লাভ গেম -Part 29+30

0
349

#লাভ_গেম(বেবি স্পেশাল)
#ফাবিহা_নওশীন
২৯+৩০
সকাল থেকেই রুশার শরীর মেজমেজ করছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। থেমে থেমে পেটে ব্যথা হচ্ছে। কথা আশ্রম যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আশ্রমে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আজ যেতেই হবে। কথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কানে দুল পরতে পরতে বলল,
“আপু, কোন কিছু প্রয়োজন হলে কাউকে ডেকো। আমি সবাইকে বলে যাব তোমার দিকে খেয়াল রাখতে। পানি আর মোবাইল হাতের কাছে রেখেছি। একা একা উঠে কোথাও যাবে না। আগামীকাল তোমার ডেট।এই একটা দিন সাবধানে থাকবা। আমি যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চলে আসব।”
রুশা আধশোয়া হয়ে মুচকি হেসে বলল,
“কথা, এত চিন্তা করো না। তুমি যাও। কাজ শেষ করে আসবে। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।”
কথা বিছানার উপরে থেকে লেডিস্ ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুশার দিকে মুচকি হেসে বিদায় নিল।
ও যেতেই রুশার মলিন মুখে পেটে হাত রাখল। ও বুঝতে পারছে না ওর এমন লাগছে কেন। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। ঘন্টাখানেক পরে ব্যথাটা চাড়া দিয়ে উঠল। আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় প্রবেশ করতেই খিঁচুনি উঠে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। রুশা বেড সাইড টেবিল থেকে পানি নিয়ে খেল। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু এখন ব্যথায় নড়তে পারছে না। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কাউকে ডাকবে মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মোবাইলটা ধরতে পারছে না আর না কেউ এই ঘরে আসছে। রুশা মাথা উঁচু করে দরজার দিকে তাকাল। ওর মনে হচ্ছে এই ঘরে কখনো কেউ আসবে না আর ওর অবস্থা জানবে না। রুশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মোবাইলটা আঙুলের স্পর্শ পেয়েছে। রুশা আরেকটু চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাচ্ছে আর সাহস জোগাচ্ছে ওকে পারতেই হবে। কিন্তু সে আশাও নিভে গেল। হাতের স্পর্শ পেয়ে মোবাইলটা নিচে পড়ে গেল। রুশার অসহায়ত্ব আরো বেড়ে গেল। ও ব্যথায় ছটফট করছে আর কাঁদছে। তারপর মাথায় আসলো পানির গ্লাসটা নিচে ফেলতে হবে। রুশা আবারও নিজেকে সামলালো। সাহস জুগিয়ে আরেকটু চেষ্টা করছে।
আদ্রিশ অফিসের জন্য বের হচ্ছে। কিছু পড়ার শব্দে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তারপর ভাবল রুশা হয়তো রাগ করে কিছু ছুড়াছুড়ি করছে। ওর অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই আর সেদিকে যাওয়ার কথা ভাবল না। তারপর দেখা যাবে দু’জনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে।
আদ্রিশ তাই কোট হাতে অফিসের জন্য বের হয়ে গেল। রুশা ছটফট করছে আর কাঁদছে। মৃদুস্বরে বিরবির করছে। বিরবির করে কিছু বলছে। গোঙ্গানি দিচ্ছে। কপাল বেয়ে চিকন ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে।
আদ্রিশ কি মনে করে আবার ফিরে এল। রুশাকে দেখার জন্য ওর ঘরের দরজার সামনে এলো। দরজা ভেড়ানো ছিল। আদ্রিশ দরজায় টোকা দিতে চেয়েও দেয় না। আস্তে আস্তে দরজা খুলে। দরজা খুলতেই ওর চোখ যায় বিছানার দিকে। যেখানে রুশা হাত পা নাড়িয়ে ছটফট করছে। আদ্রিশ হাতের কোট ফেলে রুশার কাছে দৌঁড়ে যায়। আতংকিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। আদ্রিশকে দেখে রুশার প্রাণ ফিরে এল। আদ্রিশ রুশার হাতের তালুতে হাত ঘঁষছে।
বিচলিত, ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?”
রুশা বিরবির করে বলল,
“আদ্রিশ…!”
