হৃদপূর্ণিমা -Part 12-15

0
289

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১২+15 |
রথি দ্রুত সরে গেলেও তার বুকের ভেতরের ধড়ফড়ানি কিছুতেই কমছে না। এরকম ভয় রথি তার এ জন্মেও পায়নি। সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে এই পুলিশম্যানের ভাব-ভঙ্গি! নাশিদ আঁখিপল্লবে রক্তিম ভাব এনে বলে,
-‘এতো ছেলেদের সঙ্গে কী তোমার? ওরা তোমায় দুই পয়সাও আয় করে দেয় না যার জন্য এর ওর সাথে পথেঘাটে ঘুরাঘুরি করবা। সময় থাকতে শুধরে যাও। নিজের হোল লাইফে ফোকাস করো!’
বলেই আবারও উলটোপথে হেঁটে চলে গেলো। রথি তখনো বেক্কলের মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছে। নাশিদের বলা কথাগুলো তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। এগুলো কী বলে গেলেন উনি? সে কখন কোন ছেলের সঙ্গে ঘুরাঘুরি করলো? সে তো জাস্ট আবির… এক সেকেন্ড! উনি কী আবিরকে উদ্দেশ্য করেই বললো? কিন্তু নাশিদ ওদের কোথায় দেখলো আর এরকম বিহেভ করার মানেই বা কী? কিছুই রথির এই ছোট মাথায় ঢুকছে না।
রথির ভাবনাতে ছেদ ঘটালো ফাহাদ।
-‘কী ব্যাপার রথি এভাবে দাঁড়িয়ে আছো যে?’
রথি থতমত খেয়ে পাশ ফিরে তাকালো। ফাহাদ আবারও প্রশ্ন করলো,
-‘ঠিক আছো?’
রথি কিছু ভেবে মাথা নাড়িয়ে হাসার চেষ্টা করলো। ফাহাদ ভ্রু কুচকে আবারও বললো,
-‘লোকটা কে ছিলো রথি?’
-‘কো..নটা?’
-‘এইযে সবে যার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে। দূর থেকে তো তাই দেখলাম!’
রথি আবারও চুপ মেরে গেলো। কিছুক্ষণ নিজের মধ্যে তুফান সৃষ্টি করে বললো,
-‘কেউ না!’
বলেই রথি হাঁটা ধরলো। ফাহাদ তখনো সেখানে দু’পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। রথিকে তার আজীবনই রহস্যময়ী নারী মনে হয়। এই মেয়েটা তার
নিজের সম্পর্কে কখনো কিছু বলেনি৷ আজও তাকে এড়িয়ে গেলো।
মার্জান রান্না করছিলো তখনই রথি মার্জানের সামনে একটি বাজারের ব্যাগ এনে রাখলো। মার্জান রান্না ছেড়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বাজারের ব্যাগটির দিকে তাকালো। রথি হাত ঝেড়ে বললো,
-‘তোমার দয়ায় চলার মতো মেয়ে আমি নই আর আমার মাকেও তোমার দয়ায় চলতে দিবো না। বাজারটা এতদিনে আনিনি কারণ আমাদের ওই বাসায় বেশ তরকারি আর মাংস ছিলো। সেগুলো তোমার অগোচরে এনে আমি নিজেই রেঁধে মা সহ খেয়েছি। এখন এগুলো আনলাম। তোমার রান্না শেষ হলে আমায় বলিও!’
বলেই রথি আসতে নিলো ভাবী আমায় বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করলো,
-‘টাকার গরম দেখাস আমাকে? নিজেকে নিয়ে এতো অহংকার তোর? ভুলে যাচ্ছিস আমি তোদের আমার বাসায় থাকতে দিচ্ছি?’
রথি সাময়িক হাসি দিয়ে বললো,
-‘ওই কাগজ দিয়ে আমার মাকে বোকা বানাতে পারো তবে আমাকে নয়। আমি কিন্তু পড়ালেখা জানি ভাবী, ক্ষেত থেকে উঠে আসিনি। তাই আমার বাবার বাড়িতে আমার এবং মায়ের তোমার চেয়ে বেশি অধিকার আছে। একবার যেহেতু এই বাড়িতে ঢুকিয়েছো আমার আর কী করার? এখন দেখো তোমায় কীভাবে নক্তের ন্যায় পুড়িয়ে যাই। আমি মায়ের মতো এতো সাদা-সিধে নই যে তোমার দুই একটা নরম বুলিতে পুরানো কথা ভুলে যাবো।’
বলেই হনহন করে নিজের ঘরে চলে যায় রথি। মার্জান বুঝতে পারে সে কতো বড় ভুল করেছে। এই মেয়ে এখন অনেক চালাক হয়ে গেছে। এখন কী হবে? ওদের সঙ্গে থাকা যে মার্জানের পক্ষে অসম্ভব! ভাবতেই একটা শুকনো ঢোক গিললো সে।
সেদিন বিকালে রথি এবং আবির আবারও এক সঙ্গে বের হলো। রথির বের হওয়ার একদম ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু ওই চাচীর জ্বালায় বের হতে বাধ্য হয়। সে বুঝে না বারংবার আবিরের গলায় রথিকে ঝুলানোর মানে কী? আবির কী তার আপন কেউ? আর আবিরটাই বা কেমন বলদ যে কিনা মায়ের এসব কাজ নিরবে সহ্য করছে। এই মা-ছেলের ভাব-গতিক কিছুই সন্তুষ্ট করছে না রথিকে।
————————
-‘চাচী আপনি যেটা চাইছেন সেটা কিন্তু ঠিক না!’
-‘অবশ্যই ঠিক। তুমি মানো আর না মানো, আবিরের জন্য রথিকে আমার ভিষণ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তোমার জন্যই বেয়াইয়ের কাছে আবদারটা করতে পারছি না!’
-‘কিন্তু চাচী…!’
চাচী চোখ গরম করে তাকালো, মার্জানের দিকে। মার্জান কিছু বলার সাহস পেলো না। নিজের অজান্তেই চুপ করে রইলো।

আবির রথিকে নিয়ে একটা ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটছে। আর রথি তিক্ততায় ভ্রু খানিকটা কুচকে রেখেছে। আবির নিরবতা ভেঙ্গে রথির উদ্দেশ্যে বলে,
-‘আপনাকে কিছু কথা বলার ছিলো!’
রথি থেমে যায়। বিরক্তিটা ভেতরে চেপে রেখেই বললো,
-‘বলুন!’
আবির যখনই কিছু বলতে নিবে ওমনি রথির পেছন থেকে কেউ ওকে টেনে নিলো। রথি পিছে তাকিয়ে দেখে নাফিসা মুচকি হেসে রথির পানেই তাকিয়ে। রথি তো নাফিসাকে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায়!
-‘তুই এখানে? হঠাৎ?’
-‘এইতো শপিং এ যাচ্ছি। তোকে এখানে দেখে গাড়ি থেকে নেমে আসলাম। তা উনি কে?’ আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললো নাফিসা।
আবিরের মাথা তো ততক্ষণে হ্যাং আউট হয়ে গেছে। সে নিষ্পলক দৃষ্টিতে নাফিসার দিকে তাকিয়ে রয়। নাফিসার সাথে ওর চোখাচোখি হতেই আবিরের ধ্যান ভাঙলো। রথি হেসে বলে, ‘ও আবির!’
আবির রথির কথা কানে না নিয়ে নিজেই নিজের ইন্ট্রোডাকশন দেয় নাফিসার দিকে হাত বাড়িয়ে।
-‘হাই, আমি আবির মাহমুদ! ঢাকাতেই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত। আপনার নাম?’
