#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৩+34+35
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আরেকটু খোঁজাখুঁজির পর শুদ্ধ শঙ্কিত মনে বাসায় ফিরে এলো। তার মাথা ভীষণ ঘামছে৷ কি করবে বুঝতে পারছে না। দরজা খোলাই ছিল। অবিশ্রান্ত শরীর নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো সোফায় বসে টিভিতে একটা কমেডি শো দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে ধারা। শুদ্ধ’র শিরদাঁড়া বেঁয়ে একটা স্বস্তির অনুভুতি বয়ে গেলো। পরক্ষনেই তার প্রচন্ড রাগ হলো৷ সে শক্ত মুখ করে ধারার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ধারা, ভেতরে আসো।’
শুদ্ধ’র আওয়াজ পেয়ে পাশে ঘুরে ধারা কিছু বলার আগেই শুদ্ধ গটগট করে নিজের রুমে চলে গেলো। পেছন পেছন গেলো ধারাও। ধারা রুমে ঢুকতেই শুদ্ধ দরজা ভিজিয়ে দিয়ে থম ধরা গলায় ধারাকে প্রশ্ন করলো,
‘তুমি বাসায় আসছো কখন?’
ধারা স্মিত হেসে বলল, ‘সন্ধ্যার একটু পরেই। অনেকক্ষণ হয়েছে।’
শুদ্ধ গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলল,
‘তোমাকে যে আমি বলছিলাম আমি তোমাকে নিতে আসবো সেটা কি তোমার মনে ছিল না?’
ধারা নরম গলায় বলল, ‘তোমার আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তুমি আর আসবে না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল আর কতগুলো মেয়েও আমাদের এখানের ছিল। তাই তাদের সাথে আমিও চলে এসেছি।’
‘মাত্র ত্রিশ মিনিটের মতো কি দেরি হলো আর তুমি নিজে নিজে ভেবে নিলে আমি আসবো না! তুমি জানো তোমার কলেজে গিয়ে আজ দুই ঘন্টা যাবৎ আমি কিভাবে খুঁজেছি! আমার কতো টেনশন হচ্ছিল!’
‘শুদ্ধ, আমি ইচ্ছে করে তো আর কিছু করিনি। পরিস্থিতিতে এমন হয়ে গেছে। আর…..
ধারার কথায় শুদ্ধ বাঁধা দিয়ে বলল,
‘কথার মাঝে কথা বলবে না। আগে আমার কথা শেষ করতে দাও।’
‘কথা না বললে আমি নিজেরটা এক্সপ্লেইন করবো কিভাবে?’
শুদ্ধ খুব চেচাঁমেচি করতে লাগলো। ধারা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘শুদ্ধ আস্তে কথা বলো৷ মা শুনবে।’
শুদ্ধ নিজের মতো করেই বলে যেতে লাগলো,
‘তুমি আমার জন্য দাঁড়ালে না কেন?’
‘বললাম না, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। আজকাল তো আবার তুমি খুব বেশি ব্যস্ত থাকো। তোমার কোন সময়ই হয় না।’
‘হ্যাঁ থাকি ব্যস্ত। কাজের জন্যই থাকি। অকাজে তো আর থাকি না। তাই বলে কি কখনো এমন হয়েছে তোমার কাছে আসার কথা বলেছি কিন্তু আসিনি? শুধু শুধু তো একটা পিন্চ মারা কথা বলে দিলে। আমি যে আজকে দু ঘন্টা যাবৎ কিরকম অবস্থায় পড়েছিলাম সেটা তো আর তুমি বুঝবে না।’
‘তুমি কিন্তু এখন ওভাররিয়্যাক্ট করছো!’
‘আমি ওভাররিয়্যাক্ট করছি! আর তুমি কি করেছো? বাসায় যখন একা একাই আসছিলে আমাকে ফোন করে তা জানালে না কেন?’
ধারা মুখ ভার করে বলল,
‘আমি ফোন নিয়ে যাইনি।’
‘বাহ! ফোন নিয়ে যাওনি! তাহলে ফোনটা সাথে রাখো কেন? যখন দরকারে পাওয়াই যাবে না। আমি কতবার কল করছি জানো? ফোন নাও তো নাওনি আবার বন্ধ করেও রেখে গেছো।’
‘চালু করে রাখলেও আর কি হতো? চুমকি গেছে বেড়াতে। মা স্মার্ট ফোন রিসিভ করতে পারে না। বাজলে শুধু শুধু অস্থির হতো। তাই বন্ধ করে রেখেছিলাম।’
‘তাহলে বাসায় আসার পর ফোন অন করে জানালে না কেন?
‘তোমাকে কল করিনি? একশোবার কল করে ফেলেছি। তোমার নিজের ফোনই তো বন্ধ।’
শুদ্ধ জোর গলায় বলল, ‘অসম্ভব। আমার ফোন আমি সবসময় অন রাখি। তোমার মতো অফ করে রেখে মানুষকে টেনশনে ফেলি না। এখনও অন ই আছে।’
এই বলে ধারাকে দেখানোর জন্য শুদ্ধ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো ফোন সত্যিই বন্ধ। চার্জ শেষ হয়ে কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। শুদ্ধ টেনশনের মধ্যে আর খেয়াল করেনি। ধারার কথাই সত্যি দেখে শুদ্ধ খানিক মিইয়ে গেলো। ধারা সেদিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘খুব তো চেঁচাচ্ছিলে! এখন দোষটা কার। শুধু কি আমারই? এবার বুঝলে দোষটা কার!’
