এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_৪২

0
399

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
মাশরিফ আজকে সেনানিবাস থেকে মির্জাপুরে ফিরল। প্রথমে মায়ের চিন্তিত মুখে স্বস্থি ফেরাটা তার দেখার ইচ্ছে। পরেরদিন তিতিরদের ওখানে যাবে। মায়ের কোয়াটারে গিয়ে দেখল তার বোন রিতিকাও সেখানে আছে। মাশরিফকে দেখামাত্রই মহিমা বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। মনের ভয়টা নিমিষেই শূণ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। ছেলের জন্য আজ তার ভীষণ গর্ব হচ্ছে। ছেলে যে তার বাবার কথা রাখতে পেরেছে। সায়ান এসে মাশরিফকে আলিঙ্গন করে বাহবা দিল। কিন্তু রিতিকা এখনো সোফায় এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে। মাশরিফ বোনের এই নীরবতা দেখে খানিক অবাক হলো। অতঃপর বোনের কাছে গিয়ে বোনের পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল,

“কী হয়েছে তোর আপু? তোর কি কোন কারনে মুড অফ? তুই কি আমাকে দেখে খুশি হসনি?”

রিতিকা হকচকিয়ে ওঠল। সে দ্রুত তাড়াহুড়ো করে জবাব দিল,
“না না আমি খুব খুশি হয়েছি। তুই সুস্থ ভাবে বিজয়ী হয়ে ফিরেছিস। আমি ভীষণ খুশি। তুই পারলে আমাকে মাফ করে দিস। আমি জানতাম না যে কাশফা এতটা নিচু মনের মেয়ে। আমি জানতাম না ও তোর ক্ষতি করতে চাইবে। সত্যি জানতাম না। জানলে আমি কখনোই ওর পাশে থাকতাম না। আমার এখন নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। এই কাশফার জন্য আমি তোর সাথে, মায়ের সাথে, সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। আর এই কাশফা কিনা আমার নিজের ভাইকেই মে*রে ফেলতে চেয়েছিল!”

মাশরিফ মুচকি হাসল। তার বোনটা যে সহজ সরল সে তা বোঝে তার বোনকে যে কেউ নিজের কথায় মায়াজালে জড়িয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া কাশফা মেয়েটাই এমন যে অন্যকে নিজের মায়াজালে জড়াতে বাধ্য করে। মাশরিফ তার বোনের গালে হাত রেখে বলল,

“আপু, আমি তোর প্রতি একটুও রেগে নেই। বলতে গেলে আমার তোর সাথে কোন বিবাদই ছিল না। আমি তো জানতাম কাশফা মেয়েটাই আমার বোনকে নানা কথা বুঝিয়ে এরকমটা করেছে। না হলে আমার বোন এরকম না।”

রিতিকা মলিন কন্ঠে বলল,
“তিতিরও নিশ্চয়ই আমাকে মনে মনে খুব খারাপ ভাবছে। তাই নারে? আমি ওর কাছে গিয়ে মাফ চাইব। আজকে যাবি? আমিও তোর সাথে যাব। আমি গিয়ে মাফ চাইব ওর কাছে। আমি ওর সাথে ঠিকমত কথা বলিনি, হাসি মুখে কথা বলিনি। আমি জানি ওর খারাপ লেগেছে। আমার যে কি হয়েছিল! যে কাশফা যা বলতো তাতেই আমি ইমোশনাল হয়ে পরতাম। ওর প্রতি একটা সফট কর্নার সব সময় মনের মধ্যে থাকত।”

“আরেহ আপু, তিতির তোকে কিছুই মনে করেনি। তুই তো আর ওকে কটু কথা বলিসনি। হ্যাঁ তোর কণ্ঠে একটু রূঢ়তা অবশ্যই ছিল। এখন পরেরবার ওর সাথে দেখা হলে হাসিমুখে সুন্দর করে কথা বললেই দেখবি ও আগের সব ভুলে গেছে।”