আবিরের হুট করে বলা কথাগুলো নাফিসার মাথার উপর দিয়ে গেলো। আর রথি, সে তো হা করে আবিরকে দেখছে। আবিরের হুট করে গিরগিটির ন্যায় রূপ বদলানোটা রথি কেন যেন হজম করতে পারছে না। নাফিসা নিজেকে সামলে আবিরের সাথে হাত মিলিয়ে বলে,
-‘আমি নাফিসা। এবার অনার্স লাস্ট ইয়ারে আছি। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।’ মুচকি হেসে বলে নাফিসা। নাফিসার এই হাসিটা আবিরের বুকে সুঁইয়ের ন্যায় বিঁধে গেলো। নাফিসা হাত ছাড়িয়ে রথিকে তাড়া দিয়ে বলে,
-‘ভালো কথা। আমি তোকে আমার সঙ্গে নিতে এসেছি। তোর চয়েজ ভালো, শপিংয়ের ক্ষেত্রে। তাই তুই আমার সাথে যাবি। আর মিঃ আবির, ভালো থাকবেন, আপনার বোনকে নিয়ে যাচ্ছি!’
শেষোক্ত কথাটি নাফিসা ইচ্ছে করেই বললো। কিন্তু আবিরের এতে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখায় নাফিসা কিছুটা অবাক হলো। আবির যেভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন ওই দৃষ্টি দিয়ে নাফিসাকে আস্ত গিলে ফেলবে। নাফিসা বিষম খেলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আবিরকে বিদায় দিয়ে রথিকে নিয়ে চলে গেলো। আর আবির? সে এখনো নাফিসার পথে তাকিয়ে আছে। আবির আনমনে বলে উঠলো,
-‘এটাই কী তবে, লাভ এট ফাস্ট সাইট?’
———————
-‘এটা কে রে ভাই, যেভাবে তাকিয়েছিলো যেন আমায় আস্ত গিলে ফেলবে?’
-‘ভাবীর কাজিন। সেটা বাদ দে, তুই আমায় এভাবে মাঝরাস্তা থেকে টেনে আনলি কেন?’
নাফিসা মুখে কিছু বললো না, ইশারায় সামনে তাকাতে বললো। রথি সামনে তাকিয়ে আরেকদফা বিষম খেলো। পুলিশম্যান! গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে একদম ফিল্মি হিরোর মতো দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজ তার লুকটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্ল্যাক শার্ট যার হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করা, ব্ল্যাক জিন্স আর ব্ল্যাক শু, হালকা বাতাসে অবাধ্য কয়েকগাছা চুল অসমান্তরাল ভাবে উড়ছে। আপাদমস্তক মানুষটাকে দেখে রথির জ্ঞান হারানোর উপক্রম। হা করে সে তাকিয়ে আছে নাশিদের পানে। নাশিদ তখনো রথির দৃষ্টি খেয়াল করেনি। নাফিসা পাশ থেকে রথিকে আলতোভাবে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-‘মুখ বন্ধ করে ভাইকে দেখ, মশা ঢুকে যাবে তো!’
নাফিসার এরূপ কথায় রথি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। নাফিসা মুচকি হেসে বললো,
-‘খুব তো বলতি আমার ভাই গম্ভীর টাইপ পুলিশ, তার প্রেমে পরলে গর্তে পরবি টাইপ কথাও বলেছিস। এখন তলে তলে এসব করে বেড়াচ্ছিস?’
রথি নাফিসার কাঁধে এক চড় মেরে বললো,
-‘মুখে লাগাম দিয়ে কথা বল!’
-‘সত্য বললেই এই বান্দা দোষী? বাহ!’
এসব বলতে বলতেই ওরা নাশিদের গাড়ির সামনে আসলো। নাশিদ রথিকে দেখেও না দেখার ভান করলো। রথির প্রতি নাশিদের এই ইগনোরেন্সটা তার মনে বেশ আঘাত করলো তবে রথি মুখ ফুঁটে কিছু বলেনি। রথি পেছন সিটের দরজা খুলতেই নাশিদ বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
-‘নাফিসা! ওকে বলে দে আমি কারো পার্সোনাল ড্রাইভার না!’
রথি চোখ গরম করে নাশিদের দিকে তাকালো। কিন্তু নাশিদ রথির দিকে না তাকিয়েই গাড়িতে উঠে বসলো। এই প্রথম নাশিদের প্রতি রথির চরম রাগ লাগলো। নাফিসা মুখ টিপে হেসে বললো,
-‘যা গিয়ে সামনের সিটে বস!’
রথিও কম নয়। সেও বলে উঠলো,
-‘আমি কেন বসতে যাবো? তোর ভাই তুই তার পাশে গিয়ে বস। আমি খামোখা বসে কী করবো? আর এইযে পুলিশ এসব ভাব আপনি আপনার পকেটেই রাখুন। নাফিসা আমি গেলাম, তোর এই হিটলার ভাইয়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই!’
বলেই সামনে এগোতে নিলো তখনই নাশিদ দরজা খুলে রথির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাশিদও চোখে ক্রোধ এনে বললো,
-‘আমি হিটলার? আমি হিটলার হলে এতদিনে তোমায় হিটারের মাঝে পোড়াতাম! তা না করে তোমায় হেল্প করেছি। সামান্য সম্মানবোধ তোমার মধ্যে নেই নাকি?’
-‘না নেই। যে আমার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করবে আমি ঠিক সেরূপ ব্যবহারই উপহার দিবো।’
-‘রথি, মাথা গরম করিও না। গাড়িতে ওঠো!’ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো নাশিদ।
রথি এবার পুরোপুরিভাবে নাশিদের দিকে তাকাতেই রথি আঁতকে উঠলো। চরম রেগে আছে সে, যা দেখে রথি তার হুঁশে ফেরে। আয়হায়! কী বলতে কী বলে ফেলেছে সে? নাশিদের সঙ্গে তো সে কখনোই এমন ব্যবহার করেনি, তাহলে আজ কোন ভূত তার মস্তিষ্কে ভর করলো? রথি কিছুটা বিব্রতবোধ নিয়ে দৃষ্টিনত করে ফেললো এবং চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো সিটে গিয়ে বসলো। নাফিসা এবং নাশিদ দুজনেই চমকে গেলো রথির হঠাৎ চুপ হওয়া দেখে। তবে যাই হোক, নাফিসা নিরব দর্শকের মতো ওদের ঝগড়াটা বেশ উপভোগ করেছে। কে জানতো, কোনো এক সময় ওদের ঝগড়াও সে নিজ চোখে দেখতে পারবে?
নাশিদ এবার নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘এখন তোর কান ধরে গাড়িতে উঠাতে হবে?’
ভাইয়ের মেজাজ দেখে নাফিসাও বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে উঠে বসলো। ও উঠতেই নাশিদও উঠে বসলো। নাশিদ এবং নাফিসা ঘুরতে বেরিয়েছিলো কিন্তু ব্রিজে ওদের একসঙ্গে দেখে নাশিদই নাফিসাকে বলে রথিকে আনিয়েছে। নাফিসা ভাইয়ের ভাব-গতিক বুঝলেও মুখে কিছু বলে না। থাকুক না আড়ালে নাশিদের এই স্বচ্ছ অনুভূতিগুলো!!
