#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২১+25 |
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এই কয়েকদিনে রথি যেন অতিরিক্ত জেদীতে পরিণত হয়েছে৷ রথি নাশিদের সঙ্গে অর্পিকে একদমই সহ্য করতে পারে না। এ নিয়ে রথি হুটহাট-ই রেগে যায়, নাশিদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। নাশিদ না পেরে রথিকে জিজ্ঞেস করে,
-‘তুমি এক্সেটলি কী চাচ্ছো?’
-‘বিয়ে করতে! বিয়ে না করে একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে রেখেছেন কেন? ওই চুন্নির জন্য? আপনি যদি আমায় বিয়ে না করেন তাহলে আমিও এই বাড়িতে থাকবো না!’
হ্যাঁ! বিয়ে বিয়ে করে রথি এখন নাশিদের মাথা খাচ্ছে। নাশিদ নিজেকে যথেষ্ট কান্ট্রোল করে বলতো তাকে কিছুটা সময় দিতে, সে মানসিকভাবে খানিকটা বিধ্বস্ত! কিন্তু রথি কিছু শোনার পাত্রী নয়। এখন নাশিদ পরেছে মহা ফ্যাসাদে! রথি তার গলায় এমনভাবে বেজেছে যে না পারে গিলতে, না পারে ফেলে দিতে।
নাশিদ রথির চিন্তা করতে করতে সবে বিছানায় শুয়ে তখনই নাফিসা দৌড়ে নাশিদের ঘরে এসে বললো,
-‘ভাইয়া, রথিকে খুঁজে পাচ্ছি না!’
নাশিদ লাফ দিয়ে উঠে বসলো এবং নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
-‘কী বলছিস এসব?’
-‘সত্যি ভাই! রুমে না পেয়ে সারা বাড়ি খুঁজেছি ইভেন গার্ডেনে অবধি গিয়েছি। আমার ভয় করছে ভাই!’ ভয়ার্ত কন্ঠে বললো নাফিসা।
-‘তুই ঘরে যা৷ আমি দেখছি!’
নাফিসা বিনা-বাক্যে ঘরে চলে গেলো। নাশিদ নাফিসার কথাগুলো মনে করে। কী যেন ভেবে ছাদে চলে গেলো। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই! রথি ম্যাম রেলিং এ হাতদুটো প্রসারিত করে চন্দ্রবিলাসে মগ্ন। এবার নাশিদের রাগ তার ধরা-ছোয়ার বাইরে চলে গেলো। নাশিদ লম্বা লম্বা পা ফেলে রথির কাছে গিয়ে রাগ দমিয়ে মৃদু সুরে বলে উঠলো,
-‘এখানে কী করছো?’
-‘আপনাকে বলতে বাধ্য নই!’ আনমনে উত্তর দিলো রথি।
নাশিদ রাগ দমাতে না পেরে রথির গায়ে হাত তোলার জন্য হাত উঠাতেই রথি চোখ-মুখ খিঁচে রইলো। নাশিদ চড় না মেরে নিজের মাথার পিছে হাত দিয়ে রাগ কান্ট্রোল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে রথি গালে কোনো স্পর্শ না পেয়ে রথি পিটপিট করে তাকালো। মুহূর্তেই তার চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। এই মানুষটা তার গায়ে হাত ওঠাতে নিচ্ছিলো ভাবতেই রথি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফোঁপানোর শব্দে নাশিদ পিছে ফিরে তাকালো। নাশিদ রথিকে ধমকে বললো,
-‘এই মেয়ে! কাঁদছো কেন? তোমায় কী আমি মেরেছি? এন্সা মি.. ড্যাম ইট!’
নাশিদের ধমকে রথির কান্নার স্বর আরও বেড়ে গেলো! নাশিদ দ্রুত রথির সামনে গিয়ে রথির মুখ চেপে ধরলো। যতোই হোক এখন রাত। রথির কান্নার শব্দ নিচে গেলে সর্বনাশ!
-‘সমস্যা কী? চুপ থাকতে বলেছি না?’ দাঁতে দাঁত চেপে বললো নাশিদ। রথি নাশিদের থেকে দূরে সরে বললো,
-‘আপনি অনেক খারাপ পুলিশম্যান! আপনি কথায় কথায় শুধু ধমকান! আমাকে খেয়ালও করেন না।’ কেঁদে হেঁচকি তুলে বললো।
নাশিদ পরেছে মহা ঝামেলায়। রথির এমন বিহেভিয়ার তার মাথা দিয়েই ঢুকছে না। হুটহাট রথি কেন পল্টি নিচ্ছে?
-‘তোমার খেয়াল কবে করিনি?’
-‘করলে বিয়ে কেন করছেন না?’
-‘উফফ! আবার সেই বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে! এই মেয়ে তুমি বিয়ে নিয়ে এতো মাথা ঘামাও কেন হ্যাঁ?’
-‘করবেন না তো বিয়ে? ঠিক আছে আমি চলে যাবো এখান থেকে। এই বাড়িতে আমি কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। যেখানে আমার নিজের পরিচয় নেই সেখানে থেকে আমি কী করবো? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমার যথেষ্ট সেল্ফরেসপেক্ট আছে। শুধু আপনার জন্য, আপনার জন্য এতদিন চুপ করে ছিলাম। কারণ, মনে হতো ভালোবাসায় সব জায়েজ। কিন্তু এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি তো আমায় ভালোই বাসেননি শুধু দায়িত্ববোধ ভেবেছেন। আপনি থাকুন আপনার ওই অর্পি চর্বিকে নিয়ে!’
বলেই রথি চলে যেতে নেয় ওমনি নাশিদ ওর হাত ধরে আটকে নিজের কাছে টেনে নিলো। আবছা আলোয় নাশিদের রক্তিম মুখশ্রী দেখে রথি একটু না অনেকটা ঘাবড়ে গেলো। রথি মুখ দিয়ে টু-শব্দও করার সাহসটা পাচ্ছে না। নাশিদ অতি ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘তোর বিয়ে করা লাগবে তাইতো? তাহলে চল, তোরে বিয়ে করে, বাসর করে প্রমাণ দিয়ে দেই তুই আমার কাছে কী! তোর কাছে তো বিয়ে জরুরি, বিয়ের সাথে আফকোর্স বাসরও সংযুক্ত! এতদিন ভালো কথা বলে বুঝিয়েছি কিন্তু তুই তো ভালো কথা শোনার মানুষ না। ওয়েল, আমার খারাপটার সাথেই নিজেকে এডজাস্ট করে নে!’
বলেই রথিকে টেনে-হিঁচড়ে ছাদ থেকে নামিয়ে আনলো। এদিকে রথি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে নাশিদের হাত থেকে ছাড়ানোর কিন্তু নাশিদ যে এখন ক্ষ্যাপা বাঘ হয়ে গেছে। রথিকে সে কিছুতেই ছাড়ছে না। নাশিদ কোনো দিকে না তাকিয়ে সদর দরজা খুলে রথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মনিকা তখন পানি খেতে ডাইনিং এ এসেছিলো। ধস্তাধস্তির শব্দে সে সদর দরজার দিকে তাকায়। কিন্তু আবছা আলোয় বুঝতে পারলো না ওরা কারা। সে দ্রুত হেঁটে সেই অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ওরা চলে যায় গাড়ির গ্যারেজে।
মনিকা কাউকে না পেয়ে সেও বেরিয়ে আসে। নাহ কাউকে পেলো না। হতাশ হয়ে মনিকা ভেতরে চলে আসে।
-‘দেখেন! পাগলামি করবেন না! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায় এতো রাতে?’
-‘কেন তোকে বিয়ে করতে? তুই না বিয়ের জন্য হাঁপাচ্ছিস! তোর বিয়ে করার সখ মিটিয়ে দিতে হবে না?’ নাশিদ ড্রাইভিং করতে করতে বললো। নাশিদের তুই-তুকারিতে বেশ বোঝা যাচ্ছে রাগ এখনো কমেনি। রথি মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডাকছে। এখন সে কী করবে? এভাবে বিয়ে তো সে চায়নি! চাওয়া তো দূরে থাক কল্পনাও অবধি করেনি।
নাশিদ ড্রাইভ করতে করতে ফোনে কিসব করলো। মাঝরাত হওয়ায় রাস্তা প্রায় ফাঁকা। রথি অনেক ভাবে নাশিদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু নাশিদ তার বুঝের সীমানার বাইরে আছে। মহা কেলেঙ্কারি লাগছে এই নাশিদকে। অবশেষে ওরা থানায় পৌঁছালো।
নাশিদকে থানার সামনে গাড়ি থামাতে দেখে রথি খানিক বিস্মিত হলো। রথি ভাবনা-চিন্তা করার আগেই নাশিদ তাকে টেনে-টুনে গাড়ি থেকে নামিয়ে থানার ভেতর নিয়ে গেলো। নাশিদ সোজা তার কক্ষে ঢুকে পরলো। সেখানে নয়নসহ নাশিদের দুজন বন্ধু আর কাজী সাহেব রয়েছে।
কাজী ঘুমে ঢুলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজীকে তার বাসা থেকেই তুলে আনা হয়েছে। কাজীও মুখে কুলূপ দিয়ে আছে কারণ, যতোই হোক পুলিশের বিয়ে। পুলিশের অমতে যাওয়া মানে নিজের প্রাণভোমরা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। রথি নাশিদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো দেখে নাশিদ রথিকে দেয় এক ধমক।
সেই ধমকে কাজী লাফিয়ে উঠে আর চোখের চশমা ঠিক করে এদিক সেদিক তাকিয়ে ভয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
-‘কার বিয়ে পড়াবো? কে কাবিননামায় স্বাক্ষর করবে?’
