে। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। গালি পানি শুকিয়ে হালকা দাগ হয়ে আছে।
রুমেলের চোখে মেঘার দুই হাতের ক্ষতগুলোও দৃশ্যমান হলো। কালচে হয়ে গেছে ক্ষতস্থানগুলো।
নিমিষেই রুমেলের বুকের মধ্যে ব্যাথাদের আনাগোনা শুরু হলো। ধীরে ধীরে চোখে ভেসে উঠলো গতরাতের সবকিছু। আপনাআপনিই চোখে পানি চলে এলো। স্বপ্নের রাতে দুঃস্বপ্নের মতো কিছু ঘটে যাওয়াটা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত।
রুমেল বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা টেনে দিলো। ধীর পায়ে মেঘার পাশে বসে হাতের ক্ষতগুলোতে আলতো করে চুমু খেলো। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে মলম বের করে মেঘার হাতে আর পিঠে পরম যত্নে লাগিয়ে দিলো। মেঘা ঘুমের মধ্যেই হালকা নড়েচড়ে উঠলো।
রুমেল মলম রেখে ঘড়ির দিকে তাকালো। সবে সাতটা বাজে। মেয়েটাকে এখনই ডাকা যাবে না। এভাবে ঘুমালে হাত পায়ে ব্যাথা হবে ভেবে রুমেল খুব সাবধানে মেঘাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মেঘাও আদুরে বাচ্চার মতো হালকা নড়েচড়ে রুমেলের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়লো। রুমেল মুচকি হেঁসে মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।
একবার সুস্থ হলে এই মেয়ের শরীরে একটা টোকাও লাগতে দিবে না সে। মেয়েটা নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে তাকে। এই মেয়েকে জেনেবুঝে কষ্ট দিলে সৃষ্টিকর্তাও তাকে ক্ষমা করবে না।

সাড়ে নয়টার দিকে ঘুম ভাঙলো মেঘার। ঘুম ভেঙে নিজেকে রুমেলের বুকের মধ্যে আবিষ্কার করে কিছুটা অবাক হলো সে।
এক বালিশেই মেঘার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে রুমেল। মেঘার যতদূর মনে আছে সে বিছানায় ঘুমায়নি। তাহলে কি রুমেল তাকে বিছানায় এনেছে? কথাটা ভেবেই মুচকি হাসলো মেঘা। রাতের সমস্ত কষ্ট-বেদনা এক নিমিষেই হাওয়ায় উড়ে গেলো তার।
মেঘা খুব সাবধানে রুমেলের পাশ থেকে উঠে এলো। হাতে মলম লাগানো দেখে মৃদু হাসলো। মলমের উপর নিজেই একবার আলতো স্পর্শ করলো।‌ পেছনে ফিরে রুমেলের দিকে একবার তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
গোসল শেষে বেরিয়ে দেখলো রুমেল এখনো ঘুমিয়ে আছে। মেঘা চুল মুছতে মুছতে রুমেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। শরীরে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
-“এই উঠুন। অনেক বেলা হয়েছে উঠুন।”
রুমেল মেঘার ডাককে পাত্তা না দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমালো আবার। মেঘা ফোঁস করে দম ফেলে তোয়ালে সাইডে রেখে দুই হাতে ধাক্কাতে শুরু করলো রুমেলকে। রুমেল মেঘার দিকে ফিরে পিটপিট করে চোখ মেললো। একনজর তাকিয়ে ঝট করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বিরবির করে বললো,
-“আল্লাহ বাঁচাও, আল্লাহ বাঁচাও।”
মেঘা কোমরে হাত রেখে রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুমেলের দিকে। রুমেল এক চোখ মেলে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘার রাগী চেহারা দেখে হেঁসে ফেললো। মেঘার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে এলো। কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“সকাল সকাল আমাকে পরীতে ধরতে এসেছে ভেবে ভয় পেয়েছিলাম, বউ।”
‘বউ’ শব্দটা মেঘার মস্তিষ্কে গিয়ে বিধলো। তাকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে রাখা মানুষটার বউ সে। আহ! কি সুখের অনুভুতি। মেঘা প্রশান্তির হাঁসি হাঁসলো। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই মূহূর্তে খুব করে নিজের স্বামীর সুস্থতা কামনা করলো।
..