গাড়িতে উঠতেই যখন গাড়ি স্টার্ট দিবে তখনই আবারও নাশিদ ঠ্যাস মেরে রথিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘তোর বান্ধুবিকে বল যেন সিটবেল্টটা বেঁধে নেয়। নয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাকে দিয়েই উপরমহল ওনার পোস্টমর্টেম করাবে!’
রথি এবার তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নাশিদের দিকে। কিন্তু আফসোস রথির দৃষ্টি দেখলো না নাশিদ। পেছন থেকে নাফিসার হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে। রথি চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
-‘আমার সিটবেল্ট বাঁধলে দম আটকে আসে। তাই আমি সিটবেল্ট বাঁধবো না। আর দুর্ঘটনা ঘটলে তো আপনারই লাভ! আপনার ওই আগুনে গোলার ন্যায় রাগটা আমায় পোস্টমর্টেম করে কমাবেন!’
রথির কথাগুলোতে নাশিদের ভেতরটা ধক করে উঠলো। তীব্র একটি যন্ত্রণা অনুভব করছে সে। নিজেকে খানিক সামলে সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রথি আর কিছু বলে না। জানালার বাইরে তাকিয়ে আজ সারাদিনে নাশিদের করা ব্যবহারগুলো এক এক করে মনে করতে লাগলো। নাশিদের ব্যবহার হঠাৎ পাল্টে যাওয়া, বিষয়টি তাকে ভীষণরকম ভাবাচ্ছে।
নাশিদ ইয়া বড় শপিংমলের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো। এতক্ষণে মাগরিবের আযান দিয়েছে। রথি তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়না দেয় যেটা নাশিদের চোখ এড়াইনি। এই দৃশ্যটি সে তার নজর বন্দি করে রাখলো। নাশিদ ওদের সঙ্গে শপিংমলে ঢুকলো না। নাফিসা রথিকে নিয়ে নিজের মনমতো শপিং করে তবেই ফিরলো। পরশু প্রোগ্রাম, সেই নিয়েই শপিং।
নাফিসা অবশ্য রথিকে একজোড়া ঝুমকা আর নীল চুড়ি উপহার দিয়েছে। রথি কোনক্রমেই নিতেই চায়নি কিন্তু নাফিসার জেদের কাছে হার মেনে নিতে বাধ্য হয়। তবে রথিও নাফিসাকে এক জোড়া দুল উপহার দিয়েছে। নাফিসা এবং রথি আসলে নাশিদ গাড়ি স্টার্ট দেয় এবং রথিকে তার বাসায় ড্রপ করে দিয়ে চলে যায়। রথি ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
কোনো ছেলের গাড়ি থেকে রথিকে নামতে দেখে ফেলে শামুন। সে হাত দুটি মুঠ করে রাগে সাপের ন্যায় ফোঁসফোঁস কররে লাগে।
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ আগামীকাল ইনশাল্লাহ, প্রোগ্রাম স্পেশাল পর্ব আসবে৷ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। আর দয়া করে কেউ ছোট পর্ব বলবেন না। যথেষ্ট বড়ো করেই দেই আমি!🙂#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৩ |
আজ শনিবার। প্রোগ্রামের দিন। অন্যান্য দিনেই মতোই আজও গরমের উত্তাপ বেশি। সূর্য পশ্চিমে হেলে পরেছে ঘন্টাখানেক হলো। রথি মাগরিবের নামাজ শেষ করে রেডি হতে লাগলো। লং নীল জামা, কানে ঝুমকা, হাতে নীল চুড়ি। সিল্কি চুলগুলো পিঠে ছেড়ে দিয়েছে। রথির আবার বড় চুলের সখ নেই তাই তার চুলগুলো কোমড় অবধিই সীমাবদ্ধ। সাজগোজ বলতে কিছুই করলো না। শুধু মাশকারা আর গালে হালকা করে লাল আভা ফুটালো, আইশেড দিয়ে। এই ব্লাশিংটা রথির বেশ পছন্দ। তার উজ্জ্বল ফর্সা গাল দুটোতে একটু বেশিই স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। এবার লাস্ট ঠোঁটে মেরিল দিয়ে ওড়নাটি গায়ে জড়িয়ে নেয়। একদম পারফেক্ট লাগছে রথিকে। রথি মোবাইলের টাইম দেখে বুঝলো বড্ড দেরী করে ফেলেছে সে। জলদি ব্যাগে ফোন ঢুকিয়ে মাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরে।
আবির তখনই সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসছিলো কিন্তু রথির এমন ছুটে যাওয়া দেখে কৌতুহলবশত সেও রথির পিছু নেয়৷ নিচে গিয়ে দেখলো এক গাড়ি ওদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আর সেটা থেকেই শাড়ি পরিহিত নাফিসা বেরিয়ে আসছে। নাফিসাকে দেখে আবির পূর্বের ন্যায় আবারও হিতাহিত জ্ঞান হারানোর অবস্থা। সে রথিকে পিছু ডাকলো। রথি থেমে ভ্রু কুচকে পিছে ফিরলো। আবির লম্বা লম্বা পা ফেলে অস্ফুট সুরে বলে,
-‘কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে সেখানে!’
বলেই রথি এগোতে শুরু করলো। আবির কী যেন একটা ভেবে সেও রথির পিছে ছুটতে ছুটতে জোরে বলে উঠে,
-‘দাঁড়ান আমিও যাবো।’
নাশিদ ড্রাইভিং সিটে বিসে অপেক্ষা করছে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটির জন্য। স্টেয়ারিং এ আঙুল চালাতে চালাতে ঘাড় বাঁকিয়ে গেটের দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি থমকে গেলো। ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়াম আলোতে এই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে একটু বেশিই অপরূপ লাগছে। চিকন গোলাপী ঠোঁটের হাসিটা যেন আরও স্নিগ্ধ! নাশিদ কাঁচের ভেতর দিয়ে হা করে রথিকে দেখছে। নীলে বুঝি কাউকে এতটা সুন্দর লাগে? জানা নেই নাশিদের।
যেই ছেলে কখনো কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত সেই ছেলের মাথায় একটি মেয়েকে দেখার জন্য এতটা জঘন্য বেহায়াপনা জম্মেছে কে জানতো? নাশিদের যখনই এই বিষয়টি মাথায় আসলো সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। কোণা চোখে আরেকবার তাকাতেই পেছনে আবিরকে দেখলো যার ফলে সে আবারও রেগে গেলো।
-‘ইউ আর লুকিং সো প্রিটি, নাফিসা!’
রথির সঙ্গে নাফিসা কথা বলছিলো। হুট করে আবিরের কন্ঠস্বর শুনে নাফিসা কিছুটা চমকে আবিরের দিকে তাকালো। অতঃপর নিজেকে সামলে হাসার চেষ্টা করে বললো,
-‘ধ.. ধন্যবাদ।’
নাশিদ এবার তাড়া দিয়ে বললো,’আর কতক্ষণ লাগবে নাফিসা? দেরী হচ্ছে তো?’
রথি থতমত খেয়ে ড্রাইভিং সিটে তাকালো। এ যে পুলিশম্যান! ব্যাপার কী, ইদানীং থানায় না গিয়ে বোনেএ পিছে ঘুরছে? রথি ফিসফিস করে নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তোর ভাইও যাবে নাকি?’
-‘হ্যাঁ! মা আমায় একা ছাড়ার মানুষ নয়!’
রথি মুখ বাঁকালো। এবার নাফিসা আড়চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই বান্দা এখানে কেন? যাচ্ছে না কেন চোখের সামনে থেকে?’