নাশিদ রথিকে একটি চেয়ারে বসার উদ্দেশ্য করে বললো,
-‘বসো!’
রথি ঘাবড়ে বসে পরলো। নাশিদও রথির পাশে বসে বসলো। নাশিদ রথিকে একটু খেয়াল করতেই দেখলো রথির মাথায় কাপড় নেই। নাশিদ রথির মাথায় ওড়না জড়িয়ে দিলো। যা দেখে রাতে ডিউটিরত কয়েকজন মহিলা পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে হাসছিলো। নাশিদ এবার কাজীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘বিয়ে পড়ানো শুরু করুন!’
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। একপর্যায়ে সে বলে উঠলো,
-‘আপনাদের কাগজপত্র ছাড়া বিয়ে হবে কী করে?’
নাশিদ একপলক রথির দিকে তাকালো। অতঃপর নাশিদ বললো,
-‘আপনার যা যা জানার আমাদের বলুন উত্তর দিচ্ছি। আপাতত কাগজপত্র নিয়ে আসিনি আমরা।’
-‘কিন্তু কাগজপত্র ছাড়া…’
-‘ওটা সময়মতো আপনার বাসায় পৌঁছে যাবে! আর কিছু? এখন যা করার জলদি করুন!’
কাজী আর কিছু বলার সাহস পেলো না। যাবতীয় কিছু প্রশ্ন করলো আর দুজন উত্তর দিলো। অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো। রথির চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। বিয়েটা যেভাবেই হোক, সে তার ভালোবাসাকে পবিত্ররূপে পেয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? রথি প্রশান্তিতে চোখ বুজে ফেললো। বিয়েটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা ঝড় বইলেও এখন সবকিছু কেমন শান্তি, শান্তি লাগছে। রথি যেন হাওয়ায় ভাসছে।
নাশিদ কাজীর সাথে কথা বলে কাবিননামা নিয়ে নয়নদের সাথে কথা বললো। নাশিদের এক বন্ধু হেসে বললো,
-‘তুই আর শোধরালি না! সেই কলেজ লাইফের মতো রাত করে ডেকে পাঠালি। তবে যাই বলিস, তোর বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পেরেছি এ-ই অনেক। বিয়ে মোবারক বন্ধু!’
বলেই নাশিদকে হাগ করলো। নাশিদ ওদের সঙ্গে কথা বলে রথির কাছে গেলো! রথিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাশিদ বলে উঠলো,
-‘কী হলো? যাবে না, নাকি নিজের বাসর এই থানাতেই করার ইচ্ছে?’
রথি চোখ গরম করে নাশিদের দিকে তাকালো। তখন থেকে বাসর বাসর করেই চলেছে। শালা ঠোঁটকাটা খচ্চর পুলিশ! বিয়ে শেষ পর্যন্ত তার এই থানাতেই লিখা ছিলো? রথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-‘বিয়ে করার জন্য আর কোনো প্লেস ছিলো না? থানাই কেন?’
-‘সবাই তো কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করে, আমি নাহয় ইতিহাস বদলে দিলাম। হলো না, একটা ইউনিক বিয়ে? আমার নাতি-নাতনীদের গল্প শোনাবো, তাদের দিদুনকে থানায় বিয়ে করেছি!’
-‘কচু! সরেন সামনে থেকে!’
নাশিদ খপ করে রথির হাত ধরে বলে,
-‘সরি, এখন আমরা বাসায় যাচ্ছি!’
বলেই নাশিদ নয়নদের থেকে বিদায় জানিয়ে রথিকে নিয়ে চলে গেলো। ভোর পাঁচটায় ওরা বাড়ি পৌঁছালো। নাশিদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিলো তাই বাড়িতে ঢুকতে খুব বেশি অসুবিধা হলো না। বাড়িতে সাবধানে ঢুকে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো।
~চলবে।
বিঃদ্রঃ দিয়ে দিলাম সারপ্রাইজ। এবার খুশি তো? গঠনমূলক মন্তব্য করার অনুরোধ রইলো!#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২২ |
-‘গতকাল রাতে কোথাও গিয়েছিলে নাশিদ?’
মনিকার দিকে না তাকিয়েই খেতে খেতে নাশিদ বললো,
-‘থানায় গেছিলাম। কেন মা, আজ নতুন নাকি?’
মনিকা থতমত খেয়ে গেলো নাশিদের এরূপ ব্যবহারে। ইদানীং আগের মতো ঠিকভাবে কথা বলে না। ব্যবহারটাও কেমন পাল্টে গেছে। ইদানীং ‘আপনি’ বলেও সম্বোধন করছে তাকে। অর্পি নাশিদকে টাচ করতে গেলে নাশিদ প্লেট নিয়েই উঠে দাঁড়ায় এবং লিভিংরুমে যেতে যেতে বলে,
-‘ঢোলাঢোলির জন্য ক্লাবে যাও, এটা খাবারের টেবিল। আর আমিও তোমার সো কল্ড প্লে বয় নই যে তোমার ইশারায় সাড়া দিবো!’
নেওয়াজ নাশিদকে পিছুডাক দেয় কিন্তু নাশিদ শুনলো না। নেওয়াজ অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা চোখ রাঙিয়ে মনিকার দিকে তাকালো। মনিকার চাল যে সে ধরতে পারেনি এমনটি নয়! বাবা মনিকাকে দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বললো,
-‘ছেলেটাকে কী খেতেও দিবে না শান্তিমতো?’
মনিকা কিছু বললো না, চুপ করে রইলো। নেওয়াজ আর বাবা কোনরকম খেয়েই চলে গেলো। নেওয়াজও যাওয়ার আগে মায়ের সাথে কথা বলেনি। ভাবী খাওয়া শেষ করে নাফিসাকে নিয়ে উঠে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝে নাশিদ প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলো। সেখানে হাত ধুঁয়ে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে সিঁড়ির সামনে গেলো এবং নাফিসার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো,
-‘ভার্সিটি কী আমি তোকে ড্রপ করে দিয়ে আসবো?’
-‘না ভাইয়া। আমার যেতে লেট হবে!’
নাশিদ আর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো। মনিকা বা অর্পিতার দিকে ফিরেও তাকালো না। রথি অনেক আগেই কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। অর্পিতা নাশিদের যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মনিকার দিকে তাকালো।
-‘এরকম কেন হচ্ছে ফুপ্পি? তোমার ছেলে আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না!’
-‘সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধর!’
অর্পিতা কিছু বললো না।
রেগে বোম হয়ে চলে গেলো।
রথি রিকশার জন্য কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে খানিক চিন্তিত। আজ ফাহাদ স্যারের ঘেঁষাঘেঁষিটা বিরক্তিকর ছিলো। তার ঘোরলাগা দৃষ্টিও রথির বুঝতে সময় লাগেনি। তার উপর গতকাল রাতের এমন আকস্মিক বিয়ে। রথির তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সে বিবাহিত, মিসেস নাশিদ। রথির ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে নাশিদের গাড়ি এসে থামলো। রথি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। নাশিদ সানগ্লাস খুলে রথির দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘গুড আফটারনুন বউ!’
নাশিদের মুখে ‘বউ’ শুনে রথির ভেতরটা শীতল হাওয়ায় ছেয়ে গেলো। এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব হচ্ছে তার। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে রথি বলে উঠলো,
-‘আপনি এখানে?’
-‘হু। আমি!’
-‘আমার কোচিং সেন্টারের এড্রেস কই পেলেন?’
নাশিদ গাড়ি থেকে নেমে রথির বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,
-‘মাথা কী গেছে তোমার? এর আগেও তো এখানে তোমার সাথে মিট করেছি, মনে নেই?’
বলেই নাশিদ মাথা নিচু করে রথির দিকে ঝুকতেই রথি পূর্বের ন্যায় দুই পা পিছিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। রথির এরূপ রিয়েকশনে নাশিদ হেসে উঠলো।
-‘কী মনে পরেছে?’
রথি জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। ঠিক এভাবেই! গত দেড় মাস আগে ঠিক এভাবেই নাশিদ তার উপর অদ্ভুত কারণে রাগাম্বিত হয়ে এভাবে ঝুকেছিলো। তবে আজ নাশিদ রেগে নেই, তার আজ পাগল করা হাসি।
-‘তাহলে যাওয়া যাক?’
-‘আপনার সঙ্গে যাবো না আমি!’
-‘ওরে বাচ্চাটাহ! এতো অভিযোগ, অভিমান কেন? তোমায় কী গুতা দিয়েছি?’ নাশিদ বাচ্চা বাচ্চা ফেস করে বললো! নাশিদের এমন বাচ্চামো দেখে রথির চোখ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ কোন রূপ দেখাচ্ছে নাশিদ?
