#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৭+৩৮
রুশার শাস্তি না হলেও রুশা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সারাদিন একা একা চুপচাপ বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না, ঠিক মতো খায় না এমনকি আর্দ্রের যত্নও নেয় না। আদ্রিশ এইজন্য রুশার উপর রেগে আছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। কথার কাছে সারাক্ষণ আর্দ্র থাকে।
রুশা বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে রেলিঙে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে৷ একটা দোয়েল পাখি বারবার রেলিঙের উপরে এসে বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে। মৃদুস্বরে শিষ বাজাচ্ছে। রুশা সেদিকে কান পেতে রেখেছে। আদ্রিশ ঘরে এসে রুশাকে না পেয়ে বারান্দায় এসে ওকে দেখল। আদ্রিশ বারান্দায় আসতেই দোয়েল পাখি উড়ে চলে গেল। আদ্রিশ কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কী সমস্যা তোমার রুশা? ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওকে ছুয়েও দেখছো না। খাওয়াচ্ছো না ঠিকমতো। কথার কাছে থাকে সারাক্ষণ। বাচ্চাটা কার? কথার না তোমার? ওর কীসের দায়? কিছুদিন পরে ওদের বিয়ে, ওর স্পেস প্রয়োজন। তাছাড়া বিয়ের পর নিজের লাইফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তখন আর্দ্রের কী হবে?”
রুশা আদ্রিশের কথায় কোন জবাব দিল না। যেভাবে ছিল সেভাবেই বসে আছে। ওর ভাবাবেগ না দেখে আদ্রিশের প্রচন্ড রাগ হলো। দরজায় সজোরে একটা লাথি মারল। রুশা কেঁপে উঠে। মাথা উঁচু করে আদ্রিশের দিকে তাকায়।
আদ্রিশ রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“কীসের শোক পালন করছো? একটা নিচ, খুনীকে মেরেছো। ও তোমার বড় ভাইয়ের খুনি। তার জন্য কীসের এত দরদ?”
রুশার চোখ ছলছল করছে। গলা ধরে আসছে। যেমনই হোক ছোট থেকে এক সাথে বিশ্বাস, ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে বড় হয়েছে।
আর সে ভাইদের নিয়ে নতুন রহস্য সামনে এসেছে। তার উপর নিজের হাতে নিজের ভাইকে মেরেছে৷ এসব ওর জন্য চারটে খানি কথা না। এখন মনে হচ্ছে নিজের হাতে না মেরে আইনের মাধ্যমে ওকে শাস্তি দিলে ভালো হত। নিজের হাত রক্তাক্ত হত না। আর মা সেই ঘটনা ওকে কুড়ে কুড়ে খেত।
“কী চাও আর? তোমার করা অন্যায়গুলো মাফ করেছি। তোমাকে ভালোবেসেছি। তোমার বড় ভাইয়ের খুনিকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছি। তাকে শাস্তি দিতে সাহায্য করেছি। সাজ্জাদ চৌধুরীর মৃত্যুর রহস্য সবার কাছে তুলে ধরেছি। তোমাকে জেল যাওয়ার থেকে বাঁচিয়েছি। এর জন্য আমাকে কত কী করতে হয়েছে তুমি জানো? কিভাবে কেস সাজিয়েছি আমি জানি। সব করেছি। আর কী করব? তোমার যেমন কেউ নেই তেমনি আমারও কেউ নেই। আমি দুঃখ করি না তবে তুমি কেন?”
রুশার গাল বেয়ে পানি পড়ল। চোখের পানি মুছে বলল,
“আমি চেষ্টা করছি স্বাভাবিক হতে কিন্তু পারছি না।”
আদ্রিশ চেঁচিয়ে বলল,
“হুয়াই ডেম ইট?”