-‘আমাদের সঙ্গে যাবে! তুই এক কাজ কর, তুই গাড়ি করে যা আমি আবিরের সাথে ভার্সিটি যাচ্ছি!’
রথির মুখে ‘আবির’ নামটা শুনে নাশিদ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। নাশিদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
-‘নাফিসা! ওকে বলে দে, কষ্ট করে এসেছি তার এসব ফুটন্ত বাণী শোনার জন্যে নয়। আসলে আসতে বল নয়তো বাসায় গিয়ে ঘুমাতে বল!’
রথি চোখ গরম করে তাকালেও সে এবার ইচ্ছে করেই পেছনের সিটের দিকে যেতে লাগলো। নাফিসা রথির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরে সামনের সিটে…!’
রথি থামিয়ে দিলো এবং হুড়মুড়িয়ে দরজা খুলতে নিতেই নাশিদ গাড়ি থেকে নেমে পেছন সিটের দরজা লাগিয়ে দেয়। রথি নাশিদের দিকে না তাকিয়ে আবারও খুলতে গেলে সে ব্যর্থ হয়। রথি নাশিদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বললো,
-‘সমস্যা কী আপনার?’
-‘সামনে বসো!’
-‘নাফিসাকে বলুন না, আমার পিছে কেন পরেছেন?’
এবার আবির যেন নড়েচড়ে দাঁড়ায় এবং রথির উদ্দেশ্যে বললো, ‘ভাইয়া যেহেতু এতো করে বলছেন, সামনে বসে পরুন। দেরী হচ্ছে তো!’
রথি যখন বুঝলো আর কোনো উপায় নেই সে নাশিদকে চোখ রাঙানি দিয়ে ধপ ধপ পা ফেলে সামনের দরজা খুলে চলে গেলো। রথির চোখের কোণ ভিঁজে আছে। নাশিদ উঠে বসার আগেই রথি চোখের পানি মুছে ফেললো। নাশিদের এই ব্যবহারটা রথি কেন যেন মানতে পারছে না। তার ওই শান্ত-শিষ্ট নাশিদকে প্রয়োজন।
এদিকে নাফিসা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসলো, সাথে আবিরও। আবির তো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। আবির উঠে বসতেই নাশিদ ড্রাইভিং সিটে বসে একপলক রথির দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। রথি যে রাগ করে আছে বেশ ভালো করেই বুঝলো। হুহ, এতোই যেহেতু রাগ তাহলে ওই ছেলেকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কিসের? ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভিং এ মন দিলো। রথি আড়চোখে একবার পাশের মানুষটিকে দেখে নিলো।
নাশিদকে পাঞ্জাবিতে সবে খেয়াল করলো সে। কালো পাঞ্জাবিতে বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। কিন্তু লোকটার রাগ যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে। না জানি কোন অপরাধীর রাগ রথির উপর দিয়ে ফলাচ্ছে। লোকে হয়তো ঠিকই বলে, সুন্দর মানুষের রাগ আজীবন নাকের ডগায় থাকে। যখন তখন মাথা চড়ে বসে। বিরক্তিকর রোগ!
রথি গোল গোল চোখে যে নাশিদকেই দেখছে তা নাশিদ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তবে এখন কিছু বললো না সে, সঠিক সময়ের অপেক্ষায় রইলো।
পিছে আরেক কাপলের দিকে ওদের খেয়াল নেই। আবির মুগ্ধ নয়নে নাফিসাকে দেখতে ব্যস্ত আর নাফিসা বাইরের শহরটা দেখতে ব্যস্ত। নাফিসার বড্ড অস্বস্তি লাগছে এই আবির নামক ছেলেটিকে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পারছে না। তবে সে এতটুকু বুঝতে পেরেছে আবির আর যাই হোক রথিকে পছন্দ করে না। দ্যাট মিন তার ভাইয়ের কাঁধ থেকে এক বোঝা নামলেও সেই বোঝাটা ডিরেক্ট তার ঘাড়ে আক্রমণ করেছে। নাফিসা তপ্তশ্বাস ফেললো।
আধঘন্টার মধ্যে ওরা প্রোগ্রামে এসে পৌঁছালো। বেশ হৈ-হুল্লোড় হচ্ছে যা বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। গেটে ওদের নামিয়ে নাশিদ গাড়ি নিয়ে পার্কিংলটে চলে গেলো। তিনজন একসাথে প্রবেশ করলেও দারুণ ভীড়ে ২জন একদিকে আর রথি আরেকদিকে চলে গেলো। রথি পাশে তাকিয়ে দেখে নাফিসা আর আবির নেই। সে এক্সকিউজ মি বলে বলে এদিক সেদিক যেতে নিতেই হাতে কারো ঠান্ডা স্পর্শ টের পেলো যার ফলে রথি খানিক কেঁপে উঠলো। কম্পিত ঠোঁটজোড়া ভিঁজিয়ে পিছে ফিরতেই দেখলো নাশিদ তার হাত ধরে তারই পানে তাকিয়ে রয়। রথি চোখ নামিয়ে ফেলে। নাশিদের এই দৃষ্টি তাকে মুহূর্তের মাঝে ছাড়খাড় করে দিতে সক্ষম। রথির ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে নাশিদ বললো,
-‘ভালো স্থানে না গিয়ে এই ভীড়ে কী করছো? আমার সাথে এসো!’
বলেই হাত ধরে ভীড় থেকে বের করে নিয়ে আসলো আমায়। ভীড় থেকে বের হতেই রথি আস্তে করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। রথির কান্ডে নাশিদ রথির দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বললো,
-‘খারাপ উদ্দেশ্য নেই আমার। জাস্ট ভীড়ের মাঝে যেন হারিয়ে না যাও সেজন্য ধরেছি!’
-‘বুঝেছি।’
বলেই অদূরের স্টেজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভার্সিটির এক প্রফেসর হোস্টিং করে এক স্টুডেন্টকে গান গাওয়ার উদ্দেশ্যে স্টেজে যেতে বলছে। নাশিদ কোথা থেকে চেয়ার জোগার করে আনলো। আমাকে একটি চেয়ার দিয়ে বললো,
-‘বসে উপভোগ করো!’ বলতে বলতেই নিজের চেয়ারে বসে পরলো। রথি বলে উঠলো,
-‘বসলে দেখতে পাবো না।’
নাশিদ রথির হাত ধরে বসিয়ে বামপাশে ইশারা করলো। সেখানে বড় একটি পর্দায় স্টেজ সরাসরি দেখা যাচ্ছে। যাক, স্যারদের সুবুদ্ধি হয়েছে। আমি আয়েশ করে বসে ওই পর্দাতেই তাকিয়ে রইলাম। তবে সেখানে তেমন একটা মনোযোগ যাচ্ছে না। তার মনোযোগ যে পাশের মানুষটির উপর। বিশ্বাস হচ্ছে না তারা পাশাপাশি বসে আছে। গাড়িতে সামান্য দূরত্ব থাকলেও এখানে নেই। দুটো চেয়ারই পাশাপাশি।
-‘আই নো আমি সুন্দর! এভাবে চোখ গিয়ে গিলে খাচ্ছো কেন? লুক এট দ্য স্ক্রিন!’
রথি চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় ইচ্ছে করছে মাটির সাথে মিশে যেতে। এমন একটা সময়ে নাশিদ এভাবে এরকম লজ্জাজনক একটা কথা বলবে রথি ভাবতেও পারেনি। তবে রথি এটা বেশ বুঝেছে, নাশিদ গম্ভীর হলেও হুটহাট লাগামছাড়া কথা বলে ফেলে। এই নাশিদের বহুরূপী রূপ মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মতো।
রথি সেই ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে প্রোগ্রাম দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। হুট করে তার নাফিসার কথা মনে পরলো। নাফিসা আর আবির কোথায় হারিয়ে গেলো?