শুদ্ধ খানিক ইতস্তত করে দূর্বল না হয়ে বলল, ‘এখন এতটুকুতেই আমার দোষ হয়ে গেলো? দোষটা তোমার।’
ধারাও পুরো ক্ষেপে গিয়ে বলতে লাগলো,
‘তোমার দোষ।’
‘না তোমার দোষ।’
‘তোমার দোষ।’
শুদ্ধ বলল, ‘এখন তো স্বীকার করবেই না। আমার আজকে কি অবস্থা হয়েছিল তা আমিই জানি। আমার জায়গায় তুমি থাকলে না সেখানেই অজ্ঞান হয়ে থাকতে।’
‘আমার অজ্ঞান হওয়া নিয়ে আর কিছু বলবে না।’
‘আমি তো বলবোই।’
ধারা আরো কাছে এগিয়ে বলল, ‘ভালো হবে না বলে দিচ্ছি! আর একবার বললে কিন্তু আমি তোমাকে…..
শুদ্ধ এক পা এক পা করে এগিয়ে এগিয়ে ধারাকে পেছনে নিতে নিতে বলল, ‘কি করবে? বলো কি করবো?’
ধারা বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। আমতা আমতা করতে লাগলো। শুদ্ধ’র মুখে বিজয়ের হাসি ফুটতে শুরু করলো। ধারা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে বলল,
‘তোমার সাথে কথা বলার কোন মানে হয় না।’
‘ওকে, আমার সাথে আর কথা বলবা না?’
‘আচ্ছা, মনে থাকে যেন।’
এই বলে ধারা পেছনে মুখ ঘুরে দাঁড়ালো। শুদ্ধও নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
রাতের বেলা খাবার সময় হলে সবাই ডাইনিং টেবিলে বসলো। সবাই বলতে শুদ্ধ, ধারা আর খোদেজা। শুদ্ধ আর ধারা আজ পাশাপাশি বসেনি। বসেছে একে অপরের বিপরীত প্রান্তে। মুখোমুখি। দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। দুজনেই রাগে গজ গজ করছে। খোদেজা চুপচাপ খেতে লাগলো। খেয়াল করলো খাবারের সময়ে আজ পরিবেশটা অন্য দিনের তুলনায় একদম শব্দশুন্য। কারো মুখেই কোন কথা নেই। নয়তো অন্য দিন তো দুজনে কতো হাসি মজা করে। আজ পুরো ভিন্ন। খাবারেও দুজনের মন নেই। একটু খাচ্ছে আবার শুধু নাড়াচাড়া করছে আর একটু পর পর শুধু একে অপরের দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে। মূল ধ্যান মূলত তাদের সেখানেই। খোদেজা বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। তাই সেও আর কোন কথা না বলে চুপচাপ নিজের খাবার খেয়ে প্লেট রান্নাঘরে নিয়ে রাখতে গেলো। খোদেজা যাবার পর শুদ্ধ পানি ঢালার জন্য জগ কাত করতেই বেখেয়াল বশত পানি ছিটকে পড়লো তার কোলে। শুদ্ধ থতমত খেয়ে উঠলো। ধারা নিজের খাবারের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করে হেসে উঠলো। শুদ্ধ থম মেরে বলল,
‘তুমি হাসলে কেন?’
ধারা শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
‘আমার মুখ, আমার হাসি, আমার ইচ্ছা।’
এই বলে আরও শব্দ করে হাসতে লাগলো ধারা।
শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। কিছু খাবার প্রায় শেষের দিকে। একটি বাটিতে এক পিছ বেগুন ভাজা অবশিষ্ট ছিল। ধারা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। অনভ্যাস বশত শুদ্ধও সেদিকে হাত বাড়িয়ে ফেললো। দুজনের হাত একসাথেই পড়লো বাটিতে। শুদ্ধ বলল,
‘আমি আগে হাত দিয়েছি। তুমি বাড়ালে কেন? বেগুন ভাজা আমি নেবো।’
‘ইশ! বললেই হলো! আমি আগে হাত দিয়েছি। তাই আমি নেবো।’
ধারা নিজের দিকে বাটি টেনে নিলো। শুদ্ধও আবার বাটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
‘আগে হাত আমার গেছে। বাটি ছিল মাঝখানে। তোমার হাতের চাইতে আমার হাত লম্বা। দুজনে যদি একসাথেও বাড়িয়ে থাকি লজিক্যালি আমার হাতই আগে যাবে। অতএব বেগুন ভাজা আমার।’
‘তুমি না বেগুন খাও না! বেগুন খেলে তোমার শরীরে চুলকানি হয়।’
সত্যি বলতে শুদ্ধ ভুলেই গিয়েছিল যে তার বেগুন খেলে চুলকায়। ধারার কথায় খেয়াল হলো। কিন্তু এখন এতদূর এসে হেরে যাওয়াও তো যায় না। তাই নিজের গাঁট বজায় রেখে বলল,
‘আমার শরীর নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমারটা আমি বুঝবো। এমনিতেও চোখের সামনে কতো চুলকানি সহ্য করি। বেগুনের চুলকানিতে আর কি!’
শুদ্ধ যে কথাটা ধারাকে মিন করে বলেছে তা অনুধাবন করতে পেরে ধারার মুখ হা হয়ে গেলো। সে বিস্ফোরিত মুখে বলল,
‘আমি চুলকানি!’