-‘কী হলো চুপ কেন? কই ভাবলাম তোমার সাথে লাঞ্চ করবো! কিন্তু তুমি তো আমার সাথে যেতেই চাও না। ঠিক আছে আমি লাঞ্চ না করেই থানায় চলে যাচ্ছি!’
-‘উফফ, এমন করেন কেন? উঠছি তো গাড়িতে!’
নাশিদ বাঁকা হাসলো। রথি গিয়ে দরজা খুলে উঠে বসলো। নাশিদ এর মাঝে কোথায় যেন গেলো। রথি এদিক সেদিক খুঁজতে গিয়েই তার পাশের ডোর খুললো নাশিদ। হাতে তার দুটো সান চিপসের প্যাকেট। নাশিদ মুখে হাসি নিয়ে বলে,
-‘বাসরে নাকি বউদের উপহার দিতে হয়। কিন্তু আমার তো বাসর হয়নি, তাই বাসরে না দিয়ে এখানে দিলাম। নেও তোমার উইদাউট বাসর গিফট!’
বলেই রথির কোলে চিপসের প্যাকেট ছুঁড়ে মেরে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর রথি সেখানেই বেক্কলের মতো বসে রইলো৷ নাশিদ ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। রথি চিপসের প্যাকেট উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলে,
-‘আচ্ছা ছেলেরা কী এভাবেই বিয়ের পর গিরগিটির মতো রূপ বদলায়?’
নাশিদ স্টেয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাঁকা হেসে বলে,
-‘সব ছেলের কথা তো জানি না তবে আমার হৃদপূর্ণিমার খুশির জন্য এই নাশিদ তার সর্বোচ্চ করতে রাজি, তবে লিমিট বজায় রেখে। তোমার ছেলেমানুষি আবদার করলে ঠিকই বকা খাবা!’
-‘ছেলেমানুষি আবদার মানে?’
-‘যেগুলা করা ঠিক না, আমার লিমিটের বাইরে!’
রথি ভেংচি কেটে বাইরের দিকে তাকালো। নাশিদ নিঃশব্দে হেসে ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলো। একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। রাস্তাতেই নাশিদ এমন একটা প্রশ্ন করলো যা রথিকে বিষম খাইয়ে দিলো।
-‘মা তোমায় কিছু বলেছে রথি?’
রথি বিষম খায় এবং নাশিদের দিকে তাকায়। কিন্তু নাশিদের কোনোরকম পতিক্রিয়া নেই! রথি আমতা আমতা করে বললো,
-‘মা..মানে?’
-‘মানে টা তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালো জানো! যা জিজ্ঞেস করেছি বলো, এমন চুপ করে লুকিয়ে লাভ নেই!’
রথি প্রথমে অস্বীকার করলো। পরমুহূর্তে নাশিদের কঠোর দৃষ্টিতে ঘাবড়ে বলতে বাধ্য হলো। রথি মাথা নিচু করে চিপসের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
-‘সেদিন আমি একা ঘরে ছিলাম, আন্টি আমার ঘরে এসে আমায় উল্টো পাল্টা কথা বলেছে। আমার কোনোরকম অধিকার নেই এই বাড়িতে থাকার। আমি থাকলে আপনি আমার প্রতি দুর্বল হবেন, অতঃপর আমার মতোন সমাজছাড়া মেয়ের সাথে সে আপনাকে কিছুতেই সহ্য করবে না। আমায় বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে! তাই….’
-‘তাই তুমি আমায় বিয়ে করে আমার বউয়ের পরিচয়ে থাকতে চেয়েছিলে। আমার বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছো তাইতো?’
রথি মাথা নাড়ায়। সে আবারও বলেছে,
-‘আমি আলাদা বাসা খোঁজাও শুরু করেছিলাম। মা তো আর আমার মুখও দেখবেন না বলেছিলেন তাই আলাদা বাসা দেখা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। আর আপনি তো… মাঝেমধ্যে মনে হতো আপনি দায়িত্ব মনে করে আপনার কাছে রেখেছেন, দায়িত্ব শেষ হলে হয়তো আপনার সাথে আমারও কোনো সম্পর্ক থাকবে ন…’
রথি আর কিছু বলার আগেই নাশিদ বেশ জোরে ব্রেক কষে। রথি ভয় পেয়ে নাশিদের দিকে তাকালো। নাসজিদের চোখ-মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। রথি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। নাশিদ কয়েক সেকেন্ড রাগে ফোঁসফোঁস করে রথির দিকে তাকিয়ে রথির মুখ চেপে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
-‘তোর কী আমার ভালোবাসা ঠুনকো মনে হয়? কাল থেকে আমার ভালোবাসার দিকে আঙ্গুল তুলছিস! কেউ ভালোবাসি না বললেই সে ভালোবাসে না? আর এদিকে যে তোর জন্য আমি নিঃস্বার্থে সব করে গেলাম? তোকে সময় দিয়েছি, ইঙ্গিতেও বুঝিয়েছি। তুই এতোটাও বাচ্চা না যে আমার কথা, টাইম স্পেন্ড করার মানে বুঝবি না! তুই যদি এতোই বুঝ হতি বারবার এভাবে আমায় আঘাত করতি না, আমায় চলে যাওয়ার কথাও বলতি না। তুই এখন বিবাহিত! এই নাশিদের বউ তুই! তোরে যেমন ভালোবাসতে পারবো তেমনই কষ্ট দিতে পারবো। তুই ওই মহিলার কথা শুনতে যাবি কেন? আমি বলসি, ওই মহিলার কথা শুনতে? ওই মহিলা কতোটুকু জানে আমার ভালোবাসা সম্পর্কে? লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি রথি, আমার ভালোবাসাকে খারাপ দিকে ইঙ্গিত করলে আমি যে তোকে কী করবো তা আল্লাহ’র চেয়ে ভালো কেউ জানে না। তিন কবুলে তোকে বিয়ে করেছি মনে রাখিস!’
বলেই নাশিদ রথিকে ছেড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। নাশিদ যথাসম্ভব চেষ্টা করতে লাগলো নিজের রাগকে সংগত করার। নাশিদ সরে যেতেই রথির চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। তার বৃষ্টি স্তব্ধ, বিমূঢ়! নাশিদ চোখ বুজে কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
সারা রাস্তায় আর দুজনের মধ্যে কথা হলো না। রথিকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই রথিকে কিছু না বলেই গাড়ি টান দিয়ে নাশিদ আবার থানাতে চলে যায়। রথি মন খারাপ করে ভেতরে চলে গেলো। এভাবে দুইদিন কেটে গেলো নাশিদ রথির সঙ্গে কথা বলে না। ভুল করেও রথি নাশিদের সামনে পরলে নাশিদ নিখুঁতভাবে তাকে এড়িয়ে চলে। এখন রথিকে নাশিদ একা ছাড়ে না। ড্রাউভার দিয়ে কোচিং পৌঁছে দেয় আবার ড্রাইভারের মাধ্যমে নিয়ে আসে। কিন্তু নাশিদ ভুল করেও রথিকে পিক করে না। রথির ইচ্ছে করছে সবকিছু তছনছ করে দিতে। নাশিদের এমন ইগনোরেন্স সে নিতে পারছে না।
সে মানছে সে ভুল করেছে, তাই সে রেগে আছে। এর জন্য তাকে মারুক, বকুক। তাই বলে কথা কেন বন্ধ করবে? নাশিদের এই ইগনোরেন্স তার বুকে ছুঁড়ি দ্বারা বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করছে তা কী নাশিদ বুঝে না?
গত দুই রাতের মতোই আজও রথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করছে নাশিদের জন্য। নাশিদ আজ এখনও ফিরেনি। এখন নাশিদকে না দেখলে তার ঘুম আসে না, আসে না অবস্থা। দেরী করে ফিরছে, এজন্য তার চিন্তার শেষ নেই। আচ্ছা বিয়ে হলে কী সকল মেয়েরাই এমন হয়ে যায়? আগেও তো নাশিদ দেরীতে ফিরেছে, রথির ঘুমিয়ে পরার পরে এসেছে। কিন্তু এখন? নাশিদের জন্য কতোটা উদ্বীগ্ন হয়ে আছে। বিয়ের নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের ভালোবাসা আরও গাঢ়তে রূপ নিয়েছে! অপেক্ষা করার মাঝেও আলাদা সুপ্ত অনুভূতি রয়েছে। রথির ভাবনার মাঝেই সে গাড়ির শব্দ পেলো। মুহূর্তেই তার মুখমন্ডলে খুশির আলোড়ন তৈরি হলো। রথি চোখ মুছে মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দিয়ে ভেতরে আসলো। নাফিসা ঘুমোচ্ছে। রথি মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সিঁড়ির কাছে নাশিদকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে রথি সেখানেই থমকে গেলো।
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২৩ |
রথি অশ্রুসিক্ত নয়নে নাশিদের পানে একপলক তাকিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে নাশিদের দিকে ছুটলো। নাশিদ শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে হাঁটছে। নয়ন বারংবার বলেছিলো সে নাশিদকে পৌঁছে দিবে কিন্তু নাশিদ একবারের জন্যেও তার মতামত কর্ণাধারে না নিয়ে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছে। যার ফলস্বরূপ সে হাঁটার শক্তিটাও পাচ্ছে না। এক কর্মচারী তাকে বাসা অবধি পৌঁছে দিয়েছে আর বাড়িতে ঢুকে একাই সিঁড়ি বেয়ে উঠে কোনরকম নিজের রুমের দিকে যেতে অগ্রসর হয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা তাকে বারংবার দুর্বল পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। রথি তার নরম হাতজোড়া নাশিদের বাহুতে শক্ত করে ধরে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কী হয়েছে আপনার? একি হাল করেছেন, ঠিকাছেন আপনি?’