রুশা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আদ্রিশ নিজেকে শান্ত করে ওর পাশে বসে ওকে বুকে টেনে নিল।
“আমি তোমার জন্য আছি। তুমি আমার জন্য আছো। তোমার দুঃখ কষ্ট সবকিছু আমার। তোমার আমার দুজনের একটা পরিবার আছে। আমাদের ফুটফুটে একটা ছেলে আছে। ওর কথা ভেবে আমাদের স্বাভাবিক হতে হবে। তুমি ওর মা। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে। ওর ভবিষ্যতের কথা ভাবো। ওর আমরা ছাড়া আর কে আছে?”
আদ্রিশ রুশার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
“হ্যা, আমাকে পারতে হবে। আর্দ্রকে মানুষের মতো মানুষ করব। কোন কিছুর অভাব বুঝতে দেব না। ওর সব চাওয়া পূরণ করব।”
আদ্রিশ রুশার মাথায় ঠোঁট ছুয়ালো। আদ্রিশ ভেবে পায় না ও এত বদলে গেল কি করে। আগে হলে এতক্ষণে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিত। আর এখন নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে শিখে গেছে৷ নরম গলায় বুঝিয়ে কথা বলে। রুশার অদ্ভুত ব্যবহারগুলো সহ্য করতে পারছে। হয়তো ভালোবাসা ওকে এত বদলে দিয়েছে। হয়তো সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছে। স্ত্রী সন্তানের কথা ভেবে সংসারে শান্তি বজায় রাখা জরুরি সেটা বুঝে গেছে। আদ্রিশ মুচকি হাসল।
.
আজকে কথার গায়ে হলুদ। রুশা শপিংয়ের কথা বলে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য রকির সাথে দেখা করা। রুশা সরাসরি ওর অফিসে চলে যায়৷ রকি একটা মিটিংয়ে ছিল। রুশার আসার কথা শুনে মিটিং রেখে ওর সাথে মিট করতে চলে এসেছে। রুশাকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
“আরে তুমি! কী মনে করে?”
রুশা ওর হাসিকে পাত্তা না দিয়ে কাঠ গলায় বলল,
“খবর পেয়েছো নিশ্চয়ই?”
“পাব না আবার? এত বড় ঘটনা ঘটিয়েছে আর কিছুই জানব না?”
“তুমি সব জানতে তাই না? শান ভাইয়ার সাথে তুমিও যুক্ত ছিলে তাই না?”
রকি কপাল কুঁচকে বলল,
“পাগল তুমি? শান আমাকে কেন বলবে? আর আমি ওর সাথে কেন থাকব? একদম শেষ সময়ে আমি জেনেছি তবে পুরোপুরি নয়। সাজ্জাদ চৌধুরী আমাকে তোমার জন্য পছন্দ করেছিল। তোমার দেশে আসার নিউজ শুনে শানের সাথে কথা বলতে গেলে জানায় আদ্রিশ সাজ্জাদ চৌধুরীকে খুন করেছে। আর তুমি তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছো। তুমি প্রতিশোধ না নিয়ে বিয়ে করবে না। তাই তোমাকে যদি বিয়ে করতে চাই তাহলে তোমাকে যেন তোমার কাজ শেষ করতে সাহায্য করি। যত দ্রুত কাজ শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়ে হবে। তাই সাহায্য করেছি। নয়তো কেউ জেনেশুনে নিজের হবু বউকে অন্যের লাইফে পাঠায়। তাকে বিয়ে করতেও সাহায্য করে? পাগল নাকি?”
“তুমি কখন জেনেছো সত্যিটা?”
“শপিংমলে দেখা হওয়ার কয়েকদিন আগে।”
রুশার কপাল কুঁচকে এল। ইচ্ছে করছে ওকে এখানেই গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিতে কিন্তু অফিসের মধ্যে এত মানুষের মধ্যে খুন করলে সমস্যা হয়ে যাবে। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।”
রুশা চোখ বন্ধ করে দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। রকি ওকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“হঠাৎ আমার কাছে আসার কারণ জানতে পারি?”