“হ্যা, হ্যা, বলো আমি শুনছি। বলো কী বলবে? কী হয়েছে তোমার?”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো।”
আদ্রিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কী করবে বুঝতে পারছে না। রুশার অবস্থা ওকে নার্ভাস করে দিয়েছে। চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকছে আর রুশার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। রুশাকে পাজা কোলে নিয়ে বলল,
“আমি আছি কিছু হবে না তোমার। আমরা এখুনি হাসপাতালে যাব।”
আদ্রিশ রুশাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই কাজের লোকেরা দৌঁড়াতে শুরু করল। গাড়ির দরজা খুলে দিল। ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে দিল। রুশার খিঁচুনি বেড়ে যাচ্ছে। রুশার অবস্থা দেখে আদ্রিশের নিজেকে অসহায় লাগছে। হাসপাতালে কল করল। সব কিছু ব্যবস্থা করে রাখল। যাতে রুশাকে নেওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা শুরু করে দেয়। আদ্রিশ রুশাকে আগলে রেখেছে নিজের সাথে। রুশা আদ্রিশের একটা হাত নিজের হাতে চেপে ধরেছে। ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
“রুশা, আরেকটু কষ্ট করো। আমরা চলে এসেছি। বিশ্বাস করো তোমার এই অবস্থা আমি দেখতে পারছি না। আমি সহ্য করতে পারছি না।”
আদ্রিশ আঙুল দিয়ে চোখের কোনের পানি মুছল যা রুশার চোখে পড়েনি।
হাসপাতালে রুশাকে নিতেই ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেল। সেজান আর কথাও চলে এসেছে। কথার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তাই এসে থেকে মাথা নিচু করে রেখেছে। ডাক্তার বের হয়ে এসেছে। আদ্রিশের কাছে এসে বলল,
“পেসেন্টের অবস্থা ভালো না। খিঁচ উঠছে বারবার।”
আদ্রিশ ডাক্তারের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল,
“ভালো না মানে কী? ওর এখানেই চেকাপ হয়েছে। সব সময় তো বলে এসেছেন সব নর্মাল আর এখন বলছেন ভালো না। কেন?”
সেজান ওকে ছাড়িয়ে নিল। ডাক্তারকে বলল,
“আমার স্ত্রীর কিছু হলে হাসপাতাল জ্বালিয়ে দেব। এতদিন সব ঠিক ঠিক বলে ভুল চিকিৎসা দিয়েছে এরা। এদের আমি ছাড়ব না। ”
ডাক্তার ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
“আসলে স্যার, মেম কোন ট্রমার মধ্যে চলে গেছেন। বিরবির করে বলছেন আমার বাচ্চা কাউকে দেব না। কেউ নিতে পারবে না। মনে হচ্ছে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। উনার মনে কোন ঘটনা বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। আমরা ওটিতে নিয়ে যাচ্ছি।”
কথা আর সেজান দুজনেই আদ্রিশের দিকে তাকাল। ওদের তিনজনের কারো বুঝতে বাকি নেই ঘটনাটা।
কথা আমতা আমতা করে বলল,
“আপু কয়েকদিন ধরে অনেক ডিস্টার্ব ছিল। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারত না। তার মনে একটা ভয় জেঁকে বসেছিল আপনি তার বাচ্চাকে যদি ছিনিয়ে নেন। আমি অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু রুশা আপু তো মা। আর মায়ের মনে সব সময় সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। রুশা আপুর ক্ষেত্রেও তাই।”
আদ্রিশ জানে ওকে কি করতে হবে। ওটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেজান আর কথা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে আদ্রিশকে অনুসরণ করল। আদ্রিশ জোর করে ওটির ভেতরে ঢুকে গেল। ডাক্তার, নার্স অপারেশনের ব্যবস্থা করছে৷ আদ্রিশকে দেখে তারা রেগে গেলেন এভাবে ওটিতে প্রবেশ করার জন্য। আদ্রিশ কাউকে পরোয়া না করে কোন বাঁধা না মেনে রুশার কাছে চলে গেল। ওর গালে হাত রেখে কানের কাছে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
“রুশা, আমাকে শুনতে পাচ্ছো? আমি আদ্রিশ। আমি জানি তুমি আমাকে শুনতে
পাচ্ছো। তোমার বেবি তোমারই থাকবে। ওকে কেউ কেড়ে নিবে না। সব সময় তোমার সাথে থাকবে। আমি চাই তুমি আর আমাদের বেবি সুস্থ ভাবে আমার বাড়িতে প্রবেশ করো। আর কিছু চাই না আমি। তোমার বেবি তোমার সাথে থাকবে আমি প্রমিস করছি। একটু শান্ত হও। আর আমি প্রমিস করলে সেই প্রমিস রাখি তুমি জানো।”