নাশিদের দিক থেকে কোনো প্রতিত্ত্যর এলো না। নাশিদের অবিন্যস্ত চাহনি তাকে ক্রমে ক্রমে উত্তেজিত করে তুলেছে।
-‘আমি বাড়ির বাকিদের ডাকছি দাঁড়ান!’
রথি পা বাড়াবে তার পূর্বেই নাশিদ মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-‘নাহ..!”
রথি থেমে যায় এবং পুনরায় নাশিদের দিকে তার ঝাপসা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। রথি উপায়ন্তর না পেয়ে নাশিদের বাহু ধরে ধীরগতিতে তার রুমে নিয়ে গেলো। নাশিদ বিছানার নিকট আসতেই পায়ে বল না পেয়ে আহত শরীরটা নিয়ে ধপ শব্দে বিছানায় শুয়ে পরলো। হালকা ধূসর রঙের বেডশিটটা রক্তে মাখামাখি। এই মাঝরাত্রে রথি কী করবে কোনোরূপ উপায়ন্তর খুঁজে পায় না সে। তবে তার মস্তিষ্ক এইটুকুনি জানান দিচ্ছে, যা করার তার নিজেরই করতে হবে। রথি দ্রুত লাইট জ্বালিয়ে নাশিদের কাবার্ডসহ, কয়েকটি ড্রয়ারে ফাস্ট এইড বক্স হতবিহ্বল হয়ে একমনে খুঁজে চলেছে। ওদিকে নাশিদ কৈ মাছের ন্যায় ছটফট করছে অনবরত। মিনিটখানেকের মধ্যেই সে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে নাশিদের সামনে হাজির হয়। তার চোখের কোণ বেয়ে নোনাজল অনবরত পরছেই। তার এই কান্না জানান দিচ্ছে প্রিয়মানুষের বেদনায় সে নিজেও সমানতালে ব্যথিত। রথি তার সকল অস্বস্তিকে দূরে সরিয়ে নাশিদের টেনে উঠায় এবং কোনরকমে বসিয়ে দেয়। নাশিদ বারবার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেও রথি শক্ত করে নাশিদের এক হাত ধরে রইলো এবং আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-‘একটু ধৈর্য ধরুন, পুলিশম্যান। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ!’
নাশিদ কোনোরকমে চোখ মেলে শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রথির পানে। রথি রক্তাক্ত শার্টের বোতাম এক এক করে খুলে খুবই সাবধানে নাশিদের শরীর থেকে ছাড়ালো। এর মাঝে রথি এক সার্ভেন্টকে ডেকে জলদি গরম পানি আর একটা ছোট কাপড়ের ব্যবস্থা করতে বললো। সার্ভেন্ট রথির আদেশ পেয়ে দ্রুত চলে যায় সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে। রথি ঘরে এসে নাশিদকে স্পর্শ করতেই তার সর্বাঙ্গ সিঁথিল হয়ে এলো। জ্বরের তীব্রতায় নাশিদকে স্পর্শ করা যাচ্ছে না। রথি চোখে জল নিয়ে ভাবছে, “হে আল্লাহ, আপনি আমায় এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন!?”
সার্ভেন্ট পানি এনে দিতেই রথি দ্রুত কুসুম গরম পানিতে ছোট কাপড়টা ভিঁজিয়ে নাশিদের পিঠ আর পেট থেকে সাবধানে রক্ত মুছতে শুরু করে দেয়। রক্ত মোছার শেষ পর্যায়ে রথির চোখ আটকে যায় নাশিদের শুভ্র নির্মল পিঠে। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য ক্ষতের দাগ। তবে ক্ষতগুলো গভীর নয়। পেটের দিকে দুটো ছুঁরির আঁচড় দৃশ্যমান। এরূপ অবস্থা দেখে রথির চোখ আবারও ঝাপসা হয়ে এলো। দ্রুত ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। অতঃপর কাবার্ড থেকে ঢোলা করে একটি ফতুয়া নিয়ে সেটা নাশিদের গায়ে জড়িয়ে দিলো। নাশিদ শুতে গেলে পিঠে ব্যথা ব্যথা অনুভব করে যার ফলে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে। রথি দ্রুত নাশিদকে কাত করে শুইয়ে দেয়। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ক্ষতস্থানের তো ব্যবস্থা করা হলো কিন্তু জ্বরের কী করবে? এর তীব্রতা যে মোটেই কমছে না। রথি যাহোক করেই হোক কিছুক্ষণ কপালে জলপট্টি দিলো। যেহেতু নাশিদ কাত হয়ে শুয়েছে সেহেতু রথির হাত দিয়ে কাপড়টা ধরে রাখলো। সারারাত অনেক সেবা করলো নাশিদের। নাশিদ ঘুমের ঘোরে কিছুক্ষণ বাদে বাদেই বিরবির করছিলো অনবরত। রথি তার কর্ণধার নাশিদের মুখের সামনে নিতেই কিছু অস্পষ্ট বচন শুনলো যা শুনে রথি স্তব্ধ!
-‘উনি আমার মা নন! আমার মা নেই। আমিও তোমার মতো এতিম। মায়ের মতো উনি আমার ভালো চাননি, কখনোই চায়নি। সব থাকলেও মায়ের মমতা আমার কাছে নেই, আমি একা! রথ, আমায় ছেড়ে যেও না। তোমায় ছাড়া আমার পৃথিবী থমকে যাবে। আমার মন খারাপের সঙ্গী হিসেবে তোমাকে চাই, রথ। প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না খুব ভয় হয় আমার, তোমায় হারানোর ভয়!’
রথি বিছানায় বসে নাশিদের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কোথাও যাবো না আপনাকে ছেড়ে পুলিশম্যান। আপনি যে আমার নিঃশ্বাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছেন। আপনি ছাড়া আপনার এই রথও অঁচল। জলদি সুস্থ হয়ে যান পুলিশম্যান, আপনাকে এই অবস্থায় মানায় না।’
পরমুহূর্তেই নাশিদের বাকি কথায় তার টনক নড়লো। সে স্তম্বিত হয়ে কিছুক্ষণ একমনে ভাবলো। ‘মহিলা’ বলে কাকে উদ্দেশ্য করলো? মনিকাকে? নাশিদ রথির কোলে পুনরায় ঘুমিয়ে পরলো। রথিও একসময় নাশিদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই ঘুমিয়ে গেলো দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে।
নাশিদের রুম ক্রস করে যাওয়ার সময় ভাবী নাশিদের রুমের দরজা খোলা অবস্থায় পেলো। ভাবী হালকা উঁকি দিতেই শক খেলো। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রথির কোলে মাথা রেখে নাশিদ ঘুম। ভাবী বিড়ম্বনা না করে দ্রুত চলে গেলো। তার অবশ্যই জানতে হবে রথি এবং নাশিদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না! সম্পর্ক না থাকলে দুজন এভাবে ঘনিষ্ঠতার সাথে ঘুমিয়ে কেন? এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাবীর মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে!
ভোরের দিকে পাখিদের কিঁচিরমিচিরের শব্দে নাশিদের ঘুমটা আকষ্মিক ভেঙ্গে যায়। পিটপিট করে তাকিয়ে যেই পিঠ বিছানায় দিবে তখনই পিঠে জ্বালা অনুভূত হলো না। কিঞ্চিৎ শব্দ করে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। তার শরীর কেমন ঘাম দিয়েছে। নাশিদ চারদিকে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে নেয়। পিছে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে নাশিদ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে ফিরে তাকালো। রথি এলোমেলোভাবে ঘুমিয়ে আছে। তার মাথা দেয়ালে ঠেকানো। গতরাতের অস্পষ্ট স্মৃতি একে একে তার অক্ষিকাচে ভেসে উঠলো। তবে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আর কিছুই মনে নেই। এর মানে কী দীর্ঘ রাত রথি নাশিদের সেবা করেছে। নাশিদ এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে রথির দিকে তাকালো। এই দৃষ্টিতে পবিত্রতা বিদ্যমান, সঙ্গে একরাশ মুগ্ধতা। রথি নামক মেয়েটি যে কি না নাশিদের স্ত্রী সে আবারও নাশিদকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, এই স্ত্রী ব্যতীত নাশিদ তার জীবনে কিছুই না। রথি-ই তার উত্তম সহধর্মিণী।
হ্যাঁ, তার এই রথি-ই তার হৃদপূর্ণিমা, যে কিনা তার হৃদয়ের পূর্ণিমা হয়ে তার জীবনে এসেছে। যেই পূর্ণিমা এই দুনিয়াকে অগ্রাহ্য করে নাশিদকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে। নাশিদ শব্দ না করে রথিকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের ওষ্ঠ্য-জোড়া আলতো রথির কপালে ছুঁইয়ে দেয়। অতঃপর ধীরে-সুস্থে উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
রথিও হুট করে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো নাশিদের বিছানায় সে ঘুমিয়ে আছে। রথি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।
-‘প..পুলিশম্যান কোথায়?’
