হৃদপূর্ণিমা -Part 16-20

0
295

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৬+20 |
রথি একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নাশিদ তার পাশেই বসা। নয়ন ড্রাইভ করছে। রথির কনুইয়ের কাছে ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ। সে একমনে গত দিনগুলোর কথা ভাবছে। ওরা এখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। রথি নাশিদকে সামনে পেয়েও কোনরকম রিয়েকশন করেনি৷ নাশিদও ওকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। কারণ, রথির ফ্যাকাসে মুখটা দেখলেই বোঝা যায় কী পরিমাণ চাপের মধ্যে গেছে। ডাক্তার তাকে বারণ করেছে কোনো ব্যাপারে চাপ দিতে। তাই নাশিদ এখনো গতদিনের প্রশ্নগুলো করতে পারেনি। রথির রিফ্রেশ হওয়া দরকার, আপাতত নাশিদ সেই ব্যবস্থাই করবে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা গুলশানে পৌঁছে গেলো। ভোর হওয়ায় রাস্তায় জ্যাম তেমন একটা নেই। নাশিদ ফিসফিস করে বলে,
-‘চা খাবে?’
রথি বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে নাশিদের দিকে তাকালো। তার এই দৃষ্টি নির্বিকার। রথি অস্ফুট সুরে বললো,
-‘খেতে ইচ্ছে করছে না!’
-‘খেতে হবে। নয়ন, ওই টঙের পাশের গাড়ি থামাও আর দুই কাপ চা নিয়ে এসো। তুমি খেলে তুমিও নিও।’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে টঙের সামনে গাড়ি থামিয়ে চলে গেলো। নয়ন চলে যেতেই নাশিদ বললো,
-‘খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে সেন্সিটিভ হও! আমি জানি তুমি গতকাল সারাদিন কিচ্ছু খাওনি! এরকম হলে চলে বলো তো? খেতে হবে, নয়তো তোমায় এখানে ফেলেই চলে যাবো!’
নাশিদের কথা শেষ হতেই রথি নাশিদের হাত খামচে ধরলো। অতঃপর নাশিদের কাঁধে আচমকাই মাথা রাখলো। এতে নাশিদ মুহূর্তেই জমে গেলো। কী বলবে না বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। রথি তার কাছাকাছি থাকলে এমন অনুভূতি হয় কেন? এই অনুভূতির নাম তার যে অজানা। তবে সব এলোমেলো লাগে। হঠাৎ নাশিদ তার কাঁধের শার্টে ভেঁজা কিছু অনুভব করলো। নাশিদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো রথি কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদলেও মাঝেমধ্যে ফোঁপানোর শব্দও হচ্ছে। নাশিদ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। রথি ভাঙ্গা গলায় বললো,
-‘দয়া করে আমায় ছেড়ে যাবেন না। অনেক কষ্টে আমি আপনাকে পেয়েছি, আপনি ছাড়া আমি মস্তিষ্কশূন্য হয়ে যাই। এই বিরাট পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে এক আপনি আমার ভরসার স্থান, আমার সবচেয়ে আপনজন। এতোটা নিষ্ঠুর আপনি হতে পারেন না পুলিশম্যান!’
কথার মাঝে মাঝে রথি হেঁচকি দিয়ে উঠছিলো। আর নাশিদ? তার অবস্থা নাই-বা বর্ণনা করলাম। তার চোখের কোণও সমানতালে ভিঁজে গেছে। তার ভেতরটায় কেউ যেন ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। সে মনে করতে লাগলো গতদিনটার কথা। কীভাবে তোপ্রে তোপ্রে রথিকে পাগলের মতো খুঁজেছে। রথিকে হারানোর ভয়ে অনেকটা অস্থির হয়ে গেছিলো সে। এই মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললে সে কী করে বাঁচবে? প্রিয়জনকে হারানোর ভয়টা বুঝি এতোই তীব্র? নাশিদ এবার তার অন্য হাত দিয়ে রথিকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এই মেয়েটাকে ছাড়া সে পারবে না থাকতে। কিছুতেই পারবে না। এই মেয়েটা তার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে মিশে গেছে। সব ভালোবাসা কী ছুঁয়ে অনুভব করা যায়? কিছু ভালোবাসা তো দূরত্বেই আসল চাওয়া-পাওয়া বুঝিয়ে দেয়, বুঝিয়ে ভালোবাসার মর্ম, পবিত্রতা!
নাশিদ রথির কানের সামনে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-‘শিসসস! আর কেঁদো না। আমি তো তোমারই কাছে, রথ! এভাবে কেঁদে নিজেকে ভাসালে হয়? আমি এসেছি তো।’
রথি নাশিদের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে হেঁচকি তুলে চোখ-মুখ লাল করে বলতে লাগে,
-‘আ..আবির যদি সময়মতো ন..না হেল্প করতো সত্যি সত্যিই আমি অন্যকারো..!!’
বলেই রথি আবার কেঁদে উঠলো। নাশিদের ভেতরটাও ধক করে উঠলো। সত্যিই তো কী হতো? নাশিদ রথির চোখ মুছে মৃদু সুরে বললো,
-‘ওসব ভুলে যাও রথ। সকলের জীবনে কোনো না কোনো কালো দিন আসেই। মনে রেখো দুঃখের পরেই সুখ। অতীত মনে রেখো না। কাল যেটা ঘটে গেছে সেটা তোমার অতীত আর এখন তোমার বর্তমান। বর্তমান এবং ভবিষ্যৎটাকে উপলব্ধি করো। আল্লাহ আছেন, কোনো বিপদ হবে না আর। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ রথ!’
রথি নাক টেনে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়েই মাথা নাড়ায়। নাশিদ মুচকি হাসলো। নয়ন এসে দুই কাপ চা দিলো। নাশিদ ভ্রু কুচকে বললো,
-‘দুই কাপ চা আনতে এতো সময় লাগে?’
নয়ন দাঁত কেলিয়ে বলে,
-‘আসলে হয়েছে কী স্যার আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি! তাই আপনাদের টা আনতে দেরী করে ফেলেছি!’
নাশিদ কটমট দৃষ্টিতে নয়নে পানে তাকালো। রথি নিঃশব্দে হাসলো। সেই হাসিটা নাশিদ না দেখেও উপলব্ধি করলো। অতঃপর নাশিদ চা দুটো নিয়ে নয়নের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘আরেকটা পানির বোতল আনো, সেটা দিয়ে ১০ মিনিট দূরে রোদের মধ্যে দাঁড়ায় থাকবা!’
নয়ন দাঁত কেলানো বন্ধ করে বলে, ‘কেন স্যার?’
-‘চা দেরী করে আনার শাস্তি!’
নয়ন মুখ গোমড়া করে পানির বোতল আনতে চলে গেলো। আবার কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও এলো। নাশিদ আর রথি ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। পানির বোতল দিয়ে নয়ন চলে গেলো ছায়া থেকে রোদে। নাশিদ রথির দিকে বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
-‘চোখে-মুখে পানি দাও। ইচ্ছে হলে মাথায়ও হালকা পানি দাও, অস্থিরতা কমবে!’
রথি মাথা নাড়িয়ে বোতলটা নিয়ে চোখ-মুখ ধুঁয়ে নিলো। মাথার মাঝেও হালকা পানি দিলো। অতঃপর কয়েক ঢক পানি খেয়ে নাশিদকে দিলো। নাশিদও দুই ঢক খেয়ে বোতল ফেলে দিলো কারণ, পানি শেষ। রথি ওড়না দিয়ে মুখ আর মাথা মুছে নাশিদের থেকে চা টা নিলো। আস্তে ধীরে চায়ে চুমুক দিলো আর নাশিদের সাথে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। এই পাশটা খানিক নির্জন। কিছুক্ষণ বাদে বাদে দু-একটা রিকশা যাচ্ছে। চা খেতে খেতে রথি নাশিদকে বললো,
-‘ভাইয়াটাকে ওদিকে পাঠালেন কেন? বেচারা তো ঘেমে একাকার! এমনেই কতো গরম!’
-‘মাঝেমধ্যে বাঁকাকে সোজা করতে এসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়!’
-‘আমি বাঁকা হলে?’
নাশিদ মুচকি হেসে ওয়াইনটাইম কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে মৃদু সুরে বললো,
-‘আমার স্টাইলে আবার সোজা করে দিবো!’
নাশিদের রুদ্ধ দৃষ্টি রথি সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে ফেলে। অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে তার মধ্যে, ভীষণ অদ্ভুত! অবশেষে রথির জন্যই নাশিদ নয়নকে ডাকলো। নয়ন রুমালে কপাল মুছতে মুছতে আসলো।
-‘রথের জন্য আজ শাস্তি কম দিলাম।’
নয়ন চোখ-মুখ চকচক করে বললো, ‘ম্যাম বলেছে?’
নাশিদ মাথা নাড়ায়। নয়ন দাঁত কেলিয়ে বলে,
-‘আপনি আসলেই অনেক ভালো, ম্যাম!’
