কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন অন্তিম পর্ব

0
1226

#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
অন্তিম পর্ব

পৃথিবীর কোথায় কোন রহস্য লুকিয়ে আছে মানুষের সবটা জানা সম্ভব না। কিছু রহস্য মানুষের অগোচরেই থেকে যায়। আবার কিছু রহস্য সামনে আসে। জামসেদ কহিনুরের সঙ্গে আলোচনা করে মারিয়াকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে। সেই থেকে মেয়েটা কাঁদছে। এতোদিন ওর সঙ্গে কি কি হয়েছে কিছুটা মনে আছে বাকীটা মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরতো তখন কিছুটা বুঝতে পারতো। জুবায়ের বোনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। হোক র/ক্তের সম্পর্ক নেই তবুও ছোট থেকে বড় করেছে। মেয়েটার সঙ্গে এই বাড়ির মানুষের রক্তের সম্পর্ক ছিলনা বিধায় ছোট থেকে ওর প্রতি সবাই এমন উদাসীন ছিল।কিন্তু জুবায়ের কখনও অবহেলা করেনি। বোনকে আগলে রেখেছে। ও যে কানে শুনতে পারে সেটা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে কারণ জানাজানি হলে সবাই ওর সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করতো। ও যে সুলতান বাড়ির মেয়ে না এটা জুবায়ের জানতো তবুও কাউকে বলেনি। অধরা ওকে নিজের কাছে বসিয়ে নিলো। মেয়েটার শরীর বেশ দুর্বল। কহিনুর নিজের কক্ষে সাঈদ পাথর আর সাঈদের আম্মীর সঙ্গে আলোচনা করছে। পাথর মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। মুখে হাসি নেই। সাঈদের আম্মী নীরবতা কাটিয়ে বলে উঠলেন,
> নূর তুমি তুমি ঐশ্বর্যের বাবাকে হ/ত্যা করেছিলে কিন্তু আদো সে মা/রা গিয়েছে? ওর শরীরের মৃ/ত্যু ঘটেছে কিন্তু ও আত্মা কিন্তু অক্ষত আছে। ও চাইলে যেকোনো মানুষের শরীর দখল করে আবারও নিজের কুকর্ম চালাতে পারে। এমন কিছু করতে হবে যাতে ওরা আর কখনও না ফিরে আসে বুঝলে? অর্ধমানবদের চিরতরে মারতে হলে অন্য কিছু ভাবতে হবে। ওরা সংখ্যায় অনেক।

মায়ার কথা শুনে কহিনুর উত্তর করলো না।ও গভীর চিন্তাই মগ্ন আছে। সাঈদ কিছু একটা ভেবে বলল,
> নূর জাদুলিপির সাহায্য নিতে পারো তুমি। ওই লিপিতেই কিন্তু তোমার সমস্যার সমাধান রয়েছে। জনাবের রূপ ধরে আধার কিন্তু ওই লিপির জন্যই এসেছিল সেটা এমনি এমনি না। ওর অষ্টম পৃষ্ঠাতে তুমি তোমার মনের ইচ্ছের কথা লিখে দাও। অর্ধমানব আর শয়তানের শক্তির জটিলতা থেকে মুক্তি পেয়ে চাইছো। ওখানে উল্লেখ করো পাপের বিনাশ চাও। ঝামেলা শেষ।
সাঈদের কথা শুনে কহিনুর চমকে উঠলো। এতদিনে ছেলেটা ভালো একটা বুদ্ধি দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা আছে। ওসব কালো শক্তির সাহায্য নিলে ওটা জীবিত হয়ে উঠবে। ওই শক্তির হাত ধরে আবার কোনো শয়তানি শক্তি এসে হাজির হবে। কিন্তু এছাড়া তো ভালো কোনো বুদ্ধিও মাথায় আসছে না। কহিনুর মুখটা গম্ভীর করে বলল,
> সাহায্যে নিবো বললেই নেওয়া যায়না। জাদুলিপির জন্য আবার নতুন কোনো ঝামেলা ফিরে আসবে।
> তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো তোমার মধ্যে যে শক্তি আছে সেটাও কিন্তু শেষ হবে না। সৃষ্টি করা যতটা সহজ ছিল ধ্বংস করা ততটাই কঠিন হবে। তুমি হয়তো ভাবছো তোমার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ওর শক্তি হারাবে তবে ভুল ভাবছো। ও তোমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে ধরবে। মোটকথা যতদিন খারাপ শক্তি আছে ততদিন থাকবে। তাছাড়া আল্লাহ নিজেই শয়তানকে সৃষ্টি করেছেন তোমার কি সাধ্য ওদেরকে মেরে ফেলার?। বুদ্ধি দিয়ে ভাবো। আমি কহিনুরের রক্ষক হিসেবে তোমাকে সাহায্য করছি। যতদিন ওটা তোমার মধ্যে থাকবে ততদিন আমি তোমার সঙ্গে থাকবো। ভালো পরামর্শ দিতে চাই আর কিছু না।
সাঈদের কথা শেষ হতেই পাথর জাদুলিপি কহিনুরের সামনে তুলে ধরলো। মুখটা থমথমে করেই বলল,
> লিখে ফেলো নূর। তোমার মনে যা ইচ্ছে লিখে ফেলো। আমি তোমার সঙ্গে আছি। দ্রুত করো।

কহিনুর চুপচাপ জাদুলিপিটা নিজের হাতে তুলে নিলো। লিখতে শুরু করলো,
> আমি সুলতান বংশের উত্তরসূরি সুলতান জুবায়ের ফারুকীর একমাত্র কন্যা সুলতানা কহিনুর ফারুকী। বংশানুক্রমে অভিশপ্ত হয়ে আমার জন্ম। আমি এবং আমার পরিবারের প্রতিটা সদস্য শয়তানের দ্বারা কষ্ট পেয়েছি। ধোকার স্বীকার হয়েছি। আল্লাহর রাস্তা থেকে সরে এসেছি আমি চাই এই শয়তানি শক্তির শেষ হোক। অর্ধমানবের মধ্যে পূর্ণ আত্মা ব্যতিত সকলের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটুক। অভিশাপ কাটিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে পৃথিবীতে আল্লাহর বিধান মেনে জীবন অতিবাহিত করুক। কালো শক্তির পরাজয় ঘটুক। সকল শুভ অশুভ শক্তির শেষ হোক আমি বিনিময় করতে প্রস্তুত আছি।
কহিনুর লেখা শেষ করে চোখ বন্ধ করলো। ওর জানা নেই এখন ওর থেকে কি চাওয়া হবে। পাথর দ্রুত কহিনুরের থেকে জাদুলিপিটা নিয়ে বন্ধ করে দিলো। বাইরে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে। ডাইনিং রুমে অধরা আর মীরা সুর করে কোরআন তেলোওয়াত করছে। সুলতান ভিলাতে কোরআনের সুমিষ্টি গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। কহিনুর দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। বাইরে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। কহিনুর দরজা খোঁলা মাত্র জুবায়ের এসে ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
> ঠিক আছো তুমি? উপরে চিৎকার চেচামেচি হচ্ছে। ঐশ্বর্য কেমন জানি করছে। বুঝতে পারছি না কি হচ্ছে বাড়িতে।
কহিনুর নিজেকে সামলে নিয়ে জুবায়কে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,
> করতে দাও চিৎকার। তুমি বড্ড ভালো মানুষ বাবা। তোমার ভালোর সুযোগ নিয়ে শত্রুরা এই বাড়িতে ঘাটি গড়েছে। তুমি বুঝতে পারোনি। ওখানে যাওয়া চুপচাপ তেলোওয়াত করবে যতক্ষণ থামতে না বলবো ততক্ষণ চলবে থামবে না।
জুবায়ের মাথা নাড়িয়ে কহিনুরের কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো। দোতলা থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। হঠাৎ চারদিক কেমন দুর্গন্ধময় হয়ে উঠলো। নিশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। আরমান ফারুকীর ধুপধাপ পা ফেলে ডাইনিং রুমে এসে হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> এসব কি হচ্ছে বাড়িতে? এখুনি সব বন্ধ করা হোক। বলেছিলাম না চিৎকার চেচামেচি করা যাবেনা আমার বাড়িতে?