রথি চারপাশে চোখ বুলিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই ওয়াশরুম থেকে শব্দ আসলো। এর মানে নাশিদ ওয়াশরুমে গেছে। রথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বেডশিটের দিকে চোখ যেতেই দেখলো রক্তগুলো শুকিয়ে গেছে। রথি বেডশিট তুলে রুমের বাইরে নিয়ে আসলো। অতঃপর রুমে এসে দেখলো নাশিদ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেছে। রথি উদ্বীগ্ন হয়ে নাশিদের দিকে ছুটলো। নাশিদের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা চেক করে বুঝলো জ্বর ছেড়ে গেছে। ভাগ্যিস তখন সার্ভেন্টের কথামতো একটা ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলো। নাশিদ মুগ্ধ হয়ে রথির কর্মকান্ড লক্ষ্য করছে। রথি এবার বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার এ অবস্থা হলো কী করে পুলিশম্যান?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি রথ! চিন্তা করিও না আমায় নিয়ে। আর গতকাল একটা ভয়ানক মিশন ছিলো আমাদের। আমার কোনো প্রটেকশন ব্যবহার করিনি বিধায় ক্রিমিনালরা সুযোগ পেয়েছে। বাট নাও আই এম ওকে।’
-‘গতকাল রাতে তো ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছিলেন না, আবার এখন বলেন আই এম ওকে? ফাইজলামি পাইসেন?’
নাশিদ নিঃশব্দে হাসলো। অতঃপর দুই হাত দুই দুই কাঁধে ঝুলিয়ে রথির সামনে ঝুঁকে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
-‘আমার এরকম একটা বউ থাকলে আর কী লাগে বলো? তোমার ওই নরম হাতের জাদু আর আল্লাহ’র দয়ায় আমি অনেকটা সুস্থ।’
-‘আমি এতসব শুনছি না। খাবার আনছি, খেয়ে মেডিসিন নিবেন।’
-‘এই ভোরে? কে জেগে আছে?’
-‘কেন আমি! আমি রাঁধবো আপনার জন্য। বলুন কী খাবেন?’
নাশিদ মুচকি হেসে বলে, ‘তোমার যা ইচ্ছে তাই বানিয়ে আনো!’
রথি কিছু না বলে চলে গেলো। বেডশিট বাইরেই পরে রইলো। নাশিদ ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে রথিকে নিয়ে এক আকাশ-সম স্বপ্ন বুনতে ব্যস্ত। নাশিদ হেলান দিতে গিয়েও পারলো না। কতোকগুলো লারকির উপর পরেছিলো সে, যার কারণে এমন বেহাল অবস্থা। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর রথি কিছু বানিয়ে আনলো। বেশি কিছু না শুধুই নুডুলস। নুডুলস ব্যতীত হাতের কাছে রথি কিছুই পায়নি।
নাশিদের সামনে নুডুলসের বাটিটা রেখে রথি বলে উঠলো,
-‘ফটাফট খাওয়া শুরু করুন, রাত থেকে না খেয়ে আছেন আপনি!’
-‘তুমি খাইয়ে দাও!’
নাশিদের আবদার রথি ফেলতে পারলো না। রথি নাশিদের সামনে বসে নাশিদকে খাইয়ে দিতে লাগলো। নাশিদ তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে একমনে রথিকেই দেখে চলেছে। পুরো খাওয়াটা সে রথিকে দেখেই শেষ করলো। নাশিদের ঘোর লাগা দৃষ্টি রথিকে বিব্রত করলেও সে কোনোরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। খাওয়া শেষ হতেই নাশিদের দেখিয়ে দেয়া ওষুধগুলো নাশিদকে খাইয়ে দিয়ে রথি নাফিসার ঘরে চলে গেলো। নাশিদ বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আপনমনে মনে উঠলো,
-‘কবে তোমায় সম্পূর্ণভাবে নিজের কাছে রাখবো রথ? আমি যে চেয়েও তোমায় আপন করতে পারছি না। পরিস্থিতি আমায় হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে!’
______________________________
রথি হসপিটালে কেবিনের বাইরে চুপ করে বসে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। তার সামনের কেবিনে তার মাকে চেকআপ করানো হচ্ছে। সাইফ বোনের পাশে বসে আছে। ক্ষমা চাওয়ার মুখ তার নেই। মার্জান অদূরে তাতানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাশিদ ডক্টরের সাথে আলোচনা করছে। এই অসুস্থ অবস্থায় রথির মায়ের কথা শুনে রথির সাথেই চলে এসেছে। সাইফ তার বোনের এই চুপ থাকাটা মেনে নিতে পারছে না। সাইফ বোনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘আমায় ক্ষমা করে দে বোন! আমি সত্যি জানতাম না মার্জান এই অঘটন ঘটিয়ে এসেছে। তুই আমায় আর মাকে ক্ষমা করে দে। মা যেদিন তাতানের মুখে তোর ঘটনা শুনেছে সেই থেকে দিন-রাত কেঁদেই কাটিয়েছে। কেঁদেকেটে এমন অবস্থা করেছে যে ভোরবেলা মা…’ সাইফ আর বলতে পারলো না হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। রথির চোখে জল নেই, সে যেন পাথরে রূপান্তরিত হয়েছে৷ মায়ের এমন একটা খবর সে একদমই আশা করেনি।
অদূরে মার্জান কাঁদছে অনবরত। সাইফ গতরাতেই বলেছে তাকে তালাক দিবে আর ভোরবেলা এমন অঘটন ঘটে গেলো। সে এখন কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। পাপের শাস্তি বুঝি এভাবেই চক্রাকারে ফিরে আসে? রথি উত্তর দিচ্ছে না দেখে সাইফ রথির পাশ থেকে উঠে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনই ডক্টর কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলো। নাশিদ দ্রুত ডক্টরের কাছে এসে বললো,
-‘ডক্টর..’
-‘শি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। উনি এখন ঘুমোচ্ছেন। ঘুম থেকে উঠলে আপনারা একে একে দেখা করতে পারবেন। তবে আমি পূর্বের ন্যায় আবারও বলছি, ওনাকে কষ্ট এবং মানসিক চাপ থেকে বিরত রাখবেন। আজ উনি স্ট্রোক করেছেন। এ কোনো ভালো লক্ষণ নয়। ওনাকে যথেষ্ট সময় দিন।’
-‘থ্যাংকিউ ডক্টর!’
ডক্টর মাথা নাড়িয়ে সেই স্থান প্রস্থান করলেন। অতঃপর নাশিদ রথির পাশে বসে রথির কাঁধে আলতো হাত রেখে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-‘সব ঠিক আছে। ট্রেস নিও না!’
রথি আলতো করে নাশিদের কাঁধে মাথা রাখলো। সাথে সাথেই তার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো। ওদের একসাথে সাইফ এবং মার্জান উভয়ই খেয়াল করলো কিন্তু কেউ-ই কোনোরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। হয়তো দুজনেই বুঝলো, এই অচেনা ছেলেটি রথির ভরসার কেন্দ্রস্থল!
~চলবে।
গ্রুপঃ লাবিবা’স স্টোরি ফিকশন🌻
বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।
[ছবির ক্রেডিট- অনন্যা আপু🌼]#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২৪+২৫ |
রথি তার মায়ের বুকে চুপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তার আঁখিপল্লব ভার হয়ে আছে। সেই ভারের কারণটি বোধহয় মায়ের বুকে ঘুমানোর বেহায়াপনা। পৃথিবীর সকল প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে তার। মা আঁটকে আঁটকে সিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘কতদিন পরে তোকে পেলাম রে মা। আমার ভেতরটা ঠান্ডা হলো। তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো মা?’
-‘এসব কী বলছো তুমি মা? এভাবে কেউ সন্তানের কাছে ক্ষমা চায়? তোমায় ভালোবাসি মা, তাই প্লিজ ক্ষমা শব্দটা উঠিয়ে আমায় ছোট করিও না!’
-‘পাগলি! ক্ষমা সুন্দর এবং মহৎ গুণ! সেই ক্ষমার নিকট ছোট বড় কেউ-ই অসমান নয়। আমি বড় হয়ে আমার ছোট মেয়েটার প্রতি না বুঝে অন্যায় করেছি, এর জন্য ক্ষমা না চেয়ে কীভাবে থাকি?’
-‘ওইযে বললে না, ‘না বুঝে’। আমি জানি মা, তোমায় ভুল বোঝানো হয়েছিলো তাই এমন করেছো। প্রকৃতপক্ষে আমি তোমার উপর রেগে নই। তাহলে ক্ষমা চাইছো কেন বারবার? এবার ক্ষমা চাইলে আমি সত্যি সত্যি-ই চলে যাবো!’
মা আমায় পরম আদরে বুকে আগলে নিয়ে বললো,
-‘উহু। তুই আমার সাথেই থাকবি আর আজই তোকে বাড়ি নিয়ে যাবো!’