-‘হুম হয়েছে। জলদি বাসায় চলো তোমার ম্যাম এখনো না খেয়ে আছে!’
নয়ন মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রথি গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো,
-‘আমরা এখন কোথায় যাবো?’
-‘আমার বাসায়। দুইদিন নাফিসার সাথেই থাকবে তুমি!’
-‘কিন্তু মা….’
রথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাশিদ বললো,
-‘কোনো কথা না, চলো। তোমার মাইন্ড রিফ্রেশ হওয়া আমার জন্য বেশি জরুরি!’
রথি নিচের দৃষ্টি নত করে মৃদু হাসলো। এই জোর খাটানোগুলো তার ভেতর প্রতিনিয়ত ভালোবাসার খোদাই করে যাচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যেই নাশিদদের বড় গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করলো। রথির এই বাড়িতে দ্বিতীয়বার আসা। তবে বাড়িতে ঢুকবে প্রথম। পথের দু’ধারের সৌন্দর্যে রথি বরাবরের মতোই মুগ্ধ। দরজা খোলার শব্দেই রথির ধ্যান ভাঙলো। নাশিদ দরজা খুলে রথির সামনে দাঁড়িয়েই বললো,
-‘কী ম্যাডাম? সারাদিন কী গাড়িতে বসে থাকার ইচ্ছা আছে? খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না?’
-‘আপনি এতো খাওয়া খাওয়া করেন কেন?’
-‘নামো!’
রথি ভেংচি কেটে নামলো। রথির এমন ভেংচি কাটা দেখে নাশিদ নিঃশব্দে হাসলো। এখন সকাল আটটা বাজে। নাশিদের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে রথি পুরো অবাক। এ যে পুরোই সৌখিন। শো-পিজ থেকে শুরু করে ফার্নিচার সব! রথির মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো। রথির ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটিয়ে নাশিদ বললো,
-‘চলো নাফিসার ঘরে। ওখান থেকে ফ্রেশ হয়ে ভালো ড্রেস পরে নিবা!’
বলেই রথিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রথির হাত ধরে টেনে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। তখনই হাই তুলতে তুলতে মনিকা নিজের ঘর থেকে বের হলো। সদর দরজার দিকে নয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনিকা বললো,
-‘কী নয়ন? সকাল সকাল স্যারকে নিতে এসেছো বুঝি?’
নয়ন কী বলবে বুঝলো না। বেকুবের মতো হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়। মনিকা আর কিছু না বলে কিচেনের দিকে চলে গেলো। নয়ন হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। নাশিদ বলুক আর না বলুক এই মহিলাকে তার শ্রীময়ী ভয়ংকরী লাগে। ভাগ্যিক স্যারকে ম্যামের সাথে দেখেনি৷ নয়তো নয়নের সিক্সথ সেন্স বলছে কোনো না কোনো ঝামেলা হতোই!
নাশিদ রথিকে নিয়ে নাফিসার ঘরে এসে দেখলো নাফিসা ঘুমে কাত। নাশিদ ধমকিয়ে নাফিসাকে ঘুম থেকে উঠালো। নাশিদকে আর রথিকে দেখে নাফিসার ঘুম হারিয়ে গেলো। সে চোখ বড় বড় করে রইলো। নাশিদ রথিকে নাফিসার কাছে রেখে নিজের ঘরে চলে গেলো। নাফিসা রথিকে একটা জামা দিতেই রথি জামাটা নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। রথির সাথে কোনো জামা-কাপড় নেই আবার এই ড্রেসে তার নিজেরও আনকনফরটেবল লাগছে। তাই উপায় না পেয়ে নাফিসার ড্রেসই পরছে। শাওয়ার নিয়ে নিজের ড্রেস ধুঁয়ে বেরিয়ে আসলো। নাফিসা তখন ঘরে ছিলো না। রথি বেলকনিতে গিয়ে জামা-গুলো মেলে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে এমনেই রোদের উত্তাপ বাড়বে, কাপড় তখন আরামসেই শুকিয়ে যাবে।
রথি বিছানায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করলো। মায়ের কথা বড্ড মনে পরছে। আর নাশিদই বা কোথায় চলে গেলো? নাশিদের কথা ভাবতে ভাবতেই নাশিদ ইউনিফর্ম পরে হাজির!
-‘আমি নয়নকে নিয়ে থানায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর ডাইনিং এ খাবার দিবে একসাথে খেয়ে নিও। আমি নাফিসাকে বলে যাচ্ছি, আর হ্যাঁ সবসময় নাফিসার সাথে থাকবে!’
-‘কখন ফিরবেন?’
-‘তা তো বলতে পারি না৷ তবে শীঘ্রই!’
বলেই নাশিদ চোখ টিপ দিয়ে চলে গেলো। রথির কেমন যেন লজ্জা, লজ্জা লাগছে। ওদের বিয়ে হলে বুঝি এভাবেই রথি জিজ্ঞেস করবে, নাশিদ কখন ফিরবে? নাহ রথির আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। রথি বেলকনি গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ ওইতো নাশিদের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রথি খানিক অপেক্ষা করতেই দেখলো নাশিদ বেরিয়ে গাড়িতে উঠছে। মুহূর্তেই গাড়ি গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৭+১৮ |
খাওয়ার টেবিলে মনিকা কিছুক্ষণ পর পর এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন চোখ দিয়েই সে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে। রথিও পরেছে এক অস্বস্তিকর অবস্থায়! কিছু বলতেই পারছে আবার খাবারও গলা দিয়ে নামছে না। রথিকে খাবার নাড়তে দেখে মনিকা থমথমে গলায় বললো,
-‘খাচ্ছো না কেন, রথি?’
মায়ের কথায় নাফিসা খাওয়া ছেড়ে রথির দিকে তাকালো। নেওয়াজ এবং বাবা আগেই খেয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন শুধু মেয়েরা মানে নাফিসা, মনিকা, রথি আর ভাবী নাস্তা করছে। নাফিসার থেকে রথির ঘটনা শুনলেও সে তেমন একটা ফ্রি-লি কথা বলতে পারছে না মনিকার সঙ্গে। হয়তো সময় লাগবে। তবে মনিকার কোনো সমস্যা নেই রথির এবাড়ি থাকা নিয়ে। ভাবী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
-‘নতুন পরিবেশ মা, তাই হয়তো কিছুটা বিধ্বস্ত।’
মনিকা আর কথা বাড়ায় না। দ্রুত খেয়ে চলে গেলো। উনি চলে যেতেই ভাবী রথির সঙ্গে কথা বলতে লাগলো,
-‘তোমার নামটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, সাথে তুমিও মিষ্টি একটা মেয়ে।’
ভাবীর কথায় রথি ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করলো। মৃদু সুরে বললো,
-‘ধন্যবাদ ভাবী!’
-‘ভাবী বলবে না, আপু ডাকবে!’
-‘কেন?’
-‘তোমার মিষ্টি কন্ঠে আপু ডাকটা ভালো লাগে!’
রথি হাসলো এবং খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। অবশেষে খাওয়া শেষ করলো। অতঃপর তিনজন মিলে নাফিসার ঘরে গিয়ে আড্ডা দেয়। আড্ডায় রথি ছিলো নিরব দর্শক। সে নিশ্চুপ হয়ে দেখছিলো। হুট করে ভাবীর কল আসায় সে চলে গেলো। নাফিসা তৎক্ষনাৎ রথিকে চেপে ধরলো।
-‘ভালোই তো দোস্ত! আমার ভাই এক্কেবারে রথ অবধি পৌঁছে গেছে, ভাবা যায়? কী সুন্দর করে বললো “রথের খেয়াল রাখবি” হায়! বুকে গিয়ে বিঁধিলো মেরি ঝাণ!’
-‘ঢং কম কর!’
-‘আরে না। সত্যি করে বল না, লাইন কী ক্লিয়ার?’
রথি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও মুচকি হাসি দিলো। এই হাসিতেই নাফিসা তার উত্তর পেয়ে যায়। নাফিসা রথিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,
-‘আলহামদুলিল্লাহ, রথি!!! তুই আমার ভাবী হবি! কী মজা!’
রথির ঠোঁটে তখনো হাসি। হঠাৎ কী মনে হতেই রথি নিজেকে ছাড়িয়ে ভ্রু কুচকে বললো,
-‘তুই তো আরও বড় শেয়ানা! আবিরের সাথে তোর যোগাযোগ কেমনে?’
নাফিসা লাল হয়ে মাথা চুলকানো ভঙ্গিতে বলে,
-‘একচুয়ালি আবির আমায় প্রপোজ করেছিলো। তোদের খবরের আগেই এক্সেপ্ট করে নিলাম!’
-‘ও আচ্ছা। তলে তলে এতকিছু? বাহ গ্রেট! কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করে না!’
-‘রাগ করিস না প্লিজ। তোকে বলতাম বাট সেই সুযোগ হলো কই? আবিরকে এক্সেপ্ট করেছি কারণ ওর ব্যবহার ভালো, দেখ না এখনো আমায় আপনি করে সম্বোধন করে৷ আই থিংক তোকেও….’
