#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
তিতির দরজা খোলার জন্য অগ্রসর হলে ওর মা বাধা দিয়ে ভীত কণ্ঠে বলেন,
“আগে ব্যালকনি দিয়ে গেইটের বাহিরে দেখে নে। প্রায়ই সুজন, পলাশরা কলিংবেল চাপে। গেইটে লা*থিও দেয় না খুললে। সন্ধ্যার পর এসব করে। হিয়ার উপরে নজর পলাশের।”
তিতির ওর মায়ের কথা অনুযায়ী বারান্দা দিয়ে দেখে নিলো। মাকে এসে আশ্বস্ত করে বলল,
“মনে হচ্ছে না সুজন, পলাশরা। অন্ধকারে গেইটের বাহিরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় না সুজনরা হবে। দরজাটা খুলে দেখে আসি কে আসলো।”
নাজমা বেগমের মনের ভয় পুরোপুরি কা*টেনি। সন্ধ্যা হলেই তার মনে ভয় হতে থাকে। তিতির মাকে দেখে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে কেচিগেইটের কাছে গিয়ে দেখে বাহিরে বড়ো ব্যাগ কাঁধে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে হাতে তার একটা ছোটো বক্স। তিতিরকে দেখে লোকটা বলল,
“আপনি তানুজা নূর তিতির? ম্যাম আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে।”
“কিসের পার্সেল? আমি তো কিছু অর্ডার করিনি তাছাড়া হোমডেলিভারি দেয় এমন কিছু কখনোই অর্ডার করিনি।”
তিতিরের পাল্টা প্রশ্নে লোকটা বলে,
“আমরা তো জানিনা ম্যাম। আপনার পার্সেলের জন্য গুগুল ম্যাপে ঠিকানা দেওয়া ছিল কিন্তু আপনার ফোন নাম্বার দেওয়া ছিল না। হোম ডেলিভারিতে পার্সেল এসেছে।”
তিতিরের মনে সন্দেহের দানা পাঁকে। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
“প্রেরকের নাম-পরিচয় কী?”
“সরি ম্যাম। আপনি পার্সেলটা রিসিভ করে নিজেই দেখে নিন।”
তিতির আর কথা না বাড়িয়ে পার্সেলটা নিয়ে নিলো। পার্সেলের গায়ে নাম-পরিচয় লিখা নেই। লোকটা চলে গেলে তিতির গেইট লাগিয়ে বাসায় এসে পার্সেলের বক্সটা খুলে দেখে তাতে একটা গহনার বক্স ও একটা খাম। গহনার বক্সটা তার চেনা। চেনা তো হবেই কারণ তার বিয়ের সময় তার শাশুড়ি এই বক্সটা দিয়েছিল। বক্সটা খুলে দেখল তাতে তার শ্বশুরের দেওয়া একজোড়া বালা ও বিয়ের পরদিন রাহানের দেয়া গলার চেইন ও কানের দুল। এসব সে আসার সময় শাশুড়ির ওয়ারড্রবের উপর নিরবে খুলে রেখে এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিতির। এসব ফেরত পাঠানোর কারণ বুঝল না। এবার খামটা খুলল। খামের ভিতর একটা চেক তাতে আড়াই লক্ষ টাকার এমাউন্ট। তিতির আর কাল বিলম্ব না করে তার শাশুড়ির নাম্বারে ফোন করে। রোকেয়া বেগম হয়তো ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন! রিং হওয়া মাত্রই রিসিভ হয়। তিতির সালাম বিনিময় করে বলেন,
“মা আপনি ওগুলো পাঠালেন কেনো?”