কেবিনের বাইরে থেকে দরজার ছোট কাচ দিয়ে একমনে মা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে চলেছে নাশিদ। তার মনটা কিছুটা ব্যথিত হলেও সে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো এবং সেখান থেকে সরে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। রথি তার মাকে ছেড়ে মাথা উঠিয়ে বললো,
-‘আ..আজই?’
-‘হ্যাঁ। এই হাসপাতাল, টাতালে আমি থাকতে পারবো না। আমি আমার বাসায় যাবো!’
-‘কিন্তু মা, আজ তোমায় ডিসচার্জ দিবে না!’
মা সাইফের জবাবে প্রতিত্ত্যুর না করে রথিকে বললো,
-‘বাইরে নাকি নাফিসার ভাই আছে? ওকে দিয়ে ব্যবস্থা করে দে না রথি!’
রথি খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলে,
-‘আ.. আচ্ছা মা দেখছি!’।
বলেই রথি ধপ ধপ পা ফেলে কেবিনের বাইরে চলে যায়।
_________________________________
-‘এই নাফু শুন!’
-‘বলো ভাবী!’
-‘কিছু জানার ছিলো!’
-‘কী ভাবী?’
-‘রথি আর দেবরজির মাঝে কী কোনো রিলেশন আছে?’
নাফিসা থতমত খেয়ে যায়। কী বলবে ভেবে পায় না। ভাবী রুদ্ধদ্বার স্বরে বলে উঠলো,
-‘লুকিয়ে লাভ নেই নাফু। আমি গতকাল রাতে রথিকে নাশিদের ঘরে দেখেছি আর নাশিদ রথির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলো!’
নাফিসা বুঝলো আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই সে তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,
-‘তোমার ধারণা ঠিক ভাবী! রথি আর ভাইয়ার রিলেশন আছে। তারা, দে বথ ফল ইন লাভ!’
ভাবী কিছুক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে রইলো নাফিসার পানে। অতঃপর নাফিসার দিকে অনাকাঙ্ক্ষা হাসি দিয়ে বললো,
-‘ধুর বোকা, ভয় পাচ্ছো কেন? মাকে কিছুই বলবো না আমি। আর আমি নিজেও এই বিষয়ে কবেশ খুশি। ভালোবাসা খুবই পবিত্র জিনিস! এটা আমরা ইয়াং জেনারেশন একটু বেশি-ই বুঝি, বুঝলে?’
নাফিসা হাসলো! এদিকে মনিকা সকাল বেলা নাশিদের ঘরের দিকে যেতেই দেখলো বাহিরে নাশিদের বেডশিট পরে আছে আর তা সার্ভেন্ট কাপড়ের ঝুঁড়িতে তুলছে।দ মনিকা দ্রুত পা চালিয়ে সেই স্থানে গিয়ে সার্ভেন্টের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘দাঁড়াও! ওই লাল ওটা কী?’
বলেই মনিকা ঝুঁড়ি থেকে বেডশিটটা নিয়ে রক্তের দাগগুলো পরোখ করতে লাগলো। সার্ভেন্ট মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
-‘এটায় রক্ত লাগা ম্যাডাম! তাই..’
-‘তাই কী? রক্ত কীভাবে লাগবো?’ স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে উঠলো মনিকা।
-‘ছোট স্যার কাল আহত হয়ে এসেছিলো। তার রক্তই বেডশিটে লাগানো!’
-‘কেউ ছিলো তার সাথে?’
সার্ভেন্ট খানিকটা ভড়কে গেলো মনিকার প্রশ্নে। মনিকা অগ্নিময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
-‘কী লুকোতে চাইছো? যা বলছি সাফ সাফ বলো স্টুপিড!’
সার্ভেন্ট ভয়ে কেঁপে উঠলো। সে নিজের পায়ে দৃষ্টি স্থির করে আমতা আমতা করে বললো,
-‘রথি ম্যাডাম ছিলো। উনি-ই ছোট স্যারের খেদমত করেছিলো!’
_________________________________
নাশিদ রথির মায়ের ডিসচার্জের ব্যবস্থা করে দেয়। রথি মাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে পেছন থেকে নিজেই চালিয়ে যেতে গেলো। সবার পিছে মার্জান তাতানকে নিজের সাথে জড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে থমথমে গলায় বলতে লাগলো,
-‘আমায় কেউ বুঝলো না রে বাবা। আমি যে তোকে বাঁচাতে আর তোর ফুপির ভালোর জন্যই দূরে পাঠাতে চেয়েছিলাম। জানি আমি ভুল পথে সবটা ঠিক করতে চাইছিলাম তাই বলে সবটা না জেনে তোর বাবা আমায় ডিভোর্স দিবে বলে দিলো? কেউ একটাবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলো না এসব আমি কেন করেছি? তাতান, তাতান বাবা! আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না রে।’
তাতান চুপটি করে তার মায়ের কথাগুলো শুনলো। তার হাতে মার্জানের চোখ মুছে দিয়ে বললো,
-‘কেঁদো না আম্মু!’
সাইফ এবং নাশিদ ধরে মাকে সিএনজিতে বসিয়ে দিলো। মা উঠে বসতেই মার্জান তাতানকে নিয়ে অপরপাশ দিয়ে বসলো। আর সাইফ ড্রাইভারের পাশে বসলো। সাইফ ঠান্ডা কন্ঠে রথির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘নাশিদকে বিদায় দিয়ে আয়!’
রথি কিছু না বলে সিএনজির থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা নাশিদের দিকে পা চালালো। নাশিদ তখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এক অজানা কারণে তার বুকের বা পাশটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করছে। হয়তো প্রিয় মানুষটা দূরে চলে যাবে ভেবে। রথি নিষ্প্রভ চাহনি নিক্ষেপ করলো নাশিদের কাতর ভরা আঁখিপল্লবের দিকে। পুণরায় দৃষ্টি অদলবদল হয়। রথি থমথমে গলায় বলে উঠলো,
-‘সাবধানে থাকবেন। ওষুধ ঠিকমতো নিবেন!’
-‘হুম।’
-‘নিজের খেয়াল রাখবেন।’
-‘হুম।’
-‘হুম, হুম করছেন কেন?’
-‘অনেককিছু বলতে চেয়েও পারছি না।’
বলেই নাশিদ রথির দিকে দুই পা এগিয়ে দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘এই বউ, কীভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া? আমার এখনই কেমন দম আটকে আসছে। দেখো ঠিকমতো নিঃশ্বাসটাও আসছে না! কেন এমন লাগছে বলো না? কী জাদু করেছো এ-কদিনে? পারছি না আমি, আমার ইমোশনালকে কান্ট্রোল করতে! প্লিজ সলিউশন দাও!’
রথি পুণরায় নাশিদের আকুতিভরা চোখের দিকে তাকায়। নাশিদের চোখে জল। রথি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আঁখিজোড়ার দিকে। রথি কখনো কল্পনাও করেনি কেউ তাকে এতোটা ভালোবাসবে। রথি নাশিদের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো, কিছুই বলতে পারলো না। নাশিদ মিনুতির স্বরে রথির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘এ..একবার জড়িয়ে ধরবে আমায়, বউ?’
এবার রথির চোখে জল চলে এলো। রথি নাশিদকে ছুটে জড়িয়ে ধরলো। নাশিদও পরম যত্নে তার হৃদপূর্ণিমাকে আগলে নেয়। দুজনের চোখ দিয়েই অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে। দুজনের ব্যথাটা হচ্ছে ‘দূরত্ব’! হয়তো অপ্রকাশিত কিন্তু নিরবে দুজন দুজনকে ছাড়া থাকার ব্যথাটা উপলব্ধি করতে পারছে। যেন কতো দূরে চলে যাবে! রথি দেরী করলো না। নিজ হাতে নাশিদের চোখ মুছে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
-‘আপনি একজন পুলিশ অফিসার! বউয়ের জন্য কেঁদেকেটে এভাবে চোখ-নাক লাল করে ফেললে মানুষ আপনাকে বউপাগল বলবে। বলবে বউ ছাড়া এই ইনসান কিছুই বুঝে না!’
-‘মানুষের কথা আমি শুনতে যাবো কেন? তারা কী করে জানবে আমার কাছে তোমার মূল্য?’