রুশা চোখ খুলে ওর দিকে তাকাল। লাল টকটকে চোখে ওর দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে যাবে তখন একটা মেয়ে এল। রকি মেয়েটিকে দেখে আহ্লাদী হয়ে পড়ে। তার দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে হাগ করে। রুশা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রকি রুশার দিকে চেয়ে বলল,
“পরিচয় করিয়ে দেই। আমার ওয়াইফ অন্তরা।”
রুশা রকির কথা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে।
“কতদিন হয়েছে বিয়ের?”
“এক মাস হয়নি।”
রুশা মেয়েটির দিকে আরেকবার চেয়ে মনে মনে বলল,
“এই মেয়েটার জন্য বেঁচে গেলি। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়েকে বিধবা করতে চাই না।”
রুশা অন্তরার সাথে টুকটাক কথা বলে বিদায় নিল। রকির চ্যাপ্টার এখানেই শেষ করে দিল। নিজের রিভলবারটা নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। ফেরার পথে সাজ্জাদের কবরে গিয়ে দোয়া করে বাড়িতে ফিরেছে।
পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। আলোয় ঝলমল করছে। রুশা কথার রুমে গিয়ে উঁকি দিল। ও সাজগোজের জন্য ব্যস্ত। রুশা ওর ঘরে আর গেল না। আর্দ্রকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে উপরে চলে গেল। আদ্রিশ কোন পাঞ্জাবি পরবে সেটা দেখছে৷ রুশা আর্দ্রকে দোলনায় শুইয়ে দিল। ও খেলছে একা একা। রুশা মেরুন রঙের একটা পাঞ্জাবি আদ্রিশের দিকে দিয়ে বলল,
“এটা পর। যেমন করছো মনে হচ্ছে তোমার বিয়ে।”
আদ্রিশ নিজেকে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল,
“আরেকটা বিয়ে করা যায়। কি বলো?”
রুশা চোখ ছোট ছোট করে আদ্রিশের দিকে তাকাল। আদ্রিশ হেসে ফেলল। ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
রুশা বাসন্তি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। গা ভর্তি গয়না, দুহাতে কাচের চুড়ি, চুলে বিনুনি করে ছোট ছোট অর্কিড ফুল গুজে দিয়েছে। হলুদের উপযোগী মেক আপ। আদ্রিশ আর্দ্রকে তৈরি করে দিয়েছে। রুশা আদ্রিশের সামনে এসে বলল,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
আদ্রিশ আর্দ্রকে রেখে ওর দিকে ঘোরলাগা চোখে তাকাল। রুশা ওর চাহুনি দেখে ঢোক গিলল। এই ছেলে কোন পাগলামি করে না ওর মেক আপ নষ্ট করে দেয়৷ রুশা ওর সামনে থেকে সরে যেতে নিলে আদ্রিশ ওর হাত ধরে ফেলে।
রুশা চোখ মুখ খিঁচে বলল,
“আমার মেক আপ নষ্ট করবে না।”
আদ্রিশ ঘনঘন পলক ফেলে বলল,
“আমি মেক আপ কেন নষ্ট করব? আমি তো তোমাকে দেখছি।”
“তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আমার হাত ছাড়ো।”
আদ্রিশ রুশাকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,
“শুধু শুধু অপবাদ দিচ্ছো আমায় তাই না? তাহলে সত্যি করে দেই।”
রুশা চোখ বড়বড় করে না করল। আদ্রিশ ওর ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করল। রুশা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল। আদ্রিশ মিটমিট করে হাসছে। রুশা নিজের হাই হিল দিয়ে ওর পায়ে জোরে আঘাত করল। আদ্রিশ ব্যথা পেয়ে “আহ” শব্দ করে ওকে ছেড়ে দেয়। রুশা মুখ ভেংচি কেটে আয়নার সামনে গিয়ে লিপস্টিক ঠিক করে আবারও আদ্রিশকে মুখ ভেংচি কাটল। আদ্রিশ হেসেই যাচ্ছে। রুশা নিচে চলে গেল রাগে গজগজ করতে করতে।
কথা আর সেজানকে স্টেজে আনা হয়েছে। ওরা পাশাপাশি বসে আছে। এক সাথেই ওদের হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেজান সুযোগ বুঝে বারবার কথাকে ইরিটেট করছে। কথা কিছুক্ষণ পর পর বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছে আর সেজান হাসছে। সেজানের হাসি দেখে কথাও হেসে ফেলল।
রুশা ওকে হাসতে দেখে গলা ঝেরে বলল,
“কী ব্যাপার কথা? হাসছিস কেন? ব্যাপার কী হা?”