আরমান ফারুকীর কথা শেষ হতেই কহিনুর এগিয়ে আসলো। মুখটা কঠিন করে বলল,
> কহিনুরের বাড়িতে কি চলবে আর কি চলবে না সেটা কহিনুর নিজে ঠিক করবে। আপনার গুণের তো শেষ নেই। সেই গুণের প্রকাশ ঘটাতে এসবের এখন বড্ড বেশি দরকার। ওদিকে তেলোওয়াত চলবে এদিকে শয়তান বিদায় নিবে। সুন্দর ব্যবস্থা করেছি তাইনা? আর সুখের বিষয় হচ্ছে বাড়ির বাইরে বাগানের দিকে ছোটখাট একটা মজলিশ বসিয়েছি। আসলে কি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে একদল মেধাবী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একটা প্রতিযোগিতায় এসেছিল আমি ওদেরকে এখানে নিয়ে এসেছি। ভালো করেছি তাইনা? ওরা আজ সারারাত তেলোওয়াত করবে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনবো। আপনিও আসুন যোগদান করবেন।
কহিনুরের কথা শেষ হলো না। আরমান ফারুকী গর্জন করে উঠলেন। হুঙ্কার ছেড়ে সামনে এগিয়ে আসতে গিয়ে কানে হাত লাগিয়ে ফ্লরে বসে পড়লেন। সিঁড়িতে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে নজর রেখে কহিনুর বাঁকা হাসলো। চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে মজার ছলে বলল,
> আরে আদিবাসী যে,সরি আদি চৌধুরী যাইহোক আপনাকেই তো এতোক্ষন খোঁজ করছিলাম। ফিরে আসুন আপনার নিজের রূপে। এখানে পর্দাফাস পর্ব চলছে। এতো বছরের অগণিত প্রশ্নের উত্তর দিবেন না?
আদি রাগান্বিত হয়ে ছুটে আসতে গিয়ে থমকে গেলো। হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ওর চেহারা বদল ঘটছে। সাদা চকচকে তক কুচকে গিয়ে দগদগে ঘা হয়ে গেলো। ফ্লরে র/ক্ত মাং/স ছড়িয়ে পড়ছে। বাড়িতে কাজের মেয়েগুলো ভয়ে জড়সড় হয়ে কিচেনের দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। কহিনুর এগিয়ে আসলো। তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বলল,
> এবার শুরু করি আপনার ইতিহাস নাকি আপনি বলবেন?
কহিনুরের কথা শুনে আদির অন্তরালে থাকা শয়তানটা গর্জন করে উঠলো। বলল,
> ছাড়বো না আমি। সবাইকে নিয়েই তবে আমার সমাপ্তি ঘটবে।কি ভেবেছো আমি ছেড়ে দিবো তোমাকে? সকলে আমার দাস হয়ে থাকবে।
> তাই নাকি? কিন্তু আমি যে জাদুলিপিতে তোর ভাগ্য লিপিবদ্ধ করে ফেলেছি। নিয়তি তোর সঙ্গে আজ সঙ্গ দিবে না। মৃত্যু অনিবার্য। বহুকাল পূর্বে সুলতান জুবায়ের ফারুক আর অধরা বারিকে এতিম করতে যখন তোর হাত কাঁপেনি তখন আজ আমার হাতও কাঁপবেনা। কৌশলে অধরা বারিকে এই বাড়ির বউ করে আনা হয়েছিলো তোর প্ররোচনাতে তাইনা? শুধুমাত্র কহিনুরকে আবারও ফিরিয়ে আনতে কিন্তু একটা কথা কিভাবে ভুলে গেলি কহিনুর শুভ শক্তির প্রতিক ছিল। সেটা হস্তগত করতে হলে আরও বুদ্ধির দরকার। কিছু কিছু জায়গায় শক্তি না বুদ্ধির দরকার। প্রথম থেকে খেলাটা ভালো চলছিলো। আরমান ফারুকীকে পুরোপুরি নিজের বশে এনে জুবায়ের ফারুকীর বাবা মাকে হত্যা করা ওদের বিয়ে এই পযর্ন্ত ঠিক। কিন্তু পরবর্তীকালে সবটা ভুল হয়ে গেছে । কি দরকার ছিল আদিকে বশ করার? বেচারা ভালো মানুষ ছিল ভুল এটাইযে আমাকে দেখে ওর মধ্যে মুগ্ধতা