#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৫
আচমকা ছেলের চিৎকারে মহিমা বেগম থতমত খেয়ে ওঠেন। কী হয়েছে বোঝার জন্য দ্রুত ছেলের ঘরের দিকে অগ্রসর হন। মহিমা বেগমের মতো রণিত, রাতুল, অভীও সেদিকে গেল। গিয়ে দেখল রুমের দরজার কাছে মাশরিফ হাত মুষ্টিমেয় করে দাঁড়িয়ে আছে। আর ঘরের ভেতর একটা মেয়ে মাশরিফের শার্ট হাতে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটা যে কাশফা তা উপস্থিত সকলেই জানে। মাকে দেখে মাশরিফ ক্ষিপ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
“এই মেয়েটা আমার ঘরে কী করে মা? ওকে আমার ঘরে ঢোকার পারমিশন কে দিয়েছে?!
মহিমা বেগম নিজেই অবাক হয়ে যান। একটু আগেই কাসফা যখন বাড়িতে এসেছিল তখন মাশরিফের খোঁজ করছিল কিন্তু মাশরিফ বাসায় নেই শুনে সে মহিমা বেগমের সাথে একটু কথা-টথা বলে সে চলে যাচ্ছে বলেছিল। কিন্তু মেয়েটা যে যায়নি সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। মহিমা বেগম হাসার চেষ্টা করে কাশফাকে বলেন,
” কাশফা তুমি না বলেছিলে তুমি চলে যাচ্ছ? তাহলে এখানে?”
কাশফা দৃষ্টি নিচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হুট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে হড়বড়িয়ে বলল,
“আসলে হয়েছে কি আন্টি, আমি চলেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে মাশরিফের ঘরের দিকে নজর যায়। ঘরটা খোলা ছিল তো! তখন দেখলাম যে ঘরের মধ্যে কাপড়চোপড় এলোমেলো করে ফেলানো। তাই ভাবলাম…”
কাশফাকে আর বলতে না দিয়ে মাশরিফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“একটু গুছিয়ে দেই! তাই না?”
কাশফা ধরা পড়ে গিয়ে বোকার মত হাসলো। তারপর বলল,
” ঠিক বলেছ! একটু গুছিয়ে দিচ্ছিলাম।”
“ধন্যবাদ আমার গোছানো ঘরকে আরেকটু গুছিয়ে দেওয়ার জন্য! এবার প্লিজ নিজের বাড়ি গিয়ে নিজের ঘর গোছান।”
কাশফা মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর আর কোন বাক্যব্যয় না কেরে চুপচাপ চলে যায়। কাশফা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর পর পর মাশরিফ নিজে গিয়ে বাড়িয়ে সদর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আসে। তারপর নিজের ঘরে এসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” একটা কথা বলি মা, তুমি আর আপু কিভাবে ভুলে যাও এই মেয়েটা দুই বছর আগে কী করেছিল? ওর জন্য আমি আমার আর্মি জবটা হারাতে বসেছিলাম! এই মেয়েটা যে কতটা জঘন্য তা তুমিও জানো আর আপুও জানে। তারপরও আপু যে কেন এই মেয়েটার তরফদারি করে আমি বুঝতে পারি না। আপু হয়তো মনে করে মেয়েটা তখন বাচ্চা ছিল! তাই এরকম করেছে। অতটাও কিন্তু বাচ্চা ছিল না মা। ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়া মেয়ে কখনোই বাচ্চা হতে পারে না। একটা ছেলেকে জেনে বুঝে ফাঁ*সানোর মতো অন্যায় সে করেছিল। ভাগ্য ভালো, মসজিদের ইমাম সাহেব ও পাশের বাসার হাসান আংকেল ঘটনাটা দেখে ফেলেছিল।”
ছেলে যে খুব রেগে গেছে মহিমা বেগম বুঝতে পারছেন। ছেলেকে শান্ত করতে তিনি বলেন,
“আমরা কেউ ঘটনাটা ভুলিনি। আসলে হয়তো কাশফা বুঝতে পারেনি যে ওর সামান্য মজা করে করা দুষ্টুমির কারণে তোর আর্মি জব নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে।”
মাশরিফ তাচ্ছিল্য হাসলো। সে বলল,
“তোমরা ওর অন্যায়কে দুষ্টমি বলেই চালিয়ে দাও! আসলে কি বলতো বাবা-মায়ের দুলালী! আবার মিষ্টি ভাষী! তার জন্য তোমাদের বশ করা কোনো ব্যাপারই না। বা হাতের খেল তার।”
” আরে বাবা! পুরানো কথা বাদ দে না। মেয়েটার সাথে এত রুড ব্যবহার করিস না। স্বাভাবিক কথাবার্তা বল।”