-‘হ্যাঁ করে। আবির ভালো ছেলে। তোর চয়েজ আছে।’
নাফিসার চোখ-মুখ চিকচিক করে উঠলো।
নাশিদ থানায় বসে পেন ঘুরাচ্ছে আর একমনে রথিকে ভাবছে। আপনমনেই বলে উঠলো,
-‘কৌতুহলও কী কখনো ভালোবাসায় রূপ নেয়?’

বিকালের দিকে নাশিদ বাড়ি ফিরলো। রথি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছে। নানান দুনিয়া ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পরে। নাশিদ ইউফর্ম পাল্টে শাওয়ার নিয়ে নাফিসার রুমেই গেলো। নাফিসা রুমে ছিলো না। রথি তখন তোয়াল দিয়ে মুখ মুছছিলো। মুখ থেকে তোয়াল সরিয়ে নাশিদকে দেখেই কিছুটা চমকে উঠলো। নাশিদ অবাক হয়ে রথির সদ্য ঘুম থেকে ওঠা মুখশ্রীকে দেখতে লাগলো। চোখ দুটো খানিক ফুলে যাওয়া, নাকেও হালকা লাল আভা সৃষ্টি হয়েছে। কতো মোহনীয় লাগছে এই মুখশ্রীকে। ইচ্ছে করছে তাকে খানিক ছুঁয়ে দেখতে।
নাশিদের এমন ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখে রথি চোখ নামিয়ে ফেললো লজ্জায়। নাশিদের ধ্যান ফিরলো।
-‘ঘুম হয়েছে?’
রথি মাথা নাড়ায়। নাশিদ হেসে এদিক ওদিক তাকালো। বুঝতে পারলো না পরে কী বলবে। নাশিদ আবারও বললো,
-‘খাওয়া-দাওয়া করেছো তো ঠিকমত?’
-‘না করলে আপনার কাছে খবর চলেই যেত!’
-‘তাও ঠিক।’
-‘শুনুন!’
নাশিদ রথির চোখে চোখ রেখে বললো,
-‘হু বলো!’
-‘আমি কালই বাসায় ফিরে যাবো!’
-‘কেন?’
-‘আমার মা আর ভাইয়া আছেন বাসায়। গাজীপুর তো ভাবী আর আমি-ই গিয়েছিলাম। তাইতো….’
আর কিছু বললো না রথি! নাশিদ প্রথমে অমত করলেও পরে কী ভেবে রাজি হয়। অতঃপর রুম থেকে চলে যায়! রথিও লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। এই মানুষটার সাথে কথা বলতে গেলেই কথাগুলো গলায় আটকে যায়। এখনো কেন এরকম অনুভূতি?
সন্ধ্যার পর নাশিদ নাফিসার ঘরে যাবে এমন সময়ই মনিকা নাশিদের পথ আটকে দাঁড়ায়। মনিকা থমথমে গলায় বললো,
-‘কোথায় যাচ্ছো?’
-‘রথির খবর নিতে, মা!’
-‘নাফিসা পাশে আছে, আর কোনো খবর নেয়ার দরকার নেই! তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেও!’ রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলোমনিকা। মনিকা যেন রথির খবর নেয়ার বিষয়টা মনিকাকে বিষিয়ে তুলছে।
নাশিদ একপলক সামনে নাফিসার রুমের ডোর দেখে আবারও মায়ের দিকে ফিরলো। অতঃপর মাথা নেড়ে বললো,
-‘ওকে মা।’
বলেই নাশিদ উল্টো পথে হাঁটা দেয়। মনিকা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে নাফিসার ঘরে গিয়ে বলে আসলো ৯টায় ডিনার উপরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর বেশ ভাব নিয়ে রুম ত্যাগ করলেন। রথি নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে চুপ করে বসে রইলো। এই মনিকাকে তার কেমন গন্ডগোল লাগে। নাফিসাকেও কিছু বলতে পারে না। যতোই হোক মা তো। মা সম্পর্কে কথা বলা খুব বেশি ভালো দেখায় না।
রাত ৯ টায় ডিনার পাঠালো মনিকা। দুই বান্ধুবি খেয়ে শুয়ে পরে। নাফিসার ঘরে ২৪ ইঞ্চির একটি এলইডি টিভি আছে। নাফিসা এখনো স্টুডেন্ট বিধায় খুব বড় টিভি পায়নি। তবে সেটা দিয়ে মোটামুটি ভালোই টিভি দেখা যায়। দুই বান্ধুবি টিভি দেখছে আর নানান আলাপ করছে৷ এই সময়ের মধ্যে রথি অনেকবার দরজায় তাকিয়েছে এই আশায় যে নাশিদ আসবে। কিন্তু অনেক অপেক্ষা করেও নাশিদ আসলো না। এতে রথি খানিকটা ব্যথিত হলো। মন খারাপ করে চুপ করে শুয়ে রইলো। বড্ড মিস করছে নাশিদকে। এভাবে কোথায় হারিয়ে গেলো নাশিদ?
মাঝরাতে হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে রথির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে চোখ না খুলেই বালিশের নিচে থেকে ফোন হাতড়ে হাতে নিলো। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলো নাশিদ কল করেছে। মুহূর্তেই রথির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। রথির পাশেই নাফিসা ঘুমোচ্ছে। রথি বিছানা থেকে উঠে বেলকনি চলে গেলো। কেটে যাওয়ার আগেই রথি নাশিদের কল রিসিভ করলো আর ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘হ্যালো?’
-‘ঘুমিয়ে পরেছো?’
-‘তাহলে আর কী করবো?’
-‘রেগে আছো আমার উপর?’
-‘আপনার উপর রাগ কেন করতে যাবো?’
-‘ওইযে তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি!’
রথির অভিযোগ থাকলেও সে তা প্রকাশ করলো না। থমথমে গলায় বলে উঠলো,
-‘এসব বলার জন্য কল করেছেন?’
-‘কেন ডিস্টার্ব করলাম? ওকে ঘুমাও, গুড নাইট!’
বলে কট করে কেটে দিলো। এদিকে রথির কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। নাশিদ এভাবে কেটে দিলো কেন? একরোখা, হিটলার পুলিশ! এই পুলিশদের প্রেমে পরলে এই এক জ্বালা। একেক সময় এদের একেক রূপ! ভাল্লাগে এসব? রথি দাঁত কিড়মিড় করে ভেতরে চলে গেলো। আর কথা বলবে না সে, নাশিদের সঙ্গে! সারারাত তার অস্থিরতার মাঝে কাটলো। ফজরের নামাজ পড়েই রথি ঘুমিয়েছে।
সকালে নাস্তা সেরেই নাশিদ রথিকে নিয়ে বেরিয়ে পরলো রথির বাড়ির উদ্দেশ্যে। পুরো রাস্তায় রথি একটা কথাও বললো না নাশিদের সঙ্গে। নাশিদও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বললো না। বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই রথি বিনা বাক্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে ভেতরে চলে গেলো। মুখ ফুটে কিছুই সে বললো না। নাশিদ একপলকে কিছুক্ষণ রথির যাওয়া দেখে সেও গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো।
রথি বাসায় ফিরতেই দেখলো সোফার ঘরে রথির মা থম মেরে বসে আছে৷ মুখটাও কেমন ফ্যাকাসে। মায়ের অপজিট সিটে সাইফ তার চুলগুলো দুইহাতে চেপে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মার্জান অদূরে তাতানকে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ মার্জানকে দেখেই রথি ঘৃণায় নাক সিটকালো। তবে এমন নীরবতার কারণ রথির জানা নেই। রথি “মা” বলে ডাকতেই উপস্থিত সকলে রথির দিকেই নজর দেয়। মা নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং এক পা এক পা করে রথির দিকে তাকালো। মার্জান ততক্ষণে তাতানকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়।
রথি আবারও “মা” বলে যেই জড়িয়ে ধরবে তখনই মা সজোরে তাকে থাপ্পড় মারলো। সেই থাপ্পড়ে রথি সেখানেই পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। গালে পর্যন্ত রথি হাত দিলো না। রথি জলজল দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখে স্পষ্ট আক্রোশ দেখা যাচ্ছে। রথি কিছুতেই তার মায়ের চড়টা নিতে পারছে না। কী এমন করলো যার কারণে তার মা তাকে থাপ্পড় মারলো?
রথি একপলক সাইফের দিকে তাকায়। সাইফেরও চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে কিন্তু সাইফ কিছুই বলছে না। এবার রথি নির্বিকার হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মা চোখে জল নিয়ে হুংকারের সুরে বলতে লাগলো,
-‘এই দিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম? এই দিন দেখার জন্য এই অবধি পুষেছি? কী করে এভাবে পালিয়ে গিয়ে আমার মান-সম্মান, বিশ্বাসকে তুই চুড়মার করে ফেললি? আল্লাহ! কেন তুমি আমায় এদিন দেখালে?’