-‘ঠিক আছে হয়েছে। এখন ছাড়েন, মায়েরা অপেক্ষা করছে।’
নাশিদ রথির কপালে তার ওষ্ঠ্য-জোড়া ঠেকিয়ে দূরে সরে এলো। রথি এই স্পর্শে কেঁপে উঠলো। অতঃপর নাশিদ হেসে বলে, ‘যাও।’
রথি প্রতিত্ত্যুরে হাসি উপহার দিয়ে চলে গেলো। আর নাশিদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রথি পিছে ফিরে একপলক নাশিদের দিকে তাকালো। অতঃপর হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো। সিএনজি নাশিদের চোখের আড়াল হতেই সে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।
রথি বাড়ি ফিরে মায়ের জন্য আগে কিছু রেঁধে নিলো। রান্না শেষ করে দ্রুত খাইয়ে ওষুধ দিলো। ওষুধ খেয়েই মাকে শুইয়ে দিয়ে পরম যত্নে মায়ের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। মাও ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে চোখ বুঝলো এবং কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে গেলো। মা ঘুমাতেই রথি ওয়াশরুম গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নেয়। শাওয়ার নিয়ে রুমে আসতেই বাইরে থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনলো। কন্ঠস্বর সাইফ এবং মার্জানের তা রথির বুঝতে বাকি রইলো না। সে দ্রুত বের হতেই তাতানের সামনাসামনি হলো। রথি হাঁটু গেড়ে বসে তাতানের উদ্দেশ্যে বললো,
-‘যাও তাতান, দিদুনের কাছে গিয়ে বসো।’
তাতান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রথি উঠে দাঁড়ায় এবং দ্রুত পা চালিয়ে সাইফের ঘরের দিকে চলে যায়। রুমে গিয়ে রথি স্তব্ধ হয়ে যায়। মার্জান সাইফের পা ধরে ক্ষমা চাইছে। বারংবার বলছে যেন তাকে ডিভোর্স না দেয়া হয়, তাতানকে তার থেকে দূরে না সরানো হয়! কিন্তু সাইফ শুনতে নারাজ। সাইফ নিজের রসগ দমাতে না পেরে পা ঝাড়া দেয়, যার ফলে মার্জান তাল সামলাতে না পেরে খাটের কোণায় ছিটকে যায়। কপাল লেগে কপালের এক অংশে কেটে রক্ত পরছে। রথি ছুটে মার্জানের কাছে গেলো। রথিকে দেখে সাইফ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। রথি মার্জানকে ধরে উঠাতেই সাইফ স্পষ্ট ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
-‘রথি, ও যেন আজই ওর বাবার বাড়ি চলে যায়। তিন মাস পর সময়মতো ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে। আমি যেন ওর ছায়াও এই বাড়ির ত্রি-সীমানায় না দেখি!’
বলেই সাইফ প্রস্থান করলো। মার্জান এবার রথির দিকে ফিরে মিনুতি করে বলে,
-‘প্লিজ রথি তোমার ভাইয়াকে বোঝাও! আমি ডিভোর্স চাই না। তাতানকেও…’
-‘ভাইয়া যখন বলছে চলে যাও। দেখো তুমি থাকলে ভাইয়া তোমায় মিনিটের জন্যেও শান্তিতে থাকতে দিবে না তাই চলে যাওয়াই ভালো!’
-‘রথি বিশ্বাস করো, আমি তা…’
রথি মার্জানের বাকি কথা না শুনে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সেই রুমটাতে মার্জান একাই পরে রইলো। মার্জান এক চিৎকার দিয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে রইলো।
-‘কেন কেউ শুনতে চাইছো না? আমি সব আমার তাতানের জন্যে করেছি! তোকে দূরে না সরালে আমার তাতানকে শামুন দূরে নিয়ে যেতো, অনেক দূরে। আমার তাতানকে বাঁচানোর জন্যে ওকে আমি ঘরে রাখিনি! আমার ওইটুকুনি বাচ্চাকে হোস্টেল পাঠাতে বাধ্য ছিলাম! একজন মা তার সন্তানকে বাঁচাতে সবকিছু করতে পারে রে রথি! সব!’
সেদিন রাতে সাইফ আর বাড়ি ফিরলো না। মার্জানও ঘর থেকে বের হয়নি। নিজেকে ঘর-বন্দি করে রেখেছিলো। মার্জান সাইফকে অনেকবার ফোন করেছিলো কিন্তু সাইফ কল ধরেনি। জাস্ট একটা মেসেজ করেছিলো।
-‘তুমি যতদিন বাড়িতে থাকবে, আমি ততদিন ফিরবো না! নাও চয়েজ ইজ ইওর’স!’
রথি মা, তাতান আর মার্জানকে সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে গেছে। আজ তার কোচিং যাওয়া হয়নি। মা সুস্থ না হওয়া অবধি তার কোচিং যাওয়া সম্ভব না। সারাদিনের ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই নাশিদকে বড্ড মনে পরলো। রথি উঠে বসে বিছানার দিকে তাকায়। তাতান এবং মা দুজনেই ঘুম। রথি নিজে শোয়ার জন্যে নিচে বিছানা করে শুয়েছিলো আর তাতান তার জায়গায় ঘুমিয়েছে। রথি উঠে টেবিল থেকে নিজের ফোন নিয়ে আবারও তার বিছানায় আসলো। ডায়াললিস্ট থেকে ‘পুলিশম্যান’ নামটা পেতেই কল দেয়। কিন্তু রিং হওয়ার পরেও কল রিসিভ হলো না। রথি আর কল দেয়ার সাহস পায় না। হয়তো নাশিদ ঘুমোচ্ছে। এমনিতেও তো নাশিদ আহত, তার ঘুমের প্রয়োজন। এসব ভেবে রথি ফোন রেখে নিজ কল্পনাতে নাশিদকে ভাবতে লাগলো। এতদিনের কাটানো মুহূর্তগুলো, আজকের সকালের মুহূর্ত সবটা একে একে মনে করছে আর সুখের ভেলায় ভাসছে। প্রিয়মানুষদের সাথে কাটানো সোনালী সময়গুলোর সুখটা প্রকাশ করে বোঝানো যায় না। এই সোনালী মুহূর্তগুলো একান্তই ব্যক্তিগত!
_________________________________
-‘রথির সাথে তোমার কী সম্পর্ক? সত্যি করে বলো নাশিদ!’
নাশিদ মিনিটখানেক চুপ থেকে রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
-‘আমার বউ হয় ও! শুনেছেন? বিয়ে করেছি তাকে। আমার বিয়ে করা বউ দেখেই গতরাতে সে আমার সেবা-যত্ন করেছে। আর কিছু জানতে চান?’
নাশিদের কথায় লিভিংরুমের পরিবেশটা পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে গেলো। সকলেই অত্যন্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নাশিদের দিকে। মনিকা হতবিহ্বল হয়ে বলে,
-‘ফাইজলামির লিমিট আছে! আর এটা কোন ধরণের বেয়াদবি নাশিদ? মা হই আমি তোমার!!’
নাশিদ তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। অতঃপর সার্ভেন্টকে বলে কিছু কাগজ আনায় সে। সেই কাগজই কাবিননামা। নাশিদ কাবিননামা তার বাবার হাতে দিতেই সে সবটা পড়লো। পড়ে নিজেও সে স্তব্ধ। বাবাকে এমন থম মেরে বসে থাকতে দেখে নেওয়াজ তার বাবার থেকে কাগজটা নিয়ে নিজে পড়তে থাকে। মনিকা ভ্রুযুগল একত্রিত করে থমথমে গলায় বললো,
-‘কী লেখা আছে ওটায়, নেওয়াজ?’
-‘সত্যি-ই বিয়ে হয়েছে মা!’
নাশিদ এবার তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-‘বিশ্বাস হলো তো? এখন এই অর্পিকে বিদায় করুন বাড়ি থেকে। আপনি কী ভেবেছেন? লুকিয়ে গুটি চালবেন অথচ আমি টের পাবো না? এই নাশিদের মন এতো সস্তা না যে ওর মতো চিপ গার্লের প্রতি উইক হবো।’
-‘মুখ সামলে কথা বলো। আমি তোমার ম…’
-‘ওহ প্লিজ! এক কথা বলে বলে নিজেকে নিজেই অপমান করবেন না। আপনি নিজেও ভালো করে জানেন এবং আমিও, আপনি আমার মা নন।’
বাবা ব্যতীত উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হলেন। মনিকা নিজেও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নাশিদ সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললো,
-‘আমি আমার মতামত জানাচ্ছি, রথিকে শীঘ্রই ধুমধাম করে ঘরে তুলবো। এর মাঝে যেই ব্যাগড়া দেয়ার চেষ্টা করবেন তার জন্য মোটেও ভালো হবে না! আর মিসেস মনিকা, আপনাকে তো জানিয়েই দিলাম আমি সত্যিটা জেনে গেছি তাই এখন আপনি একা একা এক রুমে বাবার সঙ্গে আমার নিন্দা না করে প্রকাশ্যে করুন। আমি আপনার সেই সুযোগ আজ করে দিলাম। আপনার যদি আমায় সহ্য-ই না হয় তাহলে ফাইন, আপনার মহলে আমি থাকবো না। আমি আমার রথিকে নিয়ে গাছতলাতেও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবো!’