“কিছু না আপু।”
“সবই বুঝি। সেজান ভাইয়া সবার আড়ালে রোমান্স করছে বুঝি?”
সেজান খুকখুক করে কাশতে লাগল।
“কি জামাই মিয়ার যক্ষা নাকি? যক্ষা রোগীর কাছে বোন বিয়ে দেব না।”
কথা রুশার কথা শুনে বলল,
“একদম। আমিও যক্ষা রোগীকে বিয়ে করব না।”
সেজান বলল,
“কী বললে? আমি যক্ষা রোগী হলে এই যক্ষা রোগীকেই বিয়ে করে যক্ষায় যক্ষিত হতে হবে।”
কথা আর রুশা দুজনেই হেসে ফেলল ওর কথা শুনে। রুশা তারপর কথার মাথায় হাত রেখে বলল,
“দোয়া করি সব সময় ভালো থাকো। জীবনে অনেক সুখী হও। সেজান ভাইয়া আমার বোনটাকে দেখে রাখবেন। কখনও চোখের পানি ফেলতে দিবেন না।”
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওকে অনেক ভালো রাখব। কোন অভিযোগ করতে দেব না।”
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে, ফ্রেশ হতে হতে রাত তিনটা বেজে গেছে। আর্দ্র আর আদ্রিশ ঘুমিয়ে পড়েছে। রুশা ফ্রেশ হয়ে মাত্র বের হলো। ওর অনেক ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিল। গা এলিয়ে দিতেই আদ্রিশ শোয়া থেকে উঠে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল। রুশা কিছু বোঝার আগেই আদ্রিশ ওর ঠোঁট নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। রুশা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরবর্তীতে আদ্রিশের ডাকে সাড়া দিল। দীর্ঘদিন পরে ভালোবাসার আরেকটা রাত পেল দুজন।
.
সকাল থেকেই তোরজোর আয়োজন চলছে। রুশা আজ শাড়ি পরেছে,আদ্রিশ স্যুট। কথা সিলভার রঙের ভারী লেহেঙ্গা পরেছে। লেহেঙ্গার গায়ে সাদা রঙের দামী পাথরের কাজ। সেজান ওর সাথে ম্যাচিং করে সেরোয়ানী পরেছে। ধুমধাম করে কথা আর সেজানের চারহাত এক করে দিল আদ্রিশ। সবাই প্রাণভরে দোয়া করল ওদের সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য।
চলবে….
#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন
৩৮(শেষ)
রুশা সোফার উপরে ফেলে রাখা আদ্রিশের জামাকাপড় ভাজ করছে। আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকেছে। ও শাওয়ার নিচ্ছে। রুশা বিরক্তি নিয়ে জামাকাপড় জায়গা মতো রাখছে। হঠাৎ শার্টের হাতার দিকে চোখ আঁটকে যায়। রুশা শার্টটা কুঁচকে
হাতে নিয়ে বড় করে শ্বাস নিল। কপাল থেকে ঘাম মুছল। একটা অস্থিরতা ওকে ঘিরে রেখেছে। আবারও শুরু হয়েছে নতুন লড়াই। রুশা এ লড়াইটাও লড়বে এবং জিতবে। নিজের জন্য না হলেও ছেলের জন্য লড়বে।
ওর সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য লড়বে।
আদ্রিশ তোয়ালে পেঁচিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হলো। রুশা ওর দিকে অস্থিরতা নিয়ে চেয়ে আছে। আদ্রিশ চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যাওয়ার জন্য কয়েক পা বাড়ালেই রুশার দিকে চোখ পড়ল। রুশার দৃষ্টিতে প্রশ্ন, ভয়, অস্থিরতা।
আদ্রিশ রুশার কাছে গিয়ে বলল,
“কী হয়েছে? এভাবে চেয়ে কী দেখছো? কোন সমস্যা?”
