#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৮+০৯ |
[সেরা কমেন্টকারীদের নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করা হবে। গত পর্বের পোস্ট কিছু সমস্যার কারণে দেয়া হয়নি। আগামীকাল দুটো পর্বের একসঙ্গেই পোস্ট করা হবে। গ্রুপের লিংক গল্পের শেষে দেয়া হলো।]
ট্রেইলার থেকে বেরিয়ে কাঠফাঁটা রোদের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে মার্কেটের দিকে যেতেই মার্কেটের পাশে আরেকটা ট্রেইলার পেলাম। সেখানে কথা বলে বুঝলাম লোকটি অসুবিধার না। তাই এবার নিশ্চিন্তে মার্কেটে ঢুকে গেলাম। নিজের জন্য জামার গজ কাপড় আর আরেকটা ওড়না কিনে শাড়ির দোকানে ঢুকলাম মায়ের জন্য একটা সুন্দর দামী শাড়ি কিনবো বলে। এ মাসের খরচ কম আছে, ডাক্তারের এপোয়েমেন্ট এই মাসে নেই তাই ভাবলাম চিকিৎসার টাকাটা দিয়ে মাকে সুন্দর শাড়ি কিনে দেই৷ বেশ খুশি মনেই শো-রুমটায় ঢুকে শাড়ি চয়েস করতে লাগলাম৷ একসময় জাম কালারের একটা শাড়ি পছন্দ হলো৷ খুবই সুন্দর। শাড়ির গায়ে রেটিং দেয়া আছে। ১ হাজার ৯০০ শাড়িটির দাম। আমার কাছে এইটাই বেশি দামী মনে হলো। তাও এর চেয়ে বেস্ট কোনোটাই পাচ্ছি না। টাকা পেমেন্ট করার কথা জিজ্ঞেস করতেই ক্যাশ কাউন্টার দেখিয়ে দেয় একজন মেয়ে। আমি তাকে ছোট করে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে চলে গেলাম কাউন্টারে। এখানে খানিক ভীড় আছে তাই সিরিয়ালে দাঁড়ালাম। যখন আমার পেমেন্ট করা বাকি তখনই এক বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।
আমার সামনের যিনি টাকা পেমেন্ট করছে তার পকেট থেকে এক চোর টাকা নিতে গিয়ে প্রায় ধরা খেয়ে যাচ্ছিলো তখনই সে টাকাটা আমার ব্যাগে রেখে ভদ্র মানুষের মতো অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি তখনো শাড়ি নিয়ে কল্পনা করছিলাম মাকে ঠিক কেমন দেখতে লাগবে। লোকটি পেছনে ঘুরে পকেটে হাত দিয়ে দেখে তার পকেট খালি। সে আমার দিকে তাকালো কপাট রেগে। আসল চোরটি আমার ব্যাগের উপর থাকা টাকাটি কৌশলে নিয়ে আমাকে অপবাদ দিয়ে বলে,
-‘এই মেয়ে। তুমি ওনার টাকা চুরি করেছো কেন?’
ওনার কথায় আমি খানিক অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বিমূঢ় দৃষ্টিপাত লোকটার উপর নিক্ষেপ করে বললাম,
-‘এসব কী আজেবাজে কথা বলছেন, আমি কেন ওনার টাকা চুরি করতে যাবো?’
-‘কারণ তুমিই ওনার পিছে দাঁড়িয়েছো আর আমি নিজের চোখে দেখেছি!’
লোকটি যেন আরও ক্ষুব্ধ হলেন। আমি শাড়িটা পাশে রেখে বলি,
-‘একদম আজেবাজে মন্তব্য করবেন না। চোখ দিয়ে দেখে অতঃপর আমায় চোর বলবেন। আর এইযে ভাইয়া [যার টাকা খোয়ানো গেছে] আপনার টাকা দেখুন কোথায় রেখেছেন আপনি চেক করুন।’
এভাবে আরও কথা কাটাকাটি শুরু হলো। ওই অচেনা লোকটি আর সামনের ভাইয়াটির সঙ্গে এক পর্যায়ে তর্ক শুরু হয়ে গেলো। সামনের ভাইয়াটি এখন পুরো দমে বিশ্বাস করেছে আমি টাকাটি চুরি করেছি। আশেপাশে ভীড় জমেছে। শো-রুমের মালিক এসে বলে,
-‘এর আগে ব্যাগে হাত দিয়ে দেখো টাকা পাও কি না, তারপর থানায় গিয়ে এর নামে কেস উঠাও! এসব মেয়েমানুষ এসে আমার শো-রুমের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে।’
আমি নির্বাক হয়ে লোকটির দিকে তাকালাম। চোখের কোণ প্রায় ভিঁজে গেছে। আজ অবধি আমি এতটা অপমানিত কখনই হইনি। শেষ পর্যন্ত চোর উপাধি পেলাম? কয়েকজন লোক তেড়ে এসে আমার ব্যাগটা টানতে শুরু করে। আমি এক হাত দিয়ে ব্যাগটা টেনে বলি,
-‘বিশ্বাস করুন, আমি চুরি করিনি!’