মাশরিফ রিতিকাকে বোঝানোর সময় রিয়ান বলে ওঠে,
“মা তুমি চিন্তা করো না। মামি অনেক সুইট। সে তোমাকে ব*কবে না। জানো সে আমাকে কতো আদর করে।”

ছেলের কথা শুনে রিতিকা হালকা হাসে। ওদের কথা-বার্তার মধ্যেই মহিমা বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,
“এই তোরা জলদি হাত-মুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি টেবিলে খাবার লাগাচ্ছি। আর মাশরিফ তুই ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় বদলে ফ্রেস হয়ে দ্রুত নামাজটা পড়ে আয়। বিকেল হয়ে যাচ্ছে।”

মাশরিফ মাকে একবার জড়িয়ে ধরে ফ্রেশ হতে চলে গেল। নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রেখে তিতিরকে মেসেজ করে দিল সে পৌঁছে গেছে।

এদিকে তিতির মাশরিফের দেওয়া মেসেজটা পড়ে মুচকি হাসল। এতটা সময় সে এটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এখন সে তার ফ্রেন্ডের বলছে,
“এই ক্যান্টিনে চল। ভীষণ খিদে পেয়েছে।”

ইমরান বলে ওঠে,
“আধা ঘন্টা আগে যখন আমরা খেতে গিয়েছিলাম তখন গেলি না কেন? তখন লাইব্রেরী তো চলে আসলি কেন পড়ার জন্য? তখন তো খুব বলেছিলি তোর পেটে খিদে নেই। তো এখন আবার খিদে কোত্থেকে আসল? আধা ঘণ্টার মধ্যেই খিদে পেয়ে গেল?”

তিতির কি বলবে? আমতা আমতা করছে সে। সে বোকার মত হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তখন খিদে ছিল না। তাছাড়া আমরা মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমাদের বুঝতে হবে, সবার পরিপাক ক্রিয়া এক সময় হয় না। মাঝেমাঝে কিছু কারণে তেরি হয়। তখন খিদেও দেরিতে লাগবে। স্বাভাবিক না!”

“হুম খুব স্বাভাবিক। এখন নিজে গিয়ে নিজের স্বাভাবিক খাবার খা। আমাদের সাথে এতো বলার পরও একটু অস্বাভাবিক ভাবে খেতে গেলি না। এখন তোর জন্য যা স্বাভাবিক তা আমাদের জন্য অস্বাভাবিক।”

ফাইজা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তিতিরকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে কথাটা বলল। তিতির ইনোসেন্ট মুখ করে বলল,
“ঠিক আছে। আমি একাই যাব। থাক তোরা।”

নাদিয়া বলে ওঠে,
“হইছে থাম। চল। আমিও যাব।”
একে একে সবাই একই কথা বলে। জারিন বাঁকা হেসে বলে,
“তুমি যে তখন কেন যাও নাই তা কি আমরা বুঝি নাই? মেসেজ দেখে এখন বলো যাবা। একটা গান আছে না? বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা! শুধু পার্থক্য একটাই, প্রকৃতিতে বসন্ত চলে গেছে কিন্তু তোর মনে বসন্ত রাঙিয়ে গেছে।”

জারিনের এহেনো কথায় বন্ধুমহলে হাসির রোল পরল ঠিক কিন্তু একজন লজ্জাবতী লতার ন্যায় চুপসে গেছে।

________

খেতে বসে মহিমা বেগম বলেন,
“কাশফার পরিবার নাকি ওদের টাঙাইলের বাড়িটা বিক্রি করে দিবে। ওদের মামা নাকি খালা কে যেন কানাডাতে আছে। সেখানে চলে যাবে। কাশফাকে জেল থেকে মুক্তি দিলেই চলে যাবে। মেয়ের জন্য ওদের দুর্নাম রটে গেছে। এখন বিবাহ উপযোগ্য মেয়েকে তো এই দেশে বিয়ে দিতে পারবে না। তাই চলে যাবে।”

মাশরিফ খেতে খেতে বলে,
“এতোটা আদর ও ছাড় দিয়েছে বলেই এই অবস্থা। মেয়ের স্বভাবে যদি প্রথমেই লাগাম টানত তবে আজ এসব হতোই না। কিন্তু উনারা তো মেয়ের আবদারের জন্য অন্যের পায়ে ধরতেও রাজি হয়ে যায়, হোক সেটা অন্যায় আবদার!”

