#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব 02+03 |
অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো। নাফিসা রথিকে বসিয়ে দিয়ে ভাবীর সাথে দেখা করতে চলে গেলো। এদিকে রথি নাফিসার ফোন দেখছে। কিন্তু দশ মিনিটের মতো হয়ে গেলো নাফিসা আসেনি। রথি ফোন রেখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষ মোটামুটি এদিকে কমে গেছে। তাই রথি নাফিসাকে খুঁজতে যেতেই পেছন থেকে কারো ডাক শুনতে পেলো।
-‘এই মেয়ে শুনো!’
নাশিদের ডাক রথির কান অবধি গেলো না। বিয়েবাড়ি বলে কথা, অন্যকাউকেও ডাকতে পারে। সে ভেবে রথি এদিক সেদিক নাফিসাকে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে লাগলো। নাশিদ বুঝলো রথি তার ডাক শুনতে পারেনি। তাই নাশিদ আরেকবার হাক ছাড়লো। এবার রথি কৌতুহলবশত পিছে ফিরে তাকালো এবং নাশিদকে দেখে কিছুটা চমকে উঠলো। নাশিদ রথিকে তার দিকে ফিরলে নাশিদ রথির দিকে এগোতে লাগলো। নাশিদ যতোই এগোচ্ছে ততোই আমার ভেতরের ধুকধুকানি বেড়েই চলেছে। আমার পা বারংবার আমায় বলছে,”চল এখান থেকে, চল চল চল।”
কিন্তু তাতেও যেন নড়তে পারছি না। পা দুটি বরফের ন্যায় জমে আছে। অবশেষে উনি আমারও হার্টবিট তীব্রতর ভাবে বাড়িয়েই সামনে দাঁড়ালেন এবং বিনা-বাক্যে বলে উঠলো,
-‘কে তুমি?’
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেমন অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,
-‘র.রথি।’
-‘রথি? তা কোন নদীর রথি শুনি? কী কী বহন করলে আজ পর্যন্ত?’
ওনার কথায় আমি তাজ্জব বনে গেলাম। হতভম্ব দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে বললাম,
-‘জ্বী?’
নাশিদ আমার কথার কোনরকম উত্তর না দিয়ে বলে,
-‘নাফিসার সাথে তোমার কী?’
তখনই নাফিসা চলে আসলো। নাফিসা পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে বললো,
-‘আমি রথির বেস্টি। তোকে বলেছিলাম না আমার বেস্টুর কথা? এই রথি-ই তো সেই!’
আমি তখনো চুপ। নাশিদ রথির পা থেকে মাথা অবধি দেখে চলে গেলো, কোন উত্তর না দিয়েই। ওনার হুট করে চলে যাওয়া দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। অতঃপর নাফিসার উদ্দেশ্যে বললাম,
-‘তোর ভাই এমন গোমড়ামুখো কেন? কিছু না বলেই চলে গেলো?’
-‘পুলিশ মানুষ এমনই হয় বোন। যাইহোক বাদ দে। এখন চল আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই ভাবীর বিদায় পর্ব শুরু হবে।’
-‘ও। তাহলে আমি আমার বাসায় চলে যাই? এখান থেকে তো বাসা কাছেই!’
-‘একদম না। আন্টি আমায় সাফ সাফ বলে দিয়েছে, তোকে যেন একা না ছাড়ি!’
-‘দেখ, তুই হচ্ছিস বরের বোন। আর তোর কিছু দায়িত্বও আছে, তুই সেসব না করে আমার পিছে পরে আছিস কেন বল তো? আমার কথা চিন্তা করিস না আমি যেতে পারবো!’
-‘নো ওয়ে! এই রাতে তোকে ছাড়বোই না। ঠিক আছে আমার দায়িত্ব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস তাইতো? ফাইন, আমি তোর সঙ্গে যাবো না তবে কেউ না কেউ তোর সাথে যাবেই!’
-‘ঠিক আছে আমি রাজি!’
