বৃহস্পতিবার। রাত দশটা ঊনত্রিশ। গল্প পড়ার এবং দেওয়ার পারফেক্ট সময়। তবে আজ আমি কোনো বানানো গল্প দেবো না। কল্পনার অথৈ সাগর হাতড়ে তৈরি করবো না কোনো অবাস্তব অস্তিত্ব। আজ আমি দেবো আমার নিজের গল্প। আমার বাস্তব অনুভূতির গল্প। যেই অনুভূতির জন্ম হয়েছিল আজ থেকে আরো সাড়ে আট বছর আগে। হুম…চৌদ্দ বছর। আমি আমার জীবনের ফার্স্ট ক্রাশটা খেয়েছিলাম ঠিক চৌদ্দ বছর বয়সেই। সেদিন খুব মুষল ধারে বৃষ্টি হয়েছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস ফাইট। স্বচ্ছ কাঁচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আমি অলস দুপুরের অলসতা নিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর তখন আমার আর মায়ের দেঢ়েক বছর। বাবা আরও আগে থেকেই সেখানে আছেন। কিছুদিন হলো আমার পরিবার নিজেদের অর্ধেক জীবনের সঞ্চয়ে ফ্লোরিডায় একটি পুরনো বাড়ি কিনেছে। সেদিন ছিল নতুন পুরনো বাড়িতে আমাদের তিনদিন। এই তিনদিন পুরনো বাড়িতে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করতে করতেই কেটে গেছে। আমার রুম গোছানো প্রায় শেষ। তাই বাবা মা যখন ওমন বৃষ্টির দুপুরে ডাইনিং হলে সোফা সঠিকভাবে সেট করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল নিতান্তই কিছু করার নেই বলে তখন আমি আমার রুমের জানালার পাশে কাঠের মেঝের উপর দাঁড়িয়ে বৃষ্টি শেষ হবার অপেক্ষায় ছিলাম। বৃষ্টি থামতে থামতে বিকেল হয়ে এলো। অঝোর ধারার বৃষ্টির পর আকাশটা একটু পরিষ্কার হয়ে তার ঝলমলে রশ্মি ছড়িয়ে দিলে আমি ব্যাকইয়ার্ড থেকে আমার গোলাপি রঙের সাইকেলটা নিয়ে বের হলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আমার পরনে হালকা নীল রঙের সুন্দর ফুল তোলা একটা স্কার্ট ছিল। মাথার খোলা চুলে ছিল হলুদ রঙের কাপড়ের ব্যান্ড। আমি প্রসন্ন মুখে ধীর গতিতে ফ্লোরিডার ভেজা পিচের রাস্তা জুড়ে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে আকাশটা ছিল কি চমৎকার! মুষলধারের বৃষ্টিতে আকাশটা যেন ধুয়ে মুছে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ঝকমকে নীল আকাশে ভাসমান পেজোর মতো মেঘগুলোর আড়াল থেকে বিকিরিত উঞ্চ রোদ যেন তাই প্রকাশ করছিল। যাকে বলে সানশাইন… বিউটিফুল সানশাইন। সেই সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করতে করতে আমি আমার ছোট্ট সাইকেলটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আর আশপাশটা দেখছিলাম। রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে চকচক করছিল। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ করে পরা বৃষ্টির বিন্দুর মতোই হঠাৎ করে আমি যেন কিভাবে রাস্তার পিচ্ছিল অংশে ফেঁসে সাইকেল নিয়ে পাশেই ঘাসের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার দু হাত বৃষ্টির কর্দমাক্ত পানিতে পড়ে নোংরা হয়ে গেলো। সূর্যের সেই ঝকঝকে তীক্ষ্ণ রশ্মি একদম এসে পড়লো আমার মুখ বরাবর। নিজেকে ধাতস্থ করে নেওয়ার সময়টুকুর মধ্যেই হঠাৎ সূর্যরশ্মি আড়াল করে একটা সুপ্রশস্থ সুন্দর হাত আমার চোখের সামনে দেখতে পেলাম। হাতের অনুসরণে সামনে তাকাতেই নজরে পড়লো উনিশ কি বিশ বছরের একটা ছেলে ঝুঁকে আমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে রেখেছে। সেই মুহুর্তটায় আমার কি হল জানি না। আমার চোখ আটকে গেলো, সেই ডার্ক চকলেট কালারের টি শার্টের উপর বোতাম খোলা কফি কালারের শার্ট গায়ের সুদর্শন ছেলেটার দিকে। আমি হিপনোটাইজ হওয়ার মতো করে তার দিকে আস্তে আস্তে আমার হাতটি বাড়িয়ে দিলাম। সে আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। তারপর স্মিত হেসে চলেও গেলো। আমি তখনো তার যাওয়ার পানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তার মাথার উপরের স্বচ্ছ নীল আকাশে ততক্ষণে ভেসে উঠেছে একটা সুন্দর রংধনু। আর সত্যি বলতে আমার মনেও। মাঝে মাঝে একটি ক্ষুদ্র ঘটনা সারা জীবনটাকে প্রতিফলিত করে বেড়ায়। আমার কিশোরী জীবনের সেই ক্ষুদ্র ঘটনা কতটুকু কি আমি জানি না। শুধু জানি সেই যে সেই বৃষ্টি শেষের রৌদ্রজ্বল বিকেলে ফ্লোরিডার ভেজা পিচ্ছিল রাস্তায় চৌদ্দ বছরের কিশোরী আমি গোলাপি রঙের সাইকেলটি নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম সেখান থেকে আমি আজও উঠতে পারিনি। সেদিনের সেই হাতের স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। সেটিই ছিল আমার জীবনের ফার্স্ট টাচ এন্ড ফার্স্ট ক্রাশ।
এরপর? এরপর….আমি জানতে পারি সেই ছেলেটার বাড়ি আমাদের বাড়ির কাছেই। ছেলেটা আমার নেইবার। ছেলেটার নাম রাইয়ান।
রাইয়ান! এই নামটা আমি যখনই লিখি অথবা যখনই শুনি অথবা যখনই উচ্চারণ করি সবসময় আমার অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠে। যেমন এই মুহুর্তে। রাইয়ানও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রীয় বাঙালী। তাদের তিন পুরুষ ধরে তারা এখানে আছে। সে তার দাদীমার সাথে থাকে। তার সাথে আমার প্রথম দেখার পর আমি জানতে পারি সে ফ্লোরিডার একটা নামকরা ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ক্লাস স্কলারশীপ নিয়ে পড়ছে। পড়ালেখায় দারুণ মেধাবী। স্টুডেন্ট লাইফে সবকটা সাইন্স প্রজেক্টে সে প্রাইজ আনতো। এককথায় ব্রিলিয়ান্ট যাকে বলে। আর আমি মাত্র তখন মিডল স্কুলের স্টুডেন্ট। আমার আধপাশ পড়ালেখার কথা আর নাই বা বললাম। সে খুব ভালো গিটার বাজাতে পারে। বাস্কেট বল খেলায়ও সে দুর্দান্ত। ক্লাস টেনে একবার ক্লাস বাঙ্ক করে আমি লুকিয়ে তার ইউনিভার্সিটিতে বাস্কেট বল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম। সেলিব্রেটি ফলোয়ারের মতো আমি তার সব খবর রাখি। ভাগ্যবশত তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িটা নজরে না পড়লেও আমার রুমের জানালা দিয়ে তাদের বাড়ির প্রধান ফটক পরিষ্কার দেখা যায়, আর দোতলায় থাকা তার রুমটাও। সে ঠিক কখন কখন বাসা থেকে বের হয়, রাতে কখন বাসায় ফেরে, ঘুমানোর আয়োজনে ঠিক কয়টা বাজে তার রুমের লাইট বন্ধ হয় সব আমার জানা। যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছিল কবে সেটা আজ অবদি মাথায় না রাখতে পারলেও তার ডেইলি রুটিন আমার একদম মুখস্থ। মর্নিং এক্সারসাইজ আমার অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র তার জন্য সকাল সকাল কানের কাছে বিকট অ্যালার্মের শব্দ সহ্য করে আমি জগিং করতে বেরোই। তার প্রতিদিনের গন্তব্য কংক্রিটের বিশাল ব্রিজটার উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আর অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করি। সকালে দৌড়াতে আসা একটা দুটো তিনটে মানুষের মাঝে যখন তারও দেখা মিলে লাজুক মুখটি লুকিয়ে আমি চুপচাপ মিটিমিটি হাসতে থাকি। তারপর সে যখন আমাকে অতিক্রম করে খানিক এগোয়, আমিও তার পিছু নেই। শাব্দিক অর্থে আমি প্রতিদিন তার পেছনে দৌড়াই। আর প্রতিদিন ভাবি যে সে একবার হলেও হয়তো একদিন পেছনে ফিরে তাকাবে! বাট মাই ব্যাড লাক, সে কখনো পেছনে ঘুরে তাকানোর মানুষ না। তার দৃষ্টি সবসময় থাকে সামনে। তাই না সে পেছনে তাকায় আর না আমি তার নাগাল পাই!