এসেছিলো। আমাকে পেতে চাইছিলো কিন্তু চন্দ্র এসে ঝামেলা করলো। আদিকে ফেলে দিয়ে হা পা ভেঙে দিলো। বাধ্য করলো বিয়ে করতে। ঐশ্বর্যের বিয়ের পর তুই ওকে নিজের দখলে নিয়ে এই বাড়িতে আসলি। দূর থেকেই তো ভালো ছিল। সুলতান পরিবার সঙ্গে খান পরিবার দুটোই তোর জন্য অভিশপ্ত। কহিনুরের সৃষ্টি তোর জন্য। পৃথিবীতে কালো জাদুর সঙ্গে সরল মানুষদের ভাগ্য জুড়ে দিয়েছিস। চন্দ্রকে সাহায্য করেছিস। কতকত পাপ তোর।

কহিনুরের চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। অধরা থমকে গেলো। ওর মনে অনেক অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ও চুপ থাকতে পারলো না। বলে দিলো,
> আমি একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম এই বাড়ির ফ্লরে আমার বাবা মা আর শশুর শাশুড়ির হাতপায়ে শিকল দ্বারা বাঁধা হয়েছে। ওদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসবের মানে কি নূর?
কহিনুর মায়ের কথা শুনে পেছনে ফিরে বলল,
> ওটা তোমাকে বোঝানোর জন্য দাদুর সঙ্গে থাকা জ্বিনেরা দেখিয়েছিলো। যাতে তুমি সাবধান হয়ে এই বাড়ি থেকে দূরে চলে যাও। দাদিজান তোমাকে বলেছিলো নিজের স্বামীকেও যেনো বিশ্বাস না করো। কারণ তুমি তখনও জানতে না এই বাড়িতে বাবার মতো দেখতে আরও একজন আছে। দাদিজান ভেবেছিলেন তুমি জুবায়ের ফারুকী ভেবে জামসেদ ফারুকীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভুল কিছু করে বসতে পারো। চাচ্চু তখন ওদের বসে ছিল। উনি ক্লিয়ার কিছু বলতে পারেননি। উনার ভয় ছিল তখন তখন উনার কিছু হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া নিজের ছেলেদের জন্য উনি চুপচাপ সব সহ্য করছিলেন। উনাকে হুমকি দিতে চুপ রাখা হয়েছিলো। সুলতান বংশের এতো এতো টাকা প্রতিপত্তির মালিক উনার স্বামী ছিলেন। আরমান ফারুকী অভিশপ্ত ছিলেন বিধায় অনেকটাই উনাকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো। পরবর্তীকালে উনি নিজের স্বার্থে ভাইকে হ/ত্যা করেন। কালোজাদুর সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। উনি নিজের ইচ্ছেতেই এসব করেছেন।
কহিনুর থামতেই জুবায়ের এগিয়ে আসলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> আর জুহিকে হ/ত্যা?
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা থমকালো। এতো বছরে প্রেমিকার মৃত্যু রহস্য জানতে লোকটা এখনো আগ্রহী। জুবায়ের ওর দিকে তাঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। বউ ভুল বুঝতে পারে ভেবে ঢোক গিলল। কহিনুর বুঝতে পেরে বলল,
> ওটা আরমান ফারুকীর কাজ ছিল বাবা। তুমি যাতে পিছুটান ভুলে অধরা বারিকে সঙ্গ দাও তাই উনাকে আর উনার প্রেমিককে হ/ত্যা করা হলো। শয়তান সঙ্গে থাকলে এসব কুমন্ত্রণা দিতে সময় লাগেনা।
কহিনুর থামল সিঁড়ির দিকে তাঁকিয়ে।উপর থেকে ঐশ্বর্য আঁধার আর ওদের দাদু নেমে আসছে। কহিনুর মিষ্টি হেসে ওয়েলকাম জানিয়ে বলল,
> সুলতান ভিলাতে ভিলেনের পদচারনা পড়েছে। মালকিন হিসেবে আমি সাদরে আপনাদেরকে স্বাগতম জানাচ্ছি। কি বলেন?
