#রোদেলা
লেখা: #মাহাবুবা_মিতু
৭৬.
সিমিদের বাড়ির সবার দাওয়াত ছোট ননদের ছেলের আকীকা অনুষ্ঠানে । সিমি রয়ে গেছে অসুস্থ হওয়ায়, আর এই বিশাল বাড়ি পাহাড়ায়। তাই ছেলেকে তিনতলায় দিয়ে এসে সোজা রান্নাঘরে চলে যায় ও। সাড়ে এগারোটা বাজে, ওদের জন্য খাবার আসবে ঐ বাড়ি থেকে, তাই রান্নার ঝামেলা নেই। হালকা নাশতা তৈরীর জন্য চুলা জ্বালায় ও। কি করা যায় ভাবতেই রোদেলার পছন্দের হোয়াইট সস পাস্তা তৈরির জন্য মন স্থির করে। রোদেলা রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ শুনে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে-
: কিরে কি শুরু করলি…?
: বেশী কিছু না, হালকা নাশতা, তুই বোস আমি আসছি।
: আরে ধ্যাত…! আমি কি খেতে আসছি…?
চুলার গ্যাস বন্ধ করে বিরক্তিতে বলে-
: আয় তো।
: জাস্ট ফিফটিন মিনিট, দোস্ত।
ঘরে না ফিরে সিমির সামনে টুল টেনে বসে রোদেলা, ওর এ ভঙ্গিটায় ও যে একটুও বদলায় নি তা অকপটে প্রকাশ পায়। তারপর বলে-
: প্রিসিলার বিয়েতে গেলিনা কোনো?
বিশাল সাইজের এক বটিতে হলুদ রঙের ক্যাপসিকাম কাটতে কাটতে সিমি বললো-
: কিছুটা তোর সাথে রাগ করে, কিছুটা পরিস্থিতির কারনে,
: পরিস্থিতি?
: হুম, তোর ভাইয়া একটা ঝামেলায় পরলো হঠাৎ, সেসব পরে বলবো নি আগে তুই বল কিভাবে লুকিয়ে রাখলি নিজেকে এই খোলামেলা পৃথিবীতে…?
: পার্থিব উপন্যাস পড়েছিস?
: নাহ, এত বড় বই, তাই শুরু করার সাহস হয়নি…
: সেখানে একটা কথা আছে-
“মানুষের পালানোর সবচেয়ে বড় জায়গা হলো তার মন।।যদি সেখানে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দিতে পারিস তা হলে আর কেউ তোর নাগাল পাবে না”
আমি তাই করেছিলামরে, তাই কেউ আমার নাগাল পায় নি…
: পায় নি কে বললো….? সুফিয়ান তো ঠিক খুঁজে বের করে ফেললো।
মুচকি হাসে রোদেলা, যেন এটাই তার উত্তর।
: অনেক ভালোরে লোকটা, তোদের দুর্দিনে পাশে ছিলো ছয়ার মতো, যতদুর জানি- তুই তাকে পছন্দ করিস না, তবুও তাকে বিয়ে করে ভালোই করেছিস,
: আমি ওকে ভালোবাসতাম না তা ঠিক, কিন্তু পরবর্তীতে আমি ওকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেছিলামরে। এ ভালোবাসাটা এমনি পাওয়া না, অর্জিত। ও এটা জিতে নিয়েছে।
: তোদের বিয়ে নাকি ফোনে হয়েছিলো…?