রুশা হাতের শার্টটা আদ্রিশের চোখের সামনে মেলে ধরল। সাদা শার্টে ছিপছিপ রক্তের দাগ।আদ্রিশ সেদিকে একবার চেয়ে রুশার দিকে তাকাল। রুশা এতটা অবাক হচ্ছে কেন সেটা বুঝতে পারছে না। এ তো নতুন কিছু না। আদ্রিশ কোন ভাবাবেগ প্রকাশ না করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রুশা শার্টটা ছুড়ে ফেলে আদ্রিশের সামনে গিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাচ্ছো কেন? আর তোমার শার্টে রক্ত কেন?”
আদ্রিশ মুচকি হেসে রুশার দুবাহু ধরে বলল,
“তুমি এমন ভাব করছো যেন আমার সাথে রক্তের দাগের কোন সম্পর্ক নেই। এমন অনেক দাগ আগেও দেখেছো।”
“হ্যা দেখেছি কিন্তু আগে বিষয়টি অন্যরকম ছিল। আমি ভেবেছিলাম তুমি শুধরে গেছো। ভালো হয়ে গেছো। খুন খারাবি ছেড়ে দিয়েছো। কিন্তু না.. তোমার শার্টে রক্তের দাগ।”
“রুশা, আমি যেমন ছিলাম তেমন থাকব। এই লোকটা আমার সাথে চিট করেছে। আর তুমি জানো চিট করার শাস্তি কী।”
রুশা আকুতি নিয়ে বলল,
“আদ্রিশ প্লিজ, এসব ছেড়ে দেও। স্বাভাবিক জীবনযাপন করো। কিছুদিন আগে তুমিই তো আমাকে বোঝাচ্ছিলে সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে আর্দ্রের জন্য। আর্দ্র কি এই রক্ত, রিভলবার, খুন, উদ্ধততা, বিভৎসতার, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতার সাথে বড় হবে? এমন অস্বাভাবিক জীবন যাপন করবে? ওর কথা ভাবো। ওর কথা ভেবে আমি আমার রিভলবার ফেলে দিয়েছি আর প্রতিজ্ঞা করেছি আর্দ্রকে এসবের সংস্পর্শে আনব না। ও জানবে না ওর বাবা আর মায়ের অতীত। আদ্রিশ প্লিজ, আমার জন্য না হোক, আর্দ্রের জন্য। ওকে তো তুমি খুব ভালোবাসো।”
“দেখো, রুশা ভালো আমি তোমাদের দু’জনকেই বাসি। তোমাদের জন্য সব বাজি রাখতে পারি কিন্তু এই কাজটা আমার পক্ষে ছাড়া সম্ভব না। আর্দ্র এসব কখনো জানবে না, আমি জানতে দেব না। ও আর দশটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিকভাবেই বড় হবে। কেউ ওর দিকে আঙুল তুলবে না। ওর বাবাকে সবাই যেমন সম্মানের চোখে দেখে তেমনি ওকেও দেখবে।”
“আদ্রিশ, সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন সত্য তার নিজ গুনেই প্রকাশিত হবে। তোমাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসে বড় হওয়ার পর যখন ওর সামনে সত্যটা আসবে, নিজেকে সামলাতে পারবে? তোমাকে ঘৃণা করবে না? তোমার, আমার প্রতি ওর বিশ্বাস, ভরসা থাকবে? ভেঙে পড়বে না? যেমন শান ভাইয়ার সত্যিটা জানার পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম, আঘাত পেয়েছিলাম, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আদ্রিশ একটু ভেবে দেখো।”
“রুশা, আমি বুঝতে পারছি। আগে না পারলেও এখন আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। কিন্তু আমার জন্য এত সহজ হবে না। প্রতারক, লোভী, চরিত্রহীন মানুষ দেখলে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।”
আদ্রিশ অস্থির হয়ে পড়ছে। বিছানায় বসে পড়ল। চাদর খাঁমচে ধরে মেঝের দিকে চেয়ে রইল।
রুশা ওর পাশে বসে ওর বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আমি আছি তো, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে শুধু….