রুশা বন্ধ চোখে ঠোঁট নাড়াচ্ছে। আদ্রিশ উঠে দাঁড়াল। রুশার দিকে আরেকবার তাকাল।
কথা একটা বেঞ্চির উপর বসে আছে। অপেক্ষা করছে বেবির জন্য। অপেক্ষা করছে কখন শুনবে বেবি আর রুশা দুজনেই ভালো আছে। ওর মাথাটা ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুখ কুকঁড়াচ্ছে। সেজান ওয়ান টাইম গ্লাসে কফি এনে ওর সামনে ধরল। কথা মাথা তুলে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
“আমি কফি খাব না সেজান ভাই। ধন্যবাদ।”
তারপর আবার দু-হাত গালে দিয়ে মাথা নিচু করে রইল। সেজান কি করবে বুঝতে পারছে না। কথা ওকে এভাবে ইগ্নোর করছে ওর ভালো লাগছে না। এটা হাসপাতাল আর রুশার এই অবস্থা তাই চুপ করে আছে নয়তো কথাকে দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিত। ওটি থেকে তোয়ালে পেঁচিয়ে একজন নার্স বের হয়ে এল। কথা দৌঁড়ে গিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নিল।
নার্স মুচকি হেসে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে। মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর।”
সেজান আর কথা বেবিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আদ্রিশ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“আমার স্ত্রী?”
“উনি ঘুমাচ্ছেন। ডাক্তারের সাথে উনার বিষয়ে কথা বলে নিবেন। উনি অনেক দূর্বল। শরীরের কন্ডিশন ভালো না। আমি আসছি।”
“আমি ওকে একটু দেখতে পারি?”
“জি অবশ্যই।”
আদ্রিশ, কথা আর সেজানের দিকে চেয়ে বলল,
“আমার ছেলেকে দেখো। আমি রুশাকে একটু দেখে আসি।”
তারপর জবারের অপেক্ষা না করে আদ্রিশ রুশার সাথে দেখা করতে চলে গেল। রুশা ঘুমাচ্ছে। ধীরে ধীরে আদ্রিশ রুশার কাছে এগিয়ে গেল। ওর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
“এত বড় লড়াইতে যখন জিতে ফিরেছো তখন তুমি এক তুড়িতে সুস্থ হয়ে যাবে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার ঘরে রওনক আনার জন্য। আমাদের ছেলেটা নাকি অনেক সুন্দর হয়েছে। এই দেখেছো ওকে তো এখনো দেখিই নি। আমি ওকে দেখে আসি। তুমি তাড়াতাড়ি জেগে যাও।”
আদ্রিশ রুশার গালে হাত ছুইয়ে উঠে দাঁড়াল। গন্তব্য সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকে ছুয়ে দেখার। আদ্রিশ অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে ছেলেকে কোলে নেওয়ার। এত সুন্দর রাজপুত্রকে দেখে ওর চোখে পানি এসে পড়েছে। কোলে নেওয়ার লোভ জেগেছে৷ কিন্তু ওকে কোলেই নিতে পারছে না। ওর ভয় লাগছে। কোলে নিলে যদি ব্যথা পায়। কথা বারবার হেসে কুটিকুটি হচ্ছে আর সেজানের ধমক খাচ্ছে।
রুশাকে বেডে সিফট করা হয়েছে। শুয়ে শুয়ে আদ্রিশকে দেখছে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে কি যেন বলছে। রুশা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কথা ওকে দেখতে ভেতরে এলে রুশা বলল,
“আদ্রিশের আমাকে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। একবার দেখতেও এলো না।”
কথা অবাক হয়ে বলল,
“কি যে বলো আপু। আদ্রিশ ভাইয়া বাচ্চাকে দেখার আগে, কোলে নেওয়ার আগে তোমার কন্ডিশন জিজ্ঞেস করেছে। তোমার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে তোমাকে দেখে গেছেন। ডাক্তারের সাথে তোমার শারীরের অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। আমাকেও এখন এখানে পাঠালো তোমাকে দেখতে। ডাক্তার যখন বলেছে তোমার শরীরের কন্ডিশন ভালো না, তার কলার চেপে ধরেছে। অপারেশনের পুরোটা সময় অস্থির অস্থির করেছে। আর মাত্রই ছেলেকে কোলে নিল। জানো ভাইয়া কি বলে তার বাচ্চাকে কোলে নিতে ভয় লাগে,এত নরম শরীর উনার শক্ত হাতের স্পর্শে যদি ব্যথা পায়। কত সেন্সেটিভ দেখেছো? ছেলেকে খুব আদরে রাখবেন ভাইয়া। ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে আপু।”
চলবে…..