বলতে বলতেই কাঁদতে লাগলো মা। রথি তখনো নির্বাক। সে যেন বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের কথার প্রতিটি অক্ষর কানে বারংবার বেজে চলেছে। স্মুক্ষ্ম সুইয়ের ন্যায় কিছু একটা বারংবার তাকে বুকে নিঁখুতভাবে আঘাত করছে। চোখের কোণ বেয়ে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরলো। রথি নির্বাক হয়ে বলে,
-‘তুমি ভুল ভাবছো মা, আমি পালাইনি আ…’
-‘চুপ কর! আর কোনোরকম নাটক করার চেষ্টা অবধি তুই করবি না! যদি পালিয়েই না থাকিস কোথায় হারিয়ে গেছিস? দুইদিন কই ছিলি? বাজে ছেলে-পুলের সাথে? তাহলে যা ওখানে, কেন এসেছিস তোর এই নিকৃষ্ট মুখটা দেখাতে? এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যা! আর কোনদিন যেন এই বাড়িতে তোকে না দেখি! কী হলো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা বলছি!’
বলেই মা আঁচলে মুখ গুঁজে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে চলে গেলো। রথি কান্নাভেজা চোখে সাইফের দিকে তাকালো। কিন্ত কোনো কিছুই হলো না। সাইফও তাকে পর করে দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। অবিশিষ্ট রইলো মার্জান, যাকে সে ঘৃণার চেয়েও অনেক বেশি কিছু করে। আজ মার্জানের জন্যই তার জীবনটা নিকষ কালো রাতের ন্যায় হয়ে গেছে।
মার্জান রথির দিকে এগিয়ে গেলো। মার্জানকে দেখে রথি বেরিয়ে আসতে নিবে ওমনি মার্জান দৌড়ে এসে রথির পথ আটকে দাঁড়ায় এবং বলতে শুরু করে,
-‘আমায় ক্ষমা করিস বোন। জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য তাও ক্ষমা চাচ্ছি। বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছা করে এসব করিনি। আমি এসব করছি ওই শামুনের জন্য। শামুন ছেলেটার কারণেই তোকে দূরে নিয়ে গেছিলাম আবিরের সঙ্গে বিয়ে দিতে। ভেবেছিলাম আবিরের সঙ্গে বিয়ে হলে এবারের যাত্রায় তুই শামুনের হাত থেকে বেঁচে যাবি কিন্তু তাও হলো না। বাসার আসার সময়ও শামুনের ওই বিশ্রী হাসি সাথে বিশ্রী কথাবার্তা আমার কানকে বিষিয়ে দিচ্ছিলো। বারবার বলেছে এবার যদি তোকে ওর কাছে বিয়ে দিতে রাজি না হই তাহলে সত্যি সত্যিই বাসা থেকে তোকে তুলে নিয়ে যাবে। যদি বিয়েও না করে তাহলে তোকে এক রাতের জন্য.. তারপর তোকে মেরে ডোবায় ফেলে দিবে। বিশ্বাস কর, আমার আত্মা কেঁপে উঠছিলো। আমি জানি তোদের সাথে অনেক অন্যায় করেছি ইভেন এখনো করছি। হয়তো সম্পত্তির লোভ ছিলো। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কোনোদিনও তোর খারাপ চাইনি। আমিও যে একজন মেয়ে। তাই বলছি প্লিজ তুই এই এলাকায় আর কোনোদিন আসিস না, তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি জানি তোর কেউ আছে যে কিনা তোকে আজীবন ভালোবাসবে। যদি ভালো নাই বাসতো তাহলে তোকে ওই অদূর গাজীপুর থেকে সুস্থ-সবল তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিতো না। তুই তার কাছেই ফিরে যা, আর আসিস না এই এলাকায়। কথা দিচ্ছি, মায়ের খুব খেয়াল রাখবো!’
শেষোক্ত কথাগুলো মার্জান কাঁদতে কাঁদতে বললো। রথির যেন সেদিকে খেয়াল নেই। সে নির্বিকার, অনুভূতিশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে। থমথমে গলাতেই বলে উঠলো,
-‘আমার আর কী আছে ভাবী? তুমি-ই তো সব কেড়ে নিলে!’
মার্জান এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। রথিকে জড়িয়ে ধরতে যেতেই রথি শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘খবরদার আমাকে ছুঁবে না! তোমার বানানো গল্প আমি শুনবো আর তোমায় ক্ষমা করবো, সেই স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো!’
বলেই রথি হনহন করে বেরিয়ে গেলো। একবার ফিরেও তাকালো না। রাস্তা দিয়ে আপনমনে হাঁটছে আর মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করছে রথি। যেই মায়ের চোখে আজীবন নিজের প্রতি আশ্বাস দেখেছে আজ সেই মায়ের চোখে অবিশ্বাস দেখেছে। এইদিন দেখার চেয়ে রথির মৃত্যুকেও সহজ লাগছিলো। রথির ভাবনার মাঝেই শামুন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। শামুন বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বলে,
-‘বাহ শিকারী দেখছি নিজেই এসে হাজির। তা মহারানী, আর ইউ রেডি ফর মিসেস শামুন?’
রথির গা শিউরে উঠলো। এমন বিশ্রী চাহনি তার গা কাঁপিয়ে তুলছে অনবরত। রথি চিৎকার দিবে তার আগেই শামুন রথির মুখ চেপে আড়ালে নিয়ে যেতে লাগলো। রথি না পেরে বারংবার হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করছে। এর মানে কী মার্জান ঠিক ছিলো? রথির চোখ বেয়ে আবারও অনবরত নোনাজল পরতে লাগলো। রথি মনে মনে চেঁচিয়ে “আল্লাহ” কে ডাকছে। কেন তাকেই কঠিন পরিস্থিতিতে জড়াতে হয়? কেন?
রথি একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলেও আবার হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। হারলে চলবে না। কী ভাবে রথি শামুনের হাতে জোরে কামড় দিলো। শামুন আর্তনাদ করে উঠলো। রথি দৌড় দিলো আর শামুন তারই পিছে। রথি দৌড়াতে দৌড়াতে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো। রথি চোখ উঠিয়ে উপরে তাকাতেই নাশিদকে দেখলো। নাশিদও খানিকটা মাথা নিচু করে রথির দিকে তাকালো। কিছু সময়ের ব্যবধানে কী হাল হয়েছে মেয়েটার। রথির ঠোঁটজোড়া মৃদু কাঁপছে। চোখও অসম্ভব লাল। সঙ্গে সঙ্গে নাশিদের ঠান্ডা মেজাজ অধিক রাগে পরিণত হলো। শামুন পুলিশ দেখে সেখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। শুকনো ঢোকও গিললো। নাশিদ রথিকে পাশে দাঁড় করিয়ে এক পা, এক পা করে শামুনের দিকে এগোতে লাগলো। শামুন উপস্থিত পরিস্থিতি সামলাতে আমতা আমতা করে বললো,
-‘দেখ! ওটা আমার শিকার। এগোচ্ছো কেন? ওহ বুঝেছি পকেট খালি তাইতো? নো প্রব্লেম মোটের অংকের মাল শীঘ্রই পৌঁছে যাবে তোর পকেটে…’
আর কিছু বলার আগেই এক নাশিদ জোরে নাক বরাবর একটা ঘুষি মারলো শামুনের নাক বরাবর। শামুন নাকে হাত দেয়ার আগেই নাশিদ এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো শামুনকে। আশেপাশে লোকজন জমে গেছে ওদের মারপিট দেখে। নাশিদ মারতে মারতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-‘এতো সাহস তোর? আরেকবার বল তো ওরে বাজে কথা, তোর ওই জিহবা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি। সে ওনলি আমার প্রোপার্টি! তাকে স্পর্শ করার, তাকে প্রটেক্ট করার অধিকার একমাত্র আমার আছে। তুই আমার পোপার্টির দিকে চোখ দিয়েছিস তোকে আমি আজ মেরেই ফেলবো হারামজাদা!’
মারতে মারতে নাশিদ শামুনকে আধমরা করে ফেলেছে। শামুন নিজের জান বাঁচাতে কোনোরকমে পকেটে থেকে একটা ছোট ছুঁরি নিয়ে সেটা দিয়ে নাশিদের হাতের খানিকটা কেটে ফেললো। নাশিদ তার থামেনি। শামুনকে একবারে মেরেই সে ক্ষান্ত হবে। পরিস্থিতি বিগ্রে যাচ্ছে দেখে রথি দৌড়ে এগিয়ে গেলো নাশিদের কাছে। তৎক্ষনাৎ নয়ন আর বাকি কয়েকজন পুলিশ চলে আসলো। ওরাই নাশিদের থেকে শামুনকে ছাড়িয়েছে। রথি নাশিদের এক বাহু শক্ত করে চেপে ধরেছে৷ নাশিদের এমন রূপ রথি এর আগে কোনোদিন দেখেনি। আজ সে প্রমাণ পেলো ঠান্ডা মানুষের রাগ ধরা-ছোয়ার বাইরে। রথি নিজেও নাশিদের এ রূপ দেখে ভয় পেয়েছে। নাশিদ তখনো রাগে সাপের ন্যায় ফোঁসফোঁস করছে। শামুনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়ই নাশিদ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-‘শালা! আমিও দেখবো তুই কেমনে জেল থেকে বের হোস! তোকে তো আমি…’
নাশিদ আবারও শামুনের দিজে এগোবে ওমনি রথি নাশিদকে জড়িয়ে ধরলো। নাশিদ থেমে গেলেও তার অস্থিরতা কমলো না। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো। নাশিদ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষ এখনো সার্কাসের আশায় দাঁড়িয়ে। নাশিদ ধমকের সুরে বললো,
-‘কী সমস্যা? আরও সার্কাস দেখবেন নাকি নিজেদের কাজে যাবেন? আর কোনো কাজ নেই? ডিসগাস্টিং!’