আঁধার বিস্ময়কর দৃষ্টিতে কহিনুরকে দেখছে। মৃত্যু নিয়ে ওর কোনো আক্ষেপ নেই। জন্ম হলে মৃত্যু হবে চিরন্তন সত্য কথা কিন্তু কহিনুরের এমন সিদ্ধান্ত মানতে পারছে না। কিছুদিন আগেও কহিনুর কি সুন্দর করে ওর সঙ্গে প্রেম নিবেদন করেছে। হৃদয়ের কতটা কাছে ছিল আর আজ ওদের বিনাশে নেমেছে কিন্তু কেনো? আঁধার কিছু একটা সন্দেহ করেছে কিন্তু আপাতত সেটা মানতে রাজি না। কহিনুর আবারও মুখ খুলল। বিনয়ের সঙ্গে বলল,
> আঁধার আপনাকে আমি পাগল প্রেমিক নাম দিয়েছি। আপনার এইটুকু জ্ঞান হলো না কহিনুর কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়াবে না? ঐশ্বর্য নিজের চেহারা বদলে আমার রূপ নিয়ে আপনার সঙ্গে ডেট করেছে। যেটা আমার জন্য ভীষণ লজ্জার। আমি কষ্ট পেয়েছি। যদিও আপনিও কম না। পাথরের রূপ নিয়ে এসেছিলেন জাদুলিপি নিতে কিন্তু ওইযে আপনার চক্ষুদ্বয় আমাকে জানিয়ে দিলো আপনি পাথর না বরং অন্যকেউ।

কহিনুর বলতে বলতে হঠাৎ ডান দিক থেকে ছুটে আসা খ/ঞ্জরটা ধরে ফেলল। পেছনে ফিরে দেখলো আদি দাঁড়িয়ে আছে। কহিনুর হাসলো। খঞ্জ/রটা যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই ফিরিয়ে দিলো। গিয়ে বিঁধলো আদির বুক বারাবর। ওর শরীর থেকে মাং/স খসে খসে পড়ে একটা স্তুপ তৈরি হলো। কহিনুর ইশারা করলো জামসেদকে। জামসেদ দ্রুত গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। সেটা দেখে ঐশ্বর্য থরথর করে কাঁপছে। আঁধার সোজাসুজি কহিনুরের সামনে এসে থামলো। ওকে আসতে দেখে পাথর এসে কহিনুরের হাত ধরলো। আঁধার ওদের হাতের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> মরতে আমি ভয় পাচ্ছি না নূর। তুমি আমাকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দাও। আমার হৃদয়ের হাহাকার শোনার মতো কেউ নেই। বাবা মা থেকেও নেই। শরীর নামের এই যন্ত্রটাকে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ঘৃণা হচ্ছে। আমি মন থেকেই তোমাকে চেয়েছি বিশ্বাস করো। পাথরের ভাগ্য দেখে আমার হিংসা হয়। আফসোস লাগে। আমি হাপিয়ে উঠেছি।
আঁধার আরও খানিকটা এগিয়ে আসলো। দাদু ওকে পেছন থেকে আটকে দিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
> দ্রুত জাদুলিপি ফিরিয়ে দাও বলছি। আমাদের অভিশাপ কাটানোর কোনো দরকার নেই। আমার পূর্বপুরুষেরা ঠিক বলেছিলো কোন নারীর হাতেই আমাদের পতন ঘটবে। পাথর তুমি খান পরিবারের ছেলে হয়ে আমাদের বিনাশ করতে স্ত্রীর পক্ষ নিচ্ছো? ছিঃ তুমি কি পুরুষ মানুষ?