আদ্রিশ রুশাকে থেমে যেতে দেখে চোখ তুলে ওর দিকে চেয়ে কৌতূহল নিয়ে বলল,
” আমাকে কী?”
রুশা চোখ নামিয়ে নিল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“আদ্রিশ, আমি তোমার ছোটবেলার রিপোর্ট দেখেছি। তুমি সুস্থ, স্বাভাবিক নও। তাই সাইকোর মতো বিহেভিয়ার করো। তোমাকে ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্টের…. ”
আদ্রিশ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“ইউ মিন আ’ম ম্যাড?”
রুশাও বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ওকে মানানোর জন্য বলল,
“তুমি এডুকেটেড ছেলে। সাইকিয়াট্রিস্ট কেন প্রয়োজন হয় তুমি ভালো করেই জানো। পাগল শব্দটা ব্যবহার না করলেই পারো। মানুষ যেমন শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয় তেমনি মানসিক ভাবেও অসুস্থ হয়। কিছুদিন আগে আমিও হয়েছিলাম। ট্রিটমেন্ট করেছি। হ্যা কারো কম সমস্যা হয়, কারো বেশি। আমার কথাগুলো ভেবে দেখো। এখন চেঞ্জ করে নেও। আমি আর্দ্রের কাছে যাচ্ছি।”
রুশা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আদ্রিশ পলকহীনভাবে কিছু ভেবে চলেছে।
রুশা আর্দ্রকে কোলে নিয়ে আদর করছে আর কথা বলছে৷
“আমার সোনা বাবাটা, বড় হয়ে কী হবে তুমি?”
মিজান চাচা বলল,
“বাবার মতো বড় ব্যবসায়ী হবে। পুরো দুনিয়ায় ওর নাম ডাক থাকবে।”
“না চাচা, ও আগে মানুষের মতো মানুষ হবে। বড় ব্যবসায়ীর চেয়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়াটা জরুরি। আর ও কারো মতো হবে না। ও ওর মতো হবে। আর্দ্রকে আমি প্রকৃত মানুষ করতে চাই। সবাই যেন ওকে দেখে বলে ছেলেটা এক পিচ।”
‘হ্যা, তা তো অবশ্যই। অনেক দোয়া করি। মানুষ হও।”
“হ্যা চাচা, দোয়া করবেন ওর জন্য। বড়দের দোয়াও প্রয়োজন। দোয়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।”
“তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে? আদ্রিশ, তুমি আর আর্দ্র ভাই তোমরাই আমার পরিবার। তোমাদের জন্য সব সময় দোয়া করি।”
আদ্রিশ চেঞ্জ করে নিচে নেমে ওদের কথা শুনে ওদের দিকে এগিয়ে এল। আর্দ্রকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেল।
.