হাসিমুখেই বললাম। সহজে রাজি হয়েছি কারণ, আমার সঙ্গে যেই যাক না কেন তাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি কিন্তু নাফিসাকে তো আর বুঝাতে পারবো না। তাই আমি এই পদ্ধতির অবলম্বন করছি। কিন্তু নাফিসা আমার সব আশায় পানি ঢেলে দিয়ে নাশিদের সাথে বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। আমার ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যাই। নাফিসার দিকে আসহায় চাহনি দিতেই দেখলাম সে মুখ চেপে হাসছে। নাফিসা আমার কানে ফিসফিস করে বললো,
-‘বান্ধুবি, তুমি যদি চলো ডালে ডালে তাহলে আমিও চলি পাতায় পাতায়। তুই কী ভেবেছিস আমি তোর ফন্দি বুঝি না? এখন ভাইরে গিয়ে বল, দেখি তোর কতো সাহস!’
আমি আর কী বলবো, চুপ করেই রইলাম। পুলিশম্যান আঙ্কেলের থেকে অনুমতি পেয়ে আমাদের দিকেই এলো। আবারও তার সাথে আমার দেখা। কীভাবে কী করবো বুঝতে পারছি না। তবে চুপ থাকাটাই স্রেয় মনে করলাম। নাফিসা আমাকে বিদায় দিতেই উনি সামনে যেতে লাগলেন আর আমি ওনার পিছে পিছে। আমাদের পথ আটকে অনেকেই এসে ওনার সাথে কথা বলেছে, উনিও তাদের সঙ্গে হেসেই ভাব-বিনিময় করেছে। আমার একটি বিষয় অদ্ভুত লাগলো যে উনি কোনকিছুকেই বিরক্তি হিসেবে নেননি। এতক্ষণে অনেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন কিন্তু কই, তার মুখে তো কোনরকম বিরক্তির ছাপ দেখিনি। আমি হলে তো কখনই বিরক্ত হয়ে যেতাম। যাক এটা ভালো গুণ।
আমার ভাবনার মাঝে উনি বলে উঠলেন,
-‘তোমার ভাবনা শেষ হলে কী গাড়িতে উঠবে, মিস রথি?’
আমি কিছুটা নড়েচড়ে জলদি পেছন সিটের দরজা খুলতে গেলাম কিন্তু উনি আমায় থামিয়ে বললো,
-‘সামনে বসো।’
আমি চোখ বড় বড় করে ওনার দিকে তাকালাম। সামনে বসবো মানে কী? তখনই মনে পরলো, আমি তো কোন শেহজাদী নই আর উনিও কোনো ড্রাইভার নয়। ভাবতেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে চটজলদি সামনের সিটে বসে পরলাম। কেন যেন অনেক অস্বস্তি লাগছে, বড্ড অস্বস্তি লাগছে। উনিও কোনরকম কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসলেন এবং আমার থেকে বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ড্রাইভিং শুরু করলেন। আমি চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। এও ভাবছি উনি তো পুলিশ, আমি যে সিটবেল্ট বাধিনি সেটা কী উনি খেয়াল করেছেন? কোণা চোখে নাশিদের দিকে তাকালাম। ওনার এদিকে কোনোরকম ভ্রুক্ষেপ নেই ইভেন একবারের জন্যে তাকানোরও প্রয়োজনবোধ করেনি। সেজন্যই হয়তো খেয়াল করেননি। যাক আমি কিছুটা শান্তি পেলাম। এই সিটবেল্ট বাঁধলে আমার কেমন দম আটকে আসে। একবার নাফিসার সাথে লং ড্রাইভে গিয়েছিলাম। নাফিসা ড্রাইভ করছিলো আর আমি তার পাশেই বসেছিলাম। সেদিন সিটবেল্ট বাঁধার পর কতো যে ঝামেলা লেগেছিলো কী বলবো। আমি জানি না আমার ক্ষেত্রেই কেন এমন হয়?
মিনিটখানেক পার হয়ে গেলো। দুজনেই নিশ্চুপ। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখলাম জীবন চাচার টং। এর মানে বাসায় প্রায় পৌঁছে গেছি। হঠাৎ ভাবীর কথা মনে হতেই ওনার উদ্দেশ্যে অস্ফুট সুরে বলে উঠলাম,
-‘গাড়ি থামান! জলদি!’