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩০.
দুদিন যাবৎ হাসপাতাল থেকে ফিরেছে রুশা। কিন্তু এখনো ঠিকমতো সুস্থ হয়নি। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। শুধু ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বিছানা থেকে নামে। আদ্রিশ ওর তত্ত্বাবধানের জন্য একজন নার্স রেখে দিয়েছে। ও যতটুকু না অসুস্থ তার চেয়ে আদ্রিশ ওকে বেশি অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে।
বেবি সারাক্ষণ আদ্রিশ, সেজান, কথা আর মিজান চাচার কাছে থাকে। ওরাই ওর দেখভাল করে। সারাক্ষণ ওদের কোলে কোলে থাকে। খাওয়ার সময় শুধু রুশার কাছে দেয়। রুশা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বেবির কিছুই ওকে করতে দিবে না আদ্রিশ। ও কিছুদিনের জন্য অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আদ্রিশ ছেলেকে যত দেখে ততই অদ্ভুত অনুভূতি হয়। একটা মায়া আচ্ছন্ন করে রাখে। সন্তান আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত। আদ্রিশ জানতো ও ওর বাচ্চাদের খুব ভালো বাসবে কিন্তু এতটা ভালো বাসবে জানা ছিল না। চোখের আড়াল হতে দিতে ইচ্ছে করে না। আদ্রিশ কিছুদিন আগেও ভাবতো রুশার চেয়ে বেশি কাউকে ভালো বাসতে পারবে না কিন্তু এখন মনে হয় এই ছেলের চেয়ে বড় কেউ নেই, কিছু নেই, ওর জন্য সব পারবে। ছেলে যখন কাঁদে মনে হয় ওর কলিজাটা কেউ কেটে ফেলছে। দিনে কম করে একশো চুমু দেয় ওর গালে, চোখে, কপালে, নাকে। সেজান হিসেব রাখে আর হাসাহাসি করে। আদ্রিশ তখন ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়।
রুশা ছেলেকে খাইয়ে কপালে চুমু দিলেই কথা বলল,
“আপু, ওর নাম চুমু কুমার রেখে দেও। যে হারে তুমি আর ভাইয়া ওকে চুমু দিচ্ছো তাতে ওর আসল নাম হারিয়ে যাবে। নাম হবে চুমু কুমার। যখন কলেজে যাবে মেয়েরা পেছনে লাইন মারবে আর ডাকবে ওগো আমার চুমু কুমার!”
রুশা ওর কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। আদ্রিশ ওর হাসির মাঝে ঘরে ঢুকে। ছেলে হাত পা নাড়াচ্ছে। বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে। গভীর ভাবে মাথার উপরের ছাদটা দেখছে। আদ্রিশ ওর কাছে এসে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“আমার বাবাটা কী করে?”