রথি উপায় না পেয়ে নাশিদকে বললো,
-‘নাফিসা আর আবির কোথায়? ভীড়ের মাঝে যে হারিয়ে গেলো খবর নেই!’
নাশিদ এক পায়ে আরেক পা উঠিয়ে চেয়ারের সঙ্গে হেলান দিয়ে এক হাতে ফোন দেখছিলো। রথির প্রশ্নে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়েই বললো,
-‘আছে আশেপাশে। চিন্তা করিও না!’
রথি এবার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে নাশিদের দিকে তাকালো। আশেপাশে চোখ দিতেই দেখলো অনেক মেয়েরা নাশিদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছে। এই চাহনির ভাষা রথির অজানা নয়। সে মুখ বাঁকিয়ে পর্দায় মন দিলো। আধঘন্টা বাদেই নাফিসা নাশিদকে কল করলো স্টেজের দিকে যাওয়ার জন্য। নাশিদ আবারও রথির হাত ধরে সাইডের উঁচু নিচু ইট-পাথরের পথ দিয়ে যেতে লাগলো। এই পথে মানুষজন কম। রথির কেমন অস্বস্তি লাগছে নাশিদের হাতের স্পর্শটা। তাই সে নাশিদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়েই হাঁটতে লাগে। কিন্তু এখানেই ঘটে যায় বিপত্তি। রথি পা মচকে পথে পরে গেলো। রথির আর্তনাদ শুনে নাশিদ চটজলদি পিছে ফিরে দেখলো রথি পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে। নাশিদ একপ্রকার ছুটে রথির কাছে আসলো। রথির পায়ে হাত দিতেই রথি আবারও চিৎকার করে উঠলো।
-‘ঘটলো তো অঘটন? হাত ছেড়ে এতো টইটই করো কেন তুমি? তোমার হাত কী আমি খেয়ে ফেলবো?’
ধমকের সুরে বললো নাশিদ। ব্যথার মাঝে রথি ঠোঁট উল্টে বসে আছে সে। কই এডভাইস দিবে তা না ধমকাচ্ছে। হিটলার একটা। রথিকে চুপ করে থাকতে দেখে নাশিদ এবার থমথমে গলায় বললো,
-‘পায়ে কীরূপ ব্যথা পাইসো সেটা আগে বলো?’
-‘মচকে গেছে!’
-‘ওহ গড!’ বলেই নাশিদ উঠে দাঁড়ালো। এক হাত কোমড়ে, আরেক হাত তার কপালে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট! রথি আগের মতোই গোমড়ামুখো হয়ে বসে আছে। নাশিদ মাথা নিচু করে রথির দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘উঠছো না কেন? সারারাত দিন কী এভাবেই বসে থাকবা?’
-‘উঠতেই তো পারছি না আমি।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো। নাশিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নাফিসাকে কল করে ওদের লোকেশন জানালো।
কিছুক্ষণ বাদে ওরা আসতেই রথির পা মচকানো সম্পর্কে নাশিদ সবটা খুলে বললো। নাফিসা মুখে হাত দিয়ে বলে,
-‘এখন বাসায় যাবি কী করে? এদিকে তো রাতও হয়ে যাচ্ছে!’
রথি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নত করে বসে রইলো। যখনই কোনকিছু নিয়ে উত্তেজনা থাকে তখনই কিছু না কিছু বিপত্তি ঘটে। কেন তার সাথেই এমন হয়? হুট করে রথির ভাবনার মাঝেই নাশিদ রথিকে কোলে তুলে নিলো। রথি আচমকা ঘাবড়ে নাশিদের পাঞ্জাবির কলার খামচে ধরলো। চোখ যেন তার বেরিয়ে আসার উপক্রম। নাফিসা এবং আবিরও অবাকের শেষ পর্যায়। আশেপাশের অনেকেই হা করে এদিকেই তাকিয়ে আছে। রথি যেন স্বপ্ন দেখছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রথি বললো,
-‘ক..কী করছেন? আশেপাশে মা…’
-‘তো কী এখানে বসিয়ে রাখবো? কোনো ওয়ে নেই, বাসায় যেতে হবে!’
বলেই নাশিদ রথিকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। তার দৃষ্টি শান্ত। রথি তখনো হা করে নাশিদকে দেখছে৷ আনএক্সেপ্টেড কিছু ঘটলে সেই ঘোর যে এতো সহজে কাটে না।
রথিকে গাড়িতে বসিয়ে নাশিদ নিজেই সিটবেল্ট বেঁধে দেয় এবং থমথমে গলায় বললো,
-‘সিটবেল্টটা তোমার গলায় লাগায় না যে তোমার দম বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এসব রং ঢং বাদ দেও।’
বলেই দরজা লাগিয়ে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলো। তখনো রথির ঘোর কাটেনি। নাশিদ উঠে বসতে বসতে নাফিসা এবং আবিরও উঠে বসলো। রথির বাসায় সামনে আসতেই ওরা নেমে যায়। ওরা নামতেই নাশিদ রথির পা টেনে নিজের হাঁটুর উপর রাখলো। রথি অস্ফুট সুরে বললো,
-‘কী করছেন কী?’
রথির কথায় নাশিদ কোনরকম পতিক্রিয়া না করে রথি পা উল্টো করে মচকে দেয়। রথি আবারও চিৎকার করে উঠে ব্যথায়। নাশিদ পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘এবার ঠিক আছে। এখন আমার কোলে করে দিয়ে আসা লাগবে না!’
রথি চোখ গরম করে বললো, ‘আমি বুঝি বসে আছি আপনার কোলে ওঠার জন্য? যত্তোসব। নাফিসা, আমায় হেল্প কর বাসায় দিয়ে আসতে!’
রথির কথামতোন নাফিসা ওকে ধরে বের করলো। রথি নাফিসার কাঁধে এক হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে চলতে লাগলো। রথিকে নাফিসা বাসা অবধি পৌঁছে দিতেই মার্জান জানালার পর্দার আড়াল থেকে নিচে দাঁড়ানো নাশিদকে আবছা দেখে নিলো। এটা কী রথির ঘনিষ্ঠ কেউ নাকি ওর বান্ধুবির কেউ? এই প্রশ্নটিই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৪ |
আবির’রা চলে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। ওরা চলে যেতেই মার্জান এবং রথির মধ্যে ভয়ানক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ভয়ানক বলতে মাত্রাতিরিক্ত ভয়াবহ। তাতানকেও হোস্টেল পাঠানো হয়েছে। এই দ্বন্দ্বের কারণ বাড়িতে থাকা নিয়ে। রথির মা রথিকে অনেক বুঝিয়েছে সে ওখানে চলে যাবে কিন্তু রথি অমত জানায়। সে বারংবার তার মাকে এটাই বলে,
-‘কেন মা? এই বাড়ি তোমার, আমি জানি! এই ভাবী জাস্ট নকল কাগজ দেখাচ্ছে তোমাকে। বিশ্বাস না হলে আমি এটা খুব শীঘ্রই প্রমাণ করবো!’