আমার আচমকা কথায় উনিও যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন যার ফলে উনি কষে ব্রেক কষলেন। অতঃপর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু সুরে বললেন,
-‘তোমার বাসা তো এটা নয়, তাহলে থামাতে বললে কেন?’
আমি ওনার কথার উত্তর না দিয়ে ডোর খুলে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললাম,
-‘এখান থেকে আমি নিজেই যেতে পারবো। এছাড়া এখান থেকে বাসা এক মিনিটের রাস্তা। ওইতো আমার বাসা দেখা যাচ্ছে।’
নাশিদ স্টেয়ারে হাত রেখে রথির ইশারা করা বাড়িটার দিকে তাকালো। বাড়িটা ৩ তলা বিশিষ্ট। এবার নাশিদের মনে প্রশ্ন আসলো, ওরা তো এতো গরিবও নয় তাহলে এসব ছেঁড়া শাড়ি পরে রথি বিয়েতে কেন আসলো? নাশিদের প্রশ্ন নাশিদের অন্তর্গহ্বরেই থেকে গেলো। রথি একটি ছোট্ট “ধন্যবাদ” দিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রথি বাসার গেট দিয়ে ঢুকা অবধি নাশিদ গাড়িতেই বসে রইলো। যখন রথি ভেতরে ঢুকলো তখনই নাশিদ গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো। পুলিশ হিসেবে তার রেসপন্সিবিলিটি সম্পর্কে সে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে। রাত করে কোন মেয়ে বিপদে পরলে অথবা তার সেফলি বাড়ি পৌঁছে দেয়াও একটা দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকেই নাশিদ রথির কেয়ার করেছে।
রথি বাসায় ঢুকতেই ৩তলা বিশিষ্ট অট্টালিকায় না ঢুকে তার পেছনের ছোটখাটো টিনের ঘরের দিকে চলে গেলো। সেটাতেই সে এবং তার মা থাকে। আর তিন তলার বাড়িটাতে পুরোটা জুড়েই রথির বড় ভাই সাইফ এবং তার ভাবী থাকে। রথি বাসায় ঢুকতেই তার মা বলে উঠলো,
-‘তুই কী পাগল হ্যাঁ? ফোন ফেলে কে বাইরে যায় হ্যাঁ? আমার চিন্তা হয় না?’
তখনই সাইফের বাড়ির কাজের মেয়ে আমিনা এসে বললো,
-‘আপা, আপনারে ভাবী ডাকতাসে!’
~চলবে।
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।
#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৩ |
আমি ভাবীর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবী আর ভাইয়া ডিনার করছে। ভাইয়া একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে আর ভাবী? সে মাঝেমধ্যে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমায় চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। আমি তাদের নাটক সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলাম,
-‘আমায় কী প্রয়োজনে ডেকেছেন বলুন নয়তো আমি চলে যাচ্ছি। এভাবে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না!’
-‘সাইফ, এতো রাতে তোমার বোন কই থেকে মেলা বাঁধিয়ে আসলো জিজ্ঞেস করো তো? আবারও কী পূর্বের ন্যায়?’
সাইফ মাঝপথে মার্জানকে থামিয়ে বললো,’চুপ করো তুমি!’
-‘বাহ! ভালো কথা বললেই দোষ হয়ে যায় নাকি তোমার বেশি ফাটে? এই রথি, সত্যি করে বল তো তুই কোথা থেকে ফিরলি?’
-‘সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলবো না ভাবী? যার যার ব্যক্তিগত জীবন তার তার!’
মার্জান সটাং করে চামচটা রেখে কপাট রেগে বলে,
-‘ভুলে যাস না তুই আমাদের কারণেই ওই বাড়িতে থাকতে পারছিস!! আবার ব্যক্তিগত বাহিরগত বুঝাস আমায়?’
-‘ভুল বললে। আমি আমার বাবার বাড়িতে থাকি। তোমার এই ইটের আবর্জনায় নয়। আর নিজে উপার্জন করেই মায়ের চিকিৎসা করছি।’
-‘দেখেছো তোমার বোন আমাদের বাড়িকে ইটের আবর্জনা বলেছে? এসবের মানে কী সাইফ? তুমি কেন কিছু বলছো না?’
-‘ভাইয়া কী বলবে? তুমিই তো যা ইচ্ছা করছো। ভাইয়া যদি বলারই হতো তাহলে তাতানকে তো হোস্টেল পাঠাতে না?’
-‘মুখ সামলে কথা বল রথি! আমার ছেলের জন্য যেটা ভালো হয়েছে আমি সেটাই করেছি। আর আমার ছেলেকে নিয়ে বলার তুই কে? হু আর ইউ?’
আমার আর তর্ক করার ইচ্ছে হলো না। এই মেয়ের সাথে কথা বললে কথা বাড়বেই। ভাবী চরম রেগে আছে দেখে ভাইয়া তাকে সামলাতে সামলাতে আমায় হাঁক ছেড়ে বলে,
-‘বাড়ি যা রথি।’
আমি আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে পরলাম। ভাইয়ারা তিন তলায় থাকে। গ্রাউন্ড ফ্লোর ফাঁকা। ২য় তলায় কোন এক সময় আমরা ছিলাম, তবে এখন সেখানে ভাড়াটিয়া ঢুকিয়েছে ভাবী। ভাবী তো আমাদের সহ্যই করতে পারে না। তার এক কথা, শ্বাশুড়ি আর ননদ থাকলে খরচ বেশি লাগবে তাই সে আলাদা থাকবে। কিন্তু সাইফ ভাইয়া কিছুতেই আমাদের ছাড়তে চাচ্ছিলো না। এ নিয়ে ভিষণ ঝামেলা হয়। এসব ঘটনা ঘটে বাবা মারা যাওয়ার পরেই। মার্জান ভাবী বলেছে বাবা নাকি তাকে এই বাড়ি লিখে দিয়েছে ইভেন কাগজও দেখিয়েছে যেখানে বাবার নামের বড় বড় অক্ষরের সাক্ষরও ছিলো। সেই কাগজ দেখে মা অনেকটা অসুস্থ হয়ে যায়। ভাইয়া চেয়েছিলো মার্জান ভাবীকে ডিভোর্স দিতে কিন্তু তাদের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমার মা। আমার মা সাইফ ভাইয়াকে কসম কাটিয়ে বলে,
-‘ভুলে যাবি না তোদের সন্তান আছে আর এই বাড়ি মার্জানের নামে লিখানো। তোদের সুখে যদি আমরা বাঁধা হয়ে যাই তাহলে আমরা আলাদা থাকবো। তাই বলে ওই নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে মা/বাবা হারা হতে দিস না।’
এই বলে মা আমার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পেছনের দুইরুম ওয়ালা টিনের ঘরে নিয়ে যায়। ওখান থেকেই আমার আরেক জীবনের সূচনা হয়।
চোখের জল ভালো করে মুছে বাইরের একটা কল থেকে মুখ ভালো ভাবে ধুঁয়ে, ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বাসায় আসলাম। ভেতরে গিয়ে দেখি মা ভাত বেড়ে আমার জন্য বসে আছে। আমি কোন কথা না বলে খেতে বসে পরলাম। মা আমায় জিজ্ঞেস করলো না কেন ভাবী ডেকে পাঠিয়েছে। সে ভাত বাড়তে বাড়তে বললো,
-‘কেমন বিয়ে বাড়িতে গেলি যে এত খেয়েও এখন আবার খিদে পেলো?’
-‘সন্ধ্যায় খেয়েছি মা তাও অল্প। এখন খিদে পেয়েছে তো। আর তোমার হাতের আলুর ভর্তার জন্য তো আমার পেট আজীবন খালিই থাকবে।’
আমি হালকা হেসে বলি। শেষোক্ত কথায় মাও হালকা হাসলো। এবার আম্মু হাত ধুঁয়ে এসে নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,
-‘তাহলে নাফিসাকে বলতি আমায় রাঁধুনি করে নিয়ে যেতে!’
-‘আমার বিয়েতে তুমিই সব রাঁধবা!’
-‘পাঁজি। খা তো!’ বলেই আরেক লোকমা মুখ পরে নিলো। আমি খেতে খেতে পুরানো দিনগুলোর কথা ভাবছি, কোনো এক সময় ভাইয়া আর আমি ঝগড়া করতাম মায়ের হাতে খাওয়ার জন্য। মা আমাদের ঝগড়া না থামাতে পেরে দুজনকে একসাথে খাইয়ে দিতো। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম,
-‘ভাইয়া, মা নামক মূল্যবান সম্পদের হেফাজত করতে তুই ব্যর্থ হলি রে। তোর এক বউ-ই সব তছনছ করে দিলো, সাথে সুখটাও কেড়ে নিলো। তবে আমি ভাগ্যবতি, মায়ের খেদমত করতে পেরে।’
-‘কী ভাবছিস?’
-‘কই কিছু না তো! খাবার দাও!’
-‘খাওয়া তো শেষ। আমি আমার আঁচল দিয়ে তোর মুখও তো মুছে দিলাম। তোর খেয়াল নেই? এর মানে নির্ঘাত কিছু ভাবছিস?’
ছোট্ট বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে বললাম,
-‘নাফিসারা কতো বড়লোক সেটাই ভাবছিলাম। আল্লাহ আমায় এতো বড়লোক বান্ধুবি কেন দিলো, বলো তো মা?’
-‘হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন?’
-‘জানি না। তবে এই “বড়লোক” শব্দটা কেন যেন সহ্য করতে পারি না!’
মা ঔষধ খেতে খেতে বলে,
-‘হয়েছে এসব কথা ছাড় আর ঘুমা। কাল তো তোর কোচিং-ও আছে নাকি?’
আমি আর কিছু বললাম না। শুয়ে পরলাম। মাও লাইট অফ করে আমার পাশে শুয়ে পরলো।
★
নাফিসা তার ভাবীকে নেওয়াজের ঘরে দিয়ে আসতেই নাশিদ বললো,
-‘অনেক তো খাটলি এখন ফ্রেশ হয়ে আয়।’
-‘যাচ্ছি ভাইয়া।’
বলেই নাফিসা চলে গেলো। নাশিদ এবং তার কিছু কাজিনরা মিলে নেওয়াজকে খেপিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। নাশিদ নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তার ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে যায়। গতকাল এমনেই যেতে পারেনি আর আজ সারাদিন ডিউটি করেনি। তাই আজকের রাতটা ডিউটি করে কাটাবে। থানায় যাওয়ার পূর্বে কী মনে করে সে নাফিসার ঘরে চলে গেলো। নাফিসা তখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। নাশিদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-‘আসবো?’
নাফিসা দরজায় তার ভাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অস্ফুট সুরে বলে,
-‘আরে ভাইয়া! এসো, পারমিশন নেও কেন বুঝি না!’
নাশিদ মুচকি হেসে বিছানায় গিয়ে বসলো। নাশিদের গায়ে ইউনিফর্ম খেয়াল করতেই নাফিসা মুখ কালো করে ফেললো এবং গম্ভীর সুরে বলে উঠলো,
-‘সারাদিন খেটে এখন না ঘুমিয়ে চোরের পিছে দৌড়াবি।’
-‘কে বললো? অনেক ফাইলস জমা আছে। সেগুলো আমি ছাড়া কে চেক দিবে হু? বাদ দে, তোর সাথে কিছু কথা ছিলো।’
-‘হুম বলো কি বলবে?’
-‘তোর বান্ধুবি রথির ব্যাপারে! ও এমন পুরাতন শাড়ি পরে এসেছিলো কেন? ওর তো থাকার জায়গা ভালোই!’
মুহূর্তেই নাফিসা মুখ গোমড়া করে বলে,’ওখানে ও থাকে না ভাই!’
-‘মানে?’
-‘ওটা ওর ভাবীর বাড়ি। আর রথির ভালো ড্রেস বা শাড়ি নেই তো তাই ওভাবে এসেছে। আসতে চায়নি আমি জোর করে আনিয়েছি। জানিস মেয়েটার জীবনে অনেক কষ্ট!’
নাফিসার থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই ওদের মা এসে হাজির হয় এবং নাশিদের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘এই রাত-বিরেতে ভাইবোন মিলে কী গল্প করা হচ্ছে শুনি? আর নাশিদ! তুই ইউনিফর্ম পরে আছিস কেন? আবার কাজের ডাক পরেছে নাকি?’