সকলে তৎক্ষনাৎ যে যার কাজে চলে গেলো। নয়ন আবারও ওদের কাছে ফিরে আসলো। থমথমে গলায় বললো,
-‘ছেলেটার অবস্থা অনেক খারাপ! কী করবো ওরে?’
-‘হসপিটাল নিয়ে চিকিৎসা করাও। সুস্থ হলে জেলে পুরবো!’
নয়ন আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো। অতঃপর নাশিদ রথিকে জড়িয়ে ধরে থমথমে গলায় বললো,
-‘বাড়ি চলো।’
তখনই রথি নাশিদের হাতের দিকে খেয়াল করলো!
-‘একি আপনার হাত কাটলো কী করে?’
বলেই দ্রুত হাত ধরলো। নাশিদ হাত ছাড়িয়ে রথির হাত ধরে গাড়ির দিকে চলতে লাগলো। রথি বুঝলো এই মানুষটার রাগ এখনো কমেনি। রথি অন্যহাতে চোখ মুছে চুপ করে চলতে লাগলো।
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ আজ তিন পর্ব দিয়েছি। ভাবা যায়? আমারই তো বিশ্বাস হচ্ছে না। যাইহোক, কাল গল্প নাও দিতে পারি তাই আজ মিটিয়ে দিলাম। যেহেতু আজ তিনটা পার্ট দিয়েছি অবশ্যই বড় মন্তব্য চাই। কষ্ট করে লিখেছি, এইটুকু তো এক্সেপ্ট করতেই পারি পাঠকমহলের কাছে। যাইহোক রিচেক দেয়া হয়নি। তাই ভলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ১৯ |
নাফিসাদের বাড়ি এসেছে দুইদিন হয়েছে। রথির এই বাড়িতে দম বন্ধের মতো লাগছে। আরেকজনের ঘাড়ের ওপর বসে খাওয়াটা একদমই তার বিবেকে সাঁয় দিচ্ছে না। তার উপর নাশিদেরও দুইদিন ধরে দেখা নেই। কথা বলা তো দূর মহারাজা একদম গুম হয়ে গেছে। ঘুমানোর আগে মায়ের দেয়া কষ্টে কাঁদে আর নাশিদের দেয়া ব্যথার তীব্রতা তো আছেই। পরেরদিন নাশিদ ওর বাসা থেকে জামা-কাপড়সহ খুঁটিনাটি এনে দিয়েছে তাও দেখা করেনি। তবে রথি কোচিং ছাড়েনি। নাশিদদের বাসা থেকে দূর হলেও রোজ বাস ধরে তাকে কোচিং যেতে হয় আবার আসতেও হয়। ভেতরটা তার দুঃখে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে মাকে আর নাশিদকে ছাড়া। এমন কী করেছে যার জন্য নাশিদ তার সঙ্গে দেখাই করছে না?
নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলে বলে নাশিদ অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে। আর ও যখন বাসা থেকে বের হয় তার আগেই রথি কোচিং এর জন্য চলে যায়। রথি মাথা নিচু করে শুধু শুনতো। নাফিসা রথির মন খারাপ দেখে রথিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে বলে,
-‘রাগারাগি হয়েছে বুঝি? আরেহ টেনশন নিস না। আমার ভাই মাঝেমধ্যে ক্ষ্যাপা হলেও ঠান্ডা হলে দেখবি তোকে চোখে হারাবে।’
-‘কেন রেগে আছে আমি তাইতো বুঝছি না নাফু। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না!’ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো রথি।
-‘ঠিক আছে আজ জেগে থাকিস, কাল তো তোর কোচিং অফ?’
রথি মাথা নাড়ায়! নাফিসা রথির চোখ মুছে দিয়ে বলে,
-‘তাহলে তো হয়েই গেলো। কাঁদিস না রথি, তোর মতো স্ট্রং মেয়ে কেঁদে বুক ভাসালে চলে? এখন যা তো ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর। আমি নিচে যাই, মা ডাকছে!’
রথি মাথা নাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। নাফিসা এদিকে নিচে নামতেই দেখলো তার মা কেমন দৌড়াদৌড়ি করছে৷ নাফিসা সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘কী ব্যাপার মা? এভাবে এতো দৌড়াদৌড়ি হচ্ছে কেন?’
মনিকা থেমে যায়। তার চোখে-মুখে খুশির আভাস। নাফিসা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো। মনিকা নাফিসার সামনে এসে হাসিখুশি স্বরে বলে উঠলো,
-‘আমার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে অর্পিতার কথা মনে আছে? অর্পি আজ আমাদের বাড়ি আসছে। থাকবেও কিছুদিন!’
নাফিসার হাসি মুখটা নিমিষেই ফুঁস। নাফিসা নরমালি বললো,
-‘হুট করে আসছে যে?’
-‘আমি বলেছি আসতে। এছাড়াও ভাইও একদিন বলেছিলো অর্পিতা আসার জন্য জেদ ধরেছে। আমি ভাবলাম আসুক কিছুদিন থেকে যাক!’
নাফিসা ছোট করে “ওহ” বললো। মনিকা থাকলো না দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। নাফিসা কিছু বিস্কুট আর সরবত নিয়ে উপরে চলে এলো। এতক্ষণে রথিও ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেছে। নাফিসাকে দেখে বললো,
-‘এসেছিস? আন্টি কী বললো?’
নাফিসা কথা ঘুরিয়ে বললো, ‘ও কিছু না। জিজ্ঞেস করলো রথির খেয়াল রাখছি কি না। দেখ আমায় দিয়ে তোর জন্যে সরবতও পাঠালো।’ মিথ্যা বলার কারণ সে চায় না অর্পির কথা উঠিয়ে নিজের মেজাজ খারাপ করুক।
রথি মুচকি হেসে বিছানায় বসতে বসতে বললো,
-‘তোরা আমায় ঋনি করে দিচ্ছিস রে নাফু। আমি সত্যি আর এখানে থাকতে পারছি না। প্লিজ আমায় ছেড়ে দে!’
-‘ঠাটিয়ে এক চড় মারবো তোকে। তোর এসব ফর্মালিটি অন্যদের সাথে দেখা কিন্তু আমার বেলায় চলবে না। আমার কথা কী বলছি, ভাইয়ের সামনে একবার এ কথা উচ্চারণ করেই দেখা না। রামধোলাই খাবি!’
রথি মুখটা ছোট করে ফেললো। নাফিসা একপ্রকার জোর করেই সরবত খাইয়ে দিলো সাথে বিস্কুটও। এদিকে রথি প্রতিনিয়ত অস্বস্তিতে মরছে।
সন্ধ্যায় রথি নাফিসার সাথে নিচে আসে। সোফায় বসে টিভি দেখছিলো তখনই নাশিদ সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো। রথির সেদিকে চোখ যেতেই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। দুইদিন পর দেখলো এই মানুষটাকে। দেখার তৃপ্তি যেন মিটে না। নাশিদকে সামনাসামনি দেখার জন্য কতো কিছুই না করেছিলো সে। দুইদিন তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিলো একপলক দেখার জন্য অথচ সেই মানুষটাই তার সামনে৷ আর কী লাগে? নাশিদ রথির দিকে একপলক তাকিয়ে উপরে চলে যায়। রথি কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে টিভি দেখায় মনোযোগী হয়।
রথিকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই নাশিদ চলে আসলো একটা এ্যাশ কালারের টিশার্ট আর সাদা টাউজার পরে। নাশিদকে দেখে রথির যেন হুঁশ উড়ে গেলো। এই ছেলে যাই পরে সেটাই তাকে স্যুট করে। এতো সুদর্শন ছেলে, রথির তো ইচ্ছে করছে কাজল এনে কানের পিছে টিপ লাগিয়ে দিতে যেভাবে তার মা ছোটবেলায় পরিয়ে দিতো। প্রতিবার টিপের সাথে বলে উঠলো,
-‘আমার রথিপরীর যাতে কারো নজর না লাগে। মাহশাল্লাহ, আমার মেয়েটা!’
