হাতটা রেখো বাড়িয়ে -Part 36+37(The End)

0
374

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৬+37
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
প্রায় দুই তিন ঘন্টা পর ধারার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে হাসপাতালের সিলিং চোখে পড়তেই প্রথমে ঠাওর করতে পারে না সে আসলে কোথায়? সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তার উপর বেশ কয়েক জায়গায় আঘাতের যন্ত্রণা। তবুও দীর্ঘ এক ঘুমের ফলে এখন শরীর একটু ভালো। সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে পাশে নিতেই হাসপাতালের বেডের স্ট্যান্ডে ঝুলে থাকা এক পরিত্যক্ত স্যালাইনের নল দেখেই ধারার পূর্বের সকল কথা মনে পড়ে যায়। ক্ষণবিলম্ব না করেই সে গায়ের থেকে সাদা চাদর সরিয়ে অস্ফুট স্বরে শুদ্ধ বলে ডেকে উঠে দ্রুত বেগে শুদ্ধ’র কেবিনে যায়। একটা ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় দরজাটা খুলতেই শুদ্ধ’র দু চোখ আস্তে করে ধারার দিকে যায়। ধারা যেন হঠাৎ থমকে যায়। এতক্ষণের ঘূর্ণিপাকের মতো উদ্বেলিত হওয়া তার সমস্ত অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ যেন এক নিমিষেই বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক যেমন প্রকৃতির এক ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পরে সমুদ্র যেভাবে শান্ত হয়। মিনিট খানেকের মতো ধারা কিছু বলতে পারে না। নড়তেও পারে না। শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে তার প্রাণের সঞ্চার, প্রশান্তির আধার, জীবনের স্বস্তিদায়ক সেই দৃষ্টিযুগলের দিকে। পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই থমকে যায় তার কাছে। আর অন্য কিছু তার দৃষ্টিতে আসে না। আসে শুধু একটা দরজা, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা তার ভালোবাসা আর তাদের মধ্যকার ক্ষুদ্র দূরত্ব। ধারা অপলক তাকিয়ে থেকে বশীকরণের মতো আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ধারাকে দেখে শুদ্ধ তার বা হাতের কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলগুলো বিছানা থেকে আস্তে আস্তে তোলার চেষ্টা করে। শুদ্ধ’র বেডের কাছে এসে নিজের হাতটা আস্তে আস্তে শুদ্ধ’র আলতো উঁচু করে দেওয়া হাতের নিচে রেখে আঁকড়ে ধরে ধারা। তারপরই হঠাৎ মেঝেতে বসে পড়ে। শুদ্ধ’র আঁকড়ে ধরা হাতটায় একটা চুমু দিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে কেঁদে উঠে ধারা। মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরা স্বামীর হাত ধরে তার শব্দহীন কান্না সেখানে উপস্থিত সকলের মন ছুঁয়ে দেয়। অন ডিউটিতে থাকা হেড ডক্টর চশমা খুলে নিজের চোখ মুছে। নার্সেরাও আবেগ্লাপুত হয়। কখন যেন অজান্তেই মনে প্রাণে তারাও চাইছিলো মেয়েটি তার স্বামী ফিরে পাক। এখন যখন তা পূর্ণ হলো তখন মেয়েটির সাথে সাথে তারাও একধরনের প্রশান্তি খুঁজে পায়৷ মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচানো শুদ্ধ ধারাকে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে কাঁদার। তার অবস্থা এখন একটু ভালো। আউট অফ ডেঞ্জার। সেই ঘন্টাখানেক আগে যখন তার জ্ঞান ফিরেছিলো তখন থেকেই ধারাকে খুঁজে চলছিলো সে৷ এখন যখন সেই কাঙ্খিত মুহুর্তটি এলো তখন ধারার সাথে সেও খানিক আবেগ্লাপুত হয়ে পড়লো। শুদ্ধ’র বারণ শুনে ধারা ঝটপট চোখের পানি মুছে মুখে হাসি টেনে উঠে দাঁড়ালো। তার শুদ্ধ বেঁচে ফিরেছে। সে আর কাঁদবে কেন? শুদ্ধ শোওয়া থেকে বসার চেষ্টা করলো। কষ্ট হলো, পারলো না। ডাক্তার নিষেধ করলো। কিন্তু শুদ্ধ শুনলো না। খোদেজা শুদ্ধকে ধরে পেছনে বালিশ দিয়ে বসার জন্য সাহায্য করতে চাইলো। হঠাৎ শুদ্ধ কেমন আতঙ্কগ্রস্ত স্বরে বলে উঠলো,
‘একি! আমি আমার পা নাড়াতে পারছি না কেন?’
একরাশ বিস্ময় নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালো ধারা। ডাক্তার কেমন যেন ইতস্তত করে সঙ্গে সঙ্গেই ফিচেল হেসে উঠে বলল,
‘আরে ও তেমন কিছু না। ছোটখাটো মাইনর ইনজুরি। তোমার এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে! এখনই তো তুমি হাঁটতে পারবে না। হাত পা নাড়াতে একটু তো সমস্যা হবেই। তুমি টেনশন নিয়ো না। কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
ডাক্তারের কথায় শুদ্ধ খানিক আশ্বস্ত হলো। আশ্বস্ত হলো ধারাও। কিন্তু এরপরই ডাক্তার তাকে একা ডেকে যা বলল তা পুরোই স্তম্ভিত করে রেখে দিলো তাকে।
__________________________________________
হাসপাতালে পনেরো দিন কাটানোর পর শুদ্ধ বাড়িতে ফিরে আসলো, হুইল চেয়ারে। ধারা হুইলচেয়ারে শুদ্ধকে টেনে রুমে নিয়ে এলো। হাত দিয়ে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। শুদ্ধ কিছুই বললো না। কেমন যেন বিষন্ন হয়ে রইলো। ধারা মুখে হাসি টেনে বলল,
‘খাবে কিছু? তোমার জন্য স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি?’