-‘সেটা ভালোই বুঝি। তাহলে এখন ব্যাগ ছাড়ো কোনো কথা না।’
অনেক চেষ্টা করেও ব্যাগটা নিজের কাছে রাখতে পারলাম না। আর যাই হোক, ২-৩ জন পুরুষের সঙ্গে কিছুতেই একটা মেয়ে পারবে না। ওরা আমার ব্যাগ খুঁজে তেমন কিছুই পেলো না, শুধু কাপড়ের গজ আর কয়েক হাজার টাকা। সেই টাকা দেখেই ওরা ধরে নেয় এগুলোই আমি চুরি করে ব্যাগে রেখেছি। বিষয়টা যেন তাদের কাছে আরও সুবিধা হলো আমায় অপদস্ত করতে। এমন একটা অবস্থা আমার, আমায় এরা টানতে টানতে থানায় নিয়ে গেলো। এবার আমি কেঁদে ফেললাম, আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার টাকাগুলো না গুণেই আমায় এভাবে অপদস্ত করছে, যেখানে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ! এই থানার আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম এই থানাতেই নাশিদ সাহেব বসে। আমি ভেঁজা আঁখিপল্লবে তৃষ্ণার্ত হয়ে তাকে খুঁজতে লাগলাম। আমার তার সাহায্যের প্রয়োজন। পুরো এক মাস কষ্টের রোজগার এগুলো। এগুলো হাতছাড়া হলে আমি মরে যাবো।
আমার মা আমার এই মিথ্যে অপবাদ একদম সহ্য করতে পারবে না, সে মরে যাবে। আমি আমার মাকে কিছুতেই হারাতে চাই না। হে আল্লাহ, আপনি আমায় এ কোন বিপদের মধ্যে ফেললেন? আমরা মেয়েরা কী এতটাই অক্ষম? আমার কোনো কথাই তারা কানে পর্যন্ত নিচ্ছেন না। এর মাঝে অফিসার আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘এর আগে কতবার চুরি করেছিস?’
অফিসারের কথায় বরফের ন্যায় পা’দুটো জমে গেলো। নিজেকে যেন প্রাণহীন প্রাণীর ন্যায় লাগছে। নির্বাক, বিমূঢ় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টিতে ক্লান্তিভাব স্পষ্ট। হাঁপিয়ে গেছি ওনাদের সঙ্গে লড়তে লড়তে।
★
নাশিদ তার হাতের কাটা অংশটাতে হেক্সিক্সল লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে সবে থানায় আসলো। নাশিদ এবং তার ফুল ফোর্স মিশনে গিয়েছিলো, ভালো ভাবেই তা সফল হয়েছে। তবে নাশিদের হাতে কিছুটা ছুঁরির আঁচড় লেগেছে। নয়ন সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতেই নাশিদের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করলো। নাশিদের সামনে দৃষ্টি যেতেই কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকালো এবং নয়নকে বললো,
-‘কী হচ্ছে এখানে? ভীড় কেন?’
-‘জানি না স্যার, দেখতে হবে।’
এবার আরেক লোক চেঁচিয়ে উঠলো, “কী হলো বলিস না কেন?”
আমি চোখ বুজে জোরে চিৎকার করে বললাম,
-‘চুপ করুন আপনারা! আর কতবার বলবো আমি চোর নই! আপনারা কিরূপ অশিক্ষিতর মতো আমায় চোরের অপবাদ দিয়েই চলেছেন। সামান্য ক’টা টাকা আপনাদের কতোটুকু প্রমাণ দিলো? ওগুলা আমার ইনকামের টাকা! পারলে ওই লোককে গুণতে বলুন!’