কথা রুশার দিকে তাকাল। রুশা আবারও হাসতে লাগল। কথা সামনের ডাবল সোফায় বসে ছিল। বসা থেকে উঠে বলল,
“লে, প্রতি লাইনে একটা করে চুমু। আমি তোমাদের চুমু দেখতে দেখতে ক্লান্ত। না জানি বাচ্চা ছেলেটার কী অবস্থা। আমি শিওর, ও না পারছে বলতে আর না পারছে সইতে।”
কথা বিরবির করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আদ্রিশ কথার যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ওর মাথায় কিছুই ঢুকল না। রুশার হাসি থামছে না।
আদ্রিশ রুশাকে হাসতে দেখে দিল এক ধমক।
“এত হাসছো কেন? অপারেশনের জায়গায় টান পড়ছে না? হাসি থামাও। নয়তো এক মাসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসব।”
রুশা হাসি থামিয়ে দিল। ওর অপারেশনের জায়গায় আসলেই একটু ব্যথা করছে। রুশা ঠিক করে শুয়ে পড়ল। আদ্রিশ ওর কুঁচকানো
মুখ দেখে কিছু বুঝল। তারপর বিছানার অপর পাশে গিয়ে বসল। রুশাকে কিছু না বলেই ওর জামায় হাত দিল। রুশা চোখ বড়বড় করে বলল,
“কী!”
আদ্রিশ ওর কথার উত্তর না দিয়ে জামা তুলে পেট দেখল। এখনো ঘা শুকায়নি। আদ্রিশ ওর ঘায়ের স্থান দেখে চমকে উঠে। কত বিভৎস ভাবে মানুষ মেরেছে। কখনও ভয় লাগেনি। রুশা জামা নামিয়ে ফেলল।
“এখনো শুকাচ্ছে না কেন? আর কতদিন লাগবে?”
রুশা মিনমিন করে বলল,
“একটু সময় লাগবে। আমার জন্য তোমাকে এত ভাবতে হবে না।”
আদ্রিশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি আমার ছেলের জন্য ভাবছি। ওকে তো এখনো কোলে নিয়ে হাঁটলে না।”
“তাতে কী? ওকে কোলে নেওয়ার মানুষের অভাব আছে? তাছাড়া আমাকে বিছানা থেকে নামতে দিলেই হয়। আমি ঢের ওকে কোলে নিয়ে হাঁটতে পারব।”
“পায়ের পাতা মেঝেতে রাখতে পারো না। হাঁটবে কী করে? ভালো করে খেয়ে দেয়ে শরীরের দূর্বলতা কমাও। তারপর নাহয় বড় বড় কথা বলবে।”
আদ্রিশ ছেলের দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে চলে গেল। রুশা বিরবির করে বলছে,
“মুখে স্বীকার করবে না। মুখে স্বীকার করলে ইগোর কম পড়ে যাবে না।”
.
কেটে গেছে দুই মাস। রুশা এখন পুরোপুরি সুস্থ। ওর ঘরে শিফট হয়ে গেছে। ছেলের নাম রেখেছে রওনক আফসান আর্দ্র। আদ্রিশ মনে করে ওদের ছেলে ওদের ঘরে রওনক নিয়ে এসেছে। রুশা আর ওকে একসাথে করেছে। তাই ওর নাম রওনক আফসান রেখেছে৷ আর রুশা আদ্রিশের নাম মিলিয়ে রেখেছে আর্দ্র। আর্দ্র ঘুমাচ্ছে। রুশা আর্দ্রের ছোট ছোট জামাগুলো ভাজ করছে। আদ্রিশ অফিসের কাজ করছে। ছেলের অজুহাতে এই ঘরেই থাকে। দীর্ঘদিন অফিসে যাওয়া হয় না। সেজান সব দেখাশোনা করে। আদ্রিশ ঘরে বসে অফিসের তদারকি যতটুকু সম্ভব করছে।
কথা এখন এখানেই থাকে। রুশা ওকে রেখে দিয়েছে। আশ্রমে অন্য শিক্ষিকার ব্যবস্থা করেছে। কথা আবার পড়াশোনা শুরু করেছে। ইউনিভার্সিটিতে যায়। ওদের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। কথা দরজায় টোকা দেয়। কিছুক্ষণ আগে ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। পুরোটা দিন আর্দ্রকে কোলে নেয়নি। তাই ফ্রেশ হয়েই চলে এসেছে ওকে দেখতে।
রুশা মুচকি হেসে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“খালা মনির আর্দ্র ঘুমাচ্ছে। খালা মনি ভার্সিটি থেকে এসেছে এখন একটু রেস্ট নিক।”
কথা দরজায় হাত রেখে বলল,