শুদ্ধ আস্তে করে মাথা নেড়ে না করলো। ধারার মধ্যে মন খারাপের ছায়া নেমে আসতে চাইলেও সে তাতে গা করলো না। আবারও হাসি টেনে রুমের পর্দাগুলো আরেকটু সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আজকে আবহাওয়া খুব সুন্দর তাই না! দেখো, আকাশটা কতো সুন্দর লাগছে।’
শুদ্ধ আস্তে করে বলল, ‘আমি হাঁটতে পারবো কবে ধারা?’
ধারার হাত থেমে গেলো। নিজেকে সামলিয়ে ধারা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, ‘কটা দিন একটু রেস্ট নিতেই হাঁপিয়ে উঠছো! তুমিও না! আমি তোমার জন্য জুস নিয়ে আসছি।’
ধারা দ্রুত সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো। আস্তে করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুদ্ধ। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে ধারা দরজা মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার মুখে মেঘের ছায়া নেমে আসলো। ধারার মনে পড়ে গেলো সেদিন ডাক্তার তাকে নিজের চেম্বারে ডেকে কি বলেছিল,
‘শুদ্ধ’র পা নাড়াতে না পারা কোন মাইনর ইনজুরির কারণে না। শুদ্ধ সামনে ছিল বলে তখন মিথ্যা বলতে হয়েছে। এক্সিডেন্টের কারণে ও’র মস্তিষ্কে আঘাতের ফলে মস্তিষ্ক থেকে নার্ভে সংকেত প্রেরণে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ও’র দুই পায়ের নিচের অংশ সম্ভবত প্যারালাইজড হয়ে গেছে৷ তবে এটা চিরস্থায়ী নাকি সাময়িক সেটা ও’র রিপোর্ট দেখে এখনই বলা যাচ্ছে না। যদি সাময়িক সময়ের জন্যও হয়ে থাকে তবুও সেটা ঠিক হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। যার ফলে শুদ্ধ হাঁটতে পারবে না। সময় লাগবে। চিকিৎসা নিতে হবে। ভেঙে পড়া যাবে না। কিন্তু এই সময় টায় বেশিরভাগ পেশেন্টই ভেঙে পড়ে। প্যারালাইসিসের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটে। তারা হাঁটতে পারে না। যার ফলে পেশেন্ট মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে কিনা সেটা আগের থেকেই গ্যারান্টি দিয়ে বলা সম্ভব না তাই তারা খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেবেই নেয় যে তারা আর কোনদিন হাঁটতে পারবে না। জীবনের প্রতি বিস্বাদ ভাব এসে পড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এবং অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যায়। তাই এই সময় পেশেন্টকে অবশ্যই প্রচুর মানসিক সাপোর্ট আর যত্নে রাখতে হয়। হাল না ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। এর উপর ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থাও আছে। আমরা ভালো কিছুর আশা রাখতে পারি৷ কিন্তু তার আগে পেশেন্টের নিজের মনোবল থাকা অনেক প্রয়োজন। তার নিজের চেষ্টা আর মনের জোরই তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। মানসিক শক্তি ছাড়া এই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠা বেশ কঠিন।
পেশেন্ট যদি হাল ছেড়ে দেয় তবে এই কেসে ট্রিটমেন্টও আর কোন কাজে আসে না।’
ডাক্তারের কথা মনে করে ধারা আরেকবার পেছনে ফিরে শুদ্ধ’র দিকে তাকায়। দেখে শুদ্ধ নিরব হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ধারার বুক চিড়েও একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
একে একে শুদ্ধ’র দিনগুলো হুইলচেয়ারেই কাটতে থাকে। কাজের চাপে আটকে থাকা শুদ্ধ’র এখন অবসরের অবকাশ নেই। সারাটা দিন বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। আর কিই বা সে করবে! সামান্য হুইলচেয়ারে বসতে হলেও তার অন্যের সাহায্য লাগে। এমনকি এখান থেকে ওখানে যেতে হলেও ডাকতে হয় অন্যদের। সাহায্য নিতে হয় হুইলচেয়ারের। পা দুটো তো প্রায় অচল। সবকিছু হুট করেই কেমন যেন পাল্টে যায়। নিজের পায়ে হাঁটতে না পারায় সে না ফ্যাক্টরিতে যেতে পারে আর না তার ফলের খামারে। সব কাজে শ্লথ তৈরি হয়। হতে থাকে ক্ষতি। এই তো সবেই পরিপূর্ণ সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। একের পর এক সুযোগ এসে ধরা দিচ্ছিল তাকে। যা সে যথাযথ কাজেও লাগাচ্ছিল। কিন্তু এই উঠতি সাফল্যের মাঝেই হঠাৎ এই দূর্ঘটনা নেমে এসে জীবনটাকে যেন নিচের দিকে টেনে ধরলো। সবকিছু থেমে গেলো। শুদ্ধ’র কিছু করার থাকে না। শুধু সারাক্ষণ বিষন্ন মনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। কখনো কখনো হুইলচেয়ার টেনে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে এখন আর সেই নজরকাড়া টোল পড়া হাসি দেখা যায় না। আগের মতো তার মুখে আর সেই দুষ্টুমির