ডিনার শেষে আদ্রিশ শুয়ে শুয়ে কিছু ভাবছে আর আর্দ্রের দিকে তাকাচ্ছে। রুশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। আদ্রিশ কী ভাবছে তা ওর অজানা নয়। রুশা শুধু মনে মনে বলছে আদ্রিশের সুবুদ্ধি হলেই হয়। রুশা ওর সাথে এ নিয়ে আর কথা বলতে চায় না। ও চায় আদ্রিশ নিজেকে সময় দিক, নিজেই সিদ্ধান্ত নিক। তাই কিছু না বলে মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল। আদ্রিশের সারারাত ঘুম হয়নি। এটা সেটা অনেক কিছু ভেবেছে। সকাল বেলায় নাস্তা করে বের হওয়ার সময় রুশাকে বলল,
“আমি রাজি। বেষ্ট সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। অফিস শেষে পাঁচটায় যাব। তুমি রেডি থেকো।”
রুশা ওর কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে পড়ল। খুশিতে গদগদ করতে করতে স্থান,কাল ভুলে ওর গালে চুমু খেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ! আমার কী যে খুশি লাগছে। আমি জানতান তুমি রাজি হবে। আমার বিশ্বাস ছিল তোমার উপর।”
আদ্রিশ ওকে ছাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“রেডি থেকো।”
আদ্রিশ রেগুলার ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে। আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। অনেক পরিবর্তন এসেছে ওর মধ্যে। এখন সব সময় হাসিখুশি থাকে। অযথা রাগারাগি করে না। রুশা খুব খুশি।
শীত যাই যাই করছে। সকালের কাঁচা রোদে বাগানে পিকনিকের আয়োজন করেছে। কথা, সেজান আর আশ্রমের কিছু বাচ্চারা এসেছে। আর্দ্র সেজানের কোলে। রুশা আর কথা হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে। আদ্রিশ এখনো আসেনি। বাচ্চাদের এই পিকনিক পিকনিক খেলায় ওর আসার ইচ্ছে নেই। অফিসের কাজ করছে। রুশা আদ্রিশের নাম্বারে বারবার মেসেজ করছে। কিন্তু আদ্রিশ তবুও আসছে না। রুশা ওদের রুমের বারান্দার দিকে তাকাল। তারপর একটা মেসেজ লিখল।
“তুমি যদি না আসো তবে আমি বাইরে থেকে হাসব্যান্ড ভাড়া করে আনব। আই মিন ইট। দশ মিনিটের মধ্যে নিচে আসবে।”
রুশা পকেটে মোবাইল রেখে আবারও বারান্দার দিকে তাকাল। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দিল। আদ্রিশ রুশার মেসেজ দেখে হেসেই যাচ্ছে। রুশা বদলালো না। কথায় কথায় হুমকি দেয়। এখন হাসব্যান্ড ভাড়া করে আনার হুমকি দিচ্ছে। আবার বলছে দশ মিনিটের মধ্যে যেতে। আদ্রিশ ডান হাতের আঙুল দিয়ে চুলে আলতো ব্রাশ করতে করতে ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়াল। তখনও ওর মুখে হাসি। এখন যদি নিচে না যায় তবে রুশা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে।
রুশা আর কথা টেবিলের উপরে খাবার সাজিয়ে রাখছে। রুশা বারবার মেইন ডোরের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু আদ্রিশের খবর নেই। রুশা সেজানের কোল থেকে আর্দ্রকে নিয়ে চেয়ার টেনে বসল। ওর মেজাজ উনপঞ্চাশ হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরেই আদ্রিশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ওর মুখে হাসি। রুশা আদ্রিশকে আসতে দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলো কিন্তু প্রকাশ করতে চাইছে না। কিন্তু ওর খুশি মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আদ্রিশ রুশার সামনে এসে বাকা হেসে ওর দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই রুশাও হেসে ফেলল। আদ্রিশ, আর্দ্রকে কোলে নিয়ে আবারও চুমু খেল।
সেজান বাচ্চাদের নিয়ে এল। ওরা সবাই এক সাথে বসে পিকনিক নামক সকালের নাস্তা করছে। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, মিষ্টি রোদ বাড়ছে। ঝলমলে রোদ্দুর্র চিরে সুখ উপচে পড়ছে। লাভ গেমের দুটো গুটি দুই পক্ষের হয়ে খেললেও এক সময় তারা একে অপরের সুতোয় বাঁধা পড়ে এক হয়ে গেছে।
~সমাপ্ত~