এক লোক হেসে কটাক্ষ করে বললো,
-‘তোর ওসব চুরির ইনকাম দেখে আমাদের কাজ নেই!’
আমি চোখ গরম করে লোকটির দিকে তাকালাম। এমন গরম দৃষ্টিতে তাকানোর ফলে লোকটি আমার দিকে তেড়ে আসলো।
-‘চুন্নি! চোর হয়ে আমারে চোখ গরম দেখাস!’
বলেই আমায় চড় মারার জন্য হাত উঠালো। আমি চোখ বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে ফেললাম। কিন্তু কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও গালে কোনরকম স্পর্শ পেলাম না, চড় তো দূরে থাক!
পিটপিট করে তাকালাম এবং দেখলাম লোকটির হাত কেউ ধরে রেখেছে। আমি সেই মানুষটার দিকে তাকালাম। নাশিদ সাহেব এসেছে। ওনাকে দেখে চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এলো। ঠোঁটজোড়া চেপে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি।
নাশিদ লোকটির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
-‘আজকাল মেয়েদের উপর হাত তোলাটা আপনাদের ফ্যাশন হয়ে গেছে তাই না? টাকা কী আপনার হারিয়েছে, আপনার এতো দরদ উতলে পরছে কেন?’
চোর লোকটি হালকা শুকনো ঢোঁক গিললো এবং নাশিদের থেকে হাতটি ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। নাশিদ এবার রথির দিকে তাকালো। কেঁদে-কেটে কী হাল বানিয়েছে মেয়েটি। প্রাণোচ্ছল মুখটি কেমন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। নাশিদের না চাইতেও চোখ-জোড়া মুছে দিতে ইচ্ছে করছে, সঙ্গে এটাও বলতে ইচ্ছে করছে,
-‘এই চোখে কান্না নয়, চঞ্চলতা মানায়।’
নাশিদ সাহেব আমার উদ্দেশ্যে বললেন,’ঘটনা কী ক্লিয়ারলি বলো। কান্না থামাও!’
আমি নাক টেনে কিছু বলতে নিবো ওমনি ভীড়ের সবার চেঁচামেচি শুরু! নাশিদ সকলকে ধমক দিয়ে বলে,
-‘এটা থানা, মাছের বাজার নয়৷ আমি একজনকে প্রশ্ন করেছি তো নাকি? ডিসিপ্লিন মেনে চুপ করে দাঁড়ান নয়তো থানা থেকে বের হয়ে যান!’
-‘স্যার, এই চোরের থেকে জিজ্ঞেস করে আপনি তো সত্য জানবেন না!’
এবার নাশিদ চোখ গরম করে চোর লোকটির দিকে তাকাতেই লোকটি চুপ হয়ে গেলো। আমি মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছি। নাশিদ বললেন,
-‘বলেছি না কান্না থামাতে? আমার দিকে তাকাও!’
চোখ মুছে মাথা কিঞ্চিৎ উঁচু করে ওনার দিকে তাকালাম। নাশিদ আবারও প্রশ্ন করলেন,
-‘কী ঘটেছিলো?’
-‘শাড়ির দোকানে শাড়ি কিনতে গিয়েছিলাম, মায়ের জন্য। ক্যাশ কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, হুট করে সামনের ভাইয়াটা মানে উনি [ভাইয়াটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে] পকেট থেকে কিছু খুঁজতে খুঁজতে আমার দিকে ফিরলেন। তখন এই লোকটা [যে চড় মারতে গিয়েছিলো] আমায় ফাঁসিয়ে বলছে আমি নাকি ওনার টাকা চুরি করেছি উনি নিজের চোখে দেখেছেন। তারপর…’
এভাবে পুরো ঘটনা খুলে বললাম ওনাকে। নাশিদ সাহেবের চোখের দিকে তাকাতেই আমি খানিক ঘাবড়ে গেলাম কারণ, ওনার চোখ তখন অসম্ভব লাল ছিলো। আমি সম্পূর্ণ ঘটনা বলার পর আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। নাশিদ সব শুনে নয়নকে ডাক দিলো। নয়ন ভীড় ঠেলে নাশিদের কাছে আসলো। নাশিদ রথির দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ওকে বেঞ্চিতে নিয়ে বসাও, পানি দাও!’