“দেখো তিতির, তোমার স্বামীর কোনো খোঁজ নেই এবং শ্বশুরও আর বেঁচে নেই। তোমার বিয়ের দেনমোহর চার লক্ষ টাকা ছিল। দেনমোহরের চার লক্ষ টাকার আওতায় এই গহনা গুলোও ছিল। খুব কম সময়ের মধ্যে বিয়ে হওয়াতে তখন বেশি গহনা গড়াতে পারিনি কিন্তু আমার ছেলে তোমার দেনমোহরের টাকা আগেই তার বাবার কাছে দিয়ে রেখেছিল। আজ তুমি বাড়ি ছেড়েছ তাই তোমার হক তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ছেলের নামে যা আছে তাও তুমি চাইলে অধিকার নিয়ে আসতেই পারো।”
“না মা। তার দরকার পরবে না। আপনার ছেলেই নেই তো আমি তার সম্পত্তি দিয়ে কি করব? আমাদের তো কোনো সন্তানও নেই। দুই বছরে মিশন থেকে ফিরল না। হেডকোয়াটারেও তার খবর জানে না। সে মিশন শেষে কোথায় গেছে কেউ জানেনা। সবই আমার ভাগ্য।”
রোকেয়া বেগম বললেন,
“ভালো থেকো। এতোদিন গা*লমন্দ করেছি। না চাইতেও করেছি। তোমার ভবিষ্যৎ ভালো হোক। অতীতের ছায়া না পড়ুক।”
তিতিরও আর কথা বাড়ালো না। শ্বশুরবাবা মা*রা যাওয়ার পর শাশুড়িমা আজকেই ফোনে তার সাথে এটুকু কথা বললেন। কাল থেকে তিনি তিতিরকে কিচ্ছুটি বলেননি। তিতির উপরের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিজের সব হতাশা উড়িয়ে দিতে চাইল। সে প্রাণখুলে বাঁচতে চায়। তিতিরের মা নাজমা বেগম তিতিরের সব কথাই শুনেছেন। তিনি মৌন রইলেন। মেয়েকে নিজে নিজে সামলে নিতে দিলেন।
শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। আকাশে প্রায়শই মেঘের আনাগোনা। ক্ষণে ক্ষণে মেঘের দল ফাঁকা গর্জন করে ওঠে। তিতির খিচুড়ির অবস্থা দেখে বুঝলো পানি আরেকটু শুকাবে তাই বাগাড়ের জন্য আগে থেকে পেঁয়াজ, রসুন কা*টছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে। সবাকে বোঝাতে চাইছে এই জলের ধারা পেঁয়াজ কা*টার দরুণ। আজ সে সব ছেড়ে যে এসেছে। মায়ের চোখ তো আর ফাঁকি দিতে পারে না! নাজমা বেগম ঠিক বুঝে গেলেন। মেয়ের হাত থেকে জোর করে পেঁয়াজ নিয়ে নিজে কা*টতে আরম্ভ করলেন আর বললেন,
“ছাদের দরজাটা বা’ড়ি দিচ্ছে। একটু যা দেখে আয়। দুপুরে মেঘ ডাকছিল বলে তড়িঘড়ি করে আচারের বয়াম গুলো আনার সময় মনে হয় লাগাইনি। আমার হাঁটুতে ব্যাথা করছে। তুই যা দেখ একটু।”
তিতির নিঃশব্দে ছাদের সিঁড়িতে ওঠল। ছাদের দরজা ভীড়ানোই ছিল। ধীর পায়ে ছাদের ভেজা মেঝেতে পা রাখল। কেমন অদ্ভুত শিহরণ। মাঝ বরাবার গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দুইহাত প্রশস্ত করে আকাশপানে মুখ করে নয়নজোরা মুদিত করল।
______
বিয়ের রাতে তিতির রাহান আসার আগেই ঘুমিয়ে পরেছিল। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার দুইদিন পরেই বিয়েটা হয় তার জন্য ক্লান্তি একটু বেশিই। তাছাড়া রাত দেড়টা অবধি অপেক্ষায় জেগে ছিল পরে না পারতে বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছিল। পরদিন সকালে উঠে দেখে হাতের চুড়ি ও গলার হারগুলো খুলে পাশের টেবিলে রাখা। পাশ ফিরে রাহানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেই বুঝেছে রাহান এগুলো খুলে দিয়েছে যাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারে। তিতিরের কিশোরী মনে তখন প্রথম প্রখর ভালো লাগার উদ্রেক ঘটে। কলেজের দুয়েকজন বান্ধুবীর মুখে বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে ভয়ংকর অভিঙ্গতা শুনে সে ভয়েই ছিল।
সেইদিন আরো একবার রাহান তিতিরকে রক্ষা করেছিল। যখন শাড়ি পড়ে ছাঁদ থেকে নামার সময় পরে যেতে নিয়েছিল তখনি রাহান তাকে বাহুডোরে আগলে নিয়েছিল। তারপর রাহানের বন্ধুত্বের প্রস্তাব। সবকিছুই তিতিরকে মুগ্ধ করছিল কিন্তু কে জানত ওগুলোই শেষ!