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, ‘যাক! তোমার বোঝার লেভেলটা অন্তত ভালো।’
ধারা রান্নাঘরের দিকে মুখ করে বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁদো কাঁদো মুখ করে জোরে ডেকে উঠলো,
‘মা!’
শুদ্ধ বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ! কিছু হলে তো শুধু এটাই পারো। ম্যাঁ!’
শুদ্ধ ধারার মতো করে মুখ ভেঙিয়ে ডেকে দেখালো। ধারা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘এমন করছো না! এখন এই বেগুন আমিই খাবো।’
ধারা বাটি টেনে ধরলো। শুদ্ধও বাটি টেনে ধরে বলল, ‘কোনদিনও না। আমি খাবো।’
দুজনে বাটি ধরে টানাটানি করে চেঁচাতে লাগলো। খোদেজা তখন ওদের মাঝখান থেকে বাটিটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,
‘কি শুরু করলি তোরা? কতক্ষণ ধইরা সহ্য করতাছি। একটু প্লেট ধুইতে রান্নাঘরে গিয়া আর টিকতে পারলাম না। তোদের দুজনের কারোরই খাওয়া লাগবো না। এই বেগুন ভাজা আমিই নিয়ে গেলাম।’
খোদেজা বেগুন নিয়ে গেলে দুজনেই হা করে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আবার একে অপরের দিকে চোখ পড়তেই দুজনের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।
ধীরে ধীরে ঘড়ির কাটা এগোতে লাগলো। রাত হলো গভীর। নিঝুম। নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। ধারা আর শুদ্ধ ঘুমানোর জন্য বিছানায় উঠে দুজনে দুজনকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চাদর টেনে বিছানার দু প্রান্তে শুয়ে রইলো। কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকালো না। তারপর শুরু হলো তাদের চাদর নিয়ে টানাটানি। ধারা এই নিজের দিকে চাদর টেনে নেয়। আবার শুদ্ধও ছাড়ে না। শক্ত করে ধরে রাখে। দুজনে দাঁত খিচে চাদর নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলো। কেউ কারো থেকে কম না। একসময় শুদ্ধ জোরে চাদর নিয়ে টান দিতেই ধারার হাত হঠাৎ আলগা হয়ে গেলো। ফলস্বরূপ আচমকা চাদর নিয়ে বিছানা ছেড়ে নিচে পড়ে গেলো শুদ্ধ। ধারা উঠে বসলো। শুদ্ধ নিজেকে ধাতস্থ করে মেঝে থেকে উঠে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে বলল,
‘এটা কি হলো?’
‘কি হলো?’
‘তুমি ভালো মতো শোও না কেন? শুধু নড়াচড়া করো।’
‘আমি নড়াচড়া করি? নড়াচড়া করার মতো জায়গাটা কোথায়? এমনিতেও তো জায়গা পাই না। এতো বড় খাট তবুও সব জায়গা তো তুমিই দখল করে রাখো। এই যে এই এতটুকু জায়গার মধ্যে আমাকে শুতে হয়।’
‘আচ্ছা! আর ঘুমানোর পর যে তুমি আমার উপর ঠ্যাং তুলে রাখো তার বেলা?’
‘আর তুমি যে শুধু নাক ডাকো তার বেলা?’
শুদ্ধ বিছানায় উঠে তেড়ে এসে বলল,
‘একদম মিথ্যা কথা বলবে না।’
ধারাও পুরো তেজের সাথে বলে,
‘মিথ্যা হলে হোক, আমি তো একশোবার বলবো।’
‘তাহলে আমিও বানিয়ে বলবো তুমি ঘুমের মধ্যে মুখের লালা দিয়ে বিছানা ভাসিয়ে ফেলো। ছি! ছি! মানুষ শুনলে কি বলবে!’
ধারা রাগে দুঃখে জ্বলে উঠে বলল, ‘ভালো হবে না কিন্তু!’
‘অবশ্যই ভালো হবে।’
ওদের কথা কাটাকাটির মাঝে হঠাৎ খোদেজা রুমের দরজা খুলে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘আহ! থামবি তোরা! তোদের চেঁচামেচিতে ঘরে থাকা যাইতাছে না। ঘুমাবো কেমনে?’
খোদেজার ধমকে দুজনেই পুরো ভেজা বিড়ালের মতো চুপসে রইলো। চেহারায় নির্দোষ নির্দোষ ভাব ফুটিয়ে রইলো তারা। শুদ্ধ বলল,
‘সরি আম্মা। ধারা এতো জোরে জোরে কথা বলছিল যে যার কারণে তোমার এমন লেগেছে। আর হবে না।’
ধারা মুখ হা করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে আবার খোদেজাকে বলল, ‘হ্যাঁ মা, আর হবে না। শুদ্ধকে আমি বুঝিয়ে দেবো। শুধু শুধু সে চেঁচামেচি করে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো।’
শুদ্ধ বলল, ‘আমি চেঁচামেচি করেছি নাকি তুমি করেছো?’
‘জ্বি না। তুমি করেছো।’
‘না তুমি করেছো।’
খোদেজা আবারও মাথায় দু পাশে হাত উঠিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘চুপ! আর একটা কথাও কেউ বলবি না। নয়তো এখন আমার থেকে খারাপ কেউ হইবো না। তোদের দুইজনের আজকে হইছে কি বলতো? তোদের একসাথেই রাখা যাইবো না। তাইলে তোরা নিজেদের ঘুম তো বাদ আর আমারেও ঘুমাতে দিবি না। হ্যাঁ রে মাহতাব, আজকে তোরও কি হইছে বলতো? তুইও কি পোলাপান হইয়া গেলি। আমি বউরে নিয়া যাইতাছি। এখন থিকা বউ আমার কাছেই ঘুমাবো। একসাথে হইলেই তোগো খালি ঝগড়া আর ঝগড়া। এখন আলাদা থাইকা শান্তিতে থাক।’
খোদেজার কথা শুনে ওদের দুজনেরই মুখের হাওয়া বেড়িয়ে গেলো। দুজনে কিছু বুঝে উঠার আগেই খোদেজা ধারার হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে গেলো। ধারাকে নিয়ে গেলে শুদ্ধ একটু উপরে উপরে ভালো থাকার ভাব ধরে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর বারবারই শুধু নড়াচড়া করতে লাগলো সে। উঠে বসলো। পানি খেলো। তারপর আবার শুয়ে পড়লো। একশোবার এপাশ ওপাশ করেও আর ঘুম আসলো না। বারবার শুধু চোখ যেতে লাগলো দরজার বাইরে, খোদেজার রুমের দিকে।
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
ঘড়ির কাটা বারোটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। রাস্তায় একটি কালো বিড়ালের মিঁউ মিঁউ ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। এমন সময় একটা লম্বাকৃতির কালো ছায়া খোদেজার রুমের বাইরে দেখা যায়। ছায়াটা খুবই আস্তে আস্তে দরজার কাছে এগোতে থাকে। ছায়াটা মূলত শুদ্ধ’র। পা টিপে টিপে মায়ের রুমে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে সে। খোদেজার রুমের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। রুমের লাইট বন্ধ। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুদ্ধ কিছু ঠাওর করতে পারে না। আরো একটু স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টায় শুদ্ধ দরজার কাছে এগোতেই দরজা তার ধাক্কায় ক্যাত করে শব্দ হলে শুদ্ধ দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে আসে। শব্দ পেয়ে ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে ধারা। খোদেজা নির্লিপ্ত থেকে একটু জোরে জোরেই বলে,
‘ও কিছু না বউ। তুমি শুইয়া থাকো। মনে হয় কোন বিড়াল ছিল। আজকাল বড্ড জ্বালানি শুরু করছে।’
ধারা শুয়ে পড়লো। তারও একদমই ঘুম আসছে না। বারবার মন শুধু বাইরে যেতে চাইছে। বাইরের শব্দটা যে শুদ্ধ’র ছিল সেটা সেও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সামনে তো আর কিছু বলতে পারে না! তাই সে চুপচাপ শুয়ে রইলো। খোদেজার কথা স্পষ্টই শুনতে পায় শুদ্ধ। মা তাকে বিড়াল বলেছে রাগে দুঃখে শুদ্ধ খোদেজার দরজার সামনে গিয়ে শুধু পায়চারি করতে থাকে। ধারা একটু মাথা উঠিয়ে দেখতে নেয়। কিন্তু খোদেজার ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি দেখে আবারো দ্রুত শুয়ে পড়ে। দরজার ওপাশে শুদ্ধ’র পায়ের খটখট শব্দ বাড়তে থাকে। খোদেজা বলল,
‘এমন হাঁটাহাটি কইরা লাভ নাই। বউরে আর পাবি না। বউ আমার কাছেই থাকবো। চুপ কইরা যাইয়া ঘুমায় থাক।’
শুদ্ধ হাঁটা থামিয়ে বলল,
‘আম্মা, এটা কিন্তু ঠিক না। তুমি আমার বউকে নিয়ে আসবা কেন? আমার বউ আমার কাছে থাকবে।’
‘এই কথা ঝগড়ার করার সময় খেয়াল ছিল না! একসাথে হইলে যখন তোমরা ঝগড়াই করবা তাইলে আলাদাই থাকো। বউ আমার কাছেই ঘুমাবো আর তুমি যাইয়া তোমার রুমে ঘুমাওগা।’
‘না তাহলে আমিও এখানেই ঘুমাবো। আমার একা একা ভয় লাগে।’
‘মাইর খাবি এখন। ছাব্বিশ বছর একলা একলা ঘুমাইছিলি কেমনে? এখন তোর ভয় লাগে! যা এদিক থিকা!’
শুদ্ধ মেঝেতে বসে পড়ে বলে, ‘না, আমি যাবো না। আমি এখানেই বসে থাকবো।’
খোদেজা নির্লিপ্ত স্বরে বলে, ‘তাইলে থাক সারারাত ঐখানেই বইসা৷ তোর যেমন ইচ্ছা।’
তারপর ধারার দিকে ফিরে খোদেজা বলে,
‘তুমিও কিন্তু আবার ও’র মতো কইরো না বুঝছো! চুপচাপ ঘুমায় থাকো।’
শ্বাশুড়ির হুকুম শুনে ধারা চটজলদি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কাঁথা মুড়ি দেয়। শুদ্ধ মুখ গোমড়া করে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে আসে৷ অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। রাত আরও গভীর হয়। একসময় ধারা আস্তে আস্তে মাথা থেকে কাঁথা সরায়। একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করে খোদেজাকে। খোদেজার চোখ বন্ধ। অপরপাশ ফিরে শুয়ে আছে সে। ঘুমে পুরো কাতর। ধারা আস্তে করে গা থেকে কাঁথা সরায়, একটু একটু করে উঠার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই খোদেজার কাশির শব্দ শুনলে আবারও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর দেখে খোদেজার ঘুম ভাঙেনি। এমনিই ঘুমের ঘোরে কেশে উঠেছিল। ধারা আবারও আরেক দফা উঠার চেষ্টা করে। খুবই আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে বিছানা ছেড়ে এগোতে থাকে। খোদেজা দরজার মুখোমুখি শোওয়া। ধারা শুয়েছিল তার বিপরীত পাশে। তাই স্বাভাবিকই ধারার খোদেজাকে অতিক্রম করেই যেতে হবে। অন্ধকারে খুব সাবধানে এগোতে থাকে ধারা। এমনসময় খোদেজা পাশ ফিরতেই ধারা দ্রুত মেঝেতে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে মাথা উঠিয়ে দেখে খোদেজা ঘুমিয়েই আছে। তারপর খুবই ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক করে বেরোতেই কার সাথে যেন হঠাৎ ধাক্কা খায়। অন্ধকারে দুজনেই চমকে উঠে। ধারা চিৎকার দিতে দিতেও থেমে যায়। শুদ্ধ মুখ চেঁপে ধরে৷ ধারা নিজেকে ধাতস্থ করে ফিসফিস করে বলে,
‘ওহ তুমি! আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।’
শুদ্ধও অভিমানের স্বরে বলে,
‘আসছো তাহলে! আমি তো ভাবছি আর আসবেই না। কি না কি একটু রাগারাগি হয়েছে তার জন্য তুমিও এভাবে মার সাথে চলে যাবা! আমার কথা একটুও ভাবলে না?’
ধারা মোলায়েম স্বরে বলল,
‘আমি কি ইচ্ছে করে গিয়েছি! মা ই তো আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। আমারও তো যেতে ইচ্ছে করছিল না। ঘুমও আসছিল না এতক্ষণ।’
‘আর আমার বুঝি খুব ঘুম আসছিল! এজন্যই তো এখানে দশবার চক্কর দিয়ে ফেললাম।’
ধারা শুদ্ধকে সাবধান করে বলল, ‘আস্তে কথা বলো। মা আবার ঘুম থেকে উঠে যেতে পারে। আমাদেরকে একসাথে মা দেখলে আবারও রাগ করবে।’
‘এদিকে আসো।’ বলে শুদ্ধ ধারাকে বারান্দায় নিয়ে আসলো। দুজনে পাশাপাশি মেঝেতে বসলো। কেউ কোন কথা বলল না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দুজনেই চুপচাপ। ইতস্তত করতে লাগলো। কি বলবে না বলবে ভেবে পেলো না। শুধু আড়চোখে বারবার একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। একসময় শুদ্ধই নিরবতা ভেঙে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,
‘আচ্ছা সরি! আমারই ভুল হয়েছে। আমি আজকে তোমার সাথে খুব বেশি রাগারাগি করেছি তাই না!’
ধারা আস্তে করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বলল,
‘না, ঠিকই আছে৷ তুমি তো আমার জন্যই চিন্তায় এমন করেছো। ভুলটা আমারই। আমিই তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলাম। আমার কোন ভাবে তোমাকে ইনফর্ম করা উচিত ছিল।’
শুদ্ধ জোর গলায় বলল,
‘আরে না। তোমার ভুল কিভাবে হয়? তুমি তো আর ইচ্ছা করে করোনি! তোমার কাছে তো আর ফোন ছিল না। জানাবে কিভাবে? তারপরে তো আমার ফোনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যা করেছো ভালোই করেছো৷ সাম হাউ যদি আমি কোথাও আটকে যেতাম তাহলে তো তোমাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমিই শুধু শুধু ওভাররিয়্যাক্ট করে ফেলেছি।’
‘না, ভুলটা আমারই। আমার জন্যই এতোকিছু হয়েছে।’
‘আরে না, আমার ভুল।’
‘না আমার ভুল।’
আবারও কথা তর্কে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে শুদ্ধ ধারা দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো৷ দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ সবকিছুই লুকিয়ে দেখছিল খোদেজা। ওদের মধ্যে সবকিছু আবার ঠিক হয়ে গেছে দেখে মুচকি হেসে আবার নিজের রুমে চলে যায় সে। খোদেজার উপস্থিতি তারা কেউই টের পায়নি। দুজনে নিজের মতো করেই কথা বলে যেতে থাকে। শুদ্ধ মৃদু হেসে মাথা চুলকে বলল,
‘কি যে করি না আমরা! আজকে কি ঝগড়াটাই না করলাম।’
ধারা মাথা নিচু করে স্মিত হেসে বলল, ‘হুম।’
শুদ্ধ বলল, ‘তবে যাই বলো, আমি প্রথম প্রথম তোমার সাথে অনেক চেচাঁমেচি করে ফেলেছি। আমার এটা ঠিক হয়নি। তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছিল! কতো সবকিছু ঠিক রাখার চেষ্টা করি। তবুও সবকিছু জীবনে স্মুথলি যায়-ই না। ছোটখাট দুঃখকর ব্যাপার গুলো ঘটেই যায়।’
ধারা বলল, ‘ছোট ছোট দুঃখ জীবনে থাকা ভালো। কখনো পরিপূর্ণ সুখী হতে নেই। ঐ যে কথায় আছে না বেশি সুখ কপালে সয় না। সুখের পাল্লা বেশি ভারী হয়ে গেলে স্রোতের মতো দুঃখ জীবনের দিকে ধেয়ে আসে। প্রকৃতি ভারসাম্য পছন্দ করে। সুখের আধিক্য যতো বেশি হবে তাকে ঘাটতি করা দুঃখের পরিমাণ ততোই বড় হবে। আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় শুদ্ধ। আমি খুব বেশি সুখী হয়ে গেছি। কিছু হবে না তো!’
শুদ্ধ হেসে ধারাকে হাত দিয়ে আগলে বলল, ‘ধুর! কিছুই হবে না। তুমি বেশি বেশি ভাবো। আমি আছি না!’
শুদ্ধ’র ভরসামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ধারা বিচলিত মুখেই স্মিত হাসে। শুদ্ধ’র কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে। আর মনে মনে কামনা করে এই সময় কখনোই না ফুরাক।
চলবে,#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
একটা কালো রঙের কাক সেই কখন থেকে রেলিংয়ের উপর বসে গলা ছেড়ে কা কা করে ডেকে যাচ্ছে। ধারা বারান্দার টবগুলোতে পানি দেওয়া অবস্থাতেই আড়চোখে একবার কাকটার দিকে তাকায়৷ ধারার চোখের দৃষ্টিতে হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক ধারা তাকাতেই কাকটা তার গলার আওয়াজ কমিয়ে ফেললো। আরো দু একবার ক্ষীণ স্বরে কা কা করে পুরোপুরিই চুপ হয়ে গেলো। ঠিক তখনই ভেতর থেকে শুদ্ধ’র গলার আওয়াজ শোনা যায়। ধারার নাম ধরে অনবরত ডেকে যাচ্ছে সে। সকালের উদীয়মান সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে ধারা পানি দেওয়া বন্ধ করে রুমের মধ্যে ঢোকে। শুদ্ধ কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়ানো। কবাট খুলে তখন থেকে কি যেন খুঁজে চলেছে। ধারা পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করে ‘কি?’
শুদ্ধ খোঁজা চালিয়ে রেখেই বলল,
‘আমার কালো রঙের টাই টা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না।’
ধারা দ্বিতীয় তাকের শার্টের স্তুপটা একটু উঁচু করতেই কালো রঙের টাই টা বেরিয়ে এলো। শুদ্ধ একগাল হেসে ফেলে বলল, ‘ও এখানে ছিল! দেখেছো আমার চোখেই পড়েনি।’
শুদ্ধ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের উপর টাই পেঁচাতে থাকে। ধারা পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসে। শুদ্ধকে আজ অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই এক্সাইটেড লাগছে। আর হবেই বা না কেন? আজ শুদ্ধ একটা ইয়াং এচিভমেন্ট ইভেন্টে এই প্রথম ইনভাইটেড। যেই ইভেন্টে এইবার প্রধান আকর্ষণই মূলত শুদ্ধ। শুদ্ধ’র মতো আরো অনেকেই আছে। তবে সাধারণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করা উঠতি সাফল্যের অধিকারী শুদ্ধ’র কাজের দক্ষতাই এখন অধিক আলোচিত। শুধু শুদ্ধ একা নয়, শুদ্ধ’র পুরো পরিবারই সেখানে আমন্ত্রিত। অতএব ধারা আর বাকি সবাইও যাবে। তবে শুদ্ধকে বেরোতো হচ্ছে একটু আগেই। ফ্যাক্টরিতে তার কিছু জরুরী কাজ আছে। সদ্য চালু হওয়া এই ফ্যাক্টরিতে এখন নানাবিধ প্রয়োজনীয়তা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। শুদ্ধ ঠিক করলো ফ্যাক্টরি থেকে সে যথাসময়ে ইভেন্টে পৌঁছে যাবে। ধারাকে বলে দিয়েছে যেন সোজা ইভেন্টে চলে যায় তারা।
ধারা অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ছিল। শুদ্ধ’র মুখের খুশির আমেজটা দেখতে তার ভালো লাগছে। তার থেকেও বেশি ভালো লাগছে, শুদ্ধ তার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে পৌঁছাতে পারছে দেখে। ধারা নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে এই অসাধারণ মানুষটির সাফল্যের দ্বারে পৌছানোর অসাধারণ যাত্রাটি নিজের চোখে দেখতে পারছে বলে। টাই বাঁধতে গিয়ে শুদ্ধ বারবার তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। ধারা সেটা খেয়াল করে মৃদু হেসে শুদ্ধ’র হাত ছাড়িয়ে নিজে টাই বেঁধে দিতে লাগলো। শুদ্ধ হড়বড় করে বলতে লাগলো,
‘ধারা, আমি কিন্তু ফ্যাক্টরির কাজ শেষ হলেই সেখানে পৌঁছে যাবো। তোমরা তার আগেই বেড়িয়ে পড়ো কিন্তু। আর….
শুদ্ধ’র কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অবিকল তার মতো করে ধারা বলতে লাগলো,
‘আর একদমই লেট করবে না, সাবধানে যাবে, নিজেদের খেয়াল রাখবে। এই তো?’