মেঘা আর রুমেলের বিয়ের চারদিন কেটে গেছে। তাদের বিয়ের পরদিনই মেহেদী-সিন্থিয়া, তিহান,শান্ত,শাফিয়া আক্তার-ইমতিয়াজ মাহমুদ চলে গিয়েছিলেন। প্রান্ত-শিরীন, শান-রুমঝুম আর মাহেরা আক্তার থেকে গিয়েছিলেন। আজ তারাও চলে যাবেন।
রুমেলের অবস্থা কিছুটা ভালো‌ এখন। ভায়োলেন্ট হলেও হুঁশ থাকে তার। মেঘা ইনজেকশন দিতে আসলে চোখ মুখ খিচে পড়ে থাকে সে। চেষ্টা করে মেঘাকে কষ্ট না দেওয়ার। তবুও মাঝে মাঝে দু-একটা আঘাত করে ফেলে যেটা মেঘা সবার থেকে লুকিয়ে যায়। সবাই ভীষণ খুশি তাদের দু’জনকে এভাবে মানিয়ে নিতে দেখে।
প্রান্ত-শিরীনের প্রেম চোখে চোখেই সীমাবদ্ধ। গতকাল রাতে প্রান্ত শিরীনকে ছাদে ডেকেছিলো। খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে শিরীনকে সব। শিরীন যেন ঠিকমতো পড়াশোনা করে, তার কথা চিন্তা করে পরীক্ষায় খারাপ না করে, তার চাকরি হলে শিরীনকে বিয়ে করবে সবকিছুই বলেছে। শিরীন হাঁসি মুখে সবকিছু মেনে নিয়েছে। ছাদ থেকে নামার আগে একবার প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
-“আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি, প্রান্ত ভাইয়া?”
প্রান্ত আমতাআমতা করলো। তারও ইচ্ছে করছে কিন্তু ..
প্রান্তর উত্তর না পেয়ে শিরীনও অপেক্ষা করলো না । এগিয়ে এসে আলগোছে জড়িয়ে ধরলো প্রান্তকে। প্রান্ত ধরলো না। স্বপ্নকুমারীর প্রথম স্পর্শে জমে গিয়েছিলো সে।
কিছুক্ষণ পর শিরীন নিজ থেকেই প্রান্তকে ছেড়ে দিলো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। নিজের পড়ালেখাতেও মন দিবো। তোমাকে খুব ভালোবাসি আমি।”
শিরীন গটগট শব্দ করে চলে এলো ছাদ থেকে। প্রান্ত সেদিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বললো,
-“আমিও তোমায় ভীষণ ভালোবাসি শিরীন।”
.
রুমঝুম চলে যাবে শুনে সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে রুশান। এই কয়েকদিনে বোনের সাথে কত্তো খুনসুটি করেছে সে‌। আজ বোনটা চলে যাবে সুদূর চট্টগ্রাম। ভেবেই রুশানের খারাপ লাগছে।
মেঘা ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে রাখতে এসে চোখ পড়লো রুশানের দিকে। এগিয়ে এসে রুশানের পাশে বসলো মেঘা। আদুরে গলায় বললো,
-“আমার ছোট্ট ভাইটার কি মন খারাপ?”
রুশান আনমনেই বললো,
-“হু।”
-“কেন মন খারাপ?”
-“আজ আপু চলে যাবে ভাবি। ও চলে গেলে আমি একা হয়ে যাবো।”
-“হ্যাঁ তোমার তো ওই একটাই আপু। আমি তো তোমার কেউ না। আপু চলে গেলে তোমার কি আর কেউ থাকবে? তুমি তো একা হবাই।”
মেঘা কথাগুলো বলতে বলতে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।
রুশান মেঘার পিছু‌ পিছু দৌড়ে এলো। প্যানপ্যান করে বললো,
-“ভাবি রাগ করতেছো কেন? ও ভাবি । রাগ করে না ভাবি‌ । তুমিও আমার আপু তো। আমি তো এমনিতেই বলেছি।”
মেঘা আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-“আমি কারো‌ আপু নই। যাও তুমি।”
-“ভাবি সরিইই। সরি তো। আর বলবো না। রাগ করো‌ না প্লিজ প্লিজ।”
-“কি রে‌, মেঘা আবার তোর উপর রাগ করলো ক্যান রুশান?”
রুমঝুম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো।
রুশান উত্তর দেওয়ার আগেই মেঘা বললো,
-“ওর একমাত্র আপু চলে যাবে। ও একা হয়ে যাবে। বেচারা দুঃখ বিলাস শুরু করেছে এখন থেকেই।”
রুশান মাথা নিচু করে শুনছে শুধু। সে বেশ‌ বুঝতে পারছে মেঘা তার কথায় রাগ করেছে।
রুমঝুম রুশানের পাশে এসে দাঁড়ালো। রুশানের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
-“তুই আমার জন্য দুঃখ বিলাসও করিস। হাউ ফানি।”
রুশান ভেঙচি কেটে বললো,
-“তোমার জন্য দুঃখ বিলাস করতে বয়েই গেছে আমার। ভাগো তুমি।”
রুশানের কথার ধরনে রুমঝুম খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। মেঘাও আর না হেঁসে পারলো‌ না। রুশান মুগ্ধ চোখে দুই রমনীর হাঁসি দেখছে। প্রাণবন্ত হাঁসি জোরা দেখে তার ঠোঁটেও মৃদু হাঁসি ফুটলো।

বেলা এগারোটা নাগাদ শান সহ বাকিরা রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। রুমেল আরো কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর মেঘা তাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে।
মাহেরা খাতুন মেঘাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। সংসার জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন উপদেশ দিলেন। মেঘাও লক্ষী মেয়ের মতো সবটা মাথায় ঢুকিয়ে নিলো।
রুমঝুম রুমেলকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলো। এতো দিন পর ভাইকে পেয়েও তার কাছে থাকতে পারলো না। বিয়ের পর মেয়েদের জীবনটা বোধহয় এমনই হয়।‌ সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ইচ্ছেমতো আর থাকা হয় না কোথায়। রুমেলকে ছেড়ে রুশানকে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুম। রুশানের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“লক্ষী ভাই ,আমার। দুষ্টুমি করবি না। বাবার,ভাইয়ার ,মেঘার খেয়াল রাখবি। তুই আমার ব্রেভ ভাই।”
রুশান টলমলে চোখেই মুচকি হাসলো। টুপ করে তার চোখ বেঁয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
রুমঝুম কান্না ভেজা মুখেই বাচ্চাদের মতো শব্দ করে হাসলো। রুশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুই আমার জন্য কাঁদছিস? হি হি হি..