নয়ন একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’
আমি কিছু না বলে নিঃশব্দে ওনার সঙ্গে চলে গেলাম। নাশিদ এবার চোর ব্যাটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নাশিদের চাহনি দেখে লোকটি ঘামতে লাগলো। নাশিদ এক পা, এক পা করে লোকটির দিকে এগোতে থাকলো এবং বললো,
-‘এখন আপনি বলুন, রথি কীভাবে চুরি করেছে!’
নাশিদের মুখে মেয়েটির নাম শুনে বাকিরা বুঝলো রথি নাশিদের পূর্বপরিচিত। এর মানে কী তারা কোনো ভুল করে বসলো? ভাবতেই সকলেই কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। লোকটি তার মনের মাঝে সাজানো ছকটা নাশিদের চাহনিতে নিমিষেই এলোমেলো করে ফেললো। সে আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
-‘ওখানে দেখেছিলাম মেয়েটা আস্তে কককরে ওওওই ভাইজা…জানের প.পকেট থেথেথেকে টাকা বের ককরে ব্যা..গে ভরে ফেলে!’
নাশিদ লোকটির পা থেকে মাথা অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। অতঃপর কিছু না বলেই লোকটির বাম পকেট থেকে পুরো টাকা বের করে ভাইয়াটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
-‘গুণে দেখুন টাকাগুলো ঠিক আছে কিনা!’
এবার লোকটির অবস্থা খারাপ। সে বুঝতে পারে তার এতো চাল চালার পরেও সে ব্যর্থ৷ নিজের মাথায় তার এখন বারি দিতে মন চাইছে। কেন আগে থেকে পালিয়ে গেলো না! সে পালাতে নিতেই নাশিদ তাকে ধরে ফেললো।
-‘হ্যাঁ এগুলা আমার টাকাই।’
নাশিদ চোরের দিকে তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-‘মেয়েটির ব্যাগে যেই টাকাগুলো ছিলো সেগুলোও গুণে দেখুন। নয়ন, রথির ব্যাগ থেকে টাকাগুলো নিয়ে গুণিয়ে দেখাও!’
নয়ন মাথা নেড়ে রথির থেকে ব্যাগ চাইলো। রথি নিশ্চুপ হয়েই ব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে নয়নকে দিলো। নয়ন টাকাগুলো লোকটির হাতে দিতেই দেখলো রথির টাকা ওর টাকার ধারেও নেই। এটা নাশিদ জানতে পেরে জোরে ঘুষি বসিয়ে দেয় চোরের নাক বরাবর!
-‘পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না! এতক্ষণ নিজে চোর হয়ে একটা অসহায় মেয়েকে ফাঁসানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছিস! আর আপনারা কেমন মানুষ যে এই চোরের কথা বিশ্বাস করে আরেকটা ভদ্র পরিবারের মেয়েকে চোর বলে গালি-গালাজ করলেন? প্রমাণের জন্য কী শুধু ব্যাগ টানাটানি-ই করা লাগতো? সিসিটিভি ফুটেজ নেই? আধুনিক যুগে এসেও আপনাদের দ্বারা এতো বড় মিস্টেক কীভাবে হয়? এন্সা মি!?’
সকলেই চুপ করে শুনলো আর আমি শূন্য দৃষ্টিতে নাশিদের দিকে তাকিয়ে আছি। নাশিদ সাহেবের কথা শুনে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। এই ছোট্ট হাসিতে তাদের প্রতি আক্রোশ বিদ্যমান। এই আক্রোশ আমি কোনদিনই প্রকাশ করবো না। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম,
-‘আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না।’
এবারও কেউ কোনরকম কথা বললো না। পুলিশম্যান বাকি মানুষদের বের করে চোরকে লকাবে পুরলেন। অতঃপর সব কাজ সেরে উনি আমার কাছে এলেন। উনি আমার সামনে দাঁড়াতেই আমি ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার টাকাগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-‘তোমার টাকাগুলো।’
আমি বিনা-বাক্যে টাকাগুলো নিলাম। কথাগুলো কেন যেন গলা দিয়ে বের হচ্ছে না। হাতঘড়ির তাকিয়ে দেখলাম বিকাল ৫টা ১৫ বাজে। নাশিদ বলে উঠলেন,
-‘আসো তোমায় পৌঁছে দেই?’