: হুম, ওর ইংল্যান্ডে যেতে কাগজপত্রের কিছু ফর্মালিটি ছিলো, তাই ফোনে বিয়ে করে, ম্যারেজ সার্টিফিকেট নিয়ে, কাগপত্র তৈরী তারপর সেখানে গিয়েছে। যদিও ইল্যান্ডে আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল। শাহনাজ আন্টি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে আমাদেরকে বিদায় দেয়। বিয়ের পর আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে উঠি।
সিদ্ধ করা পাস্তা তৈরি করা সসে ঢেলে দিতে দিতে সিমি বললো-
: বাহ্, তোদের বিয়ের ছবি রিমি আমাকে পাঠিয়েছিলো প্রথমে। রিমির বোন তো আবার প্রিসিলার সাথে পড়ে।
: হুম,
: যা ঘরে গিয়ে বস, আমি এগুলো সার্ভ করে আনছি।
রোদেলা ঘরে ঢুকে বারান্দায় চলে যায়। চারতলা এই বাড়ির বারান্দাটা বেশ বড়। এখান থেকে দাঁড়িয়ে দূরে থাকা মগবাজার ফ্লাইওভার দেখা যায়। ফ্লাইওভারটা দেখে হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পরে যায় রোদেলার-
এইখানে শেষ যেবার এসেছিলো সেবার ওর মানে রানী নামের ঐ মেয়েটির মৃ*ত্যু হয়েছিল। সেই এক্সিডেন্টটা ও দেখে নি,জানতোও না এসবের কিছুই। অনেক পরে যখন ঘটনাটা সবার মুখে মুখে চাউর হলো, রুবিন আঙ্কেল তখন বলেছিলো ঘটনাটা, তখন ও জেনেছিলো তার আগ পর্যন্ত কিছুই জানতো না। রানী নিজে মরে যেন ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো সবার নজর থেকে৷ তারপর আর ওর কথা মনে হয় নি।
তারপর তো দৌড়ে নামলো ও। নিজের পরিচয় তৈরীর, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দৌড়। তখন এসব ভাবার কোন অবকাশই ছিলো না। কত কত দিন লাঞ্চ আর ডিনার একসাথে করেছে কাপ নুডলস খেয়ে।
জীবণের এই দৌড় যখন শেষ হওয়ার পথে, সুফিয়ান যখন জীবণ নামের এই দৌড়ে ওর পাশে দাঁড়ালো কষ্ট আর না বলা কথাগুলো ভাগ করে নিতে তখন ও যেন একটু ফুরসত পেলো কোন কিছু ভাবার। রানী নামের ঐ মেয়েটির মুখ তখন ভেসে উঠতো চোখে। জ্যামের মধ্যে রিকশায় বসে থাকা অবস্থায় ওর বয়সী একটা মেয়ে কোত্থেকে এসে ব্যাগট টেনে দৌড় দিলো। এক পলকের দেখা ছিলো সেটা। ভয় আর ঘৃণা মিশ্রিত ছিলো দেই দৃষ্টি। পরে সব জানার পর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার পর অনেক পীড়া দিতো ওকে এই ব্যাপারটা ।
একটা মানুষ ম*রে* ওকে বাঁচিয়ে গেলো, কিন্তু ওর পরিবার কারো মাধ্যমে জানাতে পারলো না ওর মৃ*ত্যু খবর একটু যখন গুছিয়ে উঠলো ওরা তখন সুফিয়ানকে বলেছিলো এ ব্যাপারে মেয়েটার খোঁজ করতে। বেচারা সুফিয়ান অসাধ্য সাধন করেছে। প্রায় সাত মাস খোঁজাখুঁজির শেষে রানীর পরিবারের খবর পেয়েছিলো। তাদেরকে দিয়েছিলো তাদের নিখোঁজ মেয়ের খোঁজ।
পুলিশ প্রথমে সাহায্য করতে চায় নি, সুফিয়ানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদেয় করেছিলো। কিন্তু রোদেলা নিখোঁজ হওয়ার সময়ে পুলিশি তদন্ত সুবাদে সেই জোনের ওসির সাথে পরিচয় হয়েছিলো সুফিয়ানের, তাছাড়া ইমোশনালি দেখলে ব্যাপারটা গুরুতর। শেষ পর্যন্ত তারা সহযোগীতা করেছিলো। একপ্রকার অসাধ্য সাধন করেছেন তারা। কারন রানী নামের মেয়েটা ঐ এলাকার ছিলো না। তাই তাদেরকে বেগ পেতে হয়েছিল।
এপিটাফ বদলানো হয়েছে সেই কবরের। এপিটাফ আর কি একটা টিনের টুকরোতে মৃ*তে*র নামধাম জন্ম আর মৃত্যু তারিখ লেখা ছিলো। পরিবারের যে অবস্থা ছিলো তখন ঐ টিনের টুকরো তে লেখাও বিলাসিতা পর্যায়ের। আবার পাথরের এপিটাফ…!
পরে অবশ্য বাঁধাই করা কবরে পাথরে খোদাই করা এপিটাফ জুড়ে দিয়েছে রোদেলা নিজ খরচে। রোদেলার পরিবর্তে নাম উঠেছে রানীর। রানীর বাবা-মা সিরাজগঞ্জ থেকে সেই একবার এসেছিলো কৃষ্ণচূড়ায়। তাদের মেয়ে রোদেলার ব্যাগ চুরি করে বাসের নিচে চাপা পরেছে ব্যাপারটা তাদের জন্য ও লজ্জার। তাই হয়তো আর আসে নি এ দিকটাতে। তাছাড়া তাদের পরিবারের অবস্থা ও ভালো না, ভাত জুটেনা যে সংসারে সেখানে এতদূর বয়ে এসে মৃ*ত মেয়ের কবর দেখা তাদের জন্য হয়তো বিলাসিতা পর্যায়ে পরে।
এ ঘটনা প্রসঙ্গে সুফিয়ান রোদেলাকে বলেছিলো-
: বর্তমানে দেশের পুলিশ খুবই এডভান্স। তারা চাইলে দেশের সকল মিস্ট্রি কেস সলভ করতে পারে। পারিপার্শ্বিকতা তাদের হাত আটকে রাখে। তাই তারা তাদের সর্বোচ্চ মেধা, শ্রমটুকু দিতে পারে না।
রোদেলাও তাই বিশ্বাস করে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে মিস্ট্রি বলে কিছু নেই। চোর বা খু*নি যত চালাকই হোক না কেন কোন না কোন ক্লু সে রেখে যাবেই। যদিও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ আসার আগেই প্রমাণ ইচ্ছাকৃত হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক নষ্ট হয়ে যায়।
এসব ভাবতোই সংবিৎ ফিরে সিমির ডাকে, জোর গলায় ও আওয়াজ দেয়
: রোদেলা ঘরে আয়।
ঘরে ঢুকে ও অবাক। এইটুকু সময়ে ও হোয়াইট সস পাস্তা, চিকেন নাগেটস, আর স্যান্ডুয়েচ তৈরী করে ফেলেছে। এসব দেখে রোদেলা বলে-
: কিরে চুলায় দেখলাম শুধু পাস্তা, বাকীগুলো কখন করলি…?