ঝিলিক খেলা করে না। সবকিছুই নিরব, নির্লিপ্ত। শুদ্ধকে এই অবস্থায় দেখে সবথেকে বেশি যন্ত্রণায় ভোগে ধারা। যেই শুদ্ধ সবসময় নিজের কাজে মশগুল থাকতো, সবসময় কিছু না কিছু নতুন করার চেষ্টায় থাকতো আজ সেই উদ্যমি, পরিশ্রমী শুদ্ধ উদাস হয়ে বসে আছে হুইলচেয়ারে। যার মুখের প্রতিটি শব্দই এক আকাশ অনুপ্রেরণা বহন করতো আজ সেই হয়ে আছে হতাশায় বিবর্জিত। এই দৃশ্য ধারার জন্য যে ঠিক কতোটা অসহনীয় তা শুধু উপরওয়ালাই জানেন। তবুও সে নিজেকে সামলে সবকিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আগের মতো সবকিছু আর তেমন সহজ হয় না। আর না আগের মতো থাকে তাদের সম্পর্ক। শুদ্ধ’র মেজজ আজকাল কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছে। হয় বেশি কথাই বলে না, মনমরা হয়ে থাকে। নয়তো অল্পতেই রেগে যায়। পায়ের ব্যায়ামও করতে চায় না। চেষ্টা ছেড়ে দেয়। নিজেকে অন্যের উপর বোঝা মনে করে। কষ্ট পায়। মন খারাপ করে। জীবনটাই যেন বিস্বাদ বোধ হয় তার।
__________________________________________
অন্যদিনের মতোই সকালের পরে জানালার কাছে হুইলচেয়ারে বসে ছিল শুদ্ধ। দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টিতে কোন আশা নেই, স্বপ্ন নেই। আছে শুধু হতাশা। ধারা দরজা ঠেলে সেই সময় ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে কারো প্রবেশের শব্দে শুদ্ধ খানিক হকচকিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। ধারা এসে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে একবার মিষ্টি করে হেসে বিছানার উপর পরে থাকা শুদ্ধ’র কাপড় চোপড় গোছাতে থাকে। বালিশের দিকে চোখ যেতেই হঠাৎ ধারার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে। রাতের অন্ধকারে দৃষ্টি আড়াল করে শুদ্ধ কিভাবে তাকে বলেছিল, তার মতো অচলকে ছেড়ে দিয়ে ধারাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে। শুধু কি গতকালই! এর আগেও তো শুদ্ধ কতবার কতো ভাবে ধারাকে এই কথাগুলো বলেছে। প্রতিবারের মতোই ধারা বিরক্ত হয়েছে। কখনো কখনো এড়িয়ে গেছে। ধারার ভাবনায় ছেদ ঘটে বাইরে থেকে ভেসে আসা আওয়াজে। শুদ্ধ জানালা দিয়ে সেদিকটায় তাকিয়ে বলে,
‘এমন শব্দ কিসের?’
ধারা স্মিত হেসে বলল, ‘আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশে বাচ্চাদের খেলার ছোটখাট একটা পার্ক তৈরি হচ্ছে। বিকেলে তোমাকে নিয়ে সেখানে যাবো কেমন? ঘুরে দেখো ভালো লাগবে।’
‘আমি গিয়ে কি করবো? হাঁটতে তো আর পারবো না!’
ধারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কি বলবে খুঁজে পায় না। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য কিছু বলতে শুদ্ধ’র দিকে তাকাতেই দেখে শুদ্ধ হুইল ঘুরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ধারা জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
শুদ্ধ বলল, ‘গরম লাগছে। গোসল করবো।’
‘আচ্ছা আমি এই কাপড়গুলো ভাঁজ করেই তোমাকে করিয়ে দিচ্ছি।’
শুদ্ধ বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ‘আমি পারবো।’
আস্তে করে পেছনে ঘুরে গেলো ধারা। চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ যতোটা সে জানে ততোটা শুদ্ধও জানে সে একা পারবে না।
দুপুরের পর খোদেজা চুমকিকে নিয়ে রূপনগরে গেলো। পরদিন সকালেই চলে আসবে। রান্নাঘরের ময়লার ঝুড়ি পুরো ভরে গেছে। বাসায় আর কেউ না থাকায় ধারাকেই সেটা ফেলতে নিচে যেতে হলো। শুদ্ধ ছিল তখন ঘুমিয়ে। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ আসায় তার ঘুম ভেঙে গেলো। সে ধারার নাম ধরে ডেকে উঠলো। কোন সাড়া পেলো না। এদিকে তার যাওয়া প্রয়োজন। সে বারবার একে একে ধারা, খোদেজার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। বেগ বৃদ্ধি পেলে শুদ্ধ নিজে নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করলো। খুব কষ্ট হলো। প্রথম চেষ্টাতেই পারলো না। খুব কষ্টে বিছানার ধারে রাখা হুইলচেয়ারটি হাত দিয়ে টেনে নিয়ে নিজের পা টেনে টেনে বসার চেষ্টা করলো। পারলো না। হঠাৎ হুইলচেয়ার নিয়েই বিছানা ছেড়ে মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। খালি মেঝে থেকে উঠার জন্য শুদ্ধ পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কারো সাহায্য ব্যতিত পারলো না। শুদ্ধ’র চোখ ফেটে জল বেরোতে লাগলো। নিজের অসহায়ত্বে চিৎকার করতে লাগলো সে। ততক্ষণে বাসায় ফিরে সেই চিৎকার শুনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রুমে ছুটে আসলো ধারা। শুদ্ধকে মেঝেতে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তাকে তাড়াতাড়ি তুলতে নিলো। শুদ্ধ কোনমতে শুধু বলল,