-‘অনেকটা সেরকমই মা। যেতে হবে, আর্জেন্ট!’
-‘দেখো ছেলের কান্ড। পুলিশ হয়েছিস দেখে কী দিন-রাত ওই থানায় পরে থাকবি? নিজের দিকে খেয়াল করতে নেই বুঝি?’
-‘উফ মা, করতে হবেই তো নাকি? এতো চিন্তা করো কেন?’
-‘ঠিক আছে করবো না চিন্তা। নাফিসা, তাকে বলে দিস, না খেয়ে বাড়ির বাইরে এক পা রাখলেও তার পায়ে আগুন লাগবে, মারাত্মক আগুন!’
বলেই মা রেগে হনহন করে চলে গেলো। নাফিসা নাশিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘ভাইয়া মা ক্ষেপেছে। ভুলেও না খেয়ে বের হইও না নয়তো কপালে দুঃখ আছে।’
-‘খেয়েই যাবো, এখন আসি? তুই ঘুমিয়ে পর।’
বলেই নাশিদ লাইফ অফ করে বেরিয়ে গেলো। নিচে গিয়ে কাজের মেয়ে খাবার বেড়ে দিলে সেটা খেয়ে বেরিয়ে গেলো। মা আগেই রুমে চলে গেছেন তাই তাকে আর নাশিদ কিছু জানাতে পারেনি!
-‘হ্যাঁ গো শুনছো? তোমার এই ছেলেকে পুলিশ কী আমাকে ধরার জন্য বানিয়েছো?’
নাশিদের বাবা ফোন রেখে মনিকার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,
-‘মানে?’
-‘নাহ কিছু না। তোমার ছেলেকে সিলেট থেকে টেনে এখানে জায়গা দেয়ার কী দরকার ছিলো হ্যাঁ? সেখানে মরতে গেছিলো মরতো তারে আবার ঘাড়ে চাপাতে গেলে কেন?’
নাশিদের বাবা কপাট রেগে বলে,
-‘মুখ সামলে কথা বলো মনিকা! আমার ছেলে এ-বাড়িতে থাকলে তোমার কী আসে যায়? আমার ছেলে নিজে কামাই করে, তোমার কামাইয়ে চলছেও না ফিরছেও না!’
-‘তাহলে তার খরচেই সে চলবে। আমার নেওয়াজের টাকার দিকে যেন ফিরেও না তাকায়!’
-‘তোমার সমস্যা কী হ্যাঁ? কেন নাশিদকে সহ্য করতে পারো না?’
-‘কারণ, নীলিমা মারা যাওয়ার পর থেকে তুমি আমার নেওয়াজকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো। সারাদিন শুধু নাশিদ নাশিদ করো তুমি! আর আমিও হাঁপিয়ে গেছি ওর সাথে অভিনয় করতে করতে। নীলিমাকে কথা না দিলে নাশিদ আমার আসল দেখতো।
-‘নাশিদই তোমার সমস্যা, তাহলে নাফিসাকে কেন মাথা চড়িয়ে রাখো হু? নাশিদ আর নাফিসার মাঝে পার্থক্য কোথায়?’
-‘আমার মেয়ের সখ ছিলো সেটা তুমি ভালো করেই জানো, তাই নাফিসাকে নিজের মেয়ের মতোই রাখি। আর তুমি তোমার ঝামেলা সামলাও, নেওয়াজের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাবো।’
বলেই নাশিদের বাবাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মনিকা অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পরলো। আর নাশিদের বাবা করুণ চোখে একটা ছবির ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো মেয়ে তার মৃত বোনকে নিয়ে এতটা ঈর্ষান্বিত হয় তা এই প্রথম দেখলো সে। মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের ব্যবধানে চেনা মানুষ চোখের পলকেই অচেনা হয়ে যায়।
নাশিদ অফিস পৌঁছাতেই দেখলো তার এসিস্ট্যান্ট নয়ন দাঁত কেলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাশিদ তার এই হাসির মানে টা নাশিদ বুঝলো না। নাশিদ তার কপালে পরা চুল ঠিক করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-‘কী ব্যাপার নয়ন এভাবে হাসছো কেন?’