“কী করবে বল। বাবা-মায়ের ভালোবাসা এমনি। দোয়া করি মেয়েটা শুধরে যাক।”

মাশরিফ আর কিছু বলে না। খাওয়া-দাওয়ার পর আসরের নামাজ পড়ে একটু ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।

_____

তিতির বাড়ি ফিরতেই হিয়া উচ্ছাসিত কণ্ঠে বলে ওঠল,
“জানিস তিতির, হায়াত হাঁটতে পারে।”

“সত্যি? ও তো শুধু একটু সময় দাঁড়াতে পারে।”
তিতিরের অবাক কণ্ঠ শুনে হিয়া হেসে বলে ওঠে।
“এক কদম বাড়িয়ে পরে যায়। আমি একটু আগে দেখলাম।”

তিতির খুশি হয়ে ফ্রেশ না হয়েই হায়াতকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে তারপর ওর হাত ধরে সারা ঘরে হাঁটায়। তিতিরের ইচ্ছে হায়াত একদিনেই পুরো হাঁটা শিখে যাক!

পরের দিন বিকেলে মাশরিফ তিতিরের জন্য হসপিটালের গেইটে অপেক্ষা করছে। বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখছে। হসপিটালের অন্যান্য মেয়ে স্টুডেন্ট, ডাক্তার ও ভিজিটররা যাওয়া আসার সময় হা করে ওকে দেখতে দেখতে যাচ্ছে। মাশরিফ মেয়েগুলোর এক্টিভিটি দেখে বিরক্ত হলো। আজকে সে একটা সিগ্রিন রঙের পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে। হাতে একটা ব্যাগ আছে যাতে একটা সিগ্রিন ও কালোর মিশেলে শাড়ি ও তৈরি হওয়ার জিনিসপত্র আছে। সব সিগ্রিন। তিতিরকে এসব পড়িয়ে বিকেল বেলা একসাথে হাত ধরে হাঁটার ইচ্ছে তার। প্রায় আধা ঘণ্টা পর তিতির বের হলো। গেইটের বাহিরে মাশরিফকে দেখে বিস্মিত নয়নে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। কতো সুন্দর দেখাচ্ছে তার বরটাকে। নজর হটানো যেন অসম্ভব হয়ে পরেছে। সিগ্রিন রঙে যে কাউকে এতোটা সুদর্শন লাগতে পারে তা তিতির আজ প্রথমবারের মতো অনুধাবন করল। কনুইয়ের একটু নিচ অবধি পাঞ্জাবির হাতা গুটানো। কর্লারের দিকে দুই একটা বোতাম খোলা। চোখে সানগ্লাস! কালো জিন্স প্যান্টের সাথে চকলেট কালার ক্যাজুয়াল শু। পুরো নায়ক লাগছে। তার কাছে এসব কেমন ভ্রম মনে হচ্ছে। একবার ভালো করে চোখ মুছে নিয়ে একই নাজারা দেখে খুশি তো হলোই কিন্তু আশেপাশের আসা-যাওয়াতে মেয়েগুলোর এরকম বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে রাগও হলো ভীষণ। দ্রুতপদে মাশরিফের কাছে গিয়ে ঝাঁ*ঝালো কণ্ঠে বলল,

“আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি যে আসবেন আমাকে তো বলেননি! এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন হ্যাঁ?”