বলেই রথি হনহন করে বেরিয়ে যায়। এদিকে রথির মা এসব সহ্য করতে পারেন না, তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। সাইফ তখনই বাড়ি ফিরে৷ মাকে পরে যেতে দেখে সাইফ দ্রুত এগিয়ে যায় মায়ের দিকে। মার্জান রথির মাকে ধরতে গেলে সাইফ চোখ গরম করে থামিয়ে দেয়। থমথমে গলায় বলে,
-‘খবরদার তুমি আমার মাকে ছুঁবে না! আজ যদি আমার মায়ের কিছু হয়, তোমার বাপ-চাচা, তাতান কিছুই মানবো না!’
বলেই আমেনার সাহায্যে মাকে ভেতরের রুমে নিয়ে গেলো। এদিকে মার্জান বারংবার ঘেমে একাকার হচ্ছে। নাহ জলদি কিছু একটা করতে হবে নয়তো সে সব খুইয়ে ফেলবে সব!
রাত নয়টা। বাইরে তীব্র বাতাস চারপাশে ধুলোময় করে ফেলেছে। মানুষের চোখ-মুখে ধুলো-বালি ঢিকে যা তা অবস্থা। এই অবস্থা দেখে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না ঝড়-বৃষ্টি হবে। তাই সে তার হাতের ফাইলটি রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার দিকে যেতেই দেখলো বাইরে ঠিক তার জানালার পাশে রথি দাঁড়িয়ে। তার মাথা নিচু এবং হাতদুটোও মুঠ করে রেখেছে। রথিকে দেখে নাশিদ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। মৃদু সুরে রথিকে ডাকলো। কিন্তু রথি ভাবলেশহীন, এক চুলও নড়লো না। নাশিদ আবারও ডাকলো। আবারও। কিন্তু রথির কানে ডাকটি প্রবেশ করলো না। নাশিদ উপায় না পেয়ে থানা থেকে বেরিয়ে রথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কী হলো, এতবার ডাকছি শুনতে পাও না!’
রথি এবার খানিক নাক টানলো। সেই শব্দে নাশিদের বুঝতে বাকি রইলো না রথি কাঁদছে। নাশিদ খানিকটা বিচলিত হয়ে পরলো। এদিকে ঝড় আসবে আসবে ভাব হলেও এখন পরিবেশ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।
নাশিদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই রথি দু পা এগিয়ে নাশিদের ডান বাহুতে আলতো মাথা ঠেকিয়ে
ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘একান্ত সময় চাই!’
রথির এরূপ আবদার নাশিদকে বিষম খাওয়ালো। তবে নাশিদ রথির আবদার ফেলতে পারলো না। নাশিদ রথির উদ্দেশ্যে বলে,
-‘এখানে থাকবে নাকি অন্য কোথাও যেতে চাও!’
-‘** হোস্টেল যেতে চাই। আমার তাতানের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন নাশিদ সাহেব?’
নাশিদ এ মুহূর্তে বুঝলো না এই তাতান কে? তবে রথি যেই হোস্টেলের কথা বললো ওটার ৮০% ই বাচ্চারা। এর মানে কী কোনো বাচ্চা? তবে নাশিদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো না। সে রথির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘ঠিক আছে, তুমি অপেক্ষা করো। আমি আসছি!’
বলেই নাশিদ রথিকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে চলে গেলো। এতক্ষণে রথিও চোখ মুখে ফেললো। নাশিদ আসতেই রথিকে গাড়িতে উঠতে বললে রথি নাশিদকে থামিয়ে বলে,
-‘আমি রিক্সা করে যাবো৷ এই গাড়ি টাড়িতে বিরক্ত হয়ে গেছি।’
এবারও নাশিদ রথির কথার অমত করলো না। কেন যেন রথির এই আবদার গুলো সে ফেলতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণটার উত্তর নাশিদের জানা নেই। নাশিদ কথা না বাড়িয়ে রথির সঙ্গে যেতে লাগলো কিন্তু আফসোস কোনো রিকশা নেই। নাশিদের মাথায় এই ঢুকছে না রথি কেন রাত করে বাসা থেকে বেরিয়ে তারই থানার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো? নাশিদ রথিকে প্রশ্ন করবে তখনই রথি বললো,
-‘নাশিদ সাহেব, ওইযে রিকশা!’
নাশিদ আর প্রশ্ন করতে পারলো না। রিকশা ডেকে দুজনেই উঠে বসলো। নাশিদ আজ ইউনিফর্ম পরেনি, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।
রথি এবং নাশিদ পাশাপাশি একই রিকশায় বসা। এই অনুভূতি যেন প্রকাশ করার মতো নয়। রথি মনোযোগ দিয়ে এই মুহূর্তটি উপভোগ করছে আর নাশিদ নিজেকে বিভিন্ন প্রশ্নে গুলিয়ে ফেলছে। এই মানুষটা তার পাশে থাকলে রথি যেন চোখ বুজে সব ধরণের বিপদ অতিক্রম করতে পারে। হ্যাঁ এতোটাই জায়গা করে নিয়েছে সে রথির মনগহ্বরে। রিকশায় তাদের নিরবতাই চললো, কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহসটা জোগাতে পারলো না।
নাশিদ ভাড়া মেটাতে গেলে রথি তাকে থামালো। অতঃপর থমথমে গলায় বললো,
-‘ভাড়া দুজন মিলিয়ে ঝিলিয়ে দেয়াটাই ঠিক মনে করি!’
নাশিদ এবার রথির কথায় পাত্তা দিলো না। একপ্রকার জোর করে নিজেই ভাড়া দিলো যার কারণে খানিক মন খারাপ হলো। অতঃপর নাশিদ দারোয়ানকে বলে ভেতরে ঢুকলো। রিসিপশনে গিয়ে মেয়েটাকে তাতানের নাম, ক্লাস বলতেই মেয়েটি তাতানকে এখানে আনার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে তাতান আসলো। নাশিদ রিসিপশনের মেয়েটিকে বলে তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে আসলো।
রথি তো তাতানকে নিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তার সবকিছু এখন মরিচিকার মতো লাগছে। ভেতরটায় কেমন তুফান হচ্ছে। নাশিদ স্থির দৃষ্টিতে রথির কান্না দেখছে। তার সহ্য হচ্ছে না রথির চোখের জল, তাই সে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ালো।
—————————–
-‘আপনার ননদ তো ভালোই বড়লোকী পোলার লগে ঘুরে বেড়ায়! আমি যখন বললাম আমার হাতে ওরে তুলে দিতে তখন কেন দিলেন না?’
মার্জান খানিক আতকে উঠলো শামুনের জোড়ালো কন্ঠস্বরে। মার্জান কখনোই এই শামুনের হাতে রথিকে তুলে দেবে না। শামুন মারাত্মক খারাপ যা মার্জানের অজানা নয়। হয়তো মার্জান ওদের সহ্য করতে পারে না তাই বলে এই না যে সে রথির খারাপ চায়। মার্জান ভাবনা ছেড়ে থমথমে বলায় বললো,
-‘যা সম্ভব না, তা নিয়ে কথা বলতে আসবে না। নিষেধ করিনি?’
শামুন চোখ গরম করে মার্জানের দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করতে বলে,
-‘আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করছি এখন তবে! (কিছুটা থেমে) রথিকে না পেলে আমি সব তছনছ করে দিবো, এমনকি আপনাকেও!’