তুই তো আমাকে সহ্য করতে পারিস না তাহলে কাঁদছিস কেন?”
রুশান শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুমকে। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বললো,
-“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আপু। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি তুমি।”
রুশানের কথায় রুমঝুমও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
শান রেজাউল সাহেবের সাথে কথা বলছিলো। দুই ভাইবোনের কান্নার শব্দে এগিয়ে এলো সেদিকে । বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা করলো দু’জনকে। প্রান্ত আর শিরীন সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলেছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে দু’জন গাড়িতে বসে পড়েছে।
রুমঝুম রুশানকে ছেড়ে মেঘার কাছে গেলো। এই মেয়েটা তার জীবনে আশির্বাদ। একে একে তাকে, তার পরিবারকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। এমন‌ মেয়ের দেখা সহজে পাওয়া যায় না।
মেঘা রুমঝুমের হাত ধরে কেঁদে ফেললো। সবচেয়ে বেশি একা তো সেই হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ স্বামী, অচেনা শহর, নতুন পরিবেশ। সবকিছু কিভাবে সামলাবে সে?
রুমঝুম মেঘার চোখের পানি মুছে দিলো। কান্না মাখা কন্ঠে বললো,
-“এই পরিবারের তিনজন পুরুষের দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেলাম মেঘা। আমার বাবাকে দেখে রাখিস। লোকটা অনেক কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কষ্ট গুলো প্রকাশ করার মানুষ পায়নি। আমার ছোট ভাইটাকে সামলে রাখিস। ও অনেক ভালো। সবাইকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে জানে ছেলেটা। নিজের ভাইয়ের মতো করে ওর খেয়াল রাখিস।
আর ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু বলবো না। তাকে তুই তোর মতো করে গুছিয়ে নে।”
মেঘা কিছু বললো না। রুমঝুম গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। শান গাড়িতে বসে পড়েছে। রুমঝুম রেজাউল সাহেবের কাছে গিয়ে বললো,
-“ভালো থেকো, বাবা। মেঘা অনেক ভালো মেয়ে। ওর দিকে খেয়াল রেখো । আর নিজেরও যত্ন নিয়ো।”
রেজাউল সাহেব চোখ মুছলেন। গাড়িতে বসা শানের দিকে একনজর তাকিয়ে বললো,
-” ওই ছেলেটাকে কখনো কষ্ট দিয়ো না,মা। তোমার জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখেছি ওর চোখে। আমার জন্মদুঃখী মেয়েটার জন্য একবুক ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয়েছে ছেলেটা। ওর ভালোবাসার সম্মান করো। তোমার কাছে বাবা হিসেবে এটুকুই চাই।”
রুশান পেছন থেকে এসে বললো,
-“জানো আপু,যে রাতে তুমি পালালে? সেই রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে চেয়েছিলাম ,’তোমার জীবনটা যেনো চন্দ্র রঙে রেঙে যায়। আমার চাওয়া পূরন হয়েছিলো আপু। পরের রাতেই তোমার জীবনে আগমন ঘটেছিলো চন্দ্রকুমারের। সে তার চন্দ্রকন্যাকে ভীষণ যত্নে আগলে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমি সবসময় চাইবো চন্দ্রকুমার তার চন্দ্রকন্যাকে নিয়ে সুখময় একজীবন কাটাক।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে বসার পর শান গাড়ির ভেতর থেকে সবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। রুমেল এগিয়ে এসে বললো,
-“সাবধানে যাও সবাই। পৌঁছে কল করো।”
শান হেঁসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি যতক্ষণ দেখা গেলো ততক্ষণ সবাই চেয়ে রইলো সেদিকে। একসময় গাড়িটি তাদের দৃষ্টি সীমা‌ অতিক্রম করলো। কেউ জানেনা আর কবে তাদের দেখা হবে। আদৌ দেখা হবে কি না।
মানবজীবন বড়ই অদ্ভুত। কখন কার সাথে কি ঘটে কেউ বলতে পারে না।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here