আমি অমত জানালাম না কারণ, আমার চলার মতো শক্তিটাও নেই। অপমান, লাঞ্ছনায় আমি শেষ। আমি মাথা নাড়াতেই উনি নয়ন নামক পুলিশকে বলে উঠলো,
-‘আমি আজকের মতো আসি নয়ন। তুমিও বাড়ি চলে যাও, কোনো কাজ থাকলে আমি তোমায় জানাবো!’
নয়ন মাথা নাড়ায় আর একপলক আমার দিকে তাকায়। অতঃপর নাশিদ সাহেব নয়নকে বিদায় দিয়ে আমায় নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি চুপচাপ পাশের সিটে বসলাম আর উনি ড্রাইভিং সিটে। বসার কিছুক্ষণ বাদেই উনি গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
আমি জানালা নিয়ে এই কোলাহলপূর্ণ শহর দেখছি। এই শহর নিয়ে আমার অনেক অভিযোগ। এই শহরের মানুষগুলো বড্ড অবুঝ। চার-দেয়ালের মাঝে থেকে থেকে তারা জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। এদের সঠিক বিচার নেই আমাদের মতো মেয়েদের জন্য।
গাড়িতে কেউ কোনরকম কথা বললাম না। তবে ওনার হাতের ব্যান্ডেজটি আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।
অনেকক্ষণ কৌতুহল নিয়ে চুপ থাকলেও আর পারলাম না। বিব্রতভাব কন্ঠে ফুটিয়ে বললাম,
-‘আপনার হাতে ব্যান্ডেজ কেন?’
আমার প্রশ্নে উনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। হয়তো আশা করেননি হুট করে এমন প্রশ্ন। কোণা চোখে একপলক তাকিয়ে বলে,
-‘তেমন কিছু না, একটু চোটের কারণে!’
আমি শুধু ‘ওহ’ বললাম, কোনরকম কথা বাড়ালাম না। উনি বলতে চান না, আমার জোর করার প্রশ্নই উঠে না। কিছুক্ষণের মাঝেই বাসায় পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই কী মনে করে আবারও ওনার গাড়ির উইন্ডোর সামনে আসলাম। উনি জানালার কাঁচ খুলে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘কিছু বলবে?’
-‘ধন্যবাদ, ন্যায় বিচার করার জন্য। আপনি পুলিশ হিসেবে একটু বেশিই ভালো মানুষ। সাবধানে যাবেন, আল্লাহ হাফেজ।’
বলেই আমি গেট খুলে চলে আসলাম, পিছে আর তাকালাম না। উনি হয়তো চলে গেছেন। এদিকে নাশিদ হা করে রথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সে যেন পাথরের মূর্তি। কেমন চিন্তাশূন্য হয়ে গেছে, রথির কথাগুলো শুনে। মিনিট পাঁচেক পর তার ঘোর কাটলো। অতঃপর কী মনে করে আনমনে হেসে উঠলো। অতঃপর জানালার কাঁচ উঠিয়ে চলে গেলো সেই মার্কেটে যেখানে রথির সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে।
আমি বাসায় ফিরতেই মা প্রশ্ন করা শুরু করে দিলো। কোথায় ছিলাম এতক্ষণ, ফোন কেন নিলাম না ইত্যাদি ইত্যাদি। মায়ের কথায় একটা প্রশ্ন মাথায় আসলো, যেদিনই আমি বিপদে পরি সেদিনই কেন মোবাইলটা বাসায় ফেলে যাই? এই কনফিউশনটা আমার এখনো কাটলো না। মাকে শান্ত করতে বললাম,
-‘তেমন কিছু নয় মা। মার্কেট গিয়েছিলাম।’
-‘তাই বলে এতক্ষণ?’