‘আমাকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে নিয়ে চলো।’
শুদ্ধকে নিজের কাঁধে আশ্রয় দিয়ে দ্রুত শুদ্ধকে বাথরুমে নিয়ে গেলো ধারা। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।
__________________________________________
এই ঘটনাটা শুদ্ধ’র মনে গভীর দাগ কাটলো। তারপর থেকে আর ভালো মন্দ একটি কথাও বলেনি সে। পুরোটা সময় থম মেরে হুইলচেয়ারে একা একা বসে রইলো রুমে। একদম মূর্তির মতো স্তব্ধ। শুদ্ধ’র যাতে আর অপ্রস্তুত বোধ না হয় তাই ধারাও আর ইচ্ছে করে তার সামনে এলো না। ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। শুদ্ধ’র অবস্থানের কোন পরিবর্তন হলো না। একনাগাড়ে অন্যমনষ্ক দৃষ্টি ভেঙে হঠাৎ তার চোখ পড়লো সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। হুইলচেয়ারে বসা নিজের প্রতিবিম্ব চোখে পরতেই তার দুপুরের পরের সেই ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একদৃষ্টিতে আয়নার দিকেই তাকিয়ে রইলো সে। তার চোখ রক্তিম হতে লাগলো। হাতল ধরা হাতের মুঠি হতে লাগলো শক্ত থেকে শক্ত। হঠাৎ সে হাতের কাছের ভারী একটা শোপিজ তুলে আয়নার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মুহুর্তের মধ্যে বিকট শব্দ তুলে আয়নাটি ভেঙে চুরমার হয়ে নিচে ঝনঝনিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলো শুদ্ধ। হাতের কাছে যাই পেলো হাত দিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারলো। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে এলোপাথাড়ি ছুটতে থেকে রুমের মধ্যে ধ্বংসলীলা চালাতে লাগলো। বিছানার চাদর টেনে ফেলে দিলো। কাঁচের জগ, গ্লাস যা পেলো তাই ভাঙতে লাগলো। একটা ফুলদানি তুলে দরজার দিকে মারতে গিয়েই হঠাৎ থমকে গেলো শুদ্ধ। দরজা মুখে শান্ত মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা। তাকিয়ে আছে শুদ্ধ’র দিকে। শুদ্ধ’র প্রলয়কারী হুংকার মুহুর্তেই থেমে গিয়ে ফুলদানি ধরা হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে এলো।
চলবে,
[গত পর্বের শুরুতেই কাকের ডাক আর পরে দূর্ঘটনার ফলে অনেকে কাকের ডাকটাকে অর্থবহ ভেবে বসেছেন। এটা আমি কুসংস্কার অর্থে লিখিনি। শুধু একটা শহুরে জীবনের সাধারণ সকালের বর্ণনা স্বরূপ লিখেছিলাম। প্রকৃত অর্থে কাকের ডাক দ্বারা যে কুসংস্কার বোঝায় এটা আমি ঠিক জানতাম না। নয়তো এরকমটা লিখতাম না। তাই প্লিজ এই বিবরণে বিভ্রান্ত হবেন না। একটা পাখি প্রজাতির জীব শুধুমাত্র কালো রঙের আর কণ্ঠ খুব একটা ভালো নয় বলে তার ডাক খারাপ বার্তা বহন করবে এমনটা ভাবা নিশ্চয়ই ঠিক না।]]
#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩৭ (শেষ পর্ব)
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
অশ্রু মাখা চোখযুগল নামিয়ে আস্তে করে হাতের ফুলদানিটা মেঝেতে রেখে দিলো শুদ্ধ। কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো পেরিয়ে ধীরে ধীরে শুদ্ধ’র পাশে এসে দাঁড়ালো ধারা। শুদ্ধ মাথা নিচু করে রইলো। কোন কথা বলল না৷ ধারা শুধু তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। এর আগেও তাদের জীবনে অনেক কঠিন সময় এসেছে, অনেক বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও শুদ্ধ কখনো ভেঙে পড়েনি। হাল ছেড়ে দেয়নি। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা, বিশ্বাস সবসময়ই ছিল তার। যার জোরে সে সবকিছু জয় করেছে৷ কিন্তু আজ সেই আত্মবিশ্বাসী, স্পষ্টভাষী, শক্ত মনোবলের অধিকারী শুদ্ধই ভেঙে পড়েছে। তার আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরেছে৷ হাল ছেড়ে দিয়েছে সে। ধারা শান্ত মুখে শুধু অপলক দেখতে লাগলো সেই শুদ্ধকে। দৃষ্টি লুকিয়ে শুদ্ধ ভাঙা ভাঙা গলায় আতর্নাদের মতো করে বলতে লাগলো,
‘আমি আর এভাবে থাকতে পারছি না ধারা। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না। এভাবে অন্যের উপর বোঝা হয়ে বেঁচে থেকে কি লাভ? সামান্য নিজের কাজটুকুও আমি নিজে করতে পারছি না। এখান থেকে ওখানে যেতে হলেও আমাকে অন্যদের ডাকতে হয়৷ এমনকি বাথরুমেও আমি একা একা যেতে পারি না। অসহায়ের মতো পড়ে থাকি। কাপড় নষ্ট করে ফেলি। সেইসব তোমাকে পরিষ্কার করতে হয়। আমি আর এসব দেখতে পারছি না। সহ্য হচ্ছে না। তোমার ঘেন্না হয় না?’