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। এখন মার্জানের মাথায় হাত। সে কী করবে এখন? নাহ কোনো না কোনো সলিউশন তাকে বের করতেই হবে।
রথি কোচিং থেকে ফেরার সময় থানায় উঁকি দিতে দিতেই যাচ্ছিলো তখনই কারো সাথে সজোরে ধাক্কা খায়। রথি মাথা উঁচু করে সামনে তাকাতেই আঁতকে উঠলো কারণ তার সামনে নাশিদ ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে। নাশিদকে দেখে রথি একটি শুকনো ঢোঁক গিললো। এর মানে কী সে ধরা পরে গেলো? নাশিদ একইভাবে ভ্রু কুচকে বললো,
-‘যেভাবে আজ উঁকি দিতে দিতে যাচ্ছিলে, এই উঁকি দেয়া কী রোজ চলে?’
নাশিদের এরূপ কথায় রথি লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হতে শুরু করলো। এরকম কিছু হবে কে জানতো? কী লজ্জা, কী লজ্জা!
নাশিদ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রথির কান্ড দেখছে। রথি এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলো না। সে নাশিদকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত দৌড়ে চলে গেলো। নাশিদের এই দৃষ্টি রথির সহ্য করার ক্ষমতা নেই, একদমই নেই। নাশিদ পিছে ঘুরে রথির ছুটে যাওয়া দেখছে৷ কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে আপনমনে হেসে উঠলো। থানার সামনে নাশিদকে একা একা হাসতে দেখে নয়ন ভ্রু কুচকালো। সে নাশিদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-‘কী ব্যাপার স্যার, এভাবে হাসছেন কেন?’
-‘কিছু না, মিশনে চলো৷ দেরী হচ্ছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে থানায় ঢুকে একটা ব্যাগ এনে নাশিদের সঙ্গে তাদের মিশনে রওনা হলো। আজকের মিশনটা কিছু মহিলাকে কয়েকটি বেআইনি হোটেল থেকে উদ্ধার করা।
রথি ছুটে বাসায় আসতেই চমকে উঠে। মার্জান এবং তার মা হেসে হেসে কথা বলছে। রথিকে মার্জান দেখতেই মুচকি হেসে রথির মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তাহলে আমি রথিকে নিয়ে কালই গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। কী বলেন মা? বিকালে সাইফকে দিয়ে তাতানকেও নিয়ে আসবো, একবারের জন্য।’
মা যেন অনেকটা খুশি হলেন। আর রথি? সে তো মার্জানের কথার আগা-মুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজ লেখার মানসিকতা একদমই ছিলো না, তাও আপনাদের এতো এতো অনুরোধে বাধ্য হলাম। জানি না খাপছাড়া হয়েছে কি না তাও আপনাদের কাছে গঠনমূলক মন্তব্য চাইছি। আজ অনেকটা ঝামেলা নিয়ে লিখেছি তাই আশা করছি আমায় নিরাশ করবেন না। আসসালামু আলাইকুম।#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৫ |
আবছা অন্ধকার ঘরের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে হাঁটুতে মুখ গুঁজে আপনমনে ফুঁপিয়ে চলেছে রথি। তার আঁখিপল্লব অশ্রুসিক্ত! সে একমনে কাঁদছে। রথির ভাবী কিছুক্ষণ আগেই তাকে এই ঘরে বন্দি করে গেছে। রথি এখন গাজীপুরে আবিরের ফ্ল্যাটে আছে। এখানে ঘরোয়াভাবে রথি এবং আবিরের বিয়ের ব্যবস্থা করেছে চাচী আর ভাবী।
বিয়ের কথা শুনতেই রথির কেমন সব ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। কোনো এক জায়গা থেকে কেউ চিৎকার করে বলছিলো এই বিয়ে করলে তুই ভালো থাকবি না, কারণ তুই অন্যকাউকে ভালোবাসিস। তাকেই তোর লাগবে। রথি অমত জানায় সে বিয়ে করবে না এবং সে এই মুহূর্তে বাড়ি চলে যাবে!
এই কথা শুনতেই ভাবী জোর করে তাকে বদ্ধ ঘরে বন্ধ করে দেয়, রথির ফোনটাও সুইচড অফ করে নিজের কাছে রেখে দেয়। এই বদ্ধ ঘরে বন্দি হতেই রথি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলো তার নাশিদকে প্রয়োজন। নাশিদ তার প্রিয়জন, সে ছাড়া অন্য কাউকে কখনোই মেনে নিতে পারবে না।
জীবনটা কীভাবে যেন নতুন ঝামেলায় মোড় নেয়। একে একে বুঝতে পারলো তার ভাবী কেন একান্তই তাকে নিয়ে এই গাজীপুরে এসেছে। রথি তার ভাবীর প্রতি ঘৃণায় নাক সিটকালো। এই মানুষটাকে সে কোনোদিনও ক্ষমা করবে না।
কিছুক্ষণ বাদে হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মার্জান। রথির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে শুধুমাত্র নাশিদ এবং নাশিদের স্মৃতিগুলো ভাবতে মগ্ন। মার্জান পা ভেঙ্গে ফ্লোরে বসে খাবার এগিয়ে শক্ত গলায় বললো,
-‘খাবারটা খেয়ে নে!’
-‘খাবো না, চলে যাও এখান থেকে।’
মার্জান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেঝেতে প্লেটটা রেখে খুবই শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
-‘দেখ রথি, আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি রাজি হয়ে যা। আবির ভালো ছেলে, তোকে ভালো রাখবে!’
-‘আমার তোমার ভালোর প্রয়োজন নেই? তুমি যাবে?’
চিৎকার করে বললো রথি। মার্জান আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু রথি মার্জানের কোনো কথাই কানে নেয়নি। মার্জান নিরাশ হয়ে তপ্তশ্বাস ফেললো। অতঃপর খাবার রেখেই চলে গেলো। রথি এখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
তার মধ্যে চলছে চরম হাহাকার, মারাত্মক হাহাকার। কেন সে বুঝতে দেরী করলো, নাশিদকে সে একান্ত ভাবে চায়? কেন আগে উপলব্ধি করেনি? এমন হবে জানলে সে আগেই নাশিদকে তার জীবনে প্রবেশ করাতো। সব তো ঠিকই ছিলো তাহলে কেন সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো?
নাশিদের মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভাসছে আর প্রতিনিয়ত ভেতরটা পুড়ছে, ভয়াবহভাবে।
রথির কাঁদতে কাঁদতে পুরোটা দিন চলে গেলো। খাবারটা আগের জায়গাতেই পরে রইলো।
সন্ধ্যায় মার্জান যখন চাচীর কাজে হাত লাগাতে ব্যস্ত তাতান তখন চুপিচুপি রুমে গিয়ে রথির ফোনটা নিয়ে অন করলো। অতঃপর ডায়াল লিস্টে ‘পুলিশম্যান’ নামটা দেখে তাতান কিছু না ভেবেই সেই নম্বরে কল দিলো। দুই তিনবার রিং হতেই তাতান চটজলদি বলতে লাগলো,
-‘আমার ফুপ্পিকে ওরা জোর করে বিয়ে দিচ্ছে, আমার ফুপ্পি অনেক কান্না করছে!’