-‘কোচিং সেন্টারে মিটিং ছিলো। মিটিং থেকে বেরিয়েই মার্কেট গিয়েছিলাম।’ সত্যটা চেপে বললাম।
মা কিছুটা শান্ত হলেও আমায় বকতে ছাড়লেন না। বকতে বকতে ভাত বাড়তে লাগলেন। আমি ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। এতক্ষণের ধকলে প্রচুর খিদে পেয়েছে।
দুইদিন বাসা থেকে বের হলাম না। সেদিনের ঘোরটা কিছুতেই আমার কাটছে না। এক কথায় বলা যায় আমার এসব ভাবনায় জ্বর উঠে গিয়েছিলো। জ্বরের মাত্রা তীব্রতর হওয়ায় বাসা থেকে বের হওয়ার বিকল্প কিছু পেলাম না। আতিক স্যার আমায় এসে দেখে গেছিলো। দুইদিন ছুটি নিয়েছি কোচিং সেন্টার থেকে। দুইদিন কাটতেই জ্বর অনেকটা ছেড়ে যায়। বিকালের দিকে হঠাৎ কেউ দরজায় নক দেয়। মা দরজা খুলে নিচে একটা পার্সেল দেখতে পেলো। মা সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার নাম পেতেই সেটি নিয়ে ভেতরে চলে আসলেন। মা আনন্দিত সুরে বলে,
-‘রথি দেখ তোর জন্য উপহার এসেছে।’
মায়ের কথায় আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। আসলেই মায়ের হাতে একটা পার্সেল। আমাকে আবার কে উপহার দিবে? আমি মায়ের থেকে পার্সেলটা নিয়ে নাম চেক করে দেখলাম আসলেই আমার নাম। কিন্তু পার্সেল কোথা থেকে এসেছে সেই এড্রেসটা উল্লেখ নেই। মা অলরেডি কাঁচি নিয়ে এসেছে ট্যাপ খোলার জন্য। এই মাও না, এরকম কিছু আসলে আমার কিছু বলার আগেই খোলা শুরু করে দেয়। এসব পার্সেল, উপহার নিয়ে মায়ের কৌতুহল বেশি। মা প্রতিবারের মতো এবারও আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার থেকে পার্সেলটি নিয়ে চোখের পলকেই খুলে ফেললো।
-‘মা এটা খুলছো কেন? কে দিয়েছে সেটা তো জানতে হবে নাকি?’
-‘তোর নাম আছে এই অনেক।’
বলেই পার্সেলটির ভেতর থেকে দুটো অসম্ভব সুন্দর শাড়ি বের করলো। আমি এবং দুজনই অবাক হলাম। একটি নীল শাড়ি আরেকটা জাম কালারের শাড়ি। আরে এটা তো সেই শাড়ি যেটা মায়ের জন্য ওইদিন পছন্দ করেছিলাম। নীল শাড়িটা ফেলে মা জাম কালার শাড়িটা নিয়ে আলমারির আয়নার দিকে ছুটে গেলেন। মায়ের এই হাসিটা দেখে আমি মাকে কিছুই বলতে পারলাম না। বক্সটা হাতে নিয়ে ভেতরটা দেখতেই একটা খামে মোড়ানো চিরকুট দেখতে পেলাম। আমি সেটা খুলে পড়তে শুরু করলাম,
-‘নীল শাড়িটা আপনার জন্য এবং জাম কালারের শাড়িটি আপনার মায়ের জন্য। আশা করছি উপহারটি ফেলে দিবেন না। উপহার ফেলে দেয়া অথবা কাউকে দিয়ে দেয়া ঘোর অপরাধ, আপনি নিশ্চয়ই জানেন।’
এইটুকুই লেখা। চিঠিতেও কোনরকম সূত্র পেলাম না যে কে পাঠিয়েছে। আমার ভাবনার মাঝে মা বলে উঠলো,
-‘দেখ, আমায় মানাবে শাড়িতে তাই না?’
আমি মায়ের দিকে তাকালাম। আবারও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাকে প্রশ্ন করলাম,
-‘কিন্তু কে দিয়েছে মা? আমার জানামতে কারো এই শাড়ি উপহার দেয়ার কথা নয়।’
-‘তোর কোনো কলিগ দিয়েছে হয়তো।’
মায়ের কথাটা মানতে পারলাম না। উঠে নীল শাড়িটা আলমারিতে যত্ন করে তুলে রাখলাম। আমার দরকার নেই এসব উপহারের। সঠিক মানুষকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে। তখন এই শাড়িসহ মায়ের শাড়ির দামও চুকিয়ে দিবো। কারো দয়ায় বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। মাকে আমার নীল গজ কাপড়টি দিতেই মা আমার ফুলফিল মাপ নিয়ে ভাবীর বাড়ির দো’তলায় চলে গেলো। সেখানের ভাড়াটিয়ার মাঝে নাকি একজন মহিলা দর্জি আছেন। এই খবর এই দুইদিনেই জানতে পেরেছি। মা চলে যেতেই আমি ভাবতে লাগলাম কে এসব পার্সেল করে পাঠালো, নাম-ঠিকানা ছাড়াই?
~চলবে।