ধারা শুদ্ধ’র হুইলচেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে জোর গলায় বলল,
‘না হয় না। কারণ আমি জানি আজ যদি আমি আপনার জায়গায় থাকতাম তাহলে আপনিও আমার জন্য এসব করতেন। ঘেন্না করে দূরে সরে থাকতেন না। আমরাই তো আমাদের জন্য সবসময় থাকবো তাই না! এখানে এমন কথা কেন আসবে?’
শুদ্ধ মাথা নেড়ে বলল, ‘না ধারা। তুমি আমার কথা শোন। তুমি এখনো ইয়াং। তোমার পুরো জীবনটাই এখনো পড়ে আছে। আমার পেছনে তুমি তোমার জীবনটা নষ্ট করো না। আমার জীবনটা তো নষ্ট হয়েই গেছে। আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। আমি আর কিছু পারবো না। কোন কাজও করতে পারবো না, সংসারও করতে পারবো না। তুমি কেন এভাবে পড়ে থাকবে? এখানে থেকে তোমার আর কিচ্ছু হবে না। তুমি নিজের জীবনটা নিয়ে ভাবো। একটা জীবন কিন্তু আর বারবার ফিরে পাবে না। এটাকে নষ্ট করো না। এখান থেকে চলে যাও। আমাকে নিয়ে ভেবো না। নতুন করে জীবন শুরু করো।’
ধারা কপট রাগ নিয়ে বলল,
‘তুমি যদি আরেকবার এই কথাটা বলো তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিচ্ছি। আমাকে ছুঁয়ে বলো তো, এখন যদি তোমার জায়গায় আমি থাকতাম তাহলে তুমি কি আমাকে ছেড়ে দিতে? নতুন করে জীবন শুরু করতে! এখন বলো? এখন চুপ করে আছো কেন? যেটা তুমি করতে না সেটা আমাকে করতে বলছো কেন? আর এমন কিই বা হয়েছে তুমি হাঁটতে পারছো না বলে, যার জন্য তোমাকে আমার ছেড়ে যেতে হবে! আমার তো কোন সমস্যা মনে হচ্ছে না। তুমি জানো, এক্সিডেন্টের পর তোমার অবস্থা কতোটা খারাপ ছিল! তোমার বাঁচার সম্ভাবনা পর্যন্তও ছিল না। আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম! আল্লাহ’র কাছে শুধু পাগলের মতো একটা জিনিসই চাইছিলাম, আল্লাহ যেন তোমাকে বাঁচিয়ে দেন। আল্লাহ সেটা আমাকে দিয়েছে। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। তুমি যে বেঁচে আছো আমি এতেই অনেক খুশি। এই আমার কাছে অনেক। এখন তুমি কোন অবস্থায় আছো তাতে আমার কোন যায় আসে না। তুমি শ্বাস নিচ্ছো, এই পৃথিবীতে আছো, আমার কাছে আছো এর থেকে বেশি আর আমার কিছু চাওয়ার নেই। তুমি থাকা মানেই আমার পুরো পৃথিবী থাকা। তুমি যে আমার জন্য আমার জীবনে ঠিক কি অর্থ বহন করো সেটা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। কোনদিন হবেও না। তোমাকে আমি ভালোবাসি শুদ্ধ। তোমাকে ছাড়া থাকবো কি করে?’
কথাগুলো বলতে বলতে ধারার গলা ধরে এলো। চোখে পানি চলে এলো। শুদ্ধ’র অবস্থাও একই। শুদ্ধ অসহায়ের মতো ভরসা হারা গলায় বলল,
‘এমনটা কেন হলো ধারা? এমনটা হবার কি খুব দরকার ছিল? ব্যাংকের লোন এখনও বাকি। আর এদিকে আমার সব কাজ প্রায় বন্ধের মতো। সামনে কিভাবে কি হবে আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না৷ কতো কষ্ট করে আমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আর আজ সব এলোমেলো হয়ে গেলো। আমার সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেলো ধারা। আমার এতো দিনের পরিশ্রম সব খারাপ হয়ে গেলো। আমার বাকিটা জীবন শুধু এই হুইলচেয়ারেই বোধহয় কাটবে। আমি আর কোনদিন হাঁটতে পারবো না। কিচ্ছু করতে পারবো না। আমিও ফেইল হয়ে গেলাম। সব শেষ হয়ে গেলো ধারা৷ সব শেষ হয়ে গেলো।’
ধারার চোখে পানি চলে এলো। হুইলচেয়ারের হাতলে রাখা শুদ্ধ’র হাতের উপর দু হাত রেখে ধারা পাশ থেকে বলল,
‘কিচ্ছু শেষ হয়নি শুদ্ধ। সব ঠিক হয়ে যাবো দেখো। শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন। তুমি আবার হাঁটতে পারবে৷ তার জন্য তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। মনের জোর রাখতে হবে। তুমি হাঁটতে পারবে।’
শুদ্ধ কান্না মাখা গলায় অস্ফুট স্বরে বলল,
‘আমি পারবো না।’
ধারা জোর দিয়ে বলল, ‘তুমি পারবে। অবশ্যই পারবে। তোমার নিজের উপর বিশ্বাস না থাকলেও আমার আছে৷ তোমার উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে শুদ্ধ। তুমি চেষ্টা করলেই পারবে। তুমি ভেঙে পড়তে পারো না৷ এতো দূর এসে তুমি হাল ছাড়তে পারো না। যেই শুদ্ধ আমার মতো মানুষকে নিজের উপর বিশ্বাস রাখা শিখিয়েছে আজ সেই শুদ্ধ এভাবে ভেঙে পড়তে পারে! একটা স্বাভাবিক সিস্টেমের বিপরীতে গিয়ে অন্যদের মতের তোয়াক্কা না করে যেই শুদ্ধ এমন ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে সেই শুদ্ধ কি আজ এভাবে হাল ছেড়ে দিতে পারে! যে মানুষটা সবাইকে শক্ত থাকতে শেখায়, সবাইকে অনুপ্রাণিত করে, স্বপ্ন দেখতে বলে সেই মানুষটার মুখে কি এমন হেরে যাওয়া কথা মানায় বলো? তুমি তো হারতে কখনো শেখোনি! তোমার মনোবলে জাদু আছে শুদ্ধ। এই জাদুটা তুমি তৈরি করেছো। তুমি যা স্থির করো সেটা তুমি করেই ছাড়ো। আমি তো এমন একটা শুদ্ধকেই চিনি। এমন শুদ্ধকেই জানি। আমার জানাটা তো ভুল হতে পারে না। আমি সেই শুদ্ধটাকেই আবার দেখতে চাই। সবসময় দেখতে চাই। আমাকে দেখাবে না?’