রথির ইচ্ছে করছে নাশিদকে কালো টিপ দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলতে,
-‘আপনার উপর যেন কারো নজর না লাগে পুলিশম্যান! আপনি শুধু আপনার রথের মনপুরুষ।’
লিভিংরুমে এসে নাশিদ ঠিক রথির পাশে বসলো। রথির বাহুর সঙ্গে নাশিদের বাহু লাগতেই রথি খানিক কেঁপে উঠলো। কিন্তু নাশিদের কোনো পতিক্রিয়াই দেখা গেলো না। নাফিসা তো গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান গাইছে আর এদিকে রথি অস্বস্তিতে ভুগছে। নাফিসা ডানপাশের সারির সোফাতে। খানিকটা দূরে ওদের থেকে। রথির অস্বস্তি লাগলেও একটা সৎ সুযোগ পেলো আর তা হলো নাশিদের সঙ্গে কথা বলার। রথি আধো আধো স্বরে বললো,
-‘দুইদিন কোথায় ছিলেন আপনি? বাসা অবধি পৌঁছে দিয়েই আপনার কাজ শেষ? আমি কেমন আছি কী করছি সেটা জানার ইচ্ছা হলো না? কী দোষ ছিলো আমার যার জন্য আমার সাথে এমন অবিচার করেছেন?’
-‘ওই থার্ডক্লাস ছেলেটার কথা আগে বলো নি, এটাই তোমার দোষ!’
নাশিদ মৃদু সুরে বললো। রথি আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তার আগেই নাশিদ উঠে অন্য সোফায় গিয়ে বসলো। ঠিক তখনই মনিকা আসলো। রথি গোল গোল চোখে একবার নাশিদের দিকে তো আরেকবার মনিকার দিকে তাকালো। মনিকা হাসিমুখে নাশিদকে বললো,
-‘নাশিদ বাবা এসেছিস তুই? আজ কে আসছে বল তো?’
নাশিদ মনিকার কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো মনিকার পানে। রথি নিজেও একইভাবে অবাক। কার কথা বলছেন উনি? এদিকে মনিকার কথা শুনে নাফিসারও গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। এতে যেন রথির খটকা বেড়ে গেলো।
-‘বুঝিসনি তাইতো? অর্পি আসছে। এতক্ষণে চলে এসেছে মনে হচ্ছে!’
নাশিদ চট করে উঠে দাঁড়ালো। রথি নাশিদের দিকে চেয়েও তাকাতে পারলো না কারণ এই বজ্জাত মহিলা রথির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে আছে। মনিকা এবার মুখে কৃত্রিম হাসি নিয়ে রথিকে উদ্দেশ্য করেই বললো,
-‘আশা করছি রথি নিজের ঘরে যাবে। মেহমান আসছে তো, তোমার ভালো নাও লাগতে পারে!’
রথি প্রথমে উত্তর দিবে কিনা বুঝলো না। তবে রথি প্রথম থেকেই এই মহিলাকে সহ্য করতে পারে না। রথির কাছে কথাগুলো অপমানজনক লাগলেও সেটা উড়িয়ে দিয়ে ভাবলো কিছু মানুষের রোগই ব্যাঁকা করে কথা বলা। তাই বিষয়টিকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে হাসি দিয়ে বললো,
-‘সমস্যা নেই আন্টি। আপনার সমস্যা হলে আমি চলে যাচ্ছি!’
বলেই রথি উঠে দাঁড়ায় এবং কিছু না বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে যায়। নাশিদ রথির যাওয়ার পানেই তাকিয়ে আছে কিন্তু তার মায়ের জন্য কিছুই বলতে পারছে না। মনিকাও নাশিদের দিকেই তাকিয়ে। সে নাশিদের দৃষ্টি বোঝার চেষ্টা করছে। মনিকা এবার রথিকে আরও কিছুটা শুনিয়ে বললো,
-‘বাবা নাশিদ! অর্পি তো চলেই আসছে। যাও গেটে গিয়ে দাঁড়াও, অর্পি খুশি হবে!’
-‘আমি টায়ার্ড মা!’
বলেই নাশিদ ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে নেয়। রথি ততক্ষণে উপরে গিয়ে সবটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগে। এই অর্পি কে সেটা সে দেখেই ক্ষান্ত হবে। নাশিদ পানি খাওয়া শেষ করে লিভিং এ যাওয়ার আগেই সদর দরজা থেকে একটি মেয়ে ছুটে নাশিদের কাছে গেলো এবং কোনো কথা ছাড়াই তাকে জড়িয়ে ধরে! নাশিদ আর মেয়েটিকে একসাথে এভাবে দেখে রথির পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো। মুহূর্তের জন্যে সে ভাবতে ভুলে গেলো। বুকের বা পাশটাও কেমন চিনচিন করছে তার। চোখের কোণও ভিঁজে গেছে মুহূর্তেই। এই দৃশ্য যেন তাকে প্রাণহীন করে তুলেছে। রথির ভাবনার মাঝেই মেয়েটি বলে উঠলো,
-‘ফাইনালি! ফাইনালি নাশিদ তোমায় আমি পেলাম। তোমার এই অর্পি কতদিন তোমার অপেক্ষায় ছিলো জানো? এবার আর কোথাও যেতে দিবো না তোমায়। দরকার হলে আমার সঙ্গে সারাজীবনের জন্য বেঁধে রাখবো বুঝলে?’
মেয়েটির কথাবার্তায় রথির বুঝতে বাকি রইলো না এটাই অর্পিতা। অর্পির কথায় রথির চোখ থেকে টুপ করে জল গড়িয়ে পরলো। প্রিয় মানুষের সঙ্গে অন্য একটা মেয়েকে দেখা বুঝি এতটাই কষ্টের? কেউ যেন বারংবার তীর মেরে তার ভেতরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে। নাশিদ তৎক্ষনাৎ নিজের থেকে অর্পিকে ছাড়িয়ে নিলো। নাশিদ রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
-‘মাথা কী তোমার গেছে? এগুলা কোন ধরণের ফাইজলামি? কোথায় কী করতে হয় জানো না? তুমি কী নার্সারির বাচ্চা?’
-‘আহা! এতটুকুর জন্য এমন বিহেভ করছো কেন বলো তো? এই ফুপি! তোমার ছেলেকে কিছু বলবে?’
নাফিসার দৃ্ষ্টি তখনই উপরের দিকে গেলো। রথি নাশিদদের দিকে তাকিয়েই চোখের জল ফেলছে। নাফিসা একবার ওদের দিকে তাকিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলো। উপরে যেতে যেতে ততক্ষণে রথি রুমে চলে গেছে! নাফিসা সেখানেই রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে বসে পরলো। আপনমনে বলে উঠলো,
-‘তোকে যেটা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম তুই সেটারই মুখোমুখি হলি! আল্লাহ জানে এই অর্পি স্নেক কোন ঝামেলা পাকায়। তোদের এই মান-অভিমান আমারই যে ভালো লাগছে না!’
রাত ৯ টার মধ্যেই ওদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হলো। খাবার খেয়ে রথি নাফিসার ঘর থেকে বের হতেই অর্পির মুখোমুখি হলো সে। এক সুন্দরী মেয়েকে নাফিসার ঘর থেকে বের হতে দেখে অর্পিও খানিকটা অবাক হলো। রথির পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো। রথি পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই অর্পি রথিকে থামিয়ে বললো,
-‘তুমি কে? নাফিসার ঘরে কী করছো?’
রথি কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। তখনই নাফিসা এসে বললো,
-‘ও আমার বান্ধুবি আপু, রথি!’
-‘ও আচ্ছা।’
-‘তুমি এখানে যে?’
-‘হ্যাঁ। ফ্রেশ হয়ে তোমার ভাইয়ের রুমে যাচ্ছি, দেখি কী করছে মশাই! অফিসার তো সবসময়ই বিজি থাকেন!’ হেসেই বললো অর্পি! রথি একপলক অর্পির দিকে তাকিয়ে বুঝলো অর্পিও কম সুন্দরী না। পরমুহূর্তে নাশিদের ঘরের কথা শুনে রথির মাথা নিচু করে ফেললো।
অর্পি নাশিদের ঘরের সামনে গিয়ে দরজা কয়েকবার ধাক্কালেও নাশিদ দরজা না খুলে বললো,
-‘ডিস্টার্ব করো না অর্পি, কাজ করছি!’
নাশিদের রুদ্ধ কন্ঠস্বর শুনে অর্পি আর নাশিদকে বিরক্ত করার সাহস পেলো না। যতোই হোক, নাশিদ তার কাজ নিয়ে অনেকটা সেন্সেটিভ! সে তার কাজে কাউকেই চিনে না। অর্পি তাই কিছু না ভেবে আবার ক্যারিডোর পার হয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। নাফিসা রথিকে কাঁধ দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
-‘সুযোগ তোর সামনে। যা গিয়ে কথা বল আমি এখানে দাঁড়িয়েছি।’
রথি প্রথমে যেতে না চাইলেও নাফিসা রথিকে ধাক্কিয়ে ধুক্কিয়ে পাঠালো। রথি কাঁপা কাঁপা পায়ে নাশিদের রুমের দিকে যেতে লাগলো। মনের ভেতরে হাজারো ভয়, অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরেছে।
~চলবে।
❤️❤️আমাদের গ্রুপে ৮ হাজার হতে বেশি দেরী নেই, দ্রুত জয়েন হয়ে যান লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻 পরিবারে।❤️❤️
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২০ |
রথি নাশিদের ঘরের দরজায় নক করতেই নাশিদ বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
-‘ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট, অর্পি! এক কথা কয়বার বলবো?’