: আরে ছেলের স্কুলে নাস্তা দেই তো তাই এসব অর্ধেক তৈরী করাই থাকে। আয় বস…।
: বাব্বাহ্… তুই তো সেই কাজের হয়ে গেছিস…! অথচ বিয়ের আগে পানিও ঢেলে খাইয়েছে তোর মা।
: হ্যারে…, এ ব্যাপারটাই কষ্ট দেয়।
এখন কত কাজ করি, অথচ নিজের মাকে আরাম দিতে পারি নি কখনো, খাটিয়ে মেরেছি সবসময়।
: থাক এ ভাবে ভাবসি কেন? এখন এসব ভেবে কি হবে, তুই তোর শ্বাশুড়িকে দেখাশোনা করছিস, সংসার আগলে রাখছিস, নিশ্চয়ই আল্লাহ আন্টিকেও এমন লক্ষ্মী বৌমা জোগাড় করে দিবে।
: আমীন..
: তারপর….,
: তারপর তুই বল সুফিয়ান তোকে খুঁজে পেলো কিভাবে…?
: সে তো লম্বা কাহিনী,
: বল শুনি, হাতেও তো লম্বা সময়, এখন শুধু গল্প করবো দুজনে, খাবার পাঠিয়ে দিবে ও বাড়ি থেকে৷ এখন আমি পুরো ফ্রী। বল বল…
তারপর রোদেলা শুরু করলো সুফিয়ানের সেই রোমাঞ্চকর জার্নির গল্প। যেন কোন গল্পগাথা।
ইকুরিয়া টু ইংল্যান্ড…. এর গল্প—
” মগবাজেরে এ*ক্সি*ডে*ন্ট, ম*র্গে*র সামনে রানীর লাশ, পায়ের পাতা ইজিপশিয়ান ধরনের ছিলো না, তাতে না ছিলো মেহেদীর রঙ, সেই বিশ্বাস অবলম্বন করে খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মতো করে এত বিশাল পৃথিবীতে রোদেলাকে খুঁজে বের করার কথা । কলেজে খোঁজ করা, সেখান থেকে শাহনাজ আন্টির নম্বর জোগাড়, মোবাইল ট্রেস করার বছরের মাথায় কনভোকেশনের ছবি পাওয়া।
বাদ যায় নি ফ্লাওয়ার কাপ রেস্টুরেন্টের সেই কথোপকথন, বিস্ময়, সহানুভূতি আর ভালোবাসা মেশানো সেই দৃষ্টির কথা। সুফিয়ানের কাছে ওকে খোঁজার কারন জানতে চাওয়া, শেষের দিকে ভুল বোঝাবুঝি, গাড়িতে সুফিয়ানের মায়ের রেখে যাওয়া চুরি আর চিরকুট ফেলে যাওয়া, পরদিন এয়ারপোর্টে দু’জনের এক হওয়ার সেই মধুর গল্প। রোদেলার চোখের সামনে ভেসে গেলো সেই দিনগুলোর ছবি।
: তুই অনেক ভাগ্যবতীরে, জীবণের দৌড়ে মানুষ অর্ধেক এগিয়ে যায় সঠিক জীবনসঙ্গী পেলে। তুই তো অর্ধেক পাজল নিজেই মিলিয়ে ফেলেছিস, বাকীটা সুফিয়ান জুড়ে দিয়েছে।
: সত্যি..?
: হুম, দেশে কে মেয়ের অভাব? আর তুই আহামরি কিছু ও না, তবুও সুফিয়ান তোকে খুঁজে বের করাটা প্রয়োজন মনে করেছে।
: সত্যিরে, জীবণে বলার মতো কিছু যদি পেয়ে থাকি, তবে সেটা “আবু সুফিয়ান”। আল্লাহুমা বারিক লাহা…
চলবে….