শুদ্ধ কাঁদতে লাগলো। শুদ্ধ’র চোখের পানি মুছে দিয়ে অনেকদিন আগে একবার ধারাকে বলা শুদ্ধ’র কথা অবিকল শুদ্ধ’র মতো করেই ধারা বলতে লাগলো,
‘কাঁদবেন না শুদ্ধ। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি পাশ করুন বা ফেল করুন, ভালো করুন, খারাপ করুন আমি সবসময় আপনার সাথে আছি। সবসময়!’
অশ্রুসিক্ত চোখে শুদ্ধ ধারার দিকে আলতো করে তাকালো। তারপর ধারার ভরসা মাখা মুখের দিকে শুধু তাকিয়েই রইলো।
পরদিন সকাল সকাল ধারা শুদ্ধকে নিয়ে বাইরে বের হলো। হুইলচেয়ার টেনে একটা নিরিবিলি ফাঁকা রাস্তায় এনে থামলো ধারা। শুদ্ধ ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বুঝতে পারলো না। ধারা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে শুদ্ধ’র পায়ের দিকে ইশারা করে বলল,
‘ডাক্তার বলেছে তোমাকে অবশ্যই নিজ থেকে হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। পায়ের ব্যায়াম করতে হবে। তুমি আস্তে আস্তে পা মাটিতে রেখে হাঁটার চেষ্টা করো তো!’
শুদ্ধ কয়েকবার চেষ্টা করলো। পারলো না। একসময় ক্লান্ত মুখে বলল, ‘হবে না ধারা। ডাক্তার রোগীর মন রাখার জন্য এরকম বলেই। আমি তো বুঝি, আমি কেমন পারছি! আমি পারবো না।’
শুদ্ধ’র ভরসা হারা নত মুখের সামনে ধারা তার ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরলো। সেই হাতের অনুসরণে ধারার মুখের দিকে শুদ্ধ তাকাতেই একটা ভরসা মাখা হাসি দিলো ধারা। শুদ্ধ আস্তে করে ধারার হাতের মধ্যে নিজের হাতটা রাখলো। ধারা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। আস্তে আস্তে কাঁপা কাঁপা পায়ে খুব কষ্ট করে হুইলচেয়ার থেকে মাটিতে পা রাখলো শুদ্ধ। ধারার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালো সে। এক কদম সামনে ফেলার চেষ্টা করতেই পড়ে যেতে নিলো শুদ্ধ৷ ধারা দু হাত দিয়ে ধরে সামনে নিলো। শুদ্ধ’র একটা হাত নিজের কাঁধের উপর তুলে নিয়ে তাকে হাঁটাবার চেষ্টা করতে লাগলো। পাশাপাশি থেকে শুদ্ধকে বারবার পড়ে যাওয়া থেকে সামলাতে লাগলো সে। এগিয়ে চললো সামনে।
এরপর থেকে সত্যিকার অর্থেই ধারা শুদ্ধ’র পাশে থেকে সবটা সামলালো। ছায়ার মতো সবসময় সাথে থেকে শুদ্ধকে উৎসাহিত করলো, ভরসা দিলো, ভেঙে পড়তে দিলো না। তার শরীর ও মনের যত্ন রাখার পাশাপাশি তার কর্মজীবনেরও দেখভাল করলো। শুদ্ধকে হুইলচেয়ারে করে তার কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যেতে লাগলো। কখনো ঘরে কখনো বাইরে যেভাবে শুদ্ধ’র একটু সুবিধা হয় সেভাবে ব্যবস্থা করলো। শুদ্ধ’র থেকে কাজ বুঝে নিয়ে তার অনুপস্থিতে মাঝে মধ্যে ধারাই সামলে নিতে থাকলো সেসব। যেখানে শুদ্ধকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ধৈর্য্যের সাথে যতক্ষণ সময়ই লাগুক ধারা নিয়ে যেতো। যা সে একা একা সামলাতে পারতো তা একাই করতো। শুদ্ধ শুধু অবাক হয়ে দেখতে থাকে ধারাকে। এই মেয়েটাই একদিন সামান্য কিছুতেই ভড়কে যেতো, নার্ভাস হয়ে পড়তো, কিছু পারতো না। আর আজ সেই মেয়েটাই কিভাবে শক্ত হাতে ঘরে ও বাহিরে সবকিছু সামলে চলছে! কতো বড় দায়িত্ব নির্ভয়ে মাথা পেতে নিয়ে নিয়েছে। তার উপর পুরো দস্তর শুদ্ধ’র শরীরের যত্ন রাখা তো আছেই। না সে হাল ছেড়ে দিচ্ছে আর না শুদ্ধকে ছাড়তে দিচ্ছে। একটা কথা আছে না, “নারীকে তুমি যাই দিবে তা সে বহুগুণে তোমাকে ফিরিয়ে দেবে।” সেই কথার যথাযথ বাস্তব প্রয়োগ ঘটালো ধারা। শুদ্ধ একসময় এই ধারাকে আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, নির্ভয়া করেছিল। আজ সেই রূপ দিয়েই ধারা শুদ্ধ’র জীবনটাকে এলোমেলো হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখলো। ধারার দূর্বল হাতটাকে শুদ্ধ শক্ত করে তুলেছিল বলেই আজ সে সেই শক্ত হাতে শুদ্ধকে আঁকড়ে ধরতে পারলো। দূর্বল হতে দিলো না।
পাঁচ বছর পর,