-‘আমি অর্পি নই, রথি!’
ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। হঠাৎ খট করে দরজা খুলে গেলো৷ নাশিদ কিছু না বলেই রথির হাত টান দিয়ে ভেতরে আনলো এবং দরজাটাও তৎক্ষণাৎ আটকে দিলো। রথি খানিকটা চমকে উঠলেও পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। নাশিদ দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। আর রথি কাবার্ডের সাথে পিঠ লাগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। নাশিদ শূন্য দৃষ্টিতে রথির দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘কী বলতে এতো সাহস করে আমার রুমে এসেছো?’
রথি প্রথমে চুপ করে রইলো। অতঃপর মৃদু স্বরে বললো,
-‘দুইদিন কথা কেন বলেননি?’
-‘ওই শামুন ছেলেটার কেস নিয়ে বিজি ছিলাম তাই!’ নাশিদের সোজা জবাব!
-‘এই বলে সামান্য দেখা করা যায় না?’
-‘দেখা করে কী লাভ হতো? মেজাজ খারাপ ছিলো। মেজাজ খারাপ নিয়ে তো তোমার কাছে যেতে পারি না। আর তুমিও বা কেমন? একবারের জন্যেও ওই লম্পটটার কথা আমায় বলোনি! আগে বললে কী এমন হতো? আমি যদি সেদিন সেখানে না থাকতাম কী হতে পারতো বুঝতে পারছো তুমি, স্টুপিড!’
শেষোক্ত কথাটি নাশিদ ধমকের স্বরে বললো। রথি জানালার কাছে যেতে যেতে বলে,
-‘শামুন আমার জীবনের আরেক অভিশাপ। যেদিন থেকে আমি পথে নামি রোজগারের উদ্দেশ্যে তখন থেকেই আমার পিছু নিয়েছিলো। নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, ইভেন চড় অবধি মেরেছি। তাও পিছে ছাড়েনি। শামুনটাকে কিছুতেই পারতাম না, দূরে সরাতে। কাউকে যে বলবো, সেখান দিয়েও নিরুপায় ছিলাম!’
-‘নিরুপায় কেন?’
রথি হাসলো। অদূর আকাশে নির্বাক চাহনি নিক্ষেপ করে থমথমে গলায় বললো,
-‘বাবা নামক ছায়াকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভাই নামক ছায়াটি থেকেও ছিলো না। কাকে বলতাম? আপনি তো এসেছেন বেশি সময় হয়নি। মাঝেমধ্যে মনে আপনাকেও কবে যেন ওদের মতো হারিয়ে ফেললাম৷ আপনি থেকেও যেন নেই।’ শেষোক্ত কথাগুলো আঁটকে আঁটকে বললো রথি।
রথির কথাগুলো নাশিদের যেন তীরের মতো লাগলো।
নাফিসা তার রুমের দরজার সামনে মোবাইল গুতাচ্ছিলো তখনই দেখলো তার মা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। নাফিসা জলদি ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয় আর ভাবতে লাগে এখন সে কী করবে। মা যদি কোনো ভাবে টের পায় রথি নাশিদের ঘরে তাহলে তো সব শেষ। নাফিসা জলদি ওয়াশরুম গিয়ে শাওয়ার অন করে ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নাফিসার ঘরে নক পরলো। নাফিসা গলায় ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দরজা খুললো। দরজার সামনে মনিকা দাঁড়িয়ে আছে নাফিসার দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নাফিসা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,
-‘মা তুমি?’
-‘হু, এই অসময়ে দরজা লক করে রেখেছিস কেন?’
নাফিসা আশেপাশে তাকিয়ে আবারও হাসার চেষ্টা করে বললো,
-‘এ..এমনি মা!’
মনিকার সন্দেহ হলো। আবারও কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকে বললো,
-‘রথি কোথায়?’
-‘কেন, ওয়াশরুমে?’
মনিকা নাফিসাকে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ওয়াশরুমের দিকে যেতেই পানির শব্দ পেলো। মনিকা আর কিছু না বলে চলে গেলো। নাফিসা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আবার কী মনে হতেই জলদি নাশিদকে টেক্সট করে দিলো মনিকার কথা।
নাশিদ রথির কাঁধে হাত রাখতে যাবে তখনই দরজায় নক পরলো সাথে তার পকেটের ফোনটাও ভাইব্রেশন করে উঠলো। নাশিদ পকেট থেকে ফোন বের করে নাফিসার টেক্সটি পড়লো। তখনই আবারও দরজায় টোকা পরলো সাথে মনিকার গলার স্বর শোনা গেলো।
রথি কিছু বলতে নিবে তার আগেই রথির মুখ চেপে ধরে চোখ বড় বড় করে ইশারা করলো যেন রথি শব্দ না করে। নাশিদ রথিকে ধরেই মনিকার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘হ্যাঁ মা বলো?’
-‘দরজা বন্ধ কেন নাশিদ?’
-‘কাজ করছি মা। কাজ করলে সবসময় দরজা বন্ধ রাখি জানো না?’
-‘বুঝেছি বাবা।’
বলেই মনিকা থামলো। অতঃপর কী মনে করে বললো,
-‘রথি মেয়েটা তোর রুমে নয়তো?’
-‘এসব কী বলছো মা? ও কেন আমার রুমে থাকতে যাবে?’
নাশিদের বিরক্তিমাখা কন্ঠস্বরে মনিকা যেন ঠান্ডা হলো। অতঃপর চলে গেলো। মনিকা চলে গেছে বুঝে নাশিদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর রথির দিকে তাকালো। রথি তার অনেক কাছে। রথিও গোলগোল চোখে নাশিদকে দেখছে।
নাশিদ এতক্ষণে খেয়াল করলো তার একহাত রথির কোমড়ে আর আরেক হাত রথির মুখে। নাশিদ সঙ্গে সঙ্গে রথিকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আর রথি যেন এতক্ষণে শ্বাস নিতে পারলো। বারংবার সে কেঁপে উঠছে। ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে অনবরত। রথি কিছু বলার পূর্বেই নাশিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,
-‘আই থিংক তোমার এখন চলে যাওয়া উত্তম। কারণ, যে কেউ যখন তখন চলে আসতে পারে। মায়ের মনেও সন্দেহ হয়েছে তোমায় নিয়ে। তাই আমি তোমার থেকে দূরে দূরে থাকি যেন মায়ের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়! বুঝলে?’
রথি মাথা নাড়ায়। অতঃপর নাফিসাকে টেক্সট করে শিওর হয়ে নিলো সব ওকে কিনা। নাফিসা রুম থেকে বেরিয়ে ক্যারিডোর চেক করে সব ‘ওকে’ জানালো। নাশিদ তখনই দরজা খুলে রথিকে পাঠিয়ে দিলো। রথিও জলদি নাফিসার ঘরে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর নাশিদের ধারণা অনুযায়ী মনিকা আবারও আসলো রথিকে চেক দিতে। রথি তখন ঘরেই কিছু স্টুডেন্টদের খাতা দেখছিলো। রথিকে এভাবে দেখে মনিকা আর কিছু না বলেই নাফিসাকে বললো,
-‘নাশিদকে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে আয়!’
বলেই মনিকা চলে গেলো। নাফিসা মায়ের কথামতো নাশিদের ঘরে চলে গেলো নাশিদকে ডাকতে। নেওয়াজ আর তার বউ গেছে বান্দরবানে ঘুরতে। মাসে একবার হলেও ওরা নিজেদের সময় কাটানোর জন্য ট্যুরে যায়। বান্দরবান ট্যুরে আজ সকালেই ওরা রওনা হয়েছে। আসবে দুইদিন পর।
রথি যখন বুঝলো নাশিদ খেতে নিচে চলে গেছে তখন সে ক্যারিডোর এসে রেলিং এ দুই হাত প্রসারিত করে ওদের ডিনারের কাহীনি দেখতে শুরু করলো। নাশিদের পাশেই অর্পি বসেছে। অর্পি নানানভাবে নাশিদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে ব্যস্ত। অর্পিদের অপজিটে বসা মনিকা যেন দেখেও না দেখার ভান করছে। নাশিদ তার বাবার সাথে বিভিন্ন কথা বলতে ব্যস্ত। রথির পাশে নাফিসা দাঁড়িয়ে বললো,
-‘কী দেখছিস?’
-‘দেখছি তোর এই কাজিন কেমন ঢলাঢলিতে এক্সপার্ট। বরফকেও হার মানায়!’
-‘ওর কথা বলিস না। এই মেয়ে হলো জম্মগত লুচি পরোটা। শুনেছিলাম আগে দুটো রিলেশনে ছিলো। যবে থেকে আমার ভাইকে দেখেছে তবে থেকেই ওসব ফেলে আমার ভাইয়ের পিছে লেগেছে। ওর ওই লোভনীয় দৃ্ষ্টি গা জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।’
-‘তোর ভাই কিছু বলে না কেন?’