মাশরিফ আশেপাশে নজর বুলালো। কয়েকজন আঁড় নজরে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। মাশরিফ হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছি। বিকেলবেলা আমরা পার্কে ও রাস্তায় একসাথে হাঁটব। কিন্তু তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?”

তখন পেছন থেকে নাদিয়ারা এসে হাজির। ওরা বের হয়েছে ফুচকা খাওয়ার জন্য। তিতিরকে বারবার মাশরিফের কথা বলে পি*ঞ্চ করছিল বলে তিতির ওদের রেখে আগেই বেরিয়ে গেছে। নাদিয়া বলে,

“কেন এমন করছে বুঝেন না ভাইয়া? আপনার বউ প্রচুর জে*লা*স। এইযে আশেপাশের কু*দৃষ্টি সম্পূর্ণ রমণীগন আপনাকে তাদের চোখ দিয়ে গি*লে খা*চ্ছে! তা দেখে আমাদের বান্ধবীর ক’লিজাটা পু*ড়ে ধোঁ’য়া বের হচ্ছে। ওর এই জে*লাসির ধুম্রজালে আপনি তো নিজেকেই খুঁজে পাবেন না ভাইয়া!”

এটা বলা মাত্রই ফাইজা, জারিনরা হেসে ওঠল। তিতির ওদের ধ*মকে বলল,
“বেশি বুঝিস তোরা। ফাজলামি করবি না। উনি এখানে এসে কেন দাঁড়াবে?”

“কেন? দাঁড়ালে কী তোর বরকে কেউ চু*রি করে নিবে?”

ফাইজার টিটকারি শুনে তিতির বিড়বিড় করে বলল,
“বলা তো যায় না! নিতেও পারে।”

মাশরিফ আবছা তিতিরকে কিছু বলতে শুনে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল,
“কিছু বললে?”
“না! চলুন।”

তিতির মাশরিফের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে ধরলে মাশরিফ অবাক তো হয়ই কিন্তু পরক্ষণেই হেসে তিতিরকে থামিয়ে বলে ওঠে,
“আরে মেয়ে দাঁড়াও। কাছে হোস্টেলে গিয়ে এই বক্সের জিনিসপত্র দ্রুত পড়ে আস। বেশি সাঁজগুঁজের দরকার নেই। জাস্ট কাজল ও লিপস্টিক দিলেই হবে। জলদি যাও।”

তিতির সন্দিগ্ধ কন্ঠে শুধায়,
“কী আছে এতে?”
“দেখলেই বুঝবে। জলদি যাও। আমি এখানে অপেক্ষা করছি।”

“কিন্তু আমার টিউশনি?”
“আজ মানা করে দাও। পরে একদিন পড়িয়ে দিবে।”

তিতির ঘার কাত করে সম্মতি দিয়ে হোস্টেলের দিকে যেতে নিয়েও ফিরে এসে মাশরিফের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“আপনি কি এখানেই থাকবেন?”
“হ্যাঁ কেন?”
“মোটেও না! আপনি এখানে থাকবেন না। এমন কোথাও যান যেখানে আশেপাশের কেউ আপনার দিকে নিজেদের বে*হায়া দৃষ্টি দিবে না।”

মাশরিফ হালকা হাসল। তার বউটার যে ভীষণ হিংসে হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই সে বলল,
“যথা আজ্ঞা মহারাণী! আমি এমন কোথাও যাচ্ছি। তবে আপনিও একটু কম সময় নিবেন। নয়তো বুঝতেই পারছেন! এতো বে*হায়া দৃষ্টি থেকে বাঁচা কিন্তু খুবই মুশকিল!”

তিতির ভ্রুঁকুটি করে তাকাল। অতঃপর বলল,
“জাস্ট পনেরো মিনিটের মধ্যে চলে আসব। হুহ্!”

এই বলে তিতির দ্রুত পদে জারিনদের নিয়ে হোস্টেলের দিকে চলে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here