শুদ্ধ ধারা বসে আছে একটা অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে। খোদেজা আসেনি। বরাবরের মতোই এমন অপছন্দনীয় জায়গায় না আসার জন্য সে শুদ্ধ ধারার আড়াই বছরের মেয়েকে দেখভালের বাহানা দিয়ে বাসায় থেকে গেছে। এই বছর সেরা কৃষি উদ্যেক্তার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে শুদ্ধ। সে এখন একজন পরিপূর্ণ সফল মানুষ। সফল কৃষি উদ্যেক্তা, দক্ষ ব্যবসায়ী, এবং একজন মোটিভেশনাল স্পিকার। অসংখ্য গবেষণা চালানোর পর তার উদ্ভাবিত নতুন প্রজাতির ধান এখন কৃষি বিভাগ থেকেই স্বীকৃত। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এখন সেই ধান চাষের ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। কৃষকদের দারিদ্র্যের জীবনে অনেকাংশেই পরিবর্তন এনে দিয়েছে এই ধান। ধানের সাথে সাথে শুদ্ধ’র নাম এখন সমগ্র দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণ সমাজের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শুদ্ধ। সে যে একজন পতিতার ছেলে এই খবরও এখন আর এতো লুকিয়ে ছাপিয়ে নেই। সবাই জানে সত্য। শুদ্ধই জানিয়েছে। তবুও তাকে এই ব্যাপারে খুব একটা সমলোচিত হতে হয়নি। কারণ শুদ্ধ তার ক্ষুদ্র জীবনে এতো কিছুই করেছে যে তাকে নিয়ে বলার মতো আরো অনেক কিছুই আছে। তার জন্ম পরিচয় এখন আর অতো মুখ্য নয়। সেই দূর্ঘটনার ছয় মাসের মাথাতেই শুদ্ধ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে। আবার হাঁটতে পারে। ধারার যত্ন, সাহায্য আর নিজের মনোবলের জোরে ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। তারপর ধীরে ধীরে অর্জন করে জীবনের কাঙ্খিত সাফল্য। আল্লাহ দিলে এখন আর তার জীবনে কোনকিছুরই অভাব নেই। সফলতার চূড়ান্ত ধাপে পদার্পণ করে ফেলেছে সে। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। চুমকির বিয়ে হয়েছে। শুদ্ধ ধারার জীবনে পরীর মতো ছোট্ট একটি রাজকুমারী এসেছে। কাজের পরিসর আরো বেড়েছে। জীবনের ধরণ বদলে গেছে। রূপনগরের জন্যও অনেক কিছু করেছে শুদ্ধ। সেখানকার কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছে। গ্রামের মানুষগুলো শুদ্ধকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে। রূপনগরে অবিকল পূর্বের মতোই নতুন করে অর্ধপাকা দোচালা টিনশেডের বাড়ি বানিয়েছে সে। প্রতি মাসে এক সপ্তাহ তারা সেখানে গিয়ে কাটিয়ে আসে। তাদের সেই প্রিয় রূপনগরে। সাদা শার্টের উপর কালো স্যুট পড়ে অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার সময় শুদ্ধ তার সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব তার মা আর স্ত্রীকে দিয়ে দিলো। তার আজকের এতোদূর আসার পেছনে তাদের অবদানও তুলে ধরলো। শুদ্ধ অ্যাওয়ার্ড নিয়ে যাবার পর হোস্ট শুদ্ধ’র প্রশংসার পর ধারারও ভীষণ প্রশংসা করলো। তখন শুদ্ধ আলোচনার ভেতরে ছিল বলেই তার দূর্ঘটনার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মধ্যকার সময়ে ধারার কৃতিত্ব সবারই টুকটাক নজরে ছিল। একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে ধারাকে আখ্যায়িত করলো। তারপর কিছু বলার জন্য স্টেজে আসার অনুরোধ করলো ধারাকে। পাশে বসা শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে একবার স্মিত হেসে খুবই সুন্দর মেরুন রঙের একটা ভারী শাড়ি গায়ে ধারা স্টেজে উঠে আসলো। এই ধারাও এখন আর সাধারণ কেউ নয়। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে এখন সে একটা স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে আছে। মাঝে মধ্যে টুকটাক লেখালেখিও করে। যেই মেয়েটি আগে নিজে থেকে কোন কথাও বলতে পারতো না আজ সেই মেয়েটিই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত অকপটে তুলে ধরে তার লেখায়। জিপিএ ফাইভ না পেলে জীবনে আর ভালো কিছু হবে না, এই ধারণাকে সে ভুল প্রমাণিত করেছে। ধারার বাবা কাকাও এখন তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। সবাই আগ্রহ করে ধারার বক্তব্য শোনার জন্য বসে থাকে। ধারা হোস্টের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মাউথ স্পিকারটা ঠিক করে সবার দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হাসলো। তারপর আস্তে করে বলতে শুরু করলো,
‘খুব সাধারণ একটি মেয়ে ছিলাম আমি৷ গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ে যেমন হয়, হয়তো তার থেকেও আরেকটু বেশিই সাধারণ। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, অন্যের উপর নির্ভর হয়ে থাকা, ভয় পাওয়া, ঘাবড়ে যাওয়া ছিল আমার চিরাচরিত স্বভাব। এমন একটা সময় ছিল যখন আমার আগে পিছে শুধু অন্ধকারই চোখে পড়তো। নিজের বলতে কোন স্বপ্ন ছিল না। কোন লক্ষ্য ছিল না। একটা গন্তব্যহীন নাবিকের মতো অথৈ সমুদ্রে শুধু ভাসছিলাম। সেই সময় শুদ্ধ নামের এই মানুষটা আসে আমার জীবনে। তারপর হুট করেই একটা জাদুর মতো আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনটা রঙিন বানিয়ে দেয়।’