মাশরিফ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোমরা তার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছো না? তো করো। আমায় কেন বলছ? আমার ইচ্ছে হয় না, আমি করি না! তাকে স্ট্রিটলি বলে দিবে সে যেন আমার ঘরে ভুলেও পা না দেয়। তাহলে কিন্তু আমি কখন তাকে চ**ড়-থা*প্প*র দিয়ে দেই নিজেও বলতে পারি না। এরকম নিচু স্বভাবের মেয়ে আমার পছন্দ না।”
কথা কাটাতে অভী এসে বলল,
“আরে বাদ দে তো ওসব। চল পিঠে খাব।”
অভী মহিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আন্টি, পিঠে গুলো আগে দিয়ে যান। তারপর আস্তে আস্তে চা আনেন। হেমন্তের প্রথম পিঠে! ইশ শুনেই জীভে জল চলে আসছে।”
মহিমা বেগম আলতো হাসেন। তিনি বলেন,
“আচ্ছা, তোরা গিয়ে বস। আমি পিঠে নিয়ে আসছি।”
মহিমা বেগম চলে গেলে অভী মাশরিফকে গিয়ে ধরে।
” আজকে তুই এত রাগ কেন করছিস? সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিতিরের দিকটাও একটু ভাব। সে কিছুদিন হলো জানতে পেরেছে তার স্বামী মা*রা গেছে।”
প্রত্যুত্তরে মাশরিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
” আমি মোটেও তিতিরের সাথে কি হয়েছে সেই ঘটনা নিয়ে রিয়াক্ট করছি না। ওর দিকটা আমিও বুঝি। তাও আমি সব সাইডে রেখে ওর সাথে থাকতে চেয়েছি কারণ আমি জানি এই স্বার্থপর দুনিয়াতে একা টিকে থাকা মুশকিল। আব্বুর মৃত্যুর পর আমি নিজেই এটা বুঝেছি। তোরা তো দেখেছিস। সংসারের সাপোর্ট দিতে আমি মেডিকেল ছেড়েছি। মেডিকেলে সময় লাগে অনেকটা। সেখানে আর্মিতে ভর্তি হওয়ার পর ক্যাডেট অবস্থাতেই আমার একাউন্টে টাকা জমা হচ্ছে। সেই টাকা আমি নির্দিষ্ট সময় পর যখন আর্মি ক্যাডেট থেকে একজন আর্মি হবো তখন একসাথে পাবো। তাছাড়া বাবা বলে গিয়েছিলেন, “দেশের জন্য যা দরকার করবে।” সবটা বিবেচনা করে আজ আমি আর্মিতে। আমার এখনো মনে পড়ে ওই কাশফা মেয়েটার জন্য আমি আমার ডিপার্টমেন্টে কীরকম জবাবদিহি করেছি। তুই তো সাথে ছিলিস। তুই তো সবই জানিস। ওই মেয়েটার সাথে মা যেমনটা নয় তেমনটাই করে কিন্তু আপু যা করে সেটা দেখলে আমার সত্যি প্রচণ্ড রাগ হয়। আপু কেন এই মেয়েটাকে এত মাথায় তোলে বুঝি না। আমার তো মেয়েটাকে দেখলেই রাগ ওঠে।”
রাতুল হাই তুলতে তুলতে বলল,
“রিতিকা আপু কেনো মাথায় তোলে তা তো তুই জানিসই। একটু আগে তুই নিজেই তো বললি মেয়েটা মিষ্টি ভাষী! তো মিষ্টি ভাষী মেয়েদের মুখে মধু থাকে তা তো জানিস। মধুর মতো সুইট সুইট কথার দ্বারা সে সবাইকে বশ করে ফেলে। এখন ওই মেয়েটার কথা বাদ দে। চল পিঠা খাব। ওসব ঝামেলা এখন ভালো লাগছে না।”
মাশরিফ কপালে হাত ঘষে চোখ বন্ধ করে বলে,
“তোরা যা। আমি আসছি।”
রাতুলরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে। মাশরিফ হাত-মুখ ধুয়ে এসে ওদের সাথে বসে।
_________
বাজার করে এসে ঘর গুছিয়ে তিতির ক্লান্তিতে সোফায় বসে আছে। হিয়া ও নাজমা বেগমও এসে ওর পাশে বসে। তিতির জিজ্ঞেসা করে,
“হায়াত ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ। এতক্ষণে কেঁদে-কে*টে অস্থীর হয়ে এখন ঘুমিয়েছে।”
নাজমা বেগম বলেন,
“ভাগ্যিস তোর চাচি খাবার প্যাক করে দিয়েছিল। নাহলে এখন এসে বাজার করে রান্না করতে হতো।”
“হ্যাঁ। আচ্ছা মা, হিয়াকে আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি করব? নাকি পলিটেকনিকে? হিয়া তুই বল। তোর কোনটাতে ইচ্ছে?”
হিয়া কিয়ৎ ভেবে বলে,
“পলিটেকনিকেই মনে হয় আমার জন্য ভালো হবে।”
“আচ্ছা তবে তাই দেখি।”
তখনি হঠাৎ তিতিরের বিকেলের কথা গুলো মনে পরে। তিতির উঠে গিয়ে ব্যাগ থেকে খামটা নিয়ে আসে। অতঃপর মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“দেখো তো মা, এতে কী আছে? একজন দিলো। বলল তোমাকে দিতে।”
“কে দিলো?”
“বলছি। আগে খুলে দেখো।”
নাজমা বেগম খামটা খুললেন। সেখানে একটা ছবি রাখা। ছবিটা দেখে নাজমা বেগমের চোখ ভিজে ওঠল। তিনি ছবিটার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে কাঁদতে লাগলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।