শুদ্ধ হেসে ফেললো। ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল,
‘উহুম! আরো আছে। যাবার আগে খেয়াল করে ফোনটা সাথে করে নিয়ে যেয়ো।’
শুদ্ধ মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে বের হওয়ার জন্য এগোলো। ধারা পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,
‘আমি মাকে নিয়ে একা একা যেতে পারবো। তুমি চিন্তা করা বন্ধ করো। একটা নতুন এড্রেস খুঁজে যাওয়া আর এমন কি! আমি পারবো।’
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শুদ্ধ বলল,
‘হুম, অবশ্যই পারবে। আমি যখন থাকবো না তখন তো তোমাকে একা একাই সব করতে হবে।’
মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো ধারার। এক আকাশ অভিমান নিয়ে সে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এমন কথা আর কক্ষনো বলবে না। তোমাকে ছাড়া আমি কিচ্ছু পারবো না।’
ধারার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। শুদ্ধ হেসে ফেলে বলল,
‘আচ্ছা ঠিকাছে বলবো না৷ আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন একটু হাসো প্লিজ! আমাকে এভাবে গোমড়া মুখে বিদায় দিবে?’
ধারা ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হাসলো। ধারার কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে চলে গেলো শুদ্ধ। ধারা দাঁড়িয়ে রইলো। সিঁড়ি দিয়ে যতক্ষণ শুদ্ধ’র ছায়াটা পর্যন্তও দেখা গেলো ততক্ষণ।
__________________________________________
একটা ক্যাব ভাড়া করে যথাসময়েই ধারা, খোদেজা আর চুমকি ইভেন্টে পৌঁছে গেলো। খোদেজার আসার একদমই ইচ্ছে ছিল না। প্রচন্ড সংকোচ হচ্ছে। এতো বড় বড় মানুষের ভেতর সে অর্ধমূর্খ মানুষ আর কি করবে! কিন্তু তার ছেলে সেই কথা শুনলে তো! ঠিকই জোর করে মাকে রাজী করিয়ে ছেড়েছে। নয়তো মাকে ছাড়া সে যাবে না। চুমকি ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে আছে৷ এতো সুন্দর সাজ সজ্জা সে আগে কখনো দেখেনি। প্রবেশ দ্বারেই বেলুন দিয়ে রাউন্ড করে গেট সাজানো। এতো এতো বেলুন! চুমকির ইচ্ছে হলো দু একটা বেলুন ছুটিয়ে নিয়ে রেখে দিতে। অনেক কষ্টে সে তার ইচ্ছেটাকে সংযত করলো। অনেক মানুষ পাস দেখিয়ে ঢুকছে। ধারা সবাইকে নিয়ে ঢুকলো। কিন্তু হলের ভেতরে গেলো না। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ তাদেরকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে শুদ্ধই এখনও আসেনি। নিশ্চয়ই কোন কাজে আবার আটকা পড়ে গেছে। শুদ্ধকে ফোন লাগালো ধারা। কিছুক্ষণ বাজতেই শুদ্ধ রিসিভ করলো৷ তাড়াহুড়োর গলায় বলল,
‘ধারা, তোমরা কি পৌঁছে গেছো?’
ধারা বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি কোথায়? কখন আসবে? আর তোমার আশেপাশে এতো শব্দ কেন?’
শুদ্ধ একটা সিএনজি ডেকে উঠতে উঠতে বলল,
‘এই তো আমি রাস্তায়। মাত্র সিএনজিতে উঠলাম। একটুপরই এসে পড়বো।’
‘তুমি সবে গাড়িতে উঠলে? এতক্ষণ ফ্যাক্টরিতেই ছিলে! তাড়াতাড়ি আসো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি।’
‘আচ্ছা, আমি আসছি। ফোন রাখছি, কথা কিছু শোনা যাচ্ছে না৷ তোমরা ভেতরে গিয়ে বসো। দাঁড়িয়ে থেকো না।’
শুদ্ধ ফোন কেটে দিলো। ধারা ভেতরে গেলো না। দাঁড়িয়ে রইলো। অনেকক্ষণ পর আবার শুদ্ধকে ফোন দিলো। শুদ্ধ তখন সিএনজিতে। আশেপাশে শুধু গাড়ির হর্নের শব্দ। ফোনের আওয়াজ শুদ্ধ শুনতে পেলো না। একটু পর পর গাড়ি জ্যামে আটকে পড়ছে। শুদ্ধ বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো। এমন হতে থাকলে তার নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। শুদ্ধ সিটের সাথে ঠেস দিয়ে বসে তাড়াতাড়ি পৌছানোর অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাস্তায় এখন পুরোই রমরমা অবস্থা। শুধু গাড়ি আর গাড়ি। সবারই আগে যাবার তাড়া। একটা বড় ট্রাক সবাইকে পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগোতে লাগলো। প্রশস্ত রাস্তার মাঝখানে দাপট দিয়ে চলতে লাগলো সেটি। একসময় নিজের থেকে ক্ষুদ্র একটি সিএনজির পেছনে পড়ে তাদের গতিতে স্লোথ এসে পড়লো। বারকয়েক হর্ন বাজিয়ে সড়ে যেতে বলল। সিএনজি চালকের সাইড দিতে একটু দেরি হতে লাগলো। কিন্তু সেই দেরি সহ্য হলো না সেই বৃহদাকার ট্রাক চালকের। বৃহত্তর কেন ক্ষুদ্রতরকে পরোয়া করবে? কতোই না অবলীলায় সিএনজিটাকে ধাক্কা মেরে নিজের জায়গা বানিয়ে চলে গেলো ট্রাকটি।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো শুদ্ধ এখনও আসলো না। ধারা আর খোদেজা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলো৷ এর মাঝে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক এসে ভেতরে বসার জন্য অনুরোধ করে গেছে তাদের৷ তারা যায়নি। একসময় ইভেন্ট শুরুও হয়ে গেলো। অনেকে এসে শুদ্ধ’র কথা জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু ধারা কিছু বলতে পারলো না। বারবার শুদ্ধকে ফোন করতে লাগলো ধারা। কিন্তু না আর ফোন রিসিভ হলো আর না কোন খবর পেলো। ধারা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। একসময় খবর এলো। কিন্তু সেটা শুদ্ধ’র ফিরে আসার নয়, তার এক্সিডেন্টের।