ধারা মাথা নিচু করে মৃদু থামে। পেছনের কথা মনে আসায় খানিক আবেগী হয়ে উঠে। শুদ্ধ’র দিকে এক পলক তাকায়। ধারাকে ভরসা দিতে চোখের পলক ফেলে শুদ্ধ মিষ্টি করে হাসে। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা আবারো বলা শুরু করে,
‘তাকে নিয়ে আর নতুন করে কি বলবো? সে একজন অসাধারণ মানুষ। তার থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। শিখেছি কিভাবে নিজের লক্ষ্যে অটল থাকতে হয়, নিজের স্বপ্নের পেছনে লাগামহীন লেগে থাকতে হয়। স্বপ্ন কি? এটাও আমি তার থেকে শিখেছি। তার এই স্বপ্নের পথটা সহজ ছিল না। সাত বছর লেগে গেছে। তবে অবশেষে সে তার পরিশ্রম আর চেষ্টা দিয়ে তা অর্জন করেই ছেড়েছে। যেভাবে সে অনেক বছর আগে অর্জন করেছিল আমার মনটাকেও। সে আমার জন্য অনেক করেছে। অনেক! আমি আগে এরকম একদমই ছিলাম না।
সে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে আমার সেই নড়বড়ে স্বভাবের আপাদমস্তক পুরোটাই পাল্টে দেয়। আমার নিজের সাথে নিজের পরিচয় করায়, স্বপ্ন দেখাতে শেখায়, নিজের হয়ে কথা বলতে শেখায়। আমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে, এই পৃথিবীতে লড়াই করার মতো যোগ্য বানাতে সে তার ভালোবাসা আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার সাথে সবসময় ছায়ার মতো লেগে ছিল। আমি কি করেছি না করেছি তা কমবেশি অনেকেই জানে। কিন্তু সে আমার জন্য যে কতোটা করেছে তা সকলেরই অজানা৷ আমার জীবনে তার কৃতিত্ব বর্ণনাতীত। আজ এই যে আমি এতগুলো লোকের সামনে স্টেজে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলে যাচ্ছি, এটাও তারই জন্য। নয়তো আমি তো আগে আমার ফ্যামিলির লোকের সামনেও ঠিক মতো কথা বলতে পারতাম না। আমি খুব অসাধারণ কিছু করেছি বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সে যা করেছে তা সাধারণ ছিল না। মেয়েরা এমনই। সংসারের জন্য তারা যেকোন কিছু করতে পারে। তারা একটা বৃক্ষের মতো। সেই বৃক্ষকে একটা নতুন জায়গায় বেড়ে উঠার সময় আপনি তাকে যতো যত্ন দিবেন, সে ততোটাই বড় হয়ে আপনার সংসারটাকে নিজের ছায়াতলে আগলে রাখবে৷ কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েরাই সেই যত্ন, সেই সহযোগীতাটা পায় না। সেই বর্ণনাতীত যত্নটা আমি পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম বলেই হয়তো প্রয়োজনে আমি আমার পরিবারের জন্য কিছু করতে পেরেছি৷ একটা সংসার, একটা সম্পর্ক, একটা বন্ধন তো এমনই হওয়া উচিত তাই না! যেখানে দুজন, দুজনের শক্তি হয়ে থাকবে। যখন একজন দূর্বল হয়ে পড়বে তখন আরেকজন শক্ত থাকবে, আবার যখন সে দূর্বল হয়ে পড়বে তখন অপরজনকে শক্ত থাকতে হবে। দুজন দুজনের দিকে নিজেদের সহযোগিতার হাতটা বাড়িয়ে রাখবে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। যখন আপনি এই বিশ্বাসটা পাবেন যে আপনার যাই হয়ে যাক, আপনার পেছনে একটা ভরসার হাত সবসময় বাড়ানো আছে, তখন আপনি কখনো পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারবেন না। জীবনে যতোই ঝড় ঝাপ্টা আসুক আপনি তার মোকাবেলা করতে পারবেন। একটা সংসারের জন্য দুজনকেই দুজনের দিকে সমান ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। একে অপরের স্বপ্নকে নিজের মনে করে চলতে হবে, আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা দিতে হবে, ভালোবাসায় রাখতে হবে। দুজনকেই। শুধু যেকোন একজনকে না। দেখবেন, যেই সমস্যাই থাক একদিন ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসার সুন্দর হবে। জীবনে প্রকৃত সুখ আসবে। তাই শুধু অর্ধেকটা না। এবার থেকে পুরোটাই বলুন,
“সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে
গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।”
****সমাপ্ত****

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here