“ও উঠলে আমাকে ডাকবে কিন্তু।”
“আচ্ছা, ডাকব। মাত্র ঘুমিয়েছে। এখুনি উঠবে না নিশ্চিত থাকো।”
কথা মন খারাপ করে ঘুরে চলে যেতে নেয় তখনই আর্দ্র উঠে যায়৷ চোখ মেলে চারপাশ দেখছে। চারপাশে দেখে যখন পরিচিত কোনো মুখ দেখতে পেল না তখন কান্না শুরু করে দিল। ওর এই অভ্যাস। ঘুম ভাঙার পর চারদিক দেখবে তারপর কাঁদতে শুরু করবে।
ওর কান্নার শব্দ শুনে কথা হেসে ফেলল। তারপর ঘুরেই দৌঁড়ে রুশা কোলে নেওয়ার আগেই কোলে নিয়ে নিল। কোলে নিয়ে কান্না থামাচ্ছে।
রুশা মুচকি হেসে বলল,
“তোমার কোলে যাওয়ার জন্যই উঠেছে, খালা মনি যে এসেছে সেটা স্বপ্নে পেয়েছে।”
রুশা বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগল। কথা সেসব পাত্তা না দিয়ে আর্দ্রকে আদর করছে। নানান কথা বলছে। আদ্রিশ এক পলক দেখে আবার কাজে মনোযোগ দিল। কিছুক্ষণ পরে সেজান এসে হাজির। ওকে দরজার সামনে দেখে রুশা ভেতরে আসতে বলল। কথা এক পলক সেজানকে দেখল। তারপর আবার আর্দ্রের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।
সেজান আড়চোখে একবার কথার দিকে চেয়ে রুশাকে বলল,
“ভাবি, আর্দ্রকে আমার কোলে দিতে বলো। গতকাল থেকে ওকে কোলে নেই নি। দেখিও নি।”
কথা জবাব দিল,
“লাইনে থাকুন। আমি আজকে সারাদিন ওকে কোলে নেইনি। মাত্র নিলাম। আমার মন ভরে গেলে আপনি আসবেন।”
“তুমি তো নিয়েছো। আমি গতকাল থেকে ওকে নেইনি। এমনকি দেখিনি।”
“আমি এতকিছু জানি না। আমি দেব না ওকে।”
“দেব না মানে কী? ভাবি কিছু বলেন। আর্দ্র কী ওর বাচ্চা? আমার ভাইয়ের ছেলে আমি নেব। ওকে বিয়ে করে নিজের বাচ্চা নিয়ে বসে থাকতে বলুন।”
কথা রেগেমেগে আর্দ্রকে দিয়ে দিল সেজানের কাছে। তারপর গাল ফুলিয়ে রুশাকে বলল,
“আপু, তুমি না আমার জন্য ছেলে দেখেছিলে সে কি বিয়ে করে ফেলেছে? যদি করে ফেলে তাহলে অন্য ছেলে দেখো। আমি বিয়ে করব। আমার বাচ্চা চাই। তারপর নিজের বাচ্চা সারাদিন কোলে নিয়ে থাকব। কেউ এত কথা শোনাতে পারবে না। কোল থেকেও নিতে পারবে না।”
রুশা বিছানায় বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল,
“যদি সেজান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেই? না সেজান ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া যাবে না। তাহলে দু’জন বাচ্চা নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দিবে। তার থেকে অন্য ছেলে দেখি। কি বলেন সেজান ভাই?”
সেজান আদ্রিশের সামনে এসব বলায় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ল। গলা খাকাড়ি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি কী জানি।”
আদ্রিশের কেমন উদ্ভট লাগছে সবকিছু। এছাড়া মনে হচ্ছে কিছু একটা চলছে যা ও জানে না। সেজানের ভরকে যাওয়া মুখ, রুশার মুখ টিপে হাসা, কথার লজ্জা পাওয়া। কথা লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে চলে গেল। সেজানও আর্দ্রকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে চলে গেল।
আদ্রিশ উৎসুকভাবে রুশার দিকে চেয়ে আছে। রুশা ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“কী?”
“কী চলছে?”
“আমি কী জানি।”
রুশাও ঘর থেকে চলে গেল। আদ্রিশের মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না।
.