শেষোক্ত কথাগুলো বলার সময় নাশিদের চোখগুলো অসংখ্য লাল হয়ে গেছিলো। সকলের আড়ালে চোখের কোণ মুছে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো।
রুমে গিয়ে ডিরেক্ট বেলকনিতে গিয়ে বসে পরলো। বারংবার নাক টানছে সে। ডিভানে বসে নিশ্চুপ হয়ে তার দৃষ্টি বাহিরে স্থির করলো। তার কর্ণধারে বাবার বলা প্রতিটি কথা বারংবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নাশিদ চোখ বুঝে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো। সাময়িক শান্তির প্রয়োজন তার। আফসোস আজই রথি চলে গেছে। রথিকে ছাড়া নাশিদ আরও ব্যাকুল হয়ে উঠলো। রথি থাকলে হয়তো তাকে আশ্বাস দিতো এবং তার দুঃসময়ে সঙ্গ দিতো। নাশিদ চোখ খুলে তার অতীতে ডুব দেয়।
প্রায় সময়ই নাশিদ বাবার সাথে দেখা করতে আসলে মনিকার নাশিদকে নিয়ে বিরক্তি ভরা কথা শুনতো যা নাশিদকে কষ্ট দিতো। কিন্তু সে এসব শুনেও তাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতো। নাশিদের সামনেও যেহেতু মনিকা স্বাভাবিক আচরণ করছে তাই নাশিদ ওসব কথাবার্তা ভুলে যেত। কিন্তু তার ভেতরে একটা সংকোচ থেকেই যেত। হয়তো নাশিদের দ্বারা বড়রকম কোনো ভুল হয়েছে যার জন্য তার মা তার প্রতি অসন্তুষ্ট।
নাশিদ সিলেট চলে যায়। এর মাঝে সে বাড়ি ফিরতো না বললেই চলে। সেখানে কয়েক বছর পার করে আবারও ঢাকায় আসে। প্রথম কিছুদিন ভালো থাকলেও নাশিদ আবারও তার মায়ের ও ধরণের কথাবার্তা শুনতো। বাবা-মায়ের ঝগড়াঝাঁটিও দেখেছে। এতদিনে নাশিদ যথেষ্ট ম্যাচিউরড হয়েছে। তাই তার বিষয়টা মোটেও ভালো লাগেনি। একপ্রকার মনমরা থাকতো সবসময়। কিন্তু মনিকার বাহিক্য ব্যবহারে নাশিদ কিছু বলতে পারতো না। মূল কথা হলো প্রমাণ ছাড়া ধারণা অনুযায়ী কিছু জিজ্ঞেস করাও ঠিক হবে না। যতোই হোক সে একজন পুলিশ অফিসার এবং প্রমাণের মূল্য সে ভালোভাবেই বুঝে। একদিন বাবা লিভিংরুমে বসে ছিলো। নাশিদও ছিলো পাশে। সেদিন বাবা অফিসের জরুরি ফাইলের জন্য নাশিদকে ঘরে পাঠায়। নাশিদ বাবার কাবার্ডে ফাইল খুঁজতে খুঁজতে একটা ডেথ সার্টিফিকেট পায়। সেই সার্টিফিকেটে ‘নীলিমা’ নাম লেখা। নাশিদ প্রায়ই শুনতো তার মা মানে মনিকা ‘নীলিমা’ নামের কাউকে কথা শোনাতো। তাই নাশিদ সেই ডেথ সার্টিফিকেট সাবধানে নিজের কাছে রেখে দেয় এবং এটা নিয়ে রিসার্চ শুরু করে। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে এই সার্টিফিকেটি আর কারো না নাশিদের জম্মদাত্রী মায়ের।
তার সামনে এতো এতো প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সে কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। তাই সে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে ডিরেক্ট তার বাবার সঙ্গে দেখা করে। বাবা সবটা শুনে বেজার হয়ে বলতে শুরু করলো,
-‘হ্যাঁ! তোমার মা মনিকা নয়, নীলিমা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী তোমার আপন মা।’
-‘তাহলে… তাহলে এসবের মানে কী?’ বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো নাশিদ। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
-‘তোমার মা ছিলো আমার প্রথম ভালোবাসা। তখন আমি সবে তোমার দাদার কোম্পানিতে জয়েন করছি আর তোমার মা কলেজে পড়ে। তোমার মাকে কথা দেই জয়েন করলেই তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলবো। তোমার মা ছিলেন এতিম, চাচার ঘরে বড় হয় সে। সেই চাচারই একমাত্র মেয়ে মনিকা!’
-‘তার মানে ওনারা সম্পর্কে বোন ছিলেন?’
-‘হ্যাঁ। তোমার মাকে দেয়া কথামতো আমিও জয়েন হয়ে তার বাড়িতে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যাই। কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপত্তি। চাচা তার ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়েকে ফেলে নীলিমাকে আমার হাতে তুলে দিবে না। হয় মনিকাকে বিয়ে করতে হবে নয়তো এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে। মূলত তাদের লোভ ছিলো আমাদের সম্পত্তির প্রতি। মনিকাও আমাদের এই সম্পর্ক সম্পর্কে অবগত ছিলো। এদিকে আমার মা মনিকাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলে। সেই সময়ে নীলিমা কলেজে ছিলো তাই মা আর নীলিমাকে দেখেনি। মা সেদিনই আমাদের জোর করে আকদ করিয়ে ফেলে। মনিকা চায়নি এমনটা হোক তাও…’
-‘তারপর?’
-‘তারপর আর কী? কিছুদিন পর মনিকা এবং আমার বিয়ে হয়ে যায়। এদিকে তোমার মা এই দুঃখ সইতে না পেরে কয়েকবার আত্মহত্যা করতে চাইছিলো কিন্তু তার আগেই সে বেঁচে যায়। দিনদিন তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিলো। আমি চেয়েও তার কাছে যেতে পারতাম না কারণ মা আমায় তখন কসম কাটিয়ে রেখেছিলো। এভাবে বছরের পর বছর কেটে যায়, মনিকার কোল আলো করে নেওয়াজ আসে। নেওয়াজ জম্মের এক বছরের মাথায় মা মারা যায়। এদিকে আমি ভেতরে ভেতরে তোপ্রে তোপ্রে মরেছি নীলিমাকে ছাড়া। নীলিমা ততদিনে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছিলো। সে এতোটাই পাগলামি করতো যে তারা ওকে বিয়ে দেয়ার সাহস পায়নি। বোনের এই হাল দেখে মনিকা নিজেও বিধ্বস্ত ছিলো। তাইতো সে কোনোদিক না দেখেই নীলিমার সাথে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করে। নীলিমাকে অনেক ভালোবাসতো মনিকা, অনেক। বলা চলে দুই বোন একে অপরের জন্য সবকিছু করতে পারতো। কয়েকবছর শ্বাশুড়ির জন্যে চুপ থাকলেও সে আর কিছু না করে থাকতে পারেনি। নীলিমাকে বিয়ে করার পর তাকে আমার অনেক সময় দিতে হয়েছে। দুই বছরের মাথায় গিয়ে সে স্বাভাবিক হয়। আবার বছর ঘুরতেই তুমি আসো। আমরা সবাই সুখেই ছিলাম। আবার এটা ভেবো না মনিকাকে আমি সময় দেইনি। তাকেও যথেষ্ট সময় দিয়েছিলাম। এভাবেই তুমি আস্তে ধীরে বড় হতে লাগলে, হাঁটতে শুরু করলে, আধো আধো বুলিতে কথা বলতে শিখলে। তখন আরেক সুখবর এলো যে নতুন অতিথি মানে নাফিসা আসছে। আমরা সকলে খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু নাফিসাকে জম্ম দিতে গিয়ে তোমার মা চিরতরে আমাদের থেকে হারিয়ে গেলো। সে যাওয়ার আগে মনিকার হাতে নাফিসা এবং তোমাকে তুলে দিয়ে গেছে। মনিকা বোনকে কথা দেয় তোমাকে আর নাফিসাকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবে।
নাফিসার দিক থেকে তার কথার খেলাফ না করলেও তোমার দিক দিয়ে একটু গোলমাল করে ফেললো। নীলিমা চলে যাওয়ার পরে তিনজনকে মনিকার একা সামলাতে হবে ভেবে তোমাকে আমি সবসময় নিজের কাছে রাখতাম, গল্প করতাম, পড়াতাম ইভেন তোমার জন্যই আমি বাসায় অফিসের কাজ করেছি। আর তুমিও ছিলে বাবা ভক্ত। কিন্তু মনিকার মতে নেওয়াজের থেকে তোমায় বেশি ভালোবাসি তাই নেওয়াজকে দূরে রাখতাম। নাফিসা তখনো অনেক ছোট। এজন্যই মনিকা তোমার প্রতি কিছুটা ক্ষিপ্ত। জানো বাবা, মনিকাকে দেখে মাঝেমধ্যে ভাবি মানুষ সময়ের ব্যবধানে কতোটা বদলে যায়। অথচ আমি তার কাজ কমানোর জন্যই নিজেও এক সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নেই। নেওয়াজ বেশিরভাগ সময় পড়াশোনা আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। আমার কাছে ওর যখন ইচ্ছা তখনই আসতো, আমিও আর জোর করে নিজের কাছে তাকে বসিয়ে রাখতাম না।’
নাশিদ চুপচাপ সবটা শুনলো। কোনোরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ না করেই নিজের ঘরে চলে গেলো। বাবা ডেথ সার্টিফিকেটার দিকে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ফেলে বললো,
-‘নীলিমা, তোমার ছেলেটা কতো বড় হয়েছে খেয়াল করো না? আজ তোমার সম্পর্কে সব সত্যি বলে দিয়েছি। এবার আমি একা নই, তোমার ছেলেও তোমাকে মনে করবে, মা বলে মনে মনে ডাকবে!’
নাশিদ এবার আকাশের অসংখ্য তারার মধ্যে বাচ্চাদের মতো সবচেয়ে বেশি ঝলমলে তারাটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেই ঝলমলে তারার মাঝেই হয়তো তার মাকে খুঁজে পাবে এবং অনেক অনেক অভিযোগ করবে!
~চলবে।