-‘ভাই না বলে আছে নাকি? আর বললেও অর্পি কী শোনার মানুষ? ওইযে প্রবাদ আছে না? কুকুরের লেজ যতোই সোজা করো ওটা বাঁকা থাকবেই!’
রথির রাগ হলো অর্পির প্রতি, তবে সে প্রকাশ করলো না। নাফিসা তো অর্পিকে নিয়ে বকবক করেই চলেছে।
-‘আমার মাকেও বলিহারি! এরকম বেহায়া, নির্লজ্জ মেয়ে ভাইয়ের চারপাশে ঘুরঘুর করে আর মা তাকে এমন লাই দিচ্ছে? মায়ের প্ল্যানটা আমি বুঝতে পারছি না। আচ্ছা এমন নয়তো মা ভাইয়ের সাথে অর্পির…’
নাফিসার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রথি ভেতরে চলে গেলো। এসব সে একদমই সহ্য করতে পারবে না। এসব না ভেবে আপাতত নিজের খাতা দেখা চালিয়ে যেতে হবে। ভেবেই সে আবারও বিছানায় বসে খাতা দেখায় মনোনিবেশ হলো।
পরেরদিনের মধ্যে সারাটাদিন রথির পার হলো নাশিদের সঙ্গে অর্পির চিপকে থাকা দেখতে দেখতে। রথির রাগ অর্পির সঙ্গে সঙ্গে নাশিদের প্রতিও তীব্রগতিতে বেড়ে গেলো। সারাদিন এ এই মেয়েটার জন্যে নাশিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ভাব ধরছে এমন নাশিদ তার বিয়ে করা বর। রথি ওদের কান্ড দেখছে আর হাতের লেক্সাস বিস্কিটের প্যাকেটটা মুঠিবদ্ধ করছে তো আবার মোঁচড়া মুঁচড়ি করছে। একসময় প্যাকেটের বিস্কিটগুলো গুঁড়ো হয়ে যায় তাও রথির মনের ঝাল মিটে না। এক পর্যায়ে সে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
বিকালে নাশিদের কল আসতেই সে থানায় চলে যায়। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরতেই দেখলো মনিকা আর অর্পি নেই। হয়তো শপিং এ গিয়েছে। নাশিদ উপরে না গিয়ে তার বাবার ঘরে গেলেন। বাবা তখন চোখে মোটা চশমা নিয়ে পত্রিকা পড়তে ব্যস্ত। নাশিদ দরজায় নক করে বলে,
-‘আসবো বাবা?’
বাবা পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। নাশিদকে দেখতে পেয়ে উনি পত্রিকা ভাঁজ করে চশমা খুলে রাখতে রাখতে বললো,
-‘আরে নাশিদ যে। এসো বাবা!’
নাশিদ হাতের কাগজটা নিয়ে তার বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে বাবার অপজিটের বেতের সোফায় বসলো। বাবা মুচকি হেসে বললো,
-‘হঠাৎ এই সময়ে? কিছু বলবে?’
নাশিদ চুপ থেকেই একটা কাগজ এগিয়ে দেয়। বাবা কাগজটি নিয়ে চোখে চশমা দিয়ে কাগজের লেখাগুলো পড়তে শুরু করে। এর মাঝেই তার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। বাবা মুখটা গোমড়া করে নাশিদের পানে তাকালো।
-‘কোথায় জানলে?’
-‘মনে আছে সেদিন ফাইল খুঁজতে বলেছিলে? সেখানেই ডেথ সার্টিফিকেট পাই। তারপর…’
নাশিদ আর কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলো। বাবার মুহূর্তেই চোখের কোণ ভিঁজে যায়। সত্যটা নাশিদ জেনে গেছে। জেনেছে তার জীবনের বড় সত্যি। বাবা কিছু বলার মতো পেলো না। বাবা-ছেলের মাঝে নিরবতা চললো মিনিটখানেক। অতঃপর বাবা নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
-‘বেশ! এইটুকু যেহেতু জেনেছো, বাকিটাও তোমার জানার জরুরি!’
বলেই বাবা নাশিদের অজানা অনেককিছুই খুলে বললো।
——————————-
রথি রাতে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। এর কারণ ওই অর্পি। রথি পারে না অর্পিকে গিলে হজম করে ফেলতে। বারংবার নাশিদের সাথে এতো চিপকানোর মানে কী তার মগজে ঢুকে না। ইচ্ছে তো করে ঢলাঢলি জম্মের মতো বুঝায় দিতে। তার পাশেই নাফিসা আবিরের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরেছে। এদিকে রথির রাগে, ক্ষোভে তাকে ঘুমই ধরা দিচ্ছে না। রথির জেগে থাকার মাঝেই তার ফোনে টেক্সট আসলো। রথি ফোন চেক করে দেখলো নাশিদের টেক্সট। রথি এবার নড়েচড়ে বসলো।
-‘ছাদে আসবে, রথ?’
এমন মেসেজ দেখে রথির মাঝে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। এক অদ্ভুত শিহরণ হলো তার। মুহূর্তেই মাথায় প্রশ্ন আসলো। নাশিদ এতো রাতে ছাদে কেন ডাকছে? প্রয়োজন ছাড়া তো নাশিদ এরকম আবদার করে না। রথি নাশিদের কথা ফেলতে পারলো না। সে ফোন রেখে খুবই সাবধানে বের হলো। পুরো ক্যারিডোরের মাঝে একটা হলুদ ড্রিমলাইট জ্বলছে। আলোও খানিক আবছা। এতো বড় ক্যারিডোরে এই ছোট ড্রিমলাইট কতটুকুই-বা আলোকিত করতে সক্ষম?
রথি ধীর-পায়ে খুবই সাবধানে ছাদে চলে গেলো। ছাদে গিয়ে নাশিদকে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলো। হঠাৎ তাকে কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। রথি খানিক আঁতকে উঠলো। পরমুহূর্তেই পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণে তার বুঝতে বাকি রইলো না মানুষটি কে? রথি ওভাবেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো এবং নাশিদের ছোঁয়াটা চোখ বুজে উপভোগ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই কেটে গেলো।
-‘কেন ডেকেছেন?’
-‘একান্ত সময় কাটানোর জন্য!’
রথি সামান্য কেঁপে উঠলো নাশিদের এই শীতল কন্ঠস্বর শুনে। রথি যেন জমে যাচ্ছে। সে অপ্রস্তুত হয়ে নাশিদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়।
-‘কী হলো?’
-‘কিছু না। মাঝরাতে ডাকাটা কী উচিত ছিলো তাও রাতে?’
-‘কেন ভয় পাচ্ছো?’
রথি থতমত খেয়ে গেলো। ড্যাবড্যাব করে নাশিদের পানে তাকিয়ে বললো,
-‘একদম না। হুট করে তো তাই!’
নাশিদ হেসে রথির কাছে গিয়ে রথির হাত ধরে দোলনায় পাশাপাশি বসলো। নাশিদ রথির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিরাট আকাশের মাঝে থালার ন্যায় চাঁদটার দিকে তাকিয়ে দুলতে দুলতে বললো,
-‘খেয়াল করেছো, আজ পূর্ণিমা? এই একটা চাঁদই কিন্তু অন্ধকারের মাঝে আবছা আলো ছড়ায়। অন্ধকারের অশুভকে সরিয়ে পবিত্ররূপে মানুষদের মনে সুখের আলো ছড়ায়। ঠিকই তেমনটাই তুমি। আমার কালো সময়ে তোমায় পবিত্র পূর্ণিমা হিসেবে পেলাম, তুমি যে আমারই একান্ত পূর্ণিমা, হৃদপূর্ণিমা। যেই সুখময় স্বাদ আমি ব্যতীত কেউ অনুভব করতে পারবে না।’
বলেই নাশিদ থামলো। রথি স্তব্ধ হয়ে নাশিদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাশিদের প্রতি সারাদিনের রাগ, ক্ষোভ নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। এই মানুষটার অনুভূতি এতটাই গহীন, রথির অজানা ছিলো। কখনো চিন্তাও করেনি কেউ তাকে চাঁদের সাথে তুলনা করবে। রথির ভাবনার মাঝেই নাশিদ আবারও বলতে লাগলো,
-‘অঢেল আকাশের বুকে ওই একটা পূর্ণিমা হলেও এই ভূপৃষ্ঠে তুমি একটি-ই আমার হৃদপূর্ণিমা। চাঁদের যেমন দাগ রয়েছে কথা দিলাম, সেইরকম দাগ তোমার গায়ে আমি কোনোদিন লাগতে দিবো না। আমার হৃদপূর্ণিমা এই চাঁদের চেয়েও অধিক ডিজার্ভ করে।’
রথি চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোটা জল পরলো। নাশিদ তাকে আগলে নেয়। রথি বুকে মাথা রেখেই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘এই হাত ছাড়বেন না তো?’
-‘কখনোই না!’
~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here