__________________________________________
ধারা পাগলপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে এসে পৌঁছালো। নিঃশ্বাসটাও যেন আটকে আছে তার। তার পেছনে আছে খোদেজা আর চুমকি। কাঁদতে কাঁদতে তাদের অবস্থাও খারাপ। হাসপাতালে এসে ওরা জানতে পারলো এক্সিডেন্টের সময় সিএনজি চালক ছিটকে গাড়ির বাইরে পড়ে গিয়েছিল। সে খানিক আহত হয়েছে। আর তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু শুদ্ধ’র অবস্থা খুব বেশি খারাপ। তাকে আইসিউতে শিফট করা হয়েছে। একটা ডাক্তার সেখান থেকে বের হয়ে আসলে ধারা তোতাপাখির মতো বুলি আউড়ে শুদ্ধ’র কথা জিজ্ঞেস করলো। ডাক্তার কপালে একটা চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে বলল,
‘এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।’
ডাক্তারের মুখে এই কথা শুনে ধারার পুরো পৃথিবী ঘুরে উঠলো। মেঝেতে পড়ে গিয়ে তার কপালের কার্নিশ কেটে গেলো। গল গল করে রক্ত বেরোতে লাগলো সেখান থেকে। তার নিথর শরীরটা টেনে একটা বেডে শুইয়ে দিয়ে একজন নার্স ব্যান্ডেজ করে দিলো। একটু পর জ্ঞান ফিরে আসলে, চোখ খুলেই সে সবার আগে শুদ্ধ’র কথা জিজ্ঞেস করলো। দ্রুত বেগে উঠে বসতেই কপালের তীক্ষ্ণ ব্যাথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপই হলো না। শরীরের যন্ত্রণার চাইতে মনের যন্ত্রণাই যে তাকে অধিক কাবু করে রেখেছে। যখন সে জানতে পারলো শুদ্ধ’র অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি সে আবারো পাগলের মতো কান্নাকাটি করতে লাগলো। মাথার ব্যান্ডেজ টান দিয়ে খুলে ফেলে, দু হাত দিয়ে গাল খামছে ধরলো। কখনো আবার দাঁত দিয়ে হাত কামড়ে ধরলো। শুদ্ধকে ছাড়া এক মুহুর্তের জন্যও বেঁচে থাকার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। বারবার শুধু আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো। কেউই তাকে শান্ত করতে পারলো না। ডাক্তারদের পা পেঁচিয়ে ধরে শুধু তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য আকুতি করতে লাগলো। ডাক্তার বলল তাদের যতটুকু করার তারা করেছে। এখন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলেই কিছু একটা বলা যাবে। জ্ঞান না ফিরলে পেশেন্টের কোমায় যাবারও সম্ভাবনা আছে। ধারার বুক চিরে যাবার মতো যন্ত্রণা হতে লাগলো। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো সে। ধারার এই অবস্থা ডাক্তার নার্স সহ সবার চোখেই পানি এনে দিলো। এমন ভাবে বেশিক্ষণ চলতে থাকলে হয়তো এই মেয়েটিই মারা যাবে। একটুপর পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে সে। খোদেজার হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। ছেলের দুঃখে সে কি কাঁদবে ছেলের বউকে সামলানোর জন্য তাকেই শক্ত থাকতে হলো। ধারার মাথাটা বুকে চেঁপে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো সে। হাসপাতালে এসে শুদ্ধ’র যেই রক্তমাখা মুখটা দেখেছিল সেটা বারবার তার মস্তিষ্কে আঘাত করে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করতে লাগলো। তার ছেলে মাহতাব। জন্ম না দিলেও তার নিজের ছেলের থেকেও সে বেশি। পুরো পৃথিবীর কাছে এই মাহতাব বিচক্ষণ, দূরদর্শি, গুছিয়ে কথা বলার মানুষ হলেও মায়ের কাছে সে ছিল নিতান্তই বাচ্চাসুলভ। যখন যা মনে আসতো অবলীলায় বলে দিতো। কতো শ্রম আর মেধায় এই ছেলেই কতো কিছু করে ফেললো৷ আর আজ কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে দেখো! খোদেজার বুকের মধ্যেটা মোচড় দিয়ে উঠে।
মাঝখান থেকে কেটে গেলো সতেরো ঘন্টা। শুদ্ধ’র জ্ঞান ফেরার কোন হদিশ নেই। ধারার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। বারবার নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলতে লাগলো সে। এর মাঝে অনেকবারই জ্ঞান হারিয়েছে। তাকে সামলানো ভারী মুশকিল হয়ে উঠলো। বারবার শুদ্ধ’র কাছে যাবার জন্য পাগলামো করতে লাগলো। উপায় না পেয়ে জোর করে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করা হলো তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ তার কাজ শুরু করে দিলো। শুদ্ধ’র কাছে যাবার জন্য ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে অবশ হয়ে আসতে লাগলো তার শরীর। ক্লান্ত চোখগুলো ঝাপসা হবার আগে সে শুধু একটা কথাই শুনতে পেলো,
‘শুদ্ধ’র জ্ঞান ফিরেছে।’
চলবে,