বাকি কথা বলার আগেই তাতান তার মায়ের আসার শব্দ পেলো। সে জলদি কল কেটে ফোন বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিলো।
রাতে ভাবী আরেক দফা খাবার দিতে এসে দেখে রথি আগের খাবারই খায়নি। ভাবী তপ্তশ্বাস ফেলে খাবারটা দিয়েই চলে গেলো। আগের খাবারটা সে সঙ্গে করে নিয়ে গেলো। রথি খাবারের দিকে একমনে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আপনমনে বলে উঠলো,
-‘যেখানে মনের সুখ নেই সেখানে এই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না গো ভাবী! নাশিদ আপনি কোথায়? আমার কথা কী একটু মনে পরছে না? একটু আমার বাসায় গিয়ে আমার খবরটা নিয়ে আসুন। পারছি না আর! পুরো একটা দিন কেটে গেলো! এর মানে কী আবিরকে আমার…’
আর ভাবতে পারলো না রথি, কেঁদে উঠলো। আজ যদি বাবা থাকতো তাহলে হয়তো এমন কিছু হতো না। বাবা থাকলে হয়তো কারো এসব করার স্পর্ধাও হতো না। এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতেই রথি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলো।
মাঝরাতে হঠাৎ খট করে দরজা খোলার শব্দ পেলো। সেই শব্দতেই রথির ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে তাকাতেই কোনো মানুষের অবয়ব দেখতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গেই রথির ঘুম পুরোপুরিভাবে কেটে গেলো। রথি চোখ গোলগোল করে অবয়বটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। অবয়বটি ধীরে ধীরে রথির দিকে এগিয়ে আসছে। রথি যেই চিৎকার দিবে অবয়বটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘চেঁচাবেন না। আমি আবির!’
কন্ঠস্বর শুনে রথি শান্ত হলেও পরবর্তীতে দ্বিধা তৈরি হলো তার। আবির এতো রাতে এই রুমে কেন এসেছে? আবিরের খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? রথি কাঁপা গলায় বলে,
-‘কেন এসেছেন এই অসময়ে?’
-‘ভয় পাবেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি!’
-‘সাহায্য? কিসের?’
আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। অতঃপর থমথমে গলায় বলা শুরু করলো,
-‘দেখুন কোনো এক সময় আপনাকে পছন্দ করলেও এখন একজনকে ভালোবাসি। তখন হয়তো ভালোবাসা এবং পছন্দের পার্থক্য বুঝতাম না। তবে এখন বুঝি, উপলব্ধি করি। আমি আপনার বান্ধুবিকে ভালোবাসি রথি তাই আমিও এই বিয়ে করতে চাই না। মা জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন।’
-‘তাহলে এখন উপায়? এই বিয়ে হলে দুটো জীবন চোখ বুজে শেষ হয়ে যাবে!’
-‘আমি তো সেজন্যই এলাম। আমি আপনাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। আপনি চলে যান, মায়েরা এখন ঘুমাচ্ছে। এখনই সুযোগ। আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছি, আপনি খুব শীঘ্রই মেইন রোডে যেতে পারবেন। আর কিছু টাকাও..’
-‘টাকার চিন্তা করতে হবে না। আপনি শুধু আমায় এখান থেকে বের করুন!’
আবির মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং রথিকেও উঠতে বললো। রথি উঠে দাঁড়ালেও ব্যালেন্স হারিয়ে পরে যেতে নেয় তবে সে নিজেকে সামলে নেয়। সারাদিন এভাবে না খেয়ে, কান্না করে কাটানোর ফলই হয়তো এটা! রথি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। নিচে নামতেই আবির পথ বুঝিয়ে দিলো এবং রথির মোবাইলটাও এগিয়ে দিলো।
-‘আমি আগে ভাগেই তাতানকে দিয়ে আপনার ফোনটা নিজের কাছে রেখেছিলাম। আপনি এটা নিয়ে যান!’
রথি ফোনটা নিয়ে আবিরকে ধন্যবাদ জানালো। এই আবির না থাকলে সে যে এভাবে পালাতে পারতো না। রথি আবিরকে বিদায় দিয়ে চলে গেলো। আর আবির নাফিসাকে কল করলো।
-‘রথিকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি নাফিসা, এখন আল্লাহ ভরসা!’
রথি দ্রুত ছুটতে লাগলো। সে এই শহর ছেড়ে অনেক দূরে নাশিদের কাছে যেতে চায়। প্রাণপণে ছুটছে সে। মাঝেমধ্যে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলেও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। দিনের চেয়ে এই মাঝরাতটা পুরোই জনমানবশূন্য। সকলেই গভীর নিদ্রায় মগ্ন আর রথি নিজেকে বাঁচাতে ছুটতে ব্যস্ত। রাস্তা-ঘাট পুরো শূন্য। একটি গাড়ির চিহ্ন অবধি নেই। সেই রাস্তার মাঝে দিয়ে দৌড়ে চলেছে রথি। তার বারবার মনে হচ্ছে সে এই শহর ছাড়তে না পারলে ভাবী তাকে খুঁজে বের করে সত্যি সত্যিই আবিরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। তখন সে আফসোস করবে কেন এই রাতে সে দ্রুত পালালো না। সারাজীবন আফসোস করার চেয়ে দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটে চলা ঢের ভালো। মাঝেমধ্যে রিস্ক না নিলে জীবনে অনেককিছুই খোয়াতে হয়, অনেককিছু।
রথির চোখের সামনে তার মায়ের চেহারাটা ভেসে উঠছে। ভাসছে তাদের সুখের সংসারের এক চিত্র। যেখানে বাবা-মা, ভাইয়া, রথি সবাই।
এসব ভাবতে ভাবতেই রথি যখন অদূরে মেইন রাস্তা দেখতে পেলো তখন খানিক থেমে হাঁপিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। অতঃপর আবার ছুটতে লাগলো। যখনই সে মেইন রাস্তায় উঠবে তখনই বাম পাশ থেকে একটা গাড়ি এদিকে আসতে লাগলো। গাড়িটি রথির খুব কাছে, খুব। রথি ভয়ে চিৎকার দিয়ে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো।
নাশিদ দৌড়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। তার সঙ্গে নয়নও নামলো। রথির গায়ে লাগার আগেই নয়ন গাড়ি থামিয়ে ফেলেছিলো। নাশিদ ছুটে রথির সামনে আসতেই রথিকে বুকে টেনে নিলো এবং রথির গালে আলতো চড় দিতে লাগলো।
-‘এই রথি, রথি? এই? কী হলো? কথা বলছো না কেন? নয়ন! ও কেন কথা বলছে না?’ বিচলিত হয়ে বললো নাশিদ।
-‘স্যার শান্ত হোন। ম্যাম জ্ঞান হারিয়েছে, তাকে জলদি হসপিটালে নিতে হবে।’
নাশিদ আর ভাবতে পারলো না। রথিকে কোলে নিয়ে সে পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। নয়নও দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারা রাস্তাতেই নাশিদ রথিকে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলো কিন্তু রথি কোনো সাড়াই দিলো না।
—————————-
-‘দেখুন মি. নাশিদ, উনি ভয় পাওয়ার কারণে জ্ঞান হারালেও মানসিকভাবে উনি অনেকটা দুর্বল। আই থিংক পেশেন্টের উপর অনেক মানসিক চাপ তৈরি করা হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম কোনোটাই উনি ঠিকমতো করেননি।’
নাশিদ চুপ করে শুনলো কিছু বলার উত্তর পেলো না।
-‘এখন করণীয় কী ডক্টর?’
-‘আপাতত ওনার স্যালাইন করছে আর উনি এখন ঘুমাচ্ছে। ওনাকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে, কোনোরকম চাপ বা হতাশা থেকে বিরত রাখতে হবে। এই ধরণের মেন্টালি স্ট্রিস কোনো মানুষের জন্যই কল্যাণকর নয়।’
নাশিদ তপ্তশ্বাস ফেলে উঁকি দিয়ে রথিকে দেখলো। রথি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here