> যার শুরু আছে তার শেষও আছে মানতে চাইছেন না কেনো দাদু? এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে কতদিন আর পৃথিবীতে থাকবেন? কতশত মানুষের জীবন আপনারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নরকতুল্য করেছেন সেই হিসেবে আছে?
দাদু পাথরের কথা শুনলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে আসলো পাথরের দিকে। নক দ্বারা ওকে আঘাত করে বসলো। হঠাৎ আক্রমণের জন্য পাথর পিছিয়ে। কহিনুর চমকে গিয়ে হাতের খ/ঞ্জরটা বিধিয়ে দিলো লোকটার পিঠে। আগুন জ্বলে উঠলো। লোকটা নিজের রূপ পরিবর্তন করে অর্ধমানব হয়ে উঠলো। চারদিক থেকে কালো ধোয়া এসে গ্রাস করে নিলো সবাইকে। সেই সঙ্গে বাইরে থেকে কোরআন তেলোওয়াতের আওয়াজে মুখোরিত হয়ে উঠলো। মিনিট দশেক পর সবটা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। অর্ধমানবেরা কেউ এখানে নেই। পাথরকেও দেখা গেলো না। কহিনুর দূরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। অধরা ছুটে গিয়ে মেয়েকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিলো। কেঁদে উঠে বলল,
> নূর চোখ খুলে দেখো মা ভয় পাচ্ছে।
জুবায়ের দৌড়ে আসলো।
কহিনুর পিটপিট করে চোখ খুলল তবে নিশ্বাস নিয়ে কষ্ট হচ্ছে। ধীরস্থির ভাবে বলল,
> আমার মৃত্যু ছাড়া কহিনুরের মুক্তি মিলবে না মা। শেষ বিদায় অনেক যন্ত্রণার হবে তবে সেটা সকলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। আমার র/ক্তে ওটা মিশে আছে। কেঁদোনা প্লিজ।
কহিনুর চোখ মেলে দেখলো ওর থেকে কিছুটা দূরে পাথর দাঁড়িয়ে আছে। একপা দুপা করে ওর কাছে বসতে বসতে বলল,
> আমি জানতাম নূর তুমি আমাকে রক্ষা করতে চাইবে কিন্তু আমি তো সেটা মানতে পারিনি। তোমার আগেই আমি সেখানে তোমার আমার ভাগ্য লিপিবদ্ধ করেছি। তোমার সঙ্গে নিজের প্রাণটাকেও বিসর্জন দিয়েছি। তুমি যেমন সকলের মঙ্গল চেয়েছো আমিও চাই। পৃথিবীর সুন্দর হয়ে উঠুক। এসো আমার সঙ্গে।
পাথর হাত বাড়িয়ে দিলো ঠিক সেই সময় জাদুলিপিটা কহিনুরের সামনে এসে হাজির হলো। সেখানে বড়বড় অক্ষরে লেখা আছে, “অপেক্ষার শেষ প্রহরে ফিরে এসো দুজনে”।
কহিনুর কিছু বুঝতে পারলো না। পাথর বাঁকা হাসলো। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলো। পুলিশ এসেছে আরমান ফারুকীকে নিতে। কহিনুরের অন্তিমকাল উস্থিত হলো। জামসেদ চোখের পানি মুছে নিয়ে কহিনুরের হাত ধরে বলল,
> আমাদের ছেড়ে যেওনা। কষ্ট হবে মা।
কহিনুর থেমেথেমে বলল,
> কোথায় যাচ্ছি? এই যাওয়া হয়তো শেষ যাওয়া হবে না চাচ্চু। তোমার কহিনুর আবারও ফিরবে দেখে নিও। তার মধ্যে থাকা শক্তির মৃত্যু হবে না। ধৈর্য্য ধারণ করো। আমাকে যেতে দাও। কান্নাকাটি করোনা।
জামসেদ ফুপিয়ে উঠলো। এলোমেলো লাগছে সব। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
> সেই খুনি কে তুমি শুনবে না?