________
দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিতির। নেত্রকোন বেয়ে গড়ালো নোনাজল। এই স্মৃতিগুলোই তার দুই বছরের অপেক্ষার সঙ্গী। আর্মি হেডকোয়াটার থেকেও কোনো খোঁজ দিতে পারছে না। হঠাৎ ঢুকরে কেঁদে উঠে জড়ানো স্বরে বলতে থাকে,
“আমার সাথেই এসব কেনো হয়? স্বামী, বাবা, ভাই তারপর শ্বশুরবাবা। সবাই কেনো আমাকে একা করে চলে যায়? হারাতে হারাতে আজ আমি ক্লান্ত। মা ও হিয়াকে হারাতে চাইনা। আমার আপন বলতে ওরাই।”
খোলা আকাশের নিচে কিছুক্ষণ দুঃখবিলাস করে গায়ে গুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁট লাগামাত্রই চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় অতঃপর ছাদের দরজা লাগিয়ে নেমে আসে। বাসায় ঢুকে দেখে মা হিয়াকে খাবার টেবিলে এনে বসিয়েছেন। তিতির গিয়ে হিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“কেমন আছিস? আর মাত্র এক মাস। তারপর আমাদের সোনামণি চলে আসবে।”
হিয়া মলিন হেসে বলল,
“আমার বাচ্চাটা জন্মের আগেই এতিম হয়ে গেলো। ঠিকই আছে। মাও এতিম, বাচ্চাও এতিম। কী মিল!”
“চুপ। একদম আজেবাজে ব*কবি না। এসব ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবি না।”
“কষ্ট! ওটা নিজেই আমার কাছে আসে। নিজের চোখের সামনে নিজ স্বামীকে খু*ন হতে দেখেছি। ওটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল না রে। ইচ্ছাকৃত ছিল।”
হিয়ার কথার প্রত্যুত্তরে তাচ্ছিল্য করে তিতির বলে,
“ইনভেস্টিগেশনই হচ্ছে না। কিছু করার নাই রে। টাকা ছাড়লে সব হতো কিন্তু যেখানে বেঁচে আছি কোনোমতে সেখানে আর কি করার আছে!”
নাজমা বেগমকে আসতে দেখে হিয়া ও তিতির চুপ করে গেলো। তিনজনের জন্য খিচুড়ি ও ডিম ভাজা করে এনেছেন।
খাওয়ার মাঝপথে আবারও কলিংবেলের শব্দে হিয়া আৎকে ওঠে। তিতির বিরক্তি নিয়ে বলে,
“আবার কে?”
তিতির উঠে যেতে ধরলে হিয়া তোঁতলানো স্বরে বলল,
“যাস না তিতির। তুই যে এসেছিস ওরা খবর পেয়ে গেছে।”
“খবর পাবে কি! আমাকে আসতেই দেখেছে।”
“কেচিগেইট না খুলে দেখি কে এসেছে।”
হিয়া ও নাজমা বেগমকে কিছু বলতে না দিয়ে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে বাহিরে কেউ নেই। আরেকটু ভালো করে দেখতে সিঁড়িরঘরের বাতি জ্বালালো। কেচিগেইটের কাছ পর্যন্ত গিয়ে দেখে ফিরে আসবে তখনি দেখে একটা খাম। খামটা গেটির ফাঁকা দিয়ে হাতড়ে নিলো। ওটা নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে খাবার টেবিলের কাছে এসে বলে,
“এটা পেলাম। কেউ ছিল না।”
“খুলে দেখ।”
“হু”
তিতির খামটা খুলল অতঃপর যা দেখল অবাক না হয়ে পারল না।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
আপনাদের ভালোবাসায় আমি সত্যি কি বলব বুঝতে পারছি না। সবাইকে ভালোবাসা রইল। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।