নয়ন আবারও দাঁত কেলালো। নাশিদ নয়নের ভাব-গতি লক্ষ করতে করতে ঢেকে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি খেতে লাগলো। নয়ন তখনই দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
-‘আপনি এতো কিউট কেন স্যার?’
নয়নের এহেম কথায় কিছু পানি নাশিদের গলায় আটকে গেলো আর বাকিটা মুখে ছিলো যা নাশিদ ফ্রুত করে ফেলে দেয় এবং খাঁকখাঁক করে কাশতে থাকে। নাশিদের কাশি দেখে নয়ন দাঁত বন্ধ করে ঠোঁটজোড়া মিলিত করে ফেললো। মিনিটখানেক বাদে নাশিদের কাশি থামলো অতঃপর নয়নের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘হোয়াট দ্য হেল নয়ন? এমন হুটহাট কথা বলো কেন যেসব কথার কোনো ভিত্তি নেই?’
-‘আমাকে বললো আপনাকে জিজ্ঞেস করতে তাই করেছি, স্যার!’ গোমড়ামুখে বললো নয়ন।
-‘কে?’
নয়ন এবার দাঁত বের করে উত্তর দিলো,’মেয়ে!’
এবার নয়নের কোন কথা নাশিদ কানে নিলো না। সে জানে নয়ন কাজের চেয়ে অকাজ করে বেশি। তার উল্টো পাল্টা বকবকে মন না দিয়ে বলে উঠলো,
-‘যেসব ফাইল জমা আছে সেগুলো নিয়ে এসো!’
-‘ওকে স্যার!’
বলেই নয়ন চলে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে হাতে ২-৩টা ফাইল নিয়ে নাশিদের সামনে আসলো। নাশিদ ফাইল চেক করে ফেললো মাত্র তিনটা ফাইল তাও বেশি মোটা নয়। নাশিদ নয়নের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘তুমি না জানিয়েছো অনেকগুলো ফাইল? তো এখানে এই তিনটা কেন?’
-‘অনেকগুলো না বললে তো আপনি আসতেন না।’
-‘এগুলা তো এতো ইম্পর্টেন্টও না!’
-‘কমিশনার স্যার তো আজকের মাঝেই কাজ সারতে বলেছিলো।’
-‘জমা তো কালকে?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘তো ফাইলগুলো আমার বাসায় পাঠানো যেত না?’
নয়ন মাথা চুলকাতে লাগলো। এদিকে নাশিদ চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে কপালে হাত লাগিয়ে চোখ বুজে রইলো। এর সাথে থাকলে তার পাগল হতে বেশি দেরী নেই! নয়ন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,
-‘তাহলে এখন কী করবো স্যার?’
-‘কিছু করা লাগবে না। বাসায় গিয়ে নাক টেনে ঘুম দাও!’
-‘আচ্ছা।’ বলে সত্যি সত্যিই নয়ন চলে গেলো।
নাশিদ তিনটা ফাইল নিয়ে নিজেও বেরিয়ে পরলো। রাস্তা দিয়ে ড্রাইভিং করতে যেতে যেতেই দেখলো অদূরে কিছু কালো মুখোশ পরা লোক এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকতে চলেছে। নাশিদ তার ফোর্সকে ইনফর্ম করে কোমড় থেকে রিভলবার হাতে নিয়ে হাই স্প্রিডে ড্রাইভ করে ওদের পিছে চলে আসে এবং জোরে জোরে হর্ন বাজাতে থাকে। ডাকাতগুলো দৌড়ে গাড়ির সামনে এসে খেকিয়ে বলে,
-‘আস্তে হর্ন বাজা শালা! নয়তো এই ছুঁরি দিয়ে তোর খুলি উড়ায় দিবো। আমাগো লগে মাতলামি করোস?’
হর্ন বন্ধ হয়ে গেলো। নাশিদ তার পেছন সিট দিয়ে আস্তে করে ডোরটি খুলে ডাকাতের মেইন লিডারকে পেছন থেকে গলা চেপে মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলে,
-‘আমি মাতলামি করি?’