> না চাচ্চু আমি জানি ওটা আদি নিজেই ছিল। ঐশ্বর্যকে ক্ষেপিয়ে তুলতে এমন করেছে ঠিক না?
জামসেদ শব্দ করে কাঁদলো। অধরা হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেলো। জুবায়ের ওকে নিজের সঙ্গে আটকে রেখেছে। কহিনুর সেদিকে তাকিয়ে বলল,
> তোমরা ভালো থাকবে আমাকে মনে রেখে কষ্ট পেওনা প্লিজ। পৃথিবীতে যখনই কালো শক্তি আসবে কহিনুরও তখনই আসবে।
কহিনুর কথা বলতে বলতে চোখ বন্ধ করলো। সকলে কেঁদে উঠলো একমাত্র অধরা ছাড়া। ও শক্ত হয়ে বসে আছে। সবাইকে কাঁদতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
> কাঁদবে না কেউ। আমার মেয়েটার পথির্ব দায়িত্ব শেষ হয়েছে। আবারও ফিরে আসবে ও। কেউ কেঁদেকেটে ওর আত্মাকে কষ্ট দিওনা। দাফনের ব্যবস্থা করো।
জুবায়ের মেয়ের শোকে পাথর হয়ে গেলো। জামসেদ সব ব্যবস্থা করলো।
*******
কেঁটে গেছে দীর্ঘ পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে গেছে। সুলতান পরিবারের উপরে আর কোনো অশুভ শক্তির ছায়া নেই। মীরার দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। অধরার তিন বছরের একটা ছেলে আছে। কহিনুরের স্মৃতি সবাইকে তাড়া করে তবুও সবাই মানিয়ে নিয়েছে। কহিনুর বলেছিল ফিরবে অধরা সেই আশায় বুক বেঁধে আছে। ওর জানা নেই আদো সে ফিরবে কিনা। জুবায়ের ছেলেকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলো হঠাৎ বৃষ্টির জন্য ফিরে এসেছে। কক্ষে ফিরে অধরাকে চুপচাপ জানালার দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে বলল,
> মন খারাপ?
অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
> মেয়েটা ফিরবে বলেছিলো তাইনা?
> ওসব মনে করে আবারও কষ্ট পাচ্ছো তুমি? আমার মেয়েটাকে একটু শান্তি দাও প্লিজ। ফিরবে বললেই কি ফেরা যায় বলো? ওর শক্তি ফিরবে ও না।বোঝো না কেনো তুমি? শুনো না মন খারাপ করোনা।
অধরা পেছনে ফিরে জুবায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,
> ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দুহাতে আগলে ওকে বড় করেছি। আপনি ছিলেন না। এতো কিছুর পরেও ওকে নিজের কাছে রাখতে পারলাম না। মায়ের মন।
জুবায়ের কথা বলল না অধরাকে আগলে রাখলো। কষ্ট যে ওর হচ্ছে না এমন না। মন থেকে কিছুতেই মেয়েটাকে ভুলতে পারেনি।
*****
নির্জন বটবৃক্ষের ছায়াতলে এক যুবক অদ্ভুত টাইপের নগ্ন মূর্তির কপালে নিজের আঙুলের রক্ত দিয়ে তিলক পরিয়ে দিয়ে উচ্চারণ করলো,
“সাহায্য করো হে প্রভু আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি। বিনিময় করতে আমি রাজি আছি। কি চাই আপনার?”
লোকটার প্রার্থনা শুনে হঠাৎ চাঁদরে মোড়ানো এক লোক এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। ভয়ংকর হেসে উত্তর দিলো,
> সুখের ঘরে আগুন লাগাও রক্ত দিয়ে ভোজন করাও। কহিনুরের প্রকাশ ঘটাও।
কথাগুলো বলে লোকটা আবারও হাসলো। সেই হাসির মানে বোঝার সাধ্য কারো নেই। কহিনুরের প্রকাশ না ঘটলেও শয়তানের প্রকাশ নিশ্চয়ই ঘটবে। সেখানে নতুন কোনো রহস্যের জ্বাল বুনন করার প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গেছে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here