গভীর রাত। রুশা আর্দ্রের উপর হাত রেখে ঘুমাচ্ছে। কাজ শেষ করে আদ্রিশ ঘুমাতে এসেছে। চোখ পড়ল রুশার দিকে। অদ্ভুত মায়াবী লাগছে। ওকে ছুয়ে দেওয়ার লোভ জাগল মনে। আদ্রিশ নিজের অজান্তেই রুশার কাছে চলে গেল। রুশার ঘুমন্ত মুখ দেখে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। ওর গালে কিস করল। রুশা সাথে সাথে চোখ মেলল। আদ্রিশ হকচকিয়ে গেল। ও জানে রুশার ঘুম পাতলা তবুও এমন একটা ভুল করে ফেলল। সরে যেতে গেলেই রুশা ওর কলার চেপে ধরল। এতে দু’জন আরো কাছাকাছি চলে এল। দু’জনের উষ্ণ নিশ্বাস একে অপরের উপর পড়ছে।
রুশা দাঁত খিচিয়ে বলল,
“কী চলছে এসব? তুমি এখানে কেন?”
আদ্রিশ নিজের কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করল।
“ছেলে জেগে যাবে।”
“জেগে যাক। তুমি এখানে কেন? আমার গালে কিস করলে কেন?”
আদ্রিশ থমথমে মুখে বলল,
“করেছি তো কী হয়েছে? নিজের বউকেই করেছি। অন্য কেউ নয়।”
“কীসের বউ? এখানে আনার পর তো বলেছিলে সম্পর্ক সব শেষ। তাহলে এখন কীসের বউ আমি?”
“জানি না আমি। তোমাকে ঘৃণা করার কথা হলেও ঘৃণা করতে পারি না। কি করব আমি?”
রুশা আদ্রিশের কলার ছেড়ে দিল। ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে চেয়ে আছে। আদ্রিশ আচমকা রুশাকে জড়িয়ে ধরল। রুশা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। ফিসফিস করে বলল,
“তুমি সব সময় আমাকে ভালো বেসে এসেছো। ইনফ্যাক্ট এখনো বাসো। কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসার যোগ্য তো? তুমি আমার অনেক ক্ষতি করেছো। ওসব নাহয় বাদ দিলাম তুমি আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলেছো। এমনকি নিজের বাচ্চাকেও….।”
রুশার গলা ধরে আসছে৷ আদ্রিশ ওকে ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
কথা ছাদে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে। সেজান ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। কথা গুনগুন করছে। ওর খোলা চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। কথা কারো অস্তিত্ব অনুভব করে ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সেজানকে দেখে ভয়টা কমে গেলেও বুকটা ধুকপুক করছে। ভেবেছিল কে না কে।
সেজান ওর ভয়ার্ত মুখটা না দেখেই বলল,
” কি করছো এখানে এত রাতে?”
“কিছু না। এমনি এসেছিলাম। গুড নাইট।”
কথা ওকে পাস কাটিয়ে চলে গেল। সেজান ওকে পেছনে থেকে দাঁড়াতে বলছে। কথা দাঁড়াচ্ছে না। ছাদ থেকে নেমে বিরক্তি নিয়ে কথা বলল,
“কী চাই আপনার? বিরক্ত লাগছে।”
“কথা, তুমি এভাবে আমাকে এভয়েড করো কেন? আমার কথা তো শোনো। আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।”
“আমি আপনার উপর কেন রাগ করব? এসব আপনার ভুল ধারণা। আমার ঘুম পেয়েছে। পেছনে পেছনে আসবেন না। রাতের বেলায় পেছনে আসতে পারেন অথচ দিনের বেলায় চিনেনই না। বহুরূপী লোক।”
কথা রাগ দেখিয়ে চলে গেল। সেজান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশ হয়ে নিজের ঘরে যাবে তখনই আদ্রিশকে দেখতে পেল। আদ্রিশকে দেখে আমতা আমতা করছে। সেজান বুঝতে পারছে না আদ্রিশ কতটুকু শুনেছে আর কি বুঝেছে।
“ভাই, আপনি?”
আদ্রিশ উত্তরে বলল,
“তাহলে এই ব্যাপার?”
সেজান মাথা নিচু করে নিল।
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here