ঘটনা এতই দ্রুত ঘটলো যে ডাকাতের চ্যালাগুলা বেক্কল বনে গেলো। অতঃপর তাদের হুঁশ ফিরলে তারা নাশিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরার আগেই নাশিদ ওদের লিডারকে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে বলে,
-‘উহুহু হু! এই ভুল একদম করতে যাবি না। আর এইযে শয়তানির মাস্টার(ডাকাতের প্রধান) তোর চ্যালাদের বল আমাদের থেকে দূরে থাকতে নয়তো আমি-ই তোরে গুলি করে খুলি উড়ায় দিবো!’
ডাকাত ভয় পেয়ে যায় এবং জলদি ওদের ইশারা করলো থামতে। এবার নাশিদ ডাকাত গুলোর উদ্দেশ্যে বললো,
-‘অস্ত্র নামা নয়তো তোদের বস এখানেই খতম।’
ডাকাতগুলো বসের ইশারায় অস্ত্রগুলোও নামিয়ে ফেললো। কিছুক্ষণের মাঝেই নাশিদের ফোর্স চলে আসে এবং সব ডাকাতকে অ্যারেস্ট করলো। নাশিদ এক ফোর্সকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘এই বাড়িতে কে থাকে এবং ভেতরে কারা বসবাস করছে তাদের ডিটেইলস বের করো। ফাস্ট!’
কর্মী তার আদেশ পেয়ে খবর বের করতে চলে গেলো। কিছুক্ষণ বাদে খবর নিয়ে এলো এই বিল্ডিং এ কেউ-ই থাকে না। মালিকের নাম আর ডিটেইলস এর একটা ফাইল নাশিদের হাতে ধরিয়ে দেয়। নাশিদ সবটা চেক করতে করতে বললো,
-‘তালা ভাঙ্গো ভেতরে তল্লাশি চালাতে হবে।’
বলেই সে ফাইল রাখলো। এই মালিককে সে বেশ ভালো করেই চিনে। ইতিমধ্যে আশেপাশের মানুষজন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকে এসেছে। কিছু ফোর্স তাদের জিজ্ঞেস করেছে এই বাড়ি থেকে কাউকে আসতে বা যেতে দেখেছে কি না। কিন্তু কেউই দেখেনি। তবে একজন বলে উঠলো,
-‘একদিন রাতে কালো কাপড় পরা কিছু লোককে দেখেছিলাম খুবই সাবধানে ওই বিল্ডিং এ ঢুকতে। কিছুক্ষণ পরে একটা ভ্যান আসলে কিসব ওই বিল্ডিং এর থেকে বের করে ভ্যানে ভরছিলো।’
নাশিদ পাশ থেকে সবটা শুনতে পেরে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললো,
-‘তাহলে পুলিশকে আগেভাগে ইনফর্ম করোনি কেন?’
-‘বাবা-মা নিষেধ করেছিলেন, বলেছিলো এসবে আমি ঝামেলায় পরতে পারি তাই আর যেতে দেয়নি!’
নাশিদ বুঝলো এবং বললো, “তোমায় ধন্যবাদ। তুমি এখন যেতে পারো!” বলেই আরেকজন ফোর্সকে বললো,
-‘এখন আমি ১০০% নিশ্চিত হলাম যে ভেতরে কিছু না কিছু আছে। জলদি তালা ভাঙ্গো, ফাস্ট!’
তখনই আরেক ফোর্স এসে বললো,’তালা ভাঙ্গা হয়ে গেছে স্যার!’
নাশিদ তার ফোর্সকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো এবং ৩য় ফ্লোরে গিয়ে দেখলো এখানে নানান ধরণের বেআইনি অস্ত্র দিয়ে ভরা। এগুলো দেখে নাশিদ মনের মাঝে নয়নকে ১০০ বার ধন্যবাদ দিলো কারণ, নয়ন যদি আজ তাকে বাড়ির বাইরে বের না করতো তাহলে এতো বড় একটা কেস সে কোনদিনও পেত না! নাশিদ মিনমিন করে বললো,
-‘মূসা! এবার তোকে কে বাঁচাবে?’
~চলবে।