সে একদম পারফেক্ট। স্মার্ট, ইনটেলিজেন্ট, হ্যান্ডসাম। আর আমি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। পড়ালেখা শেষে সে এখন একটি নামকরা কোম্পানিতে খুবই ভালো পোস্টে জব করছে। আর আমি কোনমতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে…..ওহ, দুঃখিত! আমার আসল নামটাই তো এখনো বলা হয়নি। আমার নাম হৃদি। হৃদি নামেই আমি আমার আশেপাশের মানুষের কাছে পরিচিত। একটু বুঝি সামান্য ভুল হয়ে গেলো! কারণ ডাকনাম আমার হৃদি হলেও ইউএসএ আসার পর এখানকার স্থানীয়রা আমার সুন্দর নামটাকে হৃদি থেকে বানিয়ে দিয়েছে রিডি। দু চারজন বাঙালি পরিবার ছাড়া আমার নামটাকে এভাবে বিকৃত উচ্চারণেই আমাকে সবসময় শুনতে হয়। খুবই দুঃখজনক!
তো যেখানে ছিলাম, আমি হৃদি। সদ্য গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা একটি প্রাণবন্ত, হাস্যজ্জ্বল মেয়ে। আমার নেইবারহুডে আমার আরেকটি পরিচয়ও আছে, সুইট গার্ল। আমাকে সবাই ভালো জানে। কারণ আমি খুবই মিশুক এবং আমি সাহায্য করতে ভালোবাসি। আমার মনে হয় তারা আমার জন্য কিছুটা পিটিফুলও (Pitiful)। এর কারণ আমি সম্পূর্ণ একা। চার বছর হলো একটি দূর্ঘটনায় আমি আমার বাবা মা দুজনকেই হারিয়েছে। সময়টা তখন কঠিন গেলেও আমি এখন নিজেকে সামলাতে পেরেছি। জব করা আমার পছন্দ নয় তাই গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি নিজের একটি কফিশপ খুলেছি। যদিও কফিশপটি ছোট এবং কাস্টমারের সংখ্যাও খুব বেশি নয় তবুও আমি সন্তুষ্ট। বুঝতেই পারছেন, আমি খুবই খুবই সিম্পল একটি মেয়ে। আমার এই সাধারণ জীবনে সবথেকে অসাধারণ ব্যাপারটিই হলো রাইয়ান। তার কথা ভাবতেই আমার ভালো লাগে। তাকে দেখতেই আমার ভালো লাগে। তাকে ভালোবাসতে আমার ভালো লাগে। তার প্রতি আমার অনুভূতির রেশ ধরেই এই অনলাইনের গল্পের জগতে আমার পা রাখা। আমার গল্পের প্রতিটি নায়কের চরিত্রে আমি তাকেই খুঁজে বেড়াই। ভালোবাসার ব্যাখা দেই। যদিও আমি কখনো তার সামনে যাইনি। সে হয়তো জানেও না তার নেইবারহুডে হৃদি নামের একটি মেয়ে আছে যে তাকে রোজ ফলো করে। সে আমার কাছে ঠিক আকাশের চাঁদের মতো। যাকে রোজ দেখা যায়, দেখে দেখে মুগ্ধ হওয়া যায়, কিন্তু তার কাছে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্খা কখনো মনে আসে না। এভাবেই কোনধরণের এক্সপেক্টেশন ছাড়া, কোনপ্রকার স্বার্থ ছাড়া আমি তাকে এই সাড়ে আট বছর ধরে শুধু দূর থেকেই ভালোবেসে যাচ্ছি। সিক্রেট লাভেও একটা আনন্দ আছে। আমি সেই আনন্দ পুরোপুরি উপভোগ করছি। আমি কখনো আশাও করিনি তার নজরে আমি কোনদিন আসবো। কিন্তু ভাগ্য বলতেও তো একটা শব্দ আছে। নতুবা, তার দাদীমা হঠাৎ আমাকেই তার নাতবউ হওয়ার প্রস্তাব দেবে তা কে জানতো!
চলবে,
#My_First_